মরার খালের মরা লাশেরা by জয়া ফারহানা
মাস দেড়েক হল মরার খাল গ্রামে
আনজুমানারাকে নিয়ে কেচ্ছার শেষ নেই। কেচ্ছা হয় ফিসফিসিয়ে। বলা তো যায় না
কোথায় কেন জয়বাংলার লোক ঘাপটি মেরে আছে। গ্রামের লোকের ধারণা মিলিটারি
সাহেবরা আনজুমানারার শরীর ছেনে-ছুঁয়ে বহুত খুশ। মরার খাল ইউনিয়ন কাউন্সিল
অফিসে তেনারা ক্যাম্প বসিয়েছেন। সেই ক্যাম্পেরই পাহারাদার সোমেদ গাজী সময়
অসময়ে আনজুমানারার ভাঙা বেড়ায় ঠোনা দিয়ে বলে তলব কিয়া, আভিযানে হোগা। ফওরন
আইয়ে। মাঝে মধ্যে আনজুমানারা তেড়েই ওঠে। এ্যাই ছ্যাড়া কিয়ের ফরওন আইয়ে,
বাংলায় কনা কেন? মাঝে মধ্যে বিলাপ করে অভাব আমার মরণডারে ঘনাইলোরে সোমেদ। ক
চান সোমেদ বাঁচনের কী উপায় ওই জল্লাদ ব্যাটাত হাতেথ থন। যুইদ্ধ মাঠিত তন
ইব্রাহিমের বাপ ফিরত আয়া যুদিল আমার মিহি সন্দ লইয়া চায়...। সোমেদ গাজী
ঠোঁট ওল্টায়। হেই ব্যাডারে বটারে (বার্ডার) ফুটাই দিছে; হ্যায় আর আইছে!
থোও তুনার সোমসার আর সোয়ামী... তুমার সবই গেইছে। মাঝে মধ্যে সেই মানুষটার
তক্তপোষের সামনে দাঁড়িয়ে আনজুমানারা মরা কান্না কাঁদে। আমাক তুমি কনে থুয়া
গিলা। আনজুমানারার মরা কান্নায় একটা জীবনের ঢেউ ওঠে তবু... বাকি সময় মরার
খাল মরেই থাকে। কী এক মরার যুদ্ধ শুরু হল ভাবে ময়মুরব্বীরা। শহর থেকে খবির
সাহেব এসেছেন। তিনি রেডিও শোনেন নানান জায়গার। গলা খাঁকারি দিয়ে কামলা
শ্রেণীর এক দঙ্গল মানুষকে সেদিন বোঝাচ্ছিলেনও আম্রিকা, আম্রিকা সেই খানকার
বড় সাহেব বলছেন, সব নর্মাল মানে ঠিকঠাক আছে বুইচ্ছো? মানুষগুলো তার মুখের
দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে বউ-ঝিরা ব্যস্ত তাদের গৃহস্থালির কাম
কাজ নিয়ে। অবশ্য বৈকালিক আসরে উকুন আর জট ছাড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আটপৌরে
আনজুমানারার মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে বেশ্যা বনে যাওয়ার কেচ্ছা-কাহিনী যুদ্ধ
দিনেও কম রঙিন নয়। রাত বাড়লে আনজুমানারার পাগলামিও বাড়ে। বাঁশ ঝাড়ের মাথায়
চাঁদের ঘোলাটে আলোর সঙ্গে ভেসে আসে তার ডাক-চিৎকারও। তুমরা আমার মগজটিরে
টাইন্যা ধর... আল্লারে আল্লা আমার বেবাকটি মগজ ট্যাইন্যা ধর...। গেরামে
পরথম যেদিন মিলিটারি আইল বিলের মইদ্যে হুদাই গুলি কইরা মারল আমার
ইব্রাহিমেরে... ক্যা, ক্যা সব গজব আমার জান খানের উপর দিয়া যায়... গেরামে
আর কেউ-ই কি নাই? কেউরে কি আল্লা চউক্ষে দ্যাহে না? আমার আল্লায় ক্যামনে সয়
আমার রসূল ক্যামনে সয়...। চেয়ারম্যান বাড়ির পৈঠা পর্যন্ত আনজুমানারার সেই
মিহি বিলাপের সুরে কেঁপে কেঁপে ওঠে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার বিরক্তি নিয়ে
খবির সাহেব পাশ ফিরে স্ত্রীকে বলেন, মাগির চিল্লানির ঠেলায় মিলিটারি
সাহেবদের ঘুম হইবার জো নাই। এক ছটাক ঘিলু যদি থাকে মাথায়। মায়মূনা সতর্ক
কণ্টে বলে আপনে চুপ যান। এসব ঝুট ঝামেলা আপনের মতো মাইনষের পরতায় পড়েনি?
কখনও কখনও তাকে ধমকাতে ছুটে আসে আসগর মেম্বার। সেই শাসানিতে আনজুর
শ্বাস-প্রশ্বাসের স্পন্দন পর্যন্ত থেমে যাবার দশা হয়। মাঝে মাঝে সেও পাল্লা
দিয়ে চেঁচায় আমনের কথায়, আমি টাসকি মারা যামো? বিড় বিড় করে বলে ইব্রাহিম
উড বাপধন... তোমার বাপে ট্যাকা দিলে আমি মিলিটারি সাহেবগো সব
খাইদ্য-খাবারের দাম শোধ দিয়াম। আসগর মেম্বার যেতে যেতে বলে বেডির মাতাডা
হাছাই গ্যাছে গা। ক্যাম্পের ভেতর এ আনজুই আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। মরার
খাল হাইস্কুলের মিলিটারিদের আস্তানার বিশাল খোলা উনুনে যখন সে দুধ জ্বাল
দেয়, ব্লাউজ কামড়ে ধরা হাত দিয়ে যখন ক্রমাগত হাতা ঠেলে তখন সোমেদ গাজীরও
বুকের মধ্যে শিরশিরানি ওঠে। এখন সে ভাউড়া রাজাকার বটে তবে মনে মনে তারও
একটা স্বপ্ন আছে। সে স্বপ্ন দেখে মিলিটারিরা যেই সব অকাম করল এর তো একটা
পরিণাম ফল আছে, যেদিন তারা মরার খাল থেকে বিদায় নেবে সেদিনই সে দখল নেবে
আনজুর। আনজু যতই খলবলাক সোমেদ গাজীর বুকের মধ্যে এসে একদিন তাকে বাকুম
বাকুম করতেই হবে। তলে তলে সে খোঁজও নিয়েছে। বর্ডার ক্রস করার প্রথম দিনেই
আনজুর স্বামীর খেল খতম। থাকার মধ্যে ছিল ইব্রাহিমটা। তা গেরামে যেদিন পরথম
মিলিটারি ঢুকল অকারণেই মেরে ফেলল ইব্রাহিমকে। ছয় বছরের পিচ্চি পোলাপাইন,
মিলিটারি দেইখ্যা পরনের প্যান্ট খুলে মাথার ওপর পতাকার মতো দুলাতে দুলাতে
দৌড়াচ্ছিল আর চিক্কারও অবশ্য কিছু কম দেয়নি। কিন্তু সে তো খুশিতে।
ইব্রাহিমের ধারণা ছিল মিলিটারি গ্রামে ঢুকলেই বুঝি সব মুশকিল আসান। আনজুর
কপালই মন্দ। তবু এই মন্দ কপালকেই বুঝি ভালোবেসে ফেলল সোমেদ তার নিজের মন্দ
কপালের সঙ্গে মিলিয়ে। মন্দে মন্দে কাটাকাটি। নিজের মন্দ কপালের কথা ভাবতে
বসলেও সোমেদের, মিহি সুরে কাঁদতে ইচ্ছে করে আনজুর মতো। কিন্তু যেহেতু সে
ব্যাটা ছেলে কাঁদতে পারে না তাই। সোমেদ স্বপ্ন দেখে তবু একদিন এই যুদ্ধ শেষ
হবে। মাঠের পর মাঠ বাওয়া ধানের সবুজ শিষ গজাবে। শেয়াল খাওয়া লাশের বুকের
পাঁজরা আর দেখা যাবে না। মিলিটারিদের হুকুম তামিল করার জন্য গেরামের সরকার
কি তাকে মেরে ফেলবে? না তা কেন? সে তো জান বাঁচানোর গরজে কেবল সামান্য কিছু
ফুটফরমাস খাটছে। এই গ্রামে যে দশঘর গন্ধ বণিক আর বাড়ুই আছে সে কি কোন
ফাঁকে মিলিটারিদের বলে দিয়েছে?
মুক্তি কী ধার বোলো বললে সে কি মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে মুক্তিদের বাড়িঘর চিনিয়ে দিয়েছে? এসব চিন্তায় সোমেদ ভাবে, গ্রাম ছাড়বার আগে মিলিটারিরা বুঝি তাকে মেরে রেখে যাবে। তা যাক। গত দেড় মাসে চোখের সামনে কত মানুষকেই তো মরতে দেখল সোমেদ।
ফাঁকা ক্লাস করে মাথা পাগলা শঙ্কর মাস্টার খড়ি মাটি দিয়ে আঁক কষছিল। যুদ্ধ দিনের আগে থেকেই অবশ্য মাস্টারের মাথা খারাপ। মাথা খারাপ না হলে ফাঁকা ক্লাস ঘরে বসে কেউ অংক কষে? সোমেদের অঙ্গ-ই কী আর বাংলা-ই কী সবই সমান তারপরও সোমেদকে দেখলে শঙ্কর মাস্টার ডেকে নিয়ে ক্লাসে বসাবে। বিড় বিড় করে নামতা পড়বে অংক মেলাবে। তো সেই মাস্টারকেও দুম করেই বন্দুকের নল উঁচিয়ে মেরে ফেলল মিলিটারিরা। মাস্টারের আধা কষা অংক এখনও রয়ে গেছে ব্ল্যাক বোর্ডে, কিন্তু মাস্টার নাই। যাক দুঃখের প্যাচাল আর ভালো লাগে না। তার চে বরং কিছু সুখের ভাবনা ভাবা যাক।
সুখের ভাবনা মানেই তো আনজু। সংসার মানে একটা ঝাপড়ানো জাম গাছ, হাঁস, মুরগি পায়রায় উঠোনময় আদার খাওয়া দুই কানি জমি, বেগুন মুলার ক্ষেত, আনাজপাতির কোটা কুটোনি, সংসার মানে একখান পয়মন্ত মেয়েছেলে আনজুর মতো। আনজু অবশ্য এখন খেকুরে হয়েছে। তা এ যুদ্ধ দিনের কথা ধরলে চলবে কেন? বেচারি আনজুর স্বামীটা গেছে, কোলের পোছা ছেলেটা গেছে এই আকালে কার-ই বা মাথা ঠিক থাকে। মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে করে এ খাটাশগুলোকে বান মারতে। কালা বিদ্যা তারও কিছু কম জানা নেই। গেরামের সব্বাই জানে
সেই পোয়াতি কাল গেল, ইব্রাহিমরে বিয়ানোর কাল গেল কুনসমই পোলাক অবহেলা করে নাইকো আনজু। সোমেদ ভাবে সে একটা জোয়ান মর্দ ব্যাটা অথচ তার সামনেই মিলিটারিরা মরার খালের বউ-ঝিগো দিকে আ-চোখে, কু-চোখে তাকা তাগো ইজ্জত মারনের চেষ্টা করে সে ভাউড়া হইলেও তার রক্ত মাংসে তোলপাড় তোলে সেই যমদূতগুলোর পাপ। আর মিলিটারিরা আসমার (আসবার) পর থিক্কাই ব্যামাক প্রল্লাদ নারায়ণ হাইস্কুলডা হই গিল একখান শ্মশান। সোমেদ গর্তে গর্তে লাশ চাপা দেয় আর মিলিটারিরা নাক চোখ কুঁচকে বলে হাওয়ান-কা লাশ। ইদানীং তার আবার হয়েছে এক রোগ। রাতের দুই প্রহরে আনজুমানারা যখন মিহি সুরে আমপারা পড়ার মতো কাঁদে তখন পাকুড় গাছের নিচে সে এক জ্যান্ত পত্মা দ্যাখে। ওই খবিসের দীঘল হাত থেকে উদ্ধার পেতে সোমেদ গাজী কী না করেছে। প্রথম সে গেছে ধারে কাছের গফুর মওলানার কাছে। নিয়ে এসেছে সুপারি পানি পড়া- গনি মৌলভী দিল পড়া তেল। প্রায় দুই ক্রোশ পথ হেঁটে ইউনিয়ন বোর্ডের সদর রাস্তা পার হয়ে শিবু কবরেজের কাছ থেকে নিয়ে এলো অষ্ট ধাতুর মাদুলি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না সমস্ত শরীর জোড়া চোখওয়ালা পেত্নী দেখা বন্ধ হয় না তার। পেত্নীটা কি আনজু কিনা কে জানে। আনজু মরে নাই বটে কিন্তু সোমেদের ধারণা ছেলের শোকেই হোক আর স্বামীর প্যাদানির ভয়েই হোক রাতের দুই প্রহরে আজুমানারা শর্ষে ফুলের মতো হলুদ রং ধরে ওই পাকুড় গাছের ওপর বসে মিহি সুরে আমপারা পড়ে। পেত্নী ছাড়া কী? যে বিটি রাত নিই (নেই) দিন নিই, মরা ছুওয়াল পাওয়েলর কিচ্ছা কয়, সে পেত্নী ছাড়া আর কি বা! হাঁ করা নির্জনতার মুখে পড়লে সোমেদের সেই গা ছম ছমে শিরশিরানি ফেরত আসে। দিনের বেশি অংশটাই এখন তার কাটে একটা শ্যাওলা পড়া ঘাসি নৌকার পিঠে হেলান দিয়ে। এদিকে লাশের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মরার খাল সত্যি সত্যি এত দিনে মরার খাল হয়ে উঠেছে। সোমেদ গালে হাত দিয়ে ভাবে একটা গেরাম মাত্র কটা দিনে কীভাবে আগাগোড়া বদলে গেল। এখন যেখানে সেখানে পড়ে থাকে হলুদ মগজের ঘিলু আর পিতাভ নাড়ি ভুঁড়ি। ডোবার পাশে ছিটকে পড়া জমাটবাঁধা মানুষের রক্ত চেটে খায় কুকুর।
টানাটানির সময় গঞ্জে গিয়ে মহাজনদের হাতে পায়ে ধরে কেঁদে পড়লে দুচার টকা পাওয়া যেত এখন তাও পাওয়া যায় না। সমস্ত গেরাম খ্যান (যেন) খিঁচুনি রোগী, ভয়ডরে কেবল কাঁপতিছে আর কাঁপতিছে, এর মইদ্যে ওই পেতœী আনজু আবার খবর বয়ে আনে, মিলিটারিরা যেসব লাশ মাইরে রাইখে যাইচ্ছে সেসব লাশের কলাম, গন্ধ নেই কো। কী আজিব কথা! গন্ধ থাকপে না ক্যালা? মানুষ পইচে গিলিপার গন্ধ বাইর বে না এইডে একটা ফ্যাচাল। আজিব কতা। যতদিন যায় সোমেদের মাথার আউলা পানা তত বাড়ে।
দেখতে দেখতে তার, মাথার ব্যারাম এতটা বেড়ে যায় যে মিলিটারি ক্যাম্পের ভেতর গিয়ে সে তাদের বড় সাহেবকে জিজ্ঞেস করে স্যার আমি গ্রেনেড বন্দুকের নলে লাগাই? আপনেরে মাইরে দেহি চ্যান গান্দা বাইর হয় কিনা।
সোমেদ গাজীর মাথা আউলা হউক আর যাই হোক এই কথা শোনার পর মিলিটারিদের কাছে তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো প্রশ্নই নাই। ক্যাপ্টেন নবুওয়াত খানের ইশারায় একজন সেপাই চোয়াল শক্ত করে চিৎকার করে চেপে শালা চিড়িয়াকা বাচ্চা...। তেরা কেল্লা আভি হাম খায়েগা। ক্যাপ্টেনের ইশারায় এক সেপাই আরেক সেপাই তাগাদা দেয় ইস কো আভি লে চলো...।
রাইফেলের বাঁট পিঠে ঠেকিয়ে পাকুড় গাছের ঠিক নিচে গুলি করা হল সোমেদকে। ওঁৎ পেতে থাকা আনজু মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল সোমোদের লাশের ওপর। বাজখাই গলায় সেপাইটি বলল আরেকজনকে আরে ইয়ে তো বহুত বড়িয়া চিজ হ্যায়। আজনুর সেদিকে খেয়াল নেই। সে আরও উবু হয়ে ডাক-চিৎকার দিচ্ছে দ্যাখেন স্যার দ্যাখেন লাশ পচে নাই তবু ইন্দুর পচা গান্দা। দুজন সেপাই পরপর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে পরীক্ষা করতে আসল সত্যি সত্যি লাশের শরীরে গন্ধ আছে কিনা।
রুমাল মুখে চেপে অবশেষে তারা স্বীকার করল, গান্দা হ্যায় বহুত গান্দা হ্যায়। সে রাতে এত জোর বৃষ্টি নামল। তবু মরার খালের পচা দুর্গন্ধ কাটল না। আর পাকুড় গাছের আড়ালে বসে আনজু বিড় বিড় করে বলতে থাকল
মুক্তি মরলে গান্দা হয় না, তয় সোমেদ মরলে এত গান্দা ক্যা?
মুক্তি কী ধার বোলো বললে সে কি মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে মুক্তিদের বাড়িঘর চিনিয়ে দিয়েছে? এসব চিন্তায় সোমেদ ভাবে, গ্রাম ছাড়বার আগে মিলিটারিরা বুঝি তাকে মেরে রেখে যাবে। তা যাক। গত দেড় মাসে চোখের সামনে কত মানুষকেই তো মরতে দেখল সোমেদ।
ফাঁকা ক্লাস করে মাথা পাগলা শঙ্কর মাস্টার খড়ি মাটি দিয়ে আঁক কষছিল। যুদ্ধ দিনের আগে থেকেই অবশ্য মাস্টারের মাথা খারাপ। মাথা খারাপ না হলে ফাঁকা ক্লাস ঘরে বসে কেউ অংক কষে? সোমেদের অঙ্গ-ই কী আর বাংলা-ই কী সবই সমান তারপরও সোমেদকে দেখলে শঙ্কর মাস্টার ডেকে নিয়ে ক্লাসে বসাবে। বিড় বিড় করে নামতা পড়বে অংক মেলাবে। তো সেই মাস্টারকেও দুম করেই বন্দুকের নল উঁচিয়ে মেরে ফেলল মিলিটারিরা। মাস্টারের আধা কষা অংক এখনও রয়ে গেছে ব্ল্যাক বোর্ডে, কিন্তু মাস্টার নাই। যাক দুঃখের প্যাচাল আর ভালো লাগে না। তার চে বরং কিছু সুখের ভাবনা ভাবা যাক।
সুখের ভাবনা মানেই তো আনজু। সংসার মানে একটা ঝাপড়ানো জাম গাছ, হাঁস, মুরগি পায়রায় উঠোনময় আদার খাওয়া দুই কানি জমি, বেগুন মুলার ক্ষেত, আনাজপাতির কোটা কুটোনি, সংসার মানে একখান পয়মন্ত মেয়েছেলে আনজুর মতো। আনজু অবশ্য এখন খেকুরে হয়েছে। তা এ যুদ্ধ দিনের কথা ধরলে চলবে কেন? বেচারি আনজুর স্বামীটা গেছে, কোলের পোছা ছেলেটা গেছে এই আকালে কার-ই বা মাথা ঠিক থাকে। মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে করে এ খাটাশগুলোকে বান মারতে। কালা বিদ্যা তারও কিছু কম জানা নেই। গেরামের সব্বাই জানে
সেই পোয়াতি কাল গেল, ইব্রাহিমরে বিয়ানোর কাল গেল কুনসমই পোলাক অবহেলা করে নাইকো আনজু। সোমেদ ভাবে সে একটা জোয়ান মর্দ ব্যাটা অথচ তার সামনেই মিলিটারিরা মরার খালের বউ-ঝিগো দিকে আ-চোখে, কু-চোখে তাকা তাগো ইজ্জত মারনের চেষ্টা করে সে ভাউড়া হইলেও তার রক্ত মাংসে তোলপাড় তোলে সেই যমদূতগুলোর পাপ। আর মিলিটারিরা আসমার (আসবার) পর থিক্কাই ব্যামাক প্রল্লাদ নারায়ণ হাইস্কুলডা হই গিল একখান শ্মশান। সোমেদ গর্তে গর্তে লাশ চাপা দেয় আর মিলিটারিরা নাক চোখ কুঁচকে বলে হাওয়ান-কা লাশ। ইদানীং তার আবার হয়েছে এক রোগ। রাতের দুই প্রহরে আনজুমানারা যখন মিহি সুরে আমপারা পড়ার মতো কাঁদে তখন পাকুড় গাছের নিচে সে এক জ্যান্ত পত্মা দ্যাখে। ওই খবিসের দীঘল হাত থেকে উদ্ধার পেতে সোমেদ গাজী কী না করেছে। প্রথম সে গেছে ধারে কাছের গফুর মওলানার কাছে। নিয়ে এসেছে সুপারি পানি পড়া- গনি মৌলভী দিল পড়া তেল। প্রায় দুই ক্রোশ পথ হেঁটে ইউনিয়ন বোর্ডের সদর রাস্তা পার হয়ে শিবু কবরেজের কাছ থেকে নিয়ে এলো অষ্ট ধাতুর মাদুলি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না সমস্ত শরীর জোড়া চোখওয়ালা পেত্নী দেখা বন্ধ হয় না তার। পেত্নীটা কি আনজু কিনা কে জানে। আনজু মরে নাই বটে কিন্তু সোমেদের ধারণা ছেলের শোকেই হোক আর স্বামীর প্যাদানির ভয়েই হোক রাতের দুই প্রহরে আজুমানারা শর্ষে ফুলের মতো হলুদ রং ধরে ওই পাকুড় গাছের ওপর বসে মিহি সুরে আমপারা পড়ে। পেত্নী ছাড়া কী? যে বিটি রাত নিই (নেই) দিন নিই, মরা ছুওয়াল পাওয়েলর কিচ্ছা কয়, সে পেত্নী ছাড়া আর কি বা! হাঁ করা নির্জনতার মুখে পড়লে সোমেদের সেই গা ছম ছমে শিরশিরানি ফেরত আসে। দিনের বেশি অংশটাই এখন তার কাটে একটা শ্যাওলা পড়া ঘাসি নৌকার পিঠে হেলান দিয়ে। এদিকে লাশের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মরার খাল সত্যি সত্যি এত দিনে মরার খাল হয়ে উঠেছে। সোমেদ গালে হাত দিয়ে ভাবে একটা গেরাম মাত্র কটা দিনে কীভাবে আগাগোড়া বদলে গেল। এখন যেখানে সেখানে পড়ে থাকে হলুদ মগজের ঘিলু আর পিতাভ নাড়ি ভুঁড়ি। ডোবার পাশে ছিটকে পড়া জমাটবাঁধা মানুষের রক্ত চেটে খায় কুকুর।
টানাটানির সময় গঞ্জে গিয়ে মহাজনদের হাতে পায়ে ধরে কেঁদে পড়লে দুচার টকা পাওয়া যেত এখন তাও পাওয়া যায় না। সমস্ত গেরাম খ্যান (যেন) খিঁচুনি রোগী, ভয়ডরে কেবল কাঁপতিছে আর কাঁপতিছে, এর মইদ্যে ওই পেতœী আনজু আবার খবর বয়ে আনে, মিলিটারিরা যেসব লাশ মাইরে রাইখে যাইচ্ছে সেসব লাশের কলাম, গন্ধ নেই কো। কী আজিব কথা! গন্ধ থাকপে না ক্যালা? মানুষ পইচে গিলিপার গন্ধ বাইর বে না এইডে একটা ফ্যাচাল। আজিব কতা। যতদিন যায় সোমেদের মাথার আউলা পানা তত বাড়ে।
দেখতে দেখতে তার, মাথার ব্যারাম এতটা বেড়ে যায় যে মিলিটারি ক্যাম্পের ভেতর গিয়ে সে তাদের বড় সাহেবকে জিজ্ঞেস করে স্যার আমি গ্রেনেড বন্দুকের নলে লাগাই? আপনেরে মাইরে দেহি চ্যান গান্দা বাইর হয় কিনা।
সোমেদ গাজীর মাথা আউলা হউক আর যাই হোক এই কথা শোনার পর মিলিটারিদের কাছে তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো প্রশ্নই নাই। ক্যাপ্টেন নবুওয়াত খানের ইশারায় একজন সেপাই চোয়াল শক্ত করে চিৎকার করে চেপে শালা চিড়িয়াকা বাচ্চা...। তেরা কেল্লা আভি হাম খায়েগা। ক্যাপ্টেনের ইশারায় এক সেপাই আরেক সেপাই তাগাদা দেয় ইস কো আভি লে চলো...।
রাইফেলের বাঁট পিঠে ঠেকিয়ে পাকুড় গাছের ঠিক নিচে গুলি করা হল সোমেদকে। ওঁৎ পেতে থাকা আনজু মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল সোমোদের লাশের ওপর। বাজখাই গলায় সেপাইটি বলল আরেকজনকে আরে ইয়ে তো বহুত বড়িয়া চিজ হ্যায়। আজনুর সেদিকে খেয়াল নেই। সে আরও উবু হয়ে ডাক-চিৎকার দিচ্ছে দ্যাখেন স্যার দ্যাখেন লাশ পচে নাই তবু ইন্দুর পচা গান্দা। দুজন সেপাই পরপর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে পরীক্ষা করতে আসল সত্যি সত্যি লাশের শরীরে গন্ধ আছে কিনা।
রুমাল মুখে চেপে অবশেষে তারা স্বীকার করল, গান্দা হ্যায় বহুত গান্দা হ্যায়। সে রাতে এত জোর বৃষ্টি নামল। তবু মরার খালের পচা দুর্গন্ধ কাটল না। আর পাকুড় গাছের আড়ালে বসে আনজু বিড় বিড় করে বলতে থাকল
মুক্তি মরলে গান্দা হয় না, তয় সোমেদ মরলে এত গান্দা ক্যা?
No comments