মোদি-জ্বরে বঙ্গবীর by হাসান ফেরদৌস
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে ঠিক বৈদেশিক
নীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বোধ হয় বলা যায় না। তবে তিনি কয়েক বছর ভারতে কাটিয়েছেন,
কাজেই নিজেকে ভারত বিশেষজ্ঞ বলে দাবি তো করতেই পারেন। তো, সম্প্রতি কাদের
সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ভারতে মোদি আসছে, আর সে ভয়ে আওয়ামী লীগের হাঁটুতে
কাঁপুনি শুরু হয়েছে।
অনুমান করি, যেহেতু ইন্দিরা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে হাসিনা সরকারের বেশ হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে সেই ‘বিশেষ সম্পর্ক’ আর থাকবে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তাদের ‘পার্টনার’ হিসেবে অন্য কাউকে খুঁজতে হবে, আর তা সম্ভবত বিএনপি। অনুমান করি, বঙ্গবীর তাঁর বক্র মন্তব্যে এ কথাই ইঙ্গিত করেছেন।
বঙ্গবীরের আর কী দোষ, সারা ভারতে এখন মোদি-জ্বর চলছে। ভাবা হচ্ছে, বড় ধরনের বিভ্রাট না হলে নরেন্দ্র মোদিই ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। একের পর এক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক কেলেঙ্কারিতে মনমোহন সিং সরকারের রীতিমতো ছ্যাড়াবেড়া অবস্থা। এই অবস্থায় দেশের মানুষ কেন্দ্রে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন চায়। পর পর চার দফা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে মোদি দক্ষ ও সুশাসক হিসেবে প্রমাণ রেখেছেন। তাঁর গায়ে গুজরাট দাঙ্গার রক্তচিহ্ন লেগে থাকা সত্ত্বেও দেশের একটা বড় অংশ যদি এই মোদি ও তাঁর দল বিজেপিকে কেন্দ্রে সরকার গঠনের দায়িত্ব দেয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
মোদি আসা মানেই কি ভারতের বৈদেশিক নীতির খোল নলচে বদলে যাওয়া? আজকের বন্ধু রাতারাতি শত্রু হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নের এককথায় উত্তর, না। কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় নীতি—তা অভ্যন্তরীণ বা বহির্দেশবিষয়ক হোক—নির্ধারিত হয় সে দেশের জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। বস্তুত, অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতির মধ্যে কোনো মৌল বিরোধ নেই, তারা একে অপরের সম্পূরক মাত্র। জাতীয় ক্ষেত্রে যেমন, বৈদেশিক প্রশ্নের মূল কথা হলো জাতীয় স্বার্থ কোথায় এবং সেই স্বার্থ আগলানোর জন্য ক্ষমতাসীনদের কাছে কী কী রসদ মজুত রয়েছে।
ভোটের আগে নেতা-নেত্রীরা অনেক কথাই বলেন। ক্ষমতায় বসে তাঁরা সেসব প্রতিশ্রুতির কিছু কিছু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন; যদিও কাঠামোগত ও রাজনৈতিক জটিলতার কারণে সেসবের অনেকগুলোই বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। উদাহরণ হিসেবে গুয়ানতানামো বেতে মার্কিন কয়েদখানা বন্ধের ব্যাপারে বারাক ওবামার সুনির্দিষ্ট, কিন্তু ব্যর্থ প্রতিশ্রুতির কথা ভাবুন। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন তো আরও কঠিন, কারণ সে সম্পর্কের ভিত্তিতে থাকে দ্বিপক্ষীয় অথবা আন্তর্জাতিক চুক্তি। চাইলেই সে চুক্তি বাতিল করা যায় না। যেখানে সুনির্দিষ্ট আইন নেই, সেখানে প্রচলিত (কিন্তু অলিখিত) আইন বা নিয়মনীতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে এসব লিখিত-অলিখিত আইন মেনে চলতে আমরা (এমনকি মোদিও!) বাধ্য।
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বৈদেশিক নীতি প্রশ্নে কতিপয় প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করেছে, যার কোনোটাই ঠিক নতুন নয়। বলা হয়েছে, শান্তি ও শক্তির সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে। এ কথার অর্থ, প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গেই ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়, কিন্তু প্রয়োজনবোধে শক্তি ব্যবহারে সে পিছপা হবে না। এ কথার আরেক অর্থ, ভারত তার আণবিক অস্ত্র পরিহার করবে না, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সে অস্ত্রের সম্ভাব্য ব্যবহার তার অধিকারবলে বিবেচনা করবে। কিন্তু এ তো পুরোনো কথা, সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিটি ভারতীয় সরকারই এই নীতি অনুসরণ করেছে। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে। তার মানে, মোদি সাহেবের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য আগে, আদর্শগত বিবেচনা পরে। এই একই নীতি অনুসরণ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত তার নিকটবর্তী সব প্রতিবেশীর সঙ্গে বহুমুখী বাণিজ্যিক সম্পর্ক নির্মাণে বেশ সাফল্য পেয়েছে। এমনকি জাতশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গেও আন্তসীমান্ত বাণিজ্য ও আদান-প্রদান বহুগুণে বেড়ে গেছে। অনুমান করি, মোদি ক্ষমতায় এলে এই নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে এক ভাষণে মোদি অবশ্য একটি নতুন কথা বলেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ভারতের রাজ্যগুলো নিজেরাই দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক নির্মাণ করতে চাইলে তিনি তাতে সমর্থন দেবেন। উদাহরণ হিসেবে তামিলনাড়ু, শ্রীলঙ্কা, গোয়া ও পর্তুগালের কথা বলেছেন। বিজেপির ইশতেহারে অবশ্য এই নতুন রণকৌশলের কোনো উল্লেখ নেই। কাগজে-কলমে প্রস্তাবটি আকর্ষণীয়, কিন্তু কতটা বাস্তবসম্মত, তা ভাবা যেতে পারে। লক্ষণীয়, তিনি গোয়া-পর্তুগালের উদাহরণ দিয়েছেন, অথচ যাদের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব সবচেয়ে অর্থবহ হতো, সেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কথা একদম এড়িয়ে গেছেন।
পাকিস্তানের ব্যাপারে তিনি নরম-গরম অনেক কথাই বলেছেন, ইশতেহারেও যথারীতি সামরিক অনুপ্রবেশ ও উগ্রপন্থীদের কঠোর হাতে দমনের কথা বলা হয়েছে। এমন কথা ভারতের সব সরকারই বলে থাকে। অটল বিহারি বাজপেয়ির আমলেও বলা হয়েছিল, যদিও তাঁর সময়েই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক বদলানো শুরু করেছিল। ১৯৯৯ সালে বাজপেয়ি নিজ উদ্যোগেই লাহোর এসেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘লাহোর ঘোষণা’ স্বাক্ষর করেছিলেন। কারগিল নিয়ে দুই দেশের যুদ্ধের কারণে সেই চেষ্টা অবশ্য পুরোটাই ভেস্তে যায়।
বাংলাদেশের ব্যাপারে মোদি সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে নরম-গরম কথা বলেছেন; যদিও সেসবের লক্ষ্য পূর্বাঞ্চলের ভোটাররা। বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের আইনসিদ্ধ করার পক্ষে তিনি মত দিয়েছেন। এমনকি, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলমানদেরও তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে। এসবের কোনোটাই যে জাতীয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব নয়, কেবল সংখ্যালঘু ভোটারদের দলে ভেড়ানোর জন্য, তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য পূর্বাঞ্চলে বহিরাগত অনুপ্রবেশের ব্যাপারে যে সত্য-মিথ্যা জড়ানো ভীতি রয়েছে, তাতে মোদির এই কথায় আসল ভোটারদের একাংশ বিগড়ে যেতে পারে।
তো, বঙ্গবীর যতই বলুন, মোদির এই বৈদেশিক নীতি থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভীত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো ভাষ্যকার ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে মনমোহন সরকারের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, অতএব মোদি জিতলে তাদের বারোটা বাজবে’ ভেবে যে গোপন পুলক অনুভব করছেন, তারও কোনো বাস্তবসম্মত ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থ’ দুটি—এক. ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো; দুই. ভারতীয় পণ্যের বাজার বৃদ্ধি করা। প্রথম কাজে বিএনপির ভূমিকা ভারতের চোখে বন্ধুসুলভ নয়। আর বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে কে ভারতের বড় বন্ধু, আওয়ামী লীগ না বিএনপি, তা নির্ণয়ের জন্য আমাদের জাতীয় কমিশন বসাতে হবে।
সোজা কথায়, কাদের সিদ্দিকী নরেদ্র মোদির ঘাড়ে বন্দুক রেখে ‘দাঁড়াও, দেখাচ্ছি’ বলে যতই আওয়ামী লীগকে মোদি জুজুর ভয় দেখান না কেন, বিএনপির তাতে আত্মপ্রসাদ লাভের কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments