গণতন্ত্র ও জবাবদিহি- সুপ্রিম কোর্ট যখন সংবিধানবিচ্যুত by মিজানুর রহমান খান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছেন। অবিরাম জলকামান দাগিয়ে ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ ভন্ডুলের পটভূমিতে তিনি গতকাল বলেছেন,
‘এক-এগারোর কুশীলবেরা আবার সক্রিয়। একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় আনতে চান।’ এটা সত্যি, নাকি গোয়েবলসীয় প্রচারণা?

একজন রহস্যময় আবু সাফার লড়াইটা ছিল এইট পাসের তথ্য প্রকাশ না করা। হঠাৎ তাঁর অশরীরী আবির্ভাব ঘটে আপিল বিভাগে। প্রধান বিচারপতি পদে তখন জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, যিনি ইয়াজউদ্দিনের অনুকূলে সেই নজিরবিহীন আদেশটি দিয়ে এক-এগারোর পথ প্রশস্ত করেছিলেন।
রাস্তায় রাজনীতিকদের খুনোখুনিটা চোখে পড়ে। কিন্তু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কী করে রক্তাক্ত হয়, সেখানেও যে ‘ট্রাম্পকার্ড’ চলে, সেটা চোখে পড়ে না।
একটি রাষ্ট্রে অনেকগুলো নখদন্তযুক্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অবশ্যই থাকতে হবে। যারা না থাকলে এ ধরনের প্রতিকারহীন স্বেচ্ছাচার ও ধস্তাধস্তি চলতেই থাকবে। অথচ গণতান্ত্রিক পন্থায় কারও প্রতিকার লাভের সুযোগ থাকবে না। যেমন এখন আমাদের অসহায় লাগছে। ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট পুলিশি রাষ্ট্র ও ত্রাসের শাসন প্রতিহত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা সুপ্রিম কোর্টেরই। কিন্তু তাঁরা তা পারবেন না। তাঁরা পারুন তা দুই নেত্রীও চান না। এই অবস্থা ‘একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী’ সৃষ্টি করেনি। ক্রান্তিকালে সুপ্রিম কোর্ট অতীতেও ভরসা ছিল না। এখনো নয়।
দলীয়করণের নখরে প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই যে রক্তাক্ত তার প্রমাণ গতকালের ঢাকা নতুন করে দেখল। সুপ্রিম কোর্ট যদি নিজেকেই বাঁচাতে পারতেন, তাহলে তার চত্বরে কোনো দলেরই মিছিল-মিটিং হওয়ার কথা নয়। এক-এগারোর ভাঙচুর, ধর্মঘট ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার কেউ চূড়ান্ত আইনি পরিণতি দেখতে চায়নি।
আবু সাফার রায়দানকারী বিচারপতি এম এ মতিন যখন সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করলেন, তখন বিএনপি ক্ষমতায়। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামীদের সে কি লম্ফঝম্ফ। রায়ের কপি পুড়ল। কালো ফিতা বেঁধে ‘বাকস্বাধীনতা হরণে’ প্রতিবাদ হলো। সেই রায় কাগুজে। দুই দল ওই রায় প্রতিদিন দলিত করে চলেছে।
আবু সাফায় আসি। এক-এগারো এসেছিল বলেই হাওয়া ঘুরল। না হলে সম্পদের বিবরণীর দেখা পেতাম না। ১১/১২/০৭। সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্তভাবে আবু সাফার আপিল ফেলে দিয়ে বিচারপতি মতিনের হাইকোর্টের রায় বরণ করলেন। এক-এগারোর অন্যতম কুশীলব
সাবেক প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছিরদের পেশাগত অসদাচরণের বিচার আওয়ামী লীগাররা করেনি। বুলন্দ আওয়াজও তোলেনি। কুশীলব বিচারকদের জবাবদিহি কেউ নেয় না। নাগরিকদের বিরুদ্ধে এটা একটা অদৃশ্য চক্রান্ত। জবাবদিহি নিলে বেআইনি সরকারি অবরোধ ভেস্তে
দিতেন আদালত।
গণতন্ত্রের সাচ্চা অভিযাত্রা চাইলে তাই সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে আঁতাত ভাঙতে হবে।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান, বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, বিচারপতি শরিফ উদ্দিন চাকলাদার, বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন প্রমুখ বিগত জরুরি অবস্থায় বিশেষভাবে আলোচিত হন। আইনজীবী রফিক-উল হক আবির্ভূত হয়েছিলেন জাতির দুর্ভাগ্যজনক ত্রাতা হিসেবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনের ২৬ ধারায় কেউ সম্পদের বিবরণীর নোটিশ পেয়ে তথ্য গোপন করলে তিন বছর জেল। ২৭ ধারায় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের জন্য ১০ বছরের জেল। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ওই দুই কারণেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরে তাঁরই আপিলের প্রথম শুনানি হলো। তাঁর মতো দণ্ডিতকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া বিরাজনৈতিকীকরণ, নাকি তাঁর হলফনামা নিয়ে পত্রিকায় নতুন প্রতিবেদন প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া ‘বিরাজনৈতিকীকরণ’? ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়’ বিরোধী দলের সভা ভাঙা ও গণগ্রেপ্তার চলবে, কিন্তু এর কি উত্তর পেতে হবে না?
দুর্নীতির মামলার বিচারে সুপ্রিম কোর্ট ক্রমাগতভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। কারণ, জনগুরুত্বসম্পন্ন মামলার কোনো আইনি ব্যাখ্যা তাঁর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়ার কথা।
৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ দুদকে কমিশন ছিল না। দুদকের সচিব সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিশ দেন। এরপর ৫৪টি মামলা হয়। দুই দলীয় রুই-কাতলা মোটামুটি আধাআধি। এঁদের অনেকেই গতকালের ঢাকাই রঙ্গমঞ্চের পক্ষ-বিপক্ষের কুশীলব হিসেবে হাজির হয়েছেন।
রফিক-উল হক তবলায় চাটি মারলেন। কমিশন ছিল কি ছিল না সেটা ছিল ঠুনকো অজুহাত। অথচ সেটাই হলো ‘আইনের শাসন’। সুপ্রিম কোর্টের বাতাস ভারী হলো। সচিবের নোটিশ দেওয়ার এখতিয়ার ছিল না। সুতরাং ওই নোটিশ থেকে উদ্ভূত মামলাগুলো অবৈধ। তারেকের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, শেখ সেলিমের বিয়াই বিএনপির মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মির্জা আব্বাস বিএনপির রাজনীতির শাহজাদারা অভিযুক্ত ছিলেন। অধ্যাদেশ দিয়ে ওই ত্রুটি ঘোচানো হলো। অথচ নির্বাচিতের লেবাস পরেই আওয়ামী লীগের প্রথম কাজ হলো ওই অধ্যাদেশটিকে হত্যা করা। বিএনপিও আনন্দে নাচল।
বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন আওয়ামী লীগ আমলে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মামলায় প্রথম রায়টি দিলেন। এটাই ছিল জরুরি অবস্থায় বিশেষ আদালতে দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগের প্রথম ফৌজদারি আপিলের রায়। সচিবের নোটিশকে অবৈধ বললেন। এটি যখন আপিল বিভাগে গেল, সেখানে অথর জাজ হলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি বললেন, ‘জেলে রেখে নোটিশ দেওয়া যাবে না। সচিব কেবলই কর্মচারী।’ মহীউদ্দীন খান অমনি খালাস। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ অবশ্য এখনো বিচারাধীন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে তিনি তাঁর মামলার তদবিরে দুদকে ফোন করেছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছে, স্যার, আপনি একা তো নন, অনেক মামলার ভাগ্য জড়িত।
এক-এগারোতে নোটিশ পাওয়া ৫৪ জনই মহীউদ্দীন খান মামলার রায় দেখিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করলেন। দুদক বলল, জেলে থাকলে নোটিশ নয়, এটা অবিটার ডিকটা মানে পর্যবেক্ষণ, বাধ্যকর নয়। মওদুদের মামলায় বিচারপতি খন্দকার মূসা খালেদ এটা মানলেন। এর বিরুদ্ধে মওদুদ ছোটেন আপিল বিভাগে। লিভ মঞ্জুর হয়েছে। দেশ যুদ্ধাবস্থায় পৌঁছে গেছে। তবু জেলে রেখে নোটিশ তর্কের সুরাহা হলো না।
এক-এগারোতে শেখ হাসিনার মামলায় বিচারপতি শাহ আবু নঈম সম্পদ বিবরণী দাখিল করাকেই অবৈধ বলেছিলেন। সেটা ছিল দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রতি প্রথম বড় চপেটাঘাত। তারিখটি ছিল ২১ নভেম্বর ২০০৭। দুই দলের একশ্রেণীর রাজনীতিক বলেছিলেন, এই তো চাই। ওই একটি আদেশের ফলে সন্দেহভাজন দুর্নীতিগ্রস্তরা উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। দুদক হতভম্ব হয়ে পড়েছিল।
২০০৮ সালের ১৩ মার্চ। আপিল বিভাগ ক্ষীণ কণ্ঠে অবশেষে মানলেন, নোটিশ ভালো জিনিস। এটা নিরীহ। সম্পদের বিবরণ জানতে কাউকে নোটিশ দেওয়া মানেই তাঁর বিরুদ্ধে কার্যধারা চালু নয়। বিচারপতি শাহ আবু নঈমকে নাকচ করলেন আপিল বিভাগ। তত দিনে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান লাটে উঠেছে। প্রায় ৫০টি ডাকসাইটে মামলা, যা গত কয়েক দিনে প্রকাশিত কিচ্ছাকাহিনির চেয়ে দুর্দান্ত, সেগুলো ওই রায়ের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
দুদক বনাম ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর মামলায় আপিল বিভাগ কিন্তু বললেন, কমিশন চাইলে মহীউদ্দীন খানকে নতুন করে নোটিশ দিতে পারে। কিন্তু এক-এগারোর পরে দুদক ক্ষমতাসীন দলের তারকাদের কাউকেই নোটিশ দেয়নি।
বীর বাহাদুরের বাহাদুরিণীর সম্পদ বেড়েছে এক হাজার গুণের বেশি। অথচ তাঁর আয়ের উৎস অজ্ঞাত। এক-এগারোতে কতিপয় ডাকসাইটের স্ত্রীরা নোটিশ ও মামলা খেয়ে ঢোল হলেন। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদ রায় দিলেন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের অভিযুক্ত করতে হলে নোটিশ লাগবে। এর ফলে এক-এগারোয় শতাধিক মামলা মারা পড়ল। এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ মঞ্জুর হলো না। সরাসরি নাকচ হলো। তাঁর রায়টি টিকল।
বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন বললেন, আদালতে দুদকীয় মামলা ঠুকতে চার কিসিমের অনুমোদন লাগবে। আপিল বিভাগ বললেন, একটিতেই চলবে। চারটিকে একটিকে পরিণত করার মধ্যে শত মামলা ফসকে গেছে। এর দায় কে নেবে?
জরুরি অবস্থায় বিধি হলো যা এখনো বহাল, এজাহার দায়েরের পরে তদন্ত সেরে দুদক কর্মকর্তাকে ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে হবে। হাবিবুর রহমান মোল্লার মামলায় দুদক যুক্তি দিল, এটা বাধ্যকর নয়, নির্দেশনামূলক। হাইকোর্টে বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক এটা মানলেন। আপিল বিভাগও সেটা বহাল রাখলেন। তবু এ দুই রায়ের ফাঁকে এ প্রশ্নে শত মামলায় রুল ও স্টে পড়ল। বিচারিক আদালতের বিচার লাটে উঠল।
মো. খুরশীদ আলম খান দুদকের প্যানেল আইনজীবী। গত পাঁচ বছরে সুপ্রিম কোর্ট কী দিলেন জানতে চাইলে তিনি যা বললেন তার অর্থ দাঁড়াল, অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ নিয়েই তিনি একটি ব্যর্থ লড়াই করেছেন। উচ্চ আদালতে দুদকের চার শতাধিক মামলা আছে। তিনি একাই এক শ থেকে দেড় শ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ সামলাতে দুই বিভাগে ছোটাছুটি করেছেন।
বলি, জনগণের লাভ কী? ফল কী? জানলাম একটি মামলাতেও কারও দণ্ড আপিল বিভাগ পর্যন্ত গিয়ে চূড়ান্ত হয়নি। এক-এগারোর দুই বছরেও নয়। নির্বাচিতের অহংকারের পাঁচ বছরেও নয়। কুশীলবেরা সাবধান!

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.