মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে by কুলদীপ নায়ার
জেনে দুঃখ পেলাম যে অটল বিহারি বাজপেয়ি ও
আদভানি উভয়ই বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এর জন্য যে
পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে যা যা করা হয়, সেসব সম্পর্কেও। সত্যি কথা বলতে,
বাজপেয়ির যুক্তিতে আমি ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বলেন, এটা কোনো
পরিকল্পিত ঘটনা নয়, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের কারণে এটা ঘটেছে।
আদভানি
যখন নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে লোকসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তখন আমি
ভেবেছিলাম, তিনি সত্য কথা বলছেন। আমি নিজেকে এখন প্রতারিত বোধ করছি। যে
উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার
করেছিলেন, তাতে তাঁর ভণ্ডামি সবার চোখেই ধরা পড়ে। আর বাজপেয়ি এখনো বলে
বেড়ান, এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেছে। এটা সত্য নয়, কারণ পাঁচ লাখ সেবক একটি
নির্দিষ্ট দিনে জড়ো হয়েছিলেন ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত
থেকে তাঁরা এসেছিলেন, বিশেষ করে মহারাষ্ট্র থেকে।
চলমান লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ফাঁস হয়েছে ১৯৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্র। এই সময়টা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলতেই পারি। এতে নির্বাচনে বিজেপি কীভাবে লাভবান হয়েছে, আমি তা জানি না। এই নির্বাচনেই তাদের অগ্রগতির স্বরূপ দেখা যাচ্ছে, আর তারাও তাদের আসল রূপে আবির্ভূত হয়েছে, হিন্দুত্ববাদী চেহারায়। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার বাবরি মসজিদ বিষয়ে সামান্য নমনীয়, তারা সমাধান খোঁজে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে। কিন্তু তারা সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে অনড়, এই অনুচ্ছেদ জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্তকরণ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অন্যদিকে, আরেক প্রধান দল কংগ্রেসও পুরো পরিস্থিতিকে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে পূর্ণ করতে কম ভূমিকা রাখেনি। এই দলটি শাহি ইমাম বুখারি ও অন্য মুসলিম নেতাদের পেছনে জড়ো হয়েছিল। প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারা অনেকটা স্বভাববিরুদ্ধভাবে মুসলমানদের শান্ত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা এসব গায়েও মাখায়নি।
তার পরও ফাঁদ পাতার মাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলো একত্র করে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনাকে আলোয় নিয়ে আসার যে শ্রমসাধ্য কাজ হয়েছে, আমি সেটাকে সাধুবাদ জানাই। যে সংবাদ পোর্টালে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে, সেটি বলছে, এই ধ্বংসযজ্ঞ ছিল ‘একটি পরিকল্পিত অন্তর্ঘাতমূলক কাজ’। এটা খুব সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত, বাস্তবায়নের আগে এর মহড়াও করা হয়েছিল এবং বাস্তবায়নও করা হয়েছে পরিকল্পনা অনুসারে।
এতে বিচারপতি এম এস লিবারহান তাঁর প্রতিবেদনে যা বলেছেন, তার সত্যতা প্রমাণিত হলো। তিনি সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবারও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, ‘এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে সেদিনের ঘটনা কোনোভাবেই অপরিকল্পিত বা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, এটা জনগণের তরফ থেকে আবেগের অভূতপূর্ব উৎসারণও নয়। নরেন্দ্র মোদি এল কে আদভানির মন্দিরের সমর্থনে রথযাত্রার অংশ ছিলেন। বিচারপতি লিবারহানের প্রতিবেদনটি সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) তদন্তকে সমালোচনা করেছে। বলেছে, তারা ২২ বছর লাগিয়েছে এই তদন্ত শেষ করতে। তদুপরি, যেসব জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন, প্রতিবেদনটি তাঁদের প্রতিও একধরনের ভর্ৎসনা, অথচ তাঁদের গুণের অবতার হিসেবে প্রচার করা হয়। বিভিন্ন চ্যানেলে বিজেপির অন্য নেতাদের দেখি না, তাঁরা তাঁদের পাপমোচনের জন্য এ কথা বলেন না যে কংগ্রেসের দুর্নীতি তদন্তে কোনো স্টিং অপারেশন চালানো হয়েছে। এটা দেরিতে হলেও করা যেতে পারে। কিন্তু সংঘ পরিবারকে অশুভ কর্মের জন্য কোনোভাবেই ক্ষমা করা যায় না।
আমি সব সময়ই জানতাম, এই ধ্বংসযজ্ঞে তৎকালীন কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়েরও আশীর্বাদ রয়েছে। বাবরি মসজিদের কাছেই সেনা মোতায়েন করা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট যখন বিরাজমান অবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন, তখন তিনি সেনা ব্যবহার করতে বাধ্য ছিলেন। মসজিদটি রক্ষা করতে একজন সেনাও নড়েননি, এমনকি মসজিদ রক্ষা করতে কামান বসিয়ে আক্রমণ ঠেকানোর প্রস্তাবেও কর্ণপাত করা হয়নি। সমাজতান্ত্রিক নেতা মাধু লিমায়ে আমাকে যা বলেছেন, তাতে রাওয়ের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই। লিমায়ে বলেছেন, ধ্বংসযজ্ঞ যখন শুরু হয়, রাও তখন পূজায় বসেন। রাওয়ের সহকর্মীরা হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজেছেন এ কথা বলতে, তিনি যেন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তাঁর নির্দেশনা ছিল, তাঁকে যেন বিরক্ত করা না হয়। ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হলে, রাওয়ের একজন চ্যালা তাঁর কানে কানে বলেন, কাজ শেষ হয়েছে। এরপর রাও তাঁর পূজা শেষ করেন।
মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পর শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিশেষ করে মুম্বাই শহরে। রাও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে ডেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে তাঁদের সহায়তা কামনা করেন। অভ্যাগতদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। আমি রাওকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজ্যের বিজেপি সরকারকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরও রাতারাতি সেখানে মন্দির নির্মাণ হয়ে গেল, আর আপনারা কিছুই করতে পারলেন না? তিনি উত্তর দিলেন, ‘মন্দিরটি বেশি দিন থাকবে না।’
এই মসজিদ ধ্বংসের পর ২২ বছর কেটে গেছে। রাও যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, আমি বেশ কয়েকবার তাঁকে তাঁর দেওয়া নিশ্চয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি বারবার লেখার পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ছোট সেই মন্দিরটি আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করে মুসলমানদের প্রার্থনার ব্যবস্থা করার যে কথা ছিল, তা-ও আজ শোনা যায় না।
যাঁরা বলেন, এটা বাবরি মসজিদ নয়, এটা রাম জন্মভূমি, তাঁদের কথা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু যখন লাখো রাম সেবক সেখানে হাজির হন ও অহিংস গান্ধীবাদীদের ওপর চড়াও হন, তখন যে কথা প্রমাণ করতে হয় তা হলো, অধিকাংশ মানুষ শান্তির পথেই ধাবিত হবেন, যদি সম্ভব হয়, বলপ্রয়োগের দ্বারা, প্রয়োজন হলে। বাস্তবে এই বাবরি মসজিদ ধ্বংস ভারতের বহুত্ববাদী ধারার মধ্যে একটি ছেদ ঘটিয়েছে। এর পর থেকে মুসলমান সম্প্রদায় চরমপন্থার দিকে ঝুঁকেছে। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের ওপর তাদের যে বিশ্বাস ছিল, তার ভিত্তি নড়ে গেছে, এমনকি তা এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার কথাও ভাবছে না।
আমাকে যদি মুসলমানদের মধ্যে জঙ্গিত্ব দেখতে হয়, তাহলে বাবরি মসজিদের ঘটনার মধ্যেই আমাকে এর শুরু দেখতে হবে। ভারতীয় মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, বিশেষ করে মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনায়। ভারত একটি বহুধর্মীয় সমাজ, বহু শতাব্দী ধরেই এই সমাজ এভাবে চলে আসছে। মোদি যদি এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি সব দিক থেকেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হবেন। তিনি দেশের ঐক্যেরও ক্ষতিসাধন করতে পারেন। আমি আশা করি, বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে একবারের জন্য হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি উচ্চারণ করা হোক। যদিও এই দলে সদ্য যোগদানকারীরা বলেন, বিজেপি মুখে না বললেও দলটি যেহেতু সংবিধান ছুঁয়ে শপথ করে, তাই প্রকারান্তরে তারা ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নেয়। আহা! ব্যাপারটা যদি সত্যিই এমন হতো! বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়ও তো ভারতে সংবিধান ছিল!
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
চলমান লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ফাঁস হয়েছে ১৯৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্র। এই সময়টা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলতেই পারি। এতে নির্বাচনে বিজেপি কীভাবে লাভবান হয়েছে, আমি তা জানি না। এই নির্বাচনেই তাদের অগ্রগতির স্বরূপ দেখা যাচ্ছে, আর তারাও তাদের আসল রূপে আবির্ভূত হয়েছে, হিন্দুত্ববাদী চেহারায়। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার বাবরি মসজিদ বিষয়ে সামান্য নমনীয়, তারা সমাধান খোঁজে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে। কিন্তু তারা সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে অনড়, এই অনুচ্ছেদ জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্তকরণ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অন্যদিকে, আরেক প্রধান দল কংগ্রেসও পুরো পরিস্থিতিকে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে পূর্ণ করতে কম ভূমিকা রাখেনি। এই দলটি শাহি ইমাম বুখারি ও অন্য মুসলিম নেতাদের পেছনে জড়ো হয়েছিল। প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারা অনেকটা স্বভাববিরুদ্ধভাবে মুসলমানদের শান্ত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা এসব গায়েও মাখায়নি।
তার পরও ফাঁদ পাতার মাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলো একত্র করে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনাকে আলোয় নিয়ে আসার যে শ্রমসাধ্য কাজ হয়েছে, আমি সেটাকে সাধুবাদ জানাই। যে সংবাদ পোর্টালে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে, সেটি বলছে, এই ধ্বংসযজ্ঞ ছিল ‘একটি পরিকল্পিত অন্তর্ঘাতমূলক কাজ’। এটা খুব সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত, বাস্তবায়নের আগে এর মহড়াও করা হয়েছিল এবং বাস্তবায়নও করা হয়েছে পরিকল্পনা অনুসারে।
এতে বিচারপতি এম এস লিবারহান তাঁর প্রতিবেদনে যা বলেছেন, তার সত্যতা প্রমাণিত হলো। তিনি সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবারও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, ‘এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে সেদিনের ঘটনা কোনোভাবেই অপরিকল্পিত বা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, এটা জনগণের তরফ থেকে আবেগের অভূতপূর্ব উৎসারণও নয়। নরেন্দ্র মোদি এল কে আদভানির মন্দিরের সমর্থনে রথযাত্রার অংশ ছিলেন। বিচারপতি লিবারহানের প্রতিবেদনটি সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) তদন্তকে সমালোচনা করেছে। বলেছে, তারা ২২ বছর লাগিয়েছে এই তদন্ত শেষ করতে। তদুপরি, যেসব জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন, প্রতিবেদনটি তাঁদের প্রতিও একধরনের ভর্ৎসনা, অথচ তাঁদের গুণের অবতার হিসেবে প্রচার করা হয়। বিভিন্ন চ্যানেলে বিজেপির অন্য নেতাদের দেখি না, তাঁরা তাঁদের পাপমোচনের জন্য এ কথা বলেন না যে কংগ্রেসের দুর্নীতি তদন্তে কোনো স্টিং অপারেশন চালানো হয়েছে। এটা দেরিতে হলেও করা যেতে পারে। কিন্তু সংঘ পরিবারকে অশুভ কর্মের জন্য কোনোভাবেই ক্ষমা করা যায় না।
আমি সব সময়ই জানতাম, এই ধ্বংসযজ্ঞে তৎকালীন কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়েরও আশীর্বাদ রয়েছে। বাবরি মসজিদের কাছেই সেনা মোতায়েন করা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট যখন বিরাজমান অবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন, তখন তিনি সেনা ব্যবহার করতে বাধ্য ছিলেন। মসজিদটি রক্ষা করতে একজন সেনাও নড়েননি, এমনকি মসজিদ রক্ষা করতে কামান বসিয়ে আক্রমণ ঠেকানোর প্রস্তাবেও কর্ণপাত করা হয়নি। সমাজতান্ত্রিক নেতা মাধু লিমায়ে আমাকে যা বলেছেন, তাতে রাওয়ের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই। লিমায়ে বলেছেন, ধ্বংসযজ্ঞ যখন শুরু হয়, রাও তখন পূজায় বসেন। রাওয়ের সহকর্মীরা হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজেছেন এ কথা বলতে, তিনি যেন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তাঁর নির্দেশনা ছিল, তাঁকে যেন বিরক্ত করা না হয়। ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হলে, রাওয়ের একজন চ্যালা তাঁর কানে কানে বলেন, কাজ শেষ হয়েছে। এরপর রাও তাঁর পূজা শেষ করেন।
মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পর শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিশেষ করে মুম্বাই শহরে। রাও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে ডেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে তাঁদের সহায়তা কামনা করেন। অভ্যাগতদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। আমি রাওকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজ্যের বিজেপি সরকারকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরও রাতারাতি সেখানে মন্দির নির্মাণ হয়ে গেল, আর আপনারা কিছুই করতে পারলেন না? তিনি উত্তর দিলেন, ‘মন্দিরটি বেশি দিন থাকবে না।’
এই মসজিদ ধ্বংসের পর ২২ বছর কেটে গেছে। রাও যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, আমি বেশ কয়েকবার তাঁকে তাঁর দেওয়া নিশ্চয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি বারবার লেখার পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ছোট সেই মন্দিরটি আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করে মুসলমানদের প্রার্থনার ব্যবস্থা করার যে কথা ছিল, তা-ও আজ শোনা যায় না।
যাঁরা বলেন, এটা বাবরি মসজিদ নয়, এটা রাম জন্মভূমি, তাঁদের কথা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু যখন লাখো রাম সেবক সেখানে হাজির হন ও অহিংস গান্ধীবাদীদের ওপর চড়াও হন, তখন যে কথা প্রমাণ করতে হয় তা হলো, অধিকাংশ মানুষ শান্তির পথেই ধাবিত হবেন, যদি সম্ভব হয়, বলপ্রয়োগের দ্বারা, প্রয়োজন হলে। বাস্তবে এই বাবরি মসজিদ ধ্বংস ভারতের বহুত্ববাদী ধারার মধ্যে একটি ছেদ ঘটিয়েছে। এর পর থেকে মুসলমান সম্প্রদায় চরমপন্থার দিকে ঝুঁকেছে। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের ওপর তাদের যে বিশ্বাস ছিল, তার ভিত্তি নড়ে গেছে, এমনকি তা এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার কথাও ভাবছে না।
আমাকে যদি মুসলমানদের মধ্যে জঙ্গিত্ব দেখতে হয়, তাহলে বাবরি মসজিদের ঘটনার মধ্যেই আমাকে এর শুরু দেখতে হবে। ভারতীয় মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, বিশেষ করে মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনায়। ভারত একটি বহুধর্মীয় সমাজ, বহু শতাব্দী ধরেই এই সমাজ এভাবে চলে আসছে। মোদি যদি এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি সব দিক থেকেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হবেন। তিনি দেশের ঐক্যেরও ক্ষতিসাধন করতে পারেন। আমি আশা করি, বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে একবারের জন্য হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি উচ্চারণ করা হোক। যদিও এই দলে সদ্য যোগদানকারীরা বলেন, বিজেপি মুখে না বললেও দলটি যেহেতু সংবিধান ছুঁয়ে শপথ করে, তাই প্রকারান্তরে তারা ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে নেয়। আহা! ব্যাপারটা যদি সত্যিই এমন হতো! বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়ও তো ভারতে সংবিধান ছিল!
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments