স্টিয়ারিং কন্যা by জাকারিয়া পলাশ
বুদ্ধি, সাহস, হাত-পা, চোখ-কান যা যা
দরকার সবই আছে মেয়েদের। তাহলে তারা গাড়িচালক হলে সমস্যা কি? ছেলেরা পারলে
আমরাও পারবো। বলছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের গাড়িচালক আফসানা মিমি।
২৫
বছর বয়সী এই নারী এখন পুরোদস্তুর পেশাদার চালক। শখের বশে নয়, সাহসী কিছু
একটা করার প্রত্যয় নিয়েই বসেছেন চালকের আসনে। স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে ছুটে
চলছেন মহাসড়কে। সুমী, নাসরিনসহ আরও অনেকেই আছেন এই পেশায়। দেশের প্রায় সব
এলাকা থেকেই আসছেন তারা। রংপুরের রত্না, নীলফামারীর কবিতা, নারায়ণগঞ্জের
ববিতা, ময়মনসিংহের সীমা, জয়পুরহাটের সুফিয়া আছেন। আরও আছেন পারুল, ফাতেমা,
শরীফা, মিনতি, শারমিনা, মৌসুমী ও সুফিয়া। তারা এখন আর সংরক্ষিত নয়টি আসনের
যাত্রী নন। স্টিয়ারিং হুইলের নিয়ন্ত্রক। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, ঘরের
ভেতরের মতো বাইরের কাজেও সমান যত্নবান মেয়েরা। গাড়িচালকের আসনেও
শান্তশিষ্ট, ধৈর্যশীল ও নির্ভরযোগ্য তারা। আফসানা জানান, রাস্তায় যখন গাড়ি
চালাই, তখন মনে হয় যুদ্ধ করছি। সব গাড়ির ড্রাইভার পুরুষ, আমি একা মেয়ে।
সবাই তাকায়। টিটকারি, উসকানি কত কিছু মোকাবিলা করতে হয়। কেউ আসে পাল্লা
দিতে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে চালাতে হয়। অনেকে সাহায্যও করে। হাতের পাঁচটা আঙুল
তো আর সমান হয় না। বললেন, প্রথমদিকে খুব অসুবিধা হয়েছে। মানিয়ে নিতে কষ্ট
হয়েছে; কিন্তু এখন ভাল লাগে। পথে পথে এ যুদ্ধে নিজেকে সফল মনে হয়। এই
চাকরিতে আমি তো দোষের কিছু দেখি না। সকাল নয়টা থেকে বিকাল ছয়টা পর্যন্ত
অফিসের গাড়ি চালাই। শুরুতে আট হাজার টাকা বেতন পেতাম, এখন পাই ১১ হাজার।
কিন্তু বাবা, মা, নানি কেউ রাজি না। সবাই বলে মান-সম্মান যাবে। চাকরি করে
খেলে মানসম্মান যাবে কেন? পাড়ার লোকে নাকি খারাপ বলে। কিন্তু কেন? প্রশ্ন
আফসানার। বলেন, আমি তো খারাপ কিছু করছি না। শ্রম, মেধা দিয়ে আয়-রোজগার
করছি। এতে লজ্জার কিছু নেই। জানান, খুলনার দৌলতপুর থানার আড়ংঘাটা এলাকায়
বাড়ি তার। এসএসসি পাস করেছেন ২০০৪ সালে। কলেজে ভর্তির পর বিয়ে হয়েছে। তারপর
আর লেখাপড়া করা হয়নি। স্বামী হাসানুর রহমান (৩০) ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি
করেন। আফসানা কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ছয় বছর কাজ করেছেন ব্র্যাকের উন্নয়ন
প্রকল্প এডিপিতে। পরে ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলে ট্রেনিং নেয়ার সাহস করেন।
বাবা, মা, নানি, মামা সবাই বাদ সাধেন। এগিয়ে আসেন স্বামী হাসানুর রহমান।
স্ত্রীর ইচ্ছাকে সমর্থন করে ছাড় দেন। দুই মাসের ট্রেনিং শেষে বিআরটিএ’র
পরীক্ষায় পাস করে হাতে পান ড্রাইভিং লাইসেন্স। চাকরি মেলে ব্র্যাক ব্যাংকে।
এখন আফসানা থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। ওই ব্যাংকেরই আরেক স্টিয়ারিং কন্যা
নাসরীনের সঙ্গে একটি মেসে থাকেন। স্বামী হাসিনুর রহমান থাকেন খুলনায়। চার
বছর বয়সের একমাত্র মেয়েটাও স্বামীর কাছেই আছে। বলেন, মেয়েটা বড় হচ্ছে। ওর
লেখাপড়ার জন্য কিছু করতে চাই। সব সময় যোগাযোগ হয় স্বামীর সঙ্গে। মাঝেমধ্যে
খুলনায় যাই। দু’জনেই একসঙ্গে থাকতে চাই। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো পারবো। তার
সঙ্গে ব্র্যাকে কর্মরত নাসরীন ও সুমী খাতুনের কথাও বললেন। একই সঙ্গে
ড্রাইভিং শিখেছেন তারা। তারাও একই ধরনের সংগ্রাম করছেন গাড়ি নিয়ে। নাসরীনের
বাড়ি ঝিনাইদহে। সুমী এসেছেন রাজশাহী থেকে। সুমী খাতুন জানান, ব্র্যাকের
স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। পরে ড্রাইভিং শিখতে ঢাকায়
এসেছেন। এখন চাকরির পাশাপাশি লেখাপড়া করছেন ডিগ্রি প্রথম বর্ষে। বললেন,
সবাই পারলে আমিও পারবো এমন সাহস থেকেই শুরু করেছি। বাবা-মা প্রথমে নিষেধ
করেছিলেন। কিন্তু এখন তারাও খুশি। এ ব্যাপারে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন,
কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতিভা ও দক্ষতা বিকাশের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ
প্রয়োজন। সেটি আমরা নিশ্চিত করেছি। সুতরাং, আমাদের মেয়েরা তাদের যোগ্যতা
দেখাতে পারছে। ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের কর্তারা জানান, নারীদের উন্নয়নের
লক্ষ্যেই ২০১২ সালে ব্র্যাক ‘উইমেন স্টিয়ারিং ফরওয়ার্ড’ নামে একটি প্রকল্প
শুরু করে। নারীদের সুযোগ বাড়াতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়িচালক পদে ১৫ শতাংশ
নারী নিয়োগের কোটা নির্ধারিত আছে আগেই। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ
লক্ষ্যেই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে এ বিষয়ে একটি
চুক্তি হয় ব্র্যাকের। ৬০০ জন নারীকে ড্রাইভিং ট্রেনিং দেয়ার উদ্যোগ নেয়া
হয়। গত এক বছরে চারটি ব্যাচে ৭৫ জনকে ড্রাইভিং ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এর
মধ্যে ১৮ জন ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেছেন। প্রথম
ব্যাচেই ছিলেন আফসানারা। তাদের সঙ্গে মোট সাতজন চাকরি করছেন বিভিন্ন
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের পরিচালক এসএন কৈরি জানান,
পুরুষের চেয়ে নারী চালকরা বেশি সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল বলে বিভিন্ন
ক্ষেত্রে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা অনেকটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সে গাড়ি
চালান। তারা সহজে রিস্ক নেন না। তাই, সহজেই দুর্ঘটনা এড়াতে পারেন। তিনি
বলেন, পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবগুলো ক্ষেত্র এখনও পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। সব ড্রাইভার
পুরুষ, পরিবহনের নেতারা পুরুষ, টেকনিশিয়ানরা পুরুষ। এর মধ্যে দু’-একজন
নারী। তাই এখনও সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের গভর্নিং বডির সদস্য রোকেয়া এ রহমান বলেন, এটা
একটা সম্ভাবনার লক্ষণ। এখন মেয়েরা গাড়ি চালাতে গেলে মানুষ তাকিয়ে থাকে। এতে
অসুবিধা নেই। যতই তাকিয়ে থাকবে ততই প্রচার হবে। প্রমাণ হবে, মেয়েরা পারছে।
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে ১২
হাজার ৪৪৫ জন নারী বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই
ব্যক্তিগত গাড়ি চালান। ৩৫২ জন নারী পেশাদার হিসেবে চাকরির জন্য ড্রাইভিং
লাইসেন্স নিয়েছেন। নারীদের এ কাজে উৎসাহিত করতে বিআরটিএ বিভিন্ন উন্নয়ন
সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বলে তিনি জানান। প্রশিক্ষিত এসব নারীকে চাকরি দেয়ার
ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই বেশি এগিয়ে রয়েছে।
No comments