ইস্পানো-আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রতিকৃতি by রাজু আলাউদ্দিন
লেখক, অধ্যাপক, অনুবাদক ও বুদ্ধিজীবীদের
পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার চারজন চিত্রশিল্পীর নামও জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের
সঙ্গে। এদের একজন আর্হেন্তিনার ফেদেরিকো স্চিফ্। ইনি আর্হেন্তিনা থেকে
এরিবের্তো চার্লসের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের আবেস এররান্তেস (ইংরেজি Stray
Birds-এর স্পানঞ্জল অনুবাদ)-এর একটি প্রচ্ছদ করেছিলেন। সেই প্রচ্ছদে তার
আঁকা রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি ব্যবহৃত হয়েছে বা হতে পারে এ বইয়ের
জন্যই তিনি এটি এঁকেছিলেন। স্চিফ্ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। তিনি
বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করতেন; কিন্তু এর বাইরে চিত্রশিল্পী হিসেবে তার
চর্চা বা খ্যাতি ছিল কিনা জানা নেই।
তবে অন্য তিনজন শিল্পীই- কেবল মেহিকোতেই নয়, গোটা লাতিন আমেরিকাতেই তাদের অসামান্য শিল্পকৃতির জন্য পরিচিত এবং বিখ্যাত। সেই তিনজনের একজন চিত্রশিল্পী রবের্তো মন্তেনেগ্রো। মুরাল চিত্রকর্মের জন্য আজ মেহিকোর যে স্বাতন্ত্র্য ও পরিচয় দাঁড়িয়ে গেছে তিনি সেই মুরাল আন্দোলনের আদি শিল্পীদের একজন। সহপাঠী দিয়েগো রিবেরাও ছিলেন সেই আন্দোলনে। তবে রিবেরা তার মুরালে নাটকীয় গুণের কারণে মুরাল শিল্পী হিসেবে প্রবল খ্যাতি অর্জন করলেও মন্তেনেগ্রো সেই পরিচয় থেকে দূরে সরে পড়েন। তবে মেহিকোর সংস্কৃতির এমন কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে যুক্ত করলেন যেখানে তার প্রতিভা স্বতন্ত্র পরিচয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে পুস্তক সচিত্রকরণ, হস্তশিল্প এবং লোকশিল্পকে তিনি এমন এক শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, এক্ষেত্রে তার তুল্য প্রতিভা খুব কমই আছে। আরও একটি ক্ষেত্রে তিনি অনন্য, আর তা হল বিশিষ্টজনদের প্রতিকৃতি। বহু বিশিষ্টজনের সঙ্গে তার কাজ করার সুযোগ যেমন হয়েছে তেমনি এঁকেছেন বহুজনের প্রতিকৃতি। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন সেই বহুজনের একজন। তবে তার সঙ্গ তিনি পেয়েছিলেন কিনা জানি না।
১৯০৭ থেকে ১৯১০ সালে যখন প্যারিসে ছিলেন তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় পাবলো পিকাসো, জর্জ ব্রাক এবং হুয়ান গ্রিসের শিল্পীদের সঙ্গে। রেবিস্তা মুন্দিয়াল (Revista mundial) নামে এক পত্রিকায় তিনি কাজ করেছেন রুবেন দারিওর মতো বিখ্যাত কবির সঙ্গে। দেশী-বিদেশী প্রথম সারির লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কাজের সূত্রে যেমন, তেমনি বন্ধুত্বের সূত্রেও তাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন মন্তেনেগ্রো। আঁকাআঁকির বাইরে তিনি, এমনকি স্মরণীয় হয়ে আছেন বিখ্যাত রুশ চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনেস্টাইনের নির্মিত মেহিকো জিন্দাবাদ (Que viva Mexico)-এর চলচ্চিত্রায়নের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেও। মেহিকোর প্রধান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হোসে বাসকনসেলোস বিশের দশকে তার গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (ঝঊচ) প্রকাশনা প্রকল্পে প্রধান শিল্পীর মর্যাদায় নিয়োগ দিয়েছিলেন। এ প্রকল্পের অধীনে যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার মুদ্রণসৌকর্য এবং সচিত্রকরণের দায়িত্ব ছিল মন্তেনেগ্রো আর তার সহযোগী শিল্পী গাব্রিয়েল ফের্নান্দেস লেদেসমার। প্রকল্পের অধীনে প্রধান দুটো সিরিজের একটা ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য চিরায়ত পাঠ (Lecturas Clasicas Para Nios) আর অন্যটি ছিল বিশ্বজনীন চিরায়ত পাঠ(Lecturas Universales)। প্রথম সিরিজের একটি খণ্ড ছিল দূর প্রাচ্যের কিংবদন্তি(Leyendas del Lejano orientes) । এ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ১২টি কবিতা, বেদ, উপনিষদ ও রামায়নের অংশ বিশেষ, বুদ্ধের জীবনী, সহস এক আরব্য রজনীর অংশ বিশেষ এবং দূর প্রাচ্যের কিছু কিংবদন্তি। এ সিরিজের সব বইয়ের অলংকরণের দায়িত্ব ছিল তার এবং লেদেসমার। বিশ্বজনীন চিরায়ত পাঠ-এর সিরিজ হিসেবে প্রকাশিত ১৮টি খণ্ডেরও দায়িত্বে ছিলেন এ দুজন। অন্যত্র বলেছি, চিরায়ত পাঠ-এর একটি খণ্ড ছিল রবীন্দ্রনাথের। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল The Criscent moon, Nationalism, Personalit এবং Sadhana গ্রন্থগুলো। প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার এ বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে অলংকরণ। এ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্রনাথের আরও একটি বইয়েরও অলংকরণ করেছিলেন মন্তেনেগ্রো, সেটার নাম ছিল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম (Obras de Tagore)। এ বইটি বেরিয়েছিল ১৯২৪ সালে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম বলতে এতে কেবল Criscent moon-এর কবিতাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মোট ৬৩ পৃষ্ঠার এ বইটিতে মন্তেনেগ্রোর প্রচ্ছদ ও অলংকরণতো ছিলই, আমাদের জন্য বাড়তি বিস্ময় হিসেবে যুক্ত হয়েছিল তারই করা রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি। গোটা ইস্পানো-আমেরিকান জগতে এটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রতিকৃতি যা কোনো লাতিন আমেরিকান শিল্পীর আঁকা এবং এঁকেছেন মেহিকোর প্রথম সারির একজন শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও তিনি মেহিকোর চিত্রশিল্পী এবং চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন দলোরেস দেল রিও, ফ্রিদা কালো, এলিয়াস নান্দিনো, রুফিনো তামাইয়ো প্রমুখ।
রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিটি তিনি কোন মাধ্যমে এঁকেছিলেন তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই; কারণ মূল কপি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, গ্রন্থে মুদ্রিত কপিটিই আমার একমাত্র ভরসা। তবে ছবিটিতে রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গোড়ালি পর্যন্ত ঝুলানো জোব্বা, দাড়িসহ রবীন্দ্রনাথকে চিনে নেয়া যায় সহজেই। তবে একটা খটকা তবু থেকেই যায়- প্রতিকৃতিটি মন্তেনেগ্রোরই আঁকাতো। এ সংশয়ের কারণ ছবিটির কোথায়ও তার নাম নেই, যেমনটা আছে ফেদেরিকো স্চুলস্-এর আঁকা ছবিতে কিংবা গাব্রিয়েল ফের্নান্দেস লেদেসমার আঁকা ছবিতে। সন্দেহটিকে আরও সীমিত করে প্রশ্ন করা যায় এভাবে যে ছবিটি মন্তেনেগ্রো নাকি লেদেসমার আঁকা? কারণ এ দুজনই ছিলেন প্রচ্ছদ ও অলংকরণের দায়িত্বে। তবে এও ঠিক যে দুজন এক সঙ্গে কাজ করলেও দুজনেরই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ছিল আলাদা। একজনের আঁকা শিল্পকর্মের সঙ্গে আরেকজনের শিল্পকর্মকে গুলিয়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু লেদেসমার আঁকা ছবিটিও আমাদের হাতের নাগালেই আছে, তাই মিলিয়ে দেখলেই আমরা তা নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব। লেদেসমা বইয়ের অলংকরণের কাজগুলো ছাড়াও কাঠ খোদাই মাধ্যমে প্রচুর কাজ করেছেন। কিন্তু মন্তেনেগ্রো কাঠ খোদাইয়ের কাজ করেছেন- এমনটা জানা যায় না। এবং প্রতিকৃতিটি লেদেসমার মতো কাঠ খোদাইয়ের যে নয়,
তা দেখলেই বুঝা যায়। এটাকে আমার কাছে একটা প্রধান যুক্তি বলে মনে হয়। আর দ্বিতীয় আরেকটা যুক্তি হচ্ছে, লেদেসমা তার কাজগুলোয় নিজের স্বাক্ষর ব্যবহার করতেন। সুতরাং এটাতে লেদেসমার স্বাক্ষর যেহেতু নেই, অতএব মন্তেনেগ্রোরই হবে। মন্তেনেগ্রোর চিঠিপত্র ঘাটতে গিয়ে জানা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আরও একটি প্রতিকৃতিও তিনি এঁকেছিলেন। তার হদিস আমরা পাচ্ছি ১৯২৭ সালে কবিবন্ধু কার্লোস পেইয়িসেরকে লেখা মন্তেনেগ্রোর একটা চিঠিতে। সেই চিঠির পাদটীকায় রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিতে গিয়ে সম্পাদক জানাচ্ছেন যে :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ভারতীয় কবি ও লেখক। ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। পরে ১৯২২ সালে হোসে গরোস্তিসা কর্তৃক নির্বাচিত ও ভূমিকাসহ তার গল্পের একটি সংকলন১ (মন্তেনেগ্রোর আঁকা একটি প্রচ্ছদসহ) কুলতুরা প্রকাশনী (Editorial cultura) বের করে। ১৯৬৪ সালে মন্তেনেগ্রো কুয়াদের্নোস দে বেইয়াস আর্তেস (Cuadernos de Bellas Artes) পত্রিকার প্রচ্ছদের জন্য রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি আঁকেন।
মন্তেনেগ্রোর আঁকা এ প্রতিকৃতিটি আমি দেখিনি। তাহলে তথ্য আকারে মন্তেনেগ্রোর আঁকা রবীন্দ্রনাথের অন্তত দুটো প্রতিকৃতির কথা আমরা জানতে পারছি। এ দুই প্রতিকৃতির কালগত ব্যবধান ৪০ বছরের। স্বতপ্রণোদিত হয়ে নাকি অনুরুদ্ধ হয়ে তিনি এ ছবি দুটো এঁকেছিলেন তা নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই। তবে যেভাবেই হোক না কেন, এটাতো ঠিক যে লাতিন আমেরিকার প্রথম সারির একজন শিল্পী তার প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। আর মন্তেনেগ্রোই হচ্ছেন সেই শিল্পী যিনি গোটা লাতিন আমেরিকায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। তথ্যের এ ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে এ লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও বিস্তার কেবল বর্ণনির্ভর জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, চিত্রকলার জগতকেও তা ছুঁয়ে গিয়েছিল।
এ সংকলনটি ছিল সেনোবিয়া কামপ্র“বি দে হিমেনেথের অনুবাদ-এ কুয়েন্তোস (Cuentos)নামক গল্পগ্রন্থ।
তবে অন্য তিনজন শিল্পীই- কেবল মেহিকোতেই নয়, গোটা লাতিন আমেরিকাতেই তাদের অসামান্য শিল্পকৃতির জন্য পরিচিত এবং বিখ্যাত। সেই তিনজনের একজন চিত্রশিল্পী রবের্তো মন্তেনেগ্রো। মুরাল চিত্রকর্মের জন্য আজ মেহিকোর যে স্বাতন্ত্র্য ও পরিচয় দাঁড়িয়ে গেছে তিনি সেই মুরাল আন্দোলনের আদি শিল্পীদের একজন। সহপাঠী দিয়েগো রিবেরাও ছিলেন সেই আন্দোলনে। তবে রিবেরা তার মুরালে নাটকীয় গুণের কারণে মুরাল শিল্পী হিসেবে প্রবল খ্যাতি অর্জন করলেও মন্তেনেগ্রো সেই পরিচয় থেকে দূরে সরে পড়েন। তবে মেহিকোর সংস্কৃতির এমন কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে যুক্ত করলেন যেখানে তার প্রতিভা স্বতন্ত্র পরিচয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে পুস্তক সচিত্রকরণ, হস্তশিল্প এবং লোকশিল্পকে তিনি এমন এক শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, এক্ষেত্রে তার তুল্য প্রতিভা খুব কমই আছে। আরও একটি ক্ষেত্রে তিনি অনন্য, আর তা হল বিশিষ্টজনদের প্রতিকৃতি। বহু বিশিষ্টজনের সঙ্গে তার কাজ করার সুযোগ যেমন হয়েছে তেমনি এঁকেছেন বহুজনের প্রতিকৃতি। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন সেই বহুজনের একজন। তবে তার সঙ্গ তিনি পেয়েছিলেন কিনা জানি না।
১৯০৭ থেকে ১৯১০ সালে যখন প্যারিসে ছিলেন তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় পাবলো পিকাসো, জর্জ ব্রাক এবং হুয়ান গ্রিসের শিল্পীদের সঙ্গে। রেবিস্তা মুন্দিয়াল (Revista mundial) নামে এক পত্রিকায় তিনি কাজ করেছেন রুবেন দারিওর মতো বিখ্যাত কবির সঙ্গে। দেশী-বিদেশী প্রথম সারির লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কাজের সূত্রে যেমন, তেমনি বন্ধুত্বের সূত্রেও তাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন মন্তেনেগ্রো। আঁকাআঁকির বাইরে তিনি, এমনকি স্মরণীয় হয়ে আছেন বিখ্যাত রুশ চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনেস্টাইনের নির্মিত মেহিকো জিন্দাবাদ (Que viva Mexico)-এর চলচ্চিত্রায়নের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেও। মেহিকোর প্রধান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হোসে বাসকনসেলোস বিশের দশকে তার গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (ঝঊচ) প্রকাশনা প্রকল্পে প্রধান শিল্পীর মর্যাদায় নিয়োগ দিয়েছিলেন। এ প্রকল্পের অধীনে যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার মুদ্রণসৌকর্য এবং সচিত্রকরণের দায়িত্ব ছিল মন্তেনেগ্রো আর তার সহযোগী শিল্পী গাব্রিয়েল ফের্নান্দেস লেদেসমার। প্রকল্পের অধীনে প্রধান দুটো সিরিজের একটা ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য চিরায়ত পাঠ (Lecturas Clasicas Para Nios) আর অন্যটি ছিল বিশ্বজনীন চিরায়ত পাঠ(Lecturas Universales)। প্রথম সিরিজের একটি খণ্ড ছিল দূর প্রাচ্যের কিংবদন্তি(Leyendas del Lejano orientes) । এ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ১২টি কবিতা, বেদ, উপনিষদ ও রামায়নের অংশ বিশেষ, বুদ্ধের জীবনী, সহস এক আরব্য রজনীর অংশ বিশেষ এবং দূর প্রাচ্যের কিছু কিংবদন্তি। এ সিরিজের সব বইয়ের অলংকরণের দায়িত্ব ছিল তার এবং লেদেসমার। বিশ্বজনীন চিরায়ত পাঠ-এর সিরিজ হিসেবে প্রকাশিত ১৮টি খণ্ডেরও দায়িত্বে ছিলেন এ দুজন। অন্যত্র বলেছি, চিরায়ত পাঠ-এর একটি খণ্ড ছিল রবীন্দ্রনাথের। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল The Criscent moon, Nationalism, Personalit এবং Sadhana গ্রন্থগুলো। প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার এ বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে অলংকরণ। এ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্রনাথের আরও একটি বইয়েরও অলংকরণ করেছিলেন মন্তেনেগ্রো, সেটার নাম ছিল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম (Obras de Tagore)। এ বইটি বেরিয়েছিল ১৯২৪ সালে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম বলতে এতে কেবল Criscent moon-এর কবিতাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মোট ৬৩ পৃষ্ঠার এ বইটিতে মন্তেনেগ্রোর প্রচ্ছদ ও অলংকরণতো ছিলই, আমাদের জন্য বাড়তি বিস্ময় হিসেবে যুক্ত হয়েছিল তারই করা রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি। গোটা ইস্পানো-আমেরিকান জগতে এটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রতিকৃতি যা কোনো লাতিন আমেরিকান শিল্পীর আঁকা এবং এঁকেছেন মেহিকোর প্রথম সারির একজন শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও তিনি মেহিকোর চিত্রশিল্পী এবং চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন দলোরেস দেল রিও, ফ্রিদা কালো, এলিয়াস নান্দিনো, রুফিনো তামাইয়ো প্রমুখ।
রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিটি তিনি কোন মাধ্যমে এঁকেছিলেন তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই; কারণ মূল কপি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, গ্রন্থে মুদ্রিত কপিটিই আমার একমাত্র ভরসা। তবে ছবিটিতে রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গোড়ালি পর্যন্ত ঝুলানো জোব্বা, দাড়িসহ রবীন্দ্রনাথকে চিনে নেয়া যায় সহজেই। তবে একটা খটকা তবু থেকেই যায়- প্রতিকৃতিটি মন্তেনেগ্রোরই আঁকাতো। এ সংশয়ের কারণ ছবিটির কোথায়ও তার নাম নেই, যেমনটা আছে ফেদেরিকো স্চুলস্-এর আঁকা ছবিতে কিংবা গাব্রিয়েল ফের্নান্দেস লেদেসমার আঁকা ছবিতে। সন্দেহটিকে আরও সীমিত করে প্রশ্ন করা যায় এভাবে যে ছবিটি মন্তেনেগ্রো নাকি লেদেসমার আঁকা? কারণ এ দুজনই ছিলেন প্রচ্ছদ ও অলংকরণের দায়িত্বে। তবে এও ঠিক যে দুজন এক সঙ্গে কাজ করলেও দুজনেরই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ছিল আলাদা। একজনের আঁকা শিল্পকর্মের সঙ্গে আরেকজনের শিল্পকর্মকে গুলিয়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু লেদেসমার আঁকা ছবিটিও আমাদের হাতের নাগালেই আছে, তাই মিলিয়ে দেখলেই আমরা তা নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব। লেদেসমা বইয়ের অলংকরণের কাজগুলো ছাড়াও কাঠ খোদাই মাধ্যমে প্রচুর কাজ করেছেন। কিন্তু মন্তেনেগ্রো কাঠ খোদাইয়ের কাজ করেছেন- এমনটা জানা যায় না। এবং প্রতিকৃতিটি লেদেসমার মতো কাঠ খোদাইয়ের যে নয়,
তা দেখলেই বুঝা যায়। এটাকে আমার কাছে একটা প্রধান যুক্তি বলে মনে হয়। আর দ্বিতীয় আরেকটা যুক্তি হচ্ছে, লেদেসমা তার কাজগুলোয় নিজের স্বাক্ষর ব্যবহার করতেন। সুতরাং এটাতে লেদেসমার স্বাক্ষর যেহেতু নেই, অতএব মন্তেনেগ্রোরই হবে। মন্তেনেগ্রোর চিঠিপত্র ঘাটতে গিয়ে জানা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আরও একটি প্রতিকৃতিও তিনি এঁকেছিলেন। তার হদিস আমরা পাচ্ছি ১৯২৭ সালে কবিবন্ধু কার্লোস পেইয়িসেরকে লেখা মন্তেনেগ্রোর একটা চিঠিতে। সেই চিঠির পাদটীকায় রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিতে গিয়ে সম্পাদক জানাচ্ছেন যে :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ভারতীয় কবি ও লেখক। ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। পরে ১৯২২ সালে হোসে গরোস্তিসা কর্তৃক নির্বাচিত ও ভূমিকাসহ তার গল্পের একটি সংকলন১ (মন্তেনেগ্রোর আঁকা একটি প্রচ্ছদসহ) কুলতুরা প্রকাশনী (Editorial cultura) বের করে। ১৯৬৪ সালে মন্তেনেগ্রো কুয়াদের্নোস দে বেইয়াস আর্তেস (Cuadernos de Bellas Artes) পত্রিকার প্রচ্ছদের জন্য রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি আঁকেন।
মন্তেনেগ্রোর আঁকা এ প্রতিকৃতিটি আমি দেখিনি। তাহলে তথ্য আকারে মন্তেনেগ্রোর আঁকা রবীন্দ্রনাথের অন্তত দুটো প্রতিকৃতির কথা আমরা জানতে পারছি। এ দুই প্রতিকৃতির কালগত ব্যবধান ৪০ বছরের। স্বতপ্রণোদিত হয়ে নাকি অনুরুদ্ধ হয়ে তিনি এ ছবি দুটো এঁকেছিলেন তা নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই। তবে যেভাবেই হোক না কেন, এটাতো ঠিক যে লাতিন আমেরিকার প্রথম সারির একজন শিল্পী তার প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। আর মন্তেনেগ্রোই হচ্ছেন সেই শিল্পী যিনি গোটা লাতিন আমেরিকায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। তথ্যের এ ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে এ লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও বিস্তার কেবল বর্ণনির্ভর জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, চিত্রকলার জগতকেও তা ছুঁয়ে গিয়েছিল।
এ সংকলনটি ছিল সেনোবিয়া কামপ্র“বি দে হিমেনেথের অনুবাদ-এ কুয়েন্তোস (Cuentos)নামক গল্পগ্রন্থ।
No comments