দেশের জন্য সঠিক কাজটি করতে হবে by মইনুল হোসেন
গত
শনিবার বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষ থেকে অন্যায় কী বলা হয়েছে যার জন্য
ক্ষমতাসীনদের গাত্রদাহ হতে পারে? আমিও তাদের সঙ্গে বক্তব্য রেখেছি। পৃথক
পৃথকভাবে অনেকেই যে কথা বহুদিন ধরে বলে আসছেন, সে কথাই ঐক্যবদ্ধভাবে বলা
হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পরিস্থিতির জন্য সেদিন কারা অতি উৎসাহী ছিলেন তা
কাদের না জানা? যারা সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন তারা তো রাজনৈতিক
নেতা-নেত্রীই। তথাকথিত রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগ নেতারাই দাবি করে আসছিলেন
যে, ওয়ান-ইলেভেন তাদের আন্দোলনের ফসল। সুশীল সমাজের যারা শনিবারের
মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছেন তারা নিজেদের যোগ্যতায় সফল জীবনযাপন করছেন। তাদের
রাজনীতি করে রাজকীয় জীবনযাপন করতে হয় না। তারা কারও কদর পাওয়ার ভিক্ষুকও
নন। তারা বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টা করেননি। কোনো আন্দোলনে যাওয়ার কথাও বলেননি।
তারা দুই বিবদমান দলের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছতে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তারা
৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় প্রহসনের নির্বাচন স্থগিত রেখে আলোচনার মাধ্যমে
রাজনৈতিক নেতাদের সমঝোতায় আসতে বলেছেন। তারা গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থেই এ
কথা বলেছেন। গণতন্ত্র সুশীল সমাজসহ সমগ্র জনগণের জন্য প্রয়োজন।
রাজনীতিবিদরা তো স্বৈরশাসক হিসেবেও ক্ষমতায় থাকতে পারেন। রাষ্ট্রীয়
সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন।
সমাজের উচ্চতম পর্যায়ের দায়িত্বশীল নাগরিকরা শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় দুর্যোগের সময় ভূমিকা রাখার যে চেষ্টা করেছেন, তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। ব্যর্থ রাজনীতিকে নয়, দেশকে কেমন করে বাঁচানো যায়, আমাদের কী করণীয় আছে, সেটাই আমাদের সবার আত্মজিজ্ঞাসার বিষয় হতে হবে। দেশের জন্য কোনটা সঠিক সেটা আমরা জানি না তা তো নয়, কিন্তু আমরা অনেকেই স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদ দ্বারা চালিত হই। আমাদের অনেকেই টেলিভিশন টকে অংশ নেই এবং সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখি, উদ্ভূত সমস্যার ওপর আলোকপাত করি এই আশা নিয়ে যে, রাজনৈতিক নেতারা গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সবার অংশগ্রহণমূলক একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সতর্কবাণী শুনলেন না, সমঝোতার যুক্তি গ্রহণ করলেন না এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছতে ব্যর্থ হলেন।
আমরা রক্তপাত বন্ধ করতে পারলাম না, দেশের অর্থনীতির ধ্বংসও ঠেকাতে পারলাম না, কারণ সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হারাতে চায় না। অথচ এই সরকারের না আছে শাসন করার দক্ষতা, না এটা জনগণকে দিতে পারে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। পুলিশের বাড়াবাড়ি দ্বারা কখনও রাজনৈতিক ইস্যুর সমাধান করা যায় না। রাজনৈতিক আন্দোলনকে নিছক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই এবং তা মোকাবিলা করার দায়িত্বও পুলিশের নয়। বরং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরই উচিত রাজনৈতিক আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা।
যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। এর শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব হচ্ছে একটি সংসদীয় চরিত্রের গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোথাও বিদ্যমান সংসদের বিলুপ্তি না ঘটিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয় না। নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ করার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন যদি সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি জানাত, তাহলে সেটা শাসনতন্ত্রের লংঘন হতো না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অনুকূলে যা কিছু করণীয় ছিল তার সবকিছু করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের ছিল। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শনের জন্য এ কাজটুকু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের করা উচিত ছিল। বর্তমান মারাত্মক সংকট যে গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে তার মূলে রয়েছে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের, বিশেষ করে আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদ ও গণবিরোধী মনোভাব। এটা তখন আরও প্রকট হয়, যখন অযোগ্য লোকদের রাষ্ট্রীয় উচ্চাসনে স্বাগত জানানো হয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগের নেশায় যে যা বলবে সরকারি লোকজনের তাই করতে হবে, দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় থাকবে না- এটা তো স্বাধীনতার শিক্ষা হতে পারে না। স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ-সুবিধা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে। স্বাধীন দেশের সরকারি কর্মচারী ব্যক্তি বা দলের কর্মচারী হলে জনগণের অর্থে নিযুক্ত জনস্বার্থ রক্ষার কাজ করার লোক কোথা থেকে আসবে?
নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিলেই যে একজন সৎ, সাধু বা দেশপ্রেমিক হয় না, তার প্রমাণ ক্ষমতায় গিয়ে তারা কীভাবে শত শত কোটি টাকার অবৈধ মালিক হয়েছে তা দেখলেই পাওয়া যাবে। শাসনতন্ত্রের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা দখলের জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের মতো সাংবিধানিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র অসম্ভব করে মূল গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রকে বাতিল করা হয়েছে। পার্লামেন্টের আসন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিজেদের ক্ষমতার সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। যেটা হতাশাব্যঞ্জক তা হল, মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু লোক মনে করেন, দেশে তারা যতই হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ান না কেন, অন্যত্র তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থান আছে। আমার কথা হল, দেশের লোকদের ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ না করে নিজের দেশেই নিরাপদে থাকার কথা ভাবা দূরদর্শিতার পরিচয় হবে।
আর নির্বাচন সম্পর্কে বেশি কিছু বলার নেই, এটা আমাদের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, গোটা বিশ্বের কাছে আমাদের অপমান করা হয়েছে এবং জনগণ যে নির্বাচনকে অস্বীকার করছে এবং ধিক্কার জানাচ্ছে, সে নির্বাচন মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো সমীচীন মনে করছে না। যারা চিন্তা করেন আমাদের কেবল দুটি বন্ধু দেশ আছে- ভারত ও রাশিয়া, এখন তাদের শুধু বিদেশী পর্যবেক্ষক হিসেবে ভারতের ওপর নির্ভর করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হচ্ছে, ভারতও এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। আমার এই মুহূর্তের দুশ্চিন্তা হচ্ছে, একতরফা নির্বাচন দেশে না আনতে পারবে শান্তি, না আনতে পারবে স্থিতিশীলতা। ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্য যারা আরেকবার মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার ভয় দেখাচ্ছেন, তারা জানেন না যুদ্ধ কী! তারা দেশের ভেতরে একটা গৃহযুদ্ধ বাধানোর উসকানি দিচ্ছেন আর নিজেরা সব ধরনের পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে অবস্থান করছেন। দেশকে ব্যর্থ নেতৃত্ব এবং সহিংস ক্ষমতার লড়াই থেকে বাঁচানোর জন্য এখন আমি যেটা বলতে পারি তা হল, জরুরি ভিত্তিতে আমাদের মধ্যকার সুবিধাবাদকে বাতিল করে যা দেশের জন্য সঠিক সেই কাজটি করতে হবে। পুলিশ হিসেবে, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের লোকদের হত্যা করতে পারি না, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে পারি না। সুশীল সমাজ হিসেবে আমরা যে অপরাধ করেছি তা হল, ব্যর্থ নেতৃত্ব ও দুর্নীতির রাজনীতিকে দীর্ঘকাল সহ্য করতে গিয়ে জনগণের দুর্ভোগের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছি। আমাদের গণতন্ত্রকে টেকাতে হলে শুধু পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করলেই হবে না, সেইসঙ্গে আইনি বাধাও আরোপ করতে হবে, যাতে কেউ দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজা-রানী হিসেবে নিজেকে স্থায়ীভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হস্তান্তর হতেই হবে। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে গণতন্ত্র যাতে ভূমিকা রাখতে পারে তার জন্য নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
সংক্ষেপে বলতে চাই, আমাদের ভোটাধিকার এবং আমাদের সেবার জন্য সৎ ও উপযুক্ত সরকার পছন্দ করার অধিকার রক্ষার সাহস ও চরিত্র আমাদের আছে কিনা, সেটা প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকারের বিষয়টি কোনো দলবিশেষের সঙ্গে সমঝোতার বিষয় হতে পারে না। যে সরকার জনগণের অধিকার খর্ব করে থাকে, সে সরকারকেই তা পূরণ করতে হবে। এজন্য কোনো সংলাপ বা সমঝোতার দরকার হয় না।
আমরা অবশ্যই নিজেদের কাছে প্রশ্ন করব, আমরা নিজেদের জন্য, দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কী করতে পারি, যাতে আমরা শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করতে পারি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের স্থায়ী ব্যবস্থা যারা চাচ্ছেন তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। তারা দেশটিকে নিজেদের রাজত্ব হিসেবে দেখছেন। তারা নিজেরাও নিরাপদে বা শান্তিতে থাকার কথা ভাবছেন না, অন্যদেরও নিরাপদে বা শান্তিতে থাকতে দেবেন না। এটা কোনো সুস্থ চিন্তার প্রকাশ হতে পারে না।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
সমাজের উচ্চতম পর্যায়ের দায়িত্বশীল নাগরিকরা শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় দুর্যোগের সময় ভূমিকা রাখার যে চেষ্টা করেছেন, তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। ব্যর্থ রাজনীতিকে নয়, দেশকে কেমন করে বাঁচানো যায়, আমাদের কী করণীয় আছে, সেটাই আমাদের সবার আত্মজিজ্ঞাসার বিষয় হতে হবে। দেশের জন্য কোনটা সঠিক সেটা আমরা জানি না তা তো নয়, কিন্তু আমরা অনেকেই স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদ দ্বারা চালিত হই। আমাদের অনেকেই টেলিভিশন টকে অংশ নেই এবং সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখি, উদ্ভূত সমস্যার ওপর আলোকপাত করি এই আশা নিয়ে যে, রাজনৈতিক নেতারা গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সবার অংশগ্রহণমূলক একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সতর্কবাণী শুনলেন না, সমঝোতার যুক্তি গ্রহণ করলেন না এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছতে ব্যর্থ হলেন।
আমরা রক্তপাত বন্ধ করতে পারলাম না, দেশের অর্থনীতির ধ্বংসও ঠেকাতে পারলাম না, কারণ সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হারাতে চায় না। অথচ এই সরকারের না আছে শাসন করার দক্ষতা, না এটা জনগণকে দিতে পারে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। পুলিশের বাড়াবাড়ি দ্বারা কখনও রাজনৈতিক ইস্যুর সমাধান করা যায় না। রাজনৈতিক আন্দোলনকে নিছক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই এবং তা মোকাবিলা করার দায়িত্বও পুলিশের নয়। বরং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরই উচিত রাজনৈতিক আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা।
যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। এর শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব হচ্ছে একটি সংসদীয় চরিত্রের গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোথাও বিদ্যমান সংসদের বিলুপ্তি না ঘটিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয় না। নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ করার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন যদি সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি জানাত, তাহলে সেটা শাসনতন্ত্রের লংঘন হতো না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অনুকূলে যা কিছু করণীয় ছিল তার সবকিছু করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের ছিল। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শনের জন্য এ কাজটুকু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের করা উচিত ছিল। বর্তমান মারাত্মক সংকট যে গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে তার মূলে রয়েছে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের, বিশেষ করে আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদ ও গণবিরোধী মনোভাব। এটা তখন আরও প্রকট হয়, যখন অযোগ্য লোকদের রাষ্ট্রীয় উচ্চাসনে স্বাগত জানানো হয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগের নেশায় যে যা বলবে সরকারি লোকজনের তাই করতে হবে, দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় থাকবে না- এটা তো স্বাধীনতার শিক্ষা হতে পারে না। স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ-সুবিধা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে। স্বাধীন দেশের সরকারি কর্মচারী ব্যক্তি বা দলের কর্মচারী হলে জনগণের অর্থে নিযুক্ত জনস্বার্থ রক্ষার কাজ করার লোক কোথা থেকে আসবে?
নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিলেই যে একজন সৎ, সাধু বা দেশপ্রেমিক হয় না, তার প্রমাণ ক্ষমতায় গিয়ে তারা কীভাবে শত শত কোটি টাকার অবৈধ মালিক হয়েছে তা দেখলেই পাওয়া যাবে। শাসনতন্ত্রের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা দখলের জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের মতো সাংবিধানিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র অসম্ভব করে মূল গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রকে বাতিল করা হয়েছে। পার্লামেন্টের আসন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিজেদের ক্ষমতার সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। যেটা হতাশাব্যঞ্জক তা হল, মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু লোক মনে করেন, দেশে তারা যতই হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ান না কেন, অন্যত্র তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থান আছে। আমার কথা হল, দেশের লোকদের ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ না করে নিজের দেশেই নিরাপদে থাকার কথা ভাবা দূরদর্শিতার পরিচয় হবে।
আর নির্বাচন সম্পর্কে বেশি কিছু বলার নেই, এটা আমাদের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, গোটা বিশ্বের কাছে আমাদের অপমান করা হয়েছে এবং জনগণ যে নির্বাচনকে অস্বীকার করছে এবং ধিক্কার জানাচ্ছে, সে নির্বাচন মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো সমীচীন মনে করছে না। যারা চিন্তা করেন আমাদের কেবল দুটি বন্ধু দেশ আছে- ভারত ও রাশিয়া, এখন তাদের শুধু বিদেশী পর্যবেক্ষক হিসেবে ভারতের ওপর নির্ভর করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হচ্ছে, ভারতও এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। আমার এই মুহূর্তের দুশ্চিন্তা হচ্ছে, একতরফা নির্বাচন দেশে না আনতে পারবে শান্তি, না আনতে পারবে স্থিতিশীলতা। ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্য যারা আরেকবার মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার ভয় দেখাচ্ছেন, তারা জানেন না যুদ্ধ কী! তারা দেশের ভেতরে একটা গৃহযুদ্ধ বাধানোর উসকানি দিচ্ছেন আর নিজেরা সব ধরনের পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে অবস্থান করছেন। দেশকে ব্যর্থ নেতৃত্ব এবং সহিংস ক্ষমতার লড়াই থেকে বাঁচানোর জন্য এখন আমি যেটা বলতে পারি তা হল, জরুরি ভিত্তিতে আমাদের মধ্যকার সুবিধাবাদকে বাতিল করে যা দেশের জন্য সঠিক সেই কাজটি করতে হবে। পুলিশ হিসেবে, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের লোকদের হত্যা করতে পারি না, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে পারি না। সুশীল সমাজ হিসেবে আমরা যে অপরাধ করেছি তা হল, ব্যর্থ নেতৃত্ব ও দুর্নীতির রাজনীতিকে দীর্ঘকাল সহ্য করতে গিয়ে জনগণের দুর্ভোগের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছি। আমাদের গণতন্ত্রকে টেকাতে হলে শুধু পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করলেই হবে না, সেইসঙ্গে আইনি বাধাও আরোপ করতে হবে, যাতে কেউ দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজা-রানী হিসেবে নিজেকে স্থায়ীভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হস্তান্তর হতেই হবে। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে গণতন্ত্র যাতে ভূমিকা রাখতে পারে তার জন্য নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
সংক্ষেপে বলতে চাই, আমাদের ভোটাধিকার এবং আমাদের সেবার জন্য সৎ ও উপযুক্ত সরকার পছন্দ করার অধিকার রক্ষার সাহস ও চরিত্র আমাদের আছে কিনা, সেটা প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকারের বিষয়টি কোনো দলবিশেষের সঙ্গে সমঝোতার বিষয় হতে পারে না। যে সরকার জনগণের অধিকার খর্ব করে থাকে, সে সরকারকেই তা পূরণ করতে হবে। এজন্য কোনো সংলাপ বা সমঝোতার দরকার হয় না।
আমরা অবশ্যই নিজেদের কাছে প্রশ্ন করব, আমরা নিজেদের জন্য, দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কী করতে পারি, যাতে আমরা শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করতে পারি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের স্থায়ী ব্যবস্থা যারা চাচ্ছেন তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। তারা দেশটিকে নিজেদের রাজত্ব হিসেবে দেখছেন। তারা নিজেরাও নিরাপদে বা শান্তিতে থাকার কথা ভাবছেন না, অন্যদেরও নিরাপদে বা শান্তিতে থাকতে দেবেন না। এটা কোনো সুস্থ চিন্তার প্রকাশ হতে পারে না।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments