সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের বাতিল আইন ফিরছে! অর্জনটি হারিয়ে যেতে দেব না by মনজুরুল আহসান বুলবুল
সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের
ফলে ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের আমলে ১৯৭৩ সালের প্রেস অ্যান্ড
পাবলিকেশনস আইনের পত্রিকা বন্ধসংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করা হয়। বর্তমান
সরকার সেই ধারাটি পুনর্বহালের চিন্তা–ভাবনা করছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত
হয়েছে। এ নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতার অভিমত প্রকাশ
করা হলো...
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের হঠাৎ কেন মনে হলো যে পত্রিকা বন্ধ করার ক্ষমতাটি তাঁদের খুবই জরুরি? ১৯৭৩ সালের আইন। ১৯৯১ সালে সংশোধন হয়েছে। তারপর চলে গেছে দুই দশকেরও বেশি সময়। কত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এলেন-গেলেন কিন্তু তাঁরা কখনো বলেননি যে পত্রিকা বন্ধের ক্ষমতা না থাকায় তাঁদের দাপটের কমতি হচ্ছে! মনে রাখতে বলি: সাংবাদিকদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে যাচাই-বাছাই হয়। ওই কমিটির সুপারিশেই ১৯৭৩ সালের দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিক্লারেশনস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্টের শুধু একচ্ছত্র ক্ষমতা বলে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা হয়।
যাঁরা আজ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা চাইছেন, তাঁদের যদি পাল্টা প্রশ্ন করি, এই দুই দশকে তাঁরা কতশত পত্রিকার ডিক্লারেশন দিয়েছেন? তার সবই কি যোগ্যদের দিয়েছেন? কাদের সুপারিশে দিয়েছেন? যাঁদের ডিক্লারেশন দিয়েছেন যোগ্য সাংবাদিক-কর্মচারী দিয়ে তাঁদের পত্রিকা চালানোর যোগ্যতা আছে কি না; সাংবাদিক-কর্মচারীদের আইন অনুযায়ী বেতন দেওয়ার সামর্থ্য আছে কি না, দেখা হয়েছে? ডিক্লারেশন দেওয়ার পরে ছয় মাসে-নয় মাসে খোঁজ নিয়েছেন? সরকার ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করেছে, তা যে আইনে পরিণত হয়েছে, তাঁদের ডিক্লারেশন দেওয়া পত্রিকায় সরকারের এই আইন পালিত হচ্ছে কি না তাঁর কি কখনো খোঁজ নেওয়া হয়েছে? মাঠপর্যায়ে আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বুঝতে হবে পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতার চেয়ে এসব প্রশ্নের জবাব নিশ্চিত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এ এক মহাযন্ত্রণা দেখছি আজকাল। ভালো পায়ে চুলকিয়ে ঘা বানিয়ে তা সারানোর জন্য চিৎকার করা হচ্ছে। যাঁরা গণমাধ্যমের ব্যবসা করার যোগ্য না, তাঁদের দেওয়া হচ্ছে পত্রিকার ডিক্লারেশন বা টেলিভিশনের লাইসেন্স। একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে দেখা হচ্ছে ‘আবেদনকারী আমাদের সমমনা, ব্যবস্থা নিন’-মার্কা সুপারিশ। কিন্তু পরে যখন হঠাৎ দেখা যাচ্ছে; ডিক্লারেশন বা লাইসেন্স নেওয়ার পর তাঁরা ‘লাইনমতো’ চলছেন না, তখনই যেন হুঁশ হচ্ছে। তখনই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার সবক দেওয়া শুরু। অ-সাংবাদিকতা বা অপসাংবাদিতার দায় চাপানো হচ্ছে পেশাদার সাংবাদিকদের ওপর।
বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের আবদার: রাষ্ট্রবিরোধী ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানে এমন সংবাদ প্রকাশিত হলে পত্রিকাটি বাতিলের ক্ষমতা দিতে হবে তাঁদের। কেন? এই দুই অপরাধে দোষী হলে যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে [এমনকি তিনি সাংবাদিক হলেও] প্রচলিত আইনেই তো শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। সে ক্ষমতা তো তাঁদের হাতে আছেই। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা সেই আইন প্রয়োগ করুন। প্রশ্ন করি, একবারে হালে দিনাজপুরে, ঠাকুরগাঁওয়ে বা যশোরে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে যে তাণ্ডব চালানো হলো, সেখানে কয়জনের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে? ধর্মীয় লেবাসে খোদ রাজধানীতে সরকার, রাষ্ট্র, ধর্ম ও গণবিরোধী যে নরক গোলজার সৃষ্টি করা হয়েছিল, ঢাকার বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাদের কয়জনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
একটি সংবাদপত্রে বা গণমাধ্যমে অসাবধানতাবশত ভুল হলে তা সংশোধন করা বা ক্ষমা চাওয়ার প্রথাটি যুগ যুগ ধরেই প্রচলিত। পেশাদার সাংবাদিকতার বাইরে গিয়ে যদি কোনো গণমাধ্যম উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনস্বার্থবিরোধী কাজ করে বা উন্মাদনা ছড়িয়ে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তাহলে চিহ্নিত করতে হবে কে এই অপতৎপরতার জন্য দায়ী? মালিক? সম্পাদক বা বিশেষ কোনো ব্যক্তি? সেই চিহ্নিত ব্যক্তির বিচার করা অবশ্যই জরুরি। আবার কোনো গণমাধ্যম যদি গণমাধ্যমের আবরণে প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে, তবে তারও বিচার হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের জন্য সংবাদপত্র বা টেলিভিশনটি বন্ধ করে দিয়ে শত শত সাংবাদিক-কর্মচারীকে পথে বসিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
একটি পত্রিকা সরকার ঘোষিত আইন মানছে কি না দেখুন। যাঁরা সরকারি আইন মানছেন না, তাঁদের সরকারি ক্রোড়পত্র দেওয়া বন্ধ করুন, সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করুন, অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেওয়া বন্ধ করুন, সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁদের আমন্ত্রণ দেওয়া বন্ধ করুন, মন্ত্রী-সচিব-জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা সে ধরনের কোনো সংবাদপত্রের অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়া বন্ধ করুন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যেকোনো পরিচয়ে ওই মালিক-সম্পাদকের বিদেশ সফর বন্ধ করুন, সচিবালয়ে তাঁদের অবাধ চলাফেরার সুযোগ বন্ধ করুন। দেখুন ফলাফল কী দাঁড়ায়।
পাশাপাশি গণমাধ্যমের পেশাদারি জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্যই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা জরুরি। সাংবাদিকতার গুণগত মান বাড়ানোর স্বার্থে প্রেস ইনস্টিটিউটকে রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক বৃত্তের বাইরে গিয়ে সব জটিলতা মুক্ত করা প্রয়োজন। সময়ের দাবিতেই জরুরি সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে প্রেস কাউন্সিলের। গণমাধ্যমের অপেশাদারি আচরণের ব্যাপারে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করার জন্য প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর সংশোধন-সংযোজনের খসড়া প্রস্তাব তথ্য মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে। সংশোধনীগুলো কার্যকর হলে প্রেস কাউন্সিল স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে, যাতে গণমাধ্যমের অপেশাদারি আচরণ দ্রুতই নজরদারির মধ্যে আসবে, ন্যূনতম মাত্রার শাস্তি দিয়ে সতর্ক করে এক ধরনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে। এসব ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এ কথা ঠিক, গণমাধ্যম জগতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন আইন বা বিধি যেমন প্রয়োজন, তেমনি পুরোনো অনেক আইনের সংস্কার বা আধুনিকায়ন প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো আইনের কোনো কোনো অংশ বাতিল বা সংযোজন করাও জরুরি। স্বচ্ছ সম্প্রচার নীতিমালা বা অনলাইন মাধ্যমের নীতিমালা যেমন প্রয়োজন, তেমনি যুগোপযোগী করাসহ পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন ১৯৭৪ সালের নিউজ পেপার এমপ্লয়িস সার্ভিসেস অ্যান্ড কন্ডিশন্স অ্যাক্টের। তবে এসবই হতে হবে গণমাধ্যম জগতের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে আলোচনা করেই। যেকোনো আইনে পরিবর্তন আনার সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, সেই আইনের প্রয়োগকারী ও সুবিধাভোগী অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
সে পথে না এগিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা যা চাইছেন তা হচ্ছে সেই ভালো পায়ে চুলকিয়ে ঘা বানানোর অবস্থা! তাঁদের দাবি অগ্রহণযোগ্য সব বিবেচনাতেই। স্পষ্ট করেই বলতে চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ও গণমাধ্যমকে শৃঙ্খলমুক্ত রাখার অবিরাম সংগ্রামে রত সাংবাদিকেরা তাঁদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল এই অর্জনটি কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে দেবেন না। নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি অনুধাবন করবেন।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (একাংশ)। bfujpresident@gmail.com
No comments