যখন মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
রাজীব সরকারের রম্য রচনা মুখ ঢেকে যায়
বিজ্ঞাপনে এ বছর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। লেখক বাংলাদেশের একজন
শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক। পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করলেও বিতর্কের
সূত্রটি এখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। লেখালেখি অনেক আগে থেকেই শুরু করেছেন। মুখ
ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে লেখকের চতুর্থ গ্রন্থ। এ বইটিতে লেখক সহজ ও সরস ভঙ্গিতে
অনেক কঠিন কথা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যে রম্য বা রস রচনার ধারাটি
ঐতিহ্যবাহী। শিবরাম চক্রবর্তীর কথা আমরা জানি যিনি রম্য লেখক হিসেবেই
বিখ্যাত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে হালের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়- কার হাত
দিয়ে না রম্য রচনা বের হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রম্য লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তা
অর্জন করেছেন আনিসুল হক। উচ্চশিক্ষার সূত্রে লেখক কিছুদিন ইউরোপে অবস্থান
করেছেন। এ বইয়ের রচনাগুলোর অধিকাংশই সেই সময়ে লেখা। তাই কয়েকটি লেখায়
পাশ্চাত্যে লাভ করা অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে।
এ বইয়ে মোট ২০টি রচনা রয়েছে। লেখাগুলোর পরিসর তেমন বড় নয়। ভারমুক্ত হয়ে মাথা খোলাসা করে এক বসাতেই পড়ে ফেলা সম্ভব বইটি। বইয়ের প্রথম লেখাটির শিরোনাম হচ্ছে মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। কবি শঙ্খ ঘোষের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক শুরু করেছেন এভাবে- “কবি শঙ্খ ঘোষ বিজ্ঞাপনের সর্বত্রগামিতা দেখে লিখেছেন মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপন এমন মুখের সীমানা ছাড়িয়ে শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গও ঢাকতে শুরু করেছে। কাজেই শরীর ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে- এমন কথা অনায়াসে বলা যায়।” (পৃষ্ঠা ১১)।
বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে ব্যক্তিস্বার্থই যে মুখ্য তা বোঝা যায় বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে। লেখক বলছেন, একটি চিপসের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, একটি শিশু তার ভাই-বোনদের লুকিয়ে দরজা বন্ধ করে চিপস খাচ্ছে আর বলছে- একা একা খেতে চাও তো দরজা বন্ধ করে খাও। কী চমৎকার শিক্ষা। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নিজে খেতে না পারলে শিশুরা দেশের সুনাগরিক হয়ে উঠবে কীভাবে? (পৃষ্ঠা-১১)।
একবিংশ শতাব্দীর নারী স্বাধীনতার এ যুগেও এসে যখন আমাদের শুনতে হয় একটি বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে এবার একজন আসল রাঁধুনী (বৌ) নিয়ে আয়- তখন আসলে নারীর অবস্থানটি পরিষ্কার হয়ে যায়। বিজ্ঞাপনে এসব ভাষার প্রয়োগ চিহ্নিত করার মাধ্যমে লেখক আসলে সমাজের সত্যিকার অবস্থানটি নির্ণয় করতে চেয়েছেন।
লেখক ভালোবাসা বিষয়ে বেশ কটি লেখা লিখেছেন যা পড়ে তরুণদের ভালো লাগবে। যারা প্রেম করছেন বা করবেন বলে ভাবছেন অথবা কিছুদিন বিরতির পর আবারও ভালোবাসায় মনোনিবেশ করতে যাচ্ছেন তাদের জন্য এসব লেখা উপযুক্ত পথের সন্ধান দেবে।
ভালোবাসা একটি মৌলিক অধিকার, ডিজিটাল ভালোবাসা, ভালোবাসার বিশ্বায়ন, স্বামী-স্ত্রী-দ্বন্দ্ব সমাস (আসলে এটিও ভালোবাসা), বিরহের জয় হোক (এটিও ভালোবাসার একুশ কলার এক কলা), নারীর মন (ভালোবাসার সূত্র খোঁজা), ঘরকীয়া ও পরকীয়া প্রেম, এ সবগুলো লেখাতেই লেখক ভালোবাসার জয় জয়কারের কথা বলেছেন। যেমন ভালোবাসা একটি মৌলিক অধিকার- এ বলেছেন, হঠাৎ দেখি এক পুলিশ কনস্টেবল একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে। অভিযোগ তারা সেখানে অসামাজিক কাজ করছে। তারা সেখানে যা করছিল এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সামাজিক কাজ কি আছে? (পৃষ্ঠা ৩৫)।
ডিজিটাল ভালোবাসাকে লেখক পণ্যকেন্দ্রিক বলেছেন। সে কারণেই এক ব্যর্থ প্রেমিক কাম কবি লিখেছেন, মেয়েটি বাদাম ছিলিল, ছেলেটি বাদাম গিলিল। বাদাম হইল শেষ, মেয়েটি নিরুদ্দেশ। (পৃষ্ঠা ৩৯)। মেয়েটি নিরুদ্দেশ হলেও ছেলেটি কিন্তু প্রেমিকার শোকে পাগলা হয়ে মদের বোতল নিয়ে পড়ে থাকার পাত্র নয়। ডিজিটাল ভালোবাসায় দেবদাস-পার্বতী তৈরি হয় না।
চিত্তসুখ বনাম বিত্তসুখ লেখায় রাজীব সরকার চমৎকারভাবে রূঢ় সত্য কথা বলেছেন, বিত্তসুখ থাকলেই যে চিত্তে সুখ আসবে এমন কোনো কথা নেই, তবে বিত্ত না থাকলে চিত্তে যে সুখ আসবে না এটা নিশ্চিত। রসায়নের ভাষায় বলা যায়- সকল বিত্তসুখই চিত্তসুখ, কিন্তু সকল চিত্তসুখই বিত্তসুখ নয়। (পৃষ্ঠা ৩৩)।
বাংলা সিনেমা ও অশ্বডিম্ব রচনায় শুধু মন্দ সিনেমার কথাই বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে যে কিছু অসাধারণ চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে তার উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। লেখক হাস্যরসের ছলে দৈনন্দিন জীবনের ও সিস্টেমের অনেক গলদের কথাই বলেছেন। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত আমলাতন্ত্রের কথা লেখক কিছুই বলেননি। আগামী সংস্করণে নিশ্চয়ই এসবের দেখা আমরা পাব।
প্রতিশ্র“তিশীল তরুণ লেখক রাজীব সরকার বিতর্কিত বলেই হয়তো তার লেখায় যুক্তির ধার খুঁজে পাওয়া যায়। এ বইতেও তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। আগ্রহী পাঠকের মননশীলতায় চিন্তার নতুন খোরাক যোগাবে এ বই। বইটির পাঠকপ্রিয়তা ও সাফল্য কামনা করি।
শিব শংকর কারুয়া
এ বইয়ে মোট ২০টি রচনা রয়েছে। লেখাগুলোর পরিসর তেমন বড় নয়। ভারমুক্ত হয়ে মাথা খোলাসা করে এক বসাতেই পড়ে ফেলা সম্ভব বইটি। বইয়ের প্রথম লেখাটির শিরোনাম হচ্ছে মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। কবি শঙ্খ ঘোষের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক শুরু করেছেন এভাবে- “কবি শঙ্খ ঘোষ বিজ্ঞাপনের সর্বত্রগামিতা দেখে লিখেছেন মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপন এমন মুখের সীমানা ছাড়িয়ে শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গও ঢাকতে শুরু করেছে। কাজেই শরীর ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে- এমন কথা অনায়াসে বলা যায়।” (পৃষ্ঠা ১১)।
বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে ব্যক্তিস্বার্থই যে মুখ্য তা বোঝা যায় বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে। লেখক বলছেন, একটি চিপসের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, একটি শিশু তার ভাই-বোনদের লুকিয়ে দরজা বন্ধ করে চিপস খাচ্ছে আর বলছে- একা একা খেতে চাও তো দরজা বন্ধ করে খাও। কী চমৎকার শিক্ষা। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নিজে খেতে না পারলে শিশুরা দেশের সুনাগরিক হয়ে উঠবে কীভাবে? (পৃষ্ঠা-১১)।
একবিংশ শতাব্দীর নারী স্বাধীনতার এ যুগেও এসে যখন আমাদের শুনতে হয় একটি বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে এবার একজন আসল রাঁধুনী (বৌ) নিয়ে আয়- তখন আসলে নারীর অবস্থানটি পরিষ্কার হয়ে যায়। বিজ্ঞাপনে এসব ভাষার প্রয়োগ চিহ্নিত করার মাধ্যমে লেখক আসলে সমাজের সত্যিকার অবস্থানটি নির্ণয় করতে চেয়েছেন।
লেখক ভালোবাসা বিষয়ে বেশ কটি লেখা লিখেছেন যা পড়ে তরুণদের ভালো লাগবে। যারা প্রেম করছেন বা করবেন বলে ভাবছেন অথবা কিছুদিন বিরতির পর আবারও ভালোবাসায় মনোনিবেশ করতে যাচ্ছেন তাদের জন্য এসব লেখা উপযুক্ত পথের সন্ধান দেবে।
ভালোবাসা একটি মৌলিক অধিকার, ডিজিটাল ভালোবাসা, ভালোবাসার বিশ্বায়ন, স্বামী-স্ত্রী-দ্বন্দ্ব সমাস (আসলে এটিও ভালোবাসা), বিরহের জয় হোক (এটিও ভালোবাসার একুশ কলার এক কলা), নারীর মন (ভালোবাসার সূত্র খোঁজা), ঘরকীয়া ও পরকীয়া প্রেম, এ সবগুলো লেখাতেই লেখক ভালোবাসার জয় জয়কারের কথা বলেছেন। যেমন ভালোবাসা একটি মৌলিক অধিকার- এ বলেছেন, হঠাৎ দেখি এক পুলিশ কনস্টেবল একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে। অভিযোগ তারা সেখানে অসামাজিক কাজ করছে। তারা সেখানে যা করছিল এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সামাজিক কাজ কি আছে? (পৃষ্ঠা ৩৫)।
ডিজিটাল ভালোবাসাকে লেখক পণ্যকেন্দ্রিক বলেছেন। সে কারণেই এক ব্যর্থ প্রেমিক কাম কবি লিখেছেন, মেয়েটি বাদাম ছিলিল, ছেলেটি বাদাম গিলিল। বাদাম হইল শেষ, মেয়েটি নিরুদ্দেশ। (পৃষ্ঠা ৩৯)। মেয়েটি নিরুদ্দেশ হলেও ছেলেটি কিন্তু প্রেমিকার শোকে পাগলা হয়ে মদের বোতল নিয়ে পড়ে থাকার পাত্র নয়। ডিজিটাল ভালোবাসায় দেবদাস-পার্বতী তৈরি হয় না।
চিত্তসুখ বনাম বিত্তসুখ লেখায় রাজীব সরকার চমৎকারভাবে রূঢ় সত্য কথা বলেছেন, বিত্তসুখ থাকলেই যে চিত্তে সুখ আসবে এমন কোনো কথা নেই, তবে বিত্ত না থাকলে চিত্তে যে সুখ আসবে না এটা নিশ্চিত। রসায়নের ভাষায় বলা যায়- সকল বিত্তসুখই চিত্তসুখ, কিন্তু সকল চিত্তসুখই বিত্তসুখ নয়। (পৃষ্ঠা ৩৩)।
বাংলা সিনেমা ও অশ্বডিম্ব রচনায় শুধু মন্দ সিনেমার কথাই বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে যে কিছু অসাধারণ চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে তার উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। লেখক হাস্যরসের ছলে দৈনন্দিন জীবনের ও সিস্টেমের অনেক গলদের কথাই বলেছেন। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত আমলাতন্ত্রের কথা লেখক কিছুই বলেননি। আগামী সংস্করণে নিশ্চয়ই এসবের দেখা আমরা পাব।
প্রতিশ্র“তিশীল তরুণ লেখক রাজীব সরকার বিতর্কিত বলেই হয়তো তার লেখায় যুক্তির ধার খুঁজে পাওয়া যায়। এ বইতেও তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। আগ্রহী পাঠকের মননশীলতায় চিন্তার নতুন খোরাক যোগাবে এ বই। বইটির পাঠকপ্রিয়তা ও সাফল্য কামনা করি।
শিব শংকর কারুয়া
No comments