দিল্লির চিঠি- সোনার খাজানার খোঁজে by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শোভন সরকারকে আমি কস্মিনকালেও চিনতাম না।
আমার মতোই কোটি কোটি ভারতীয়ও তাঁকে চিনতেন না। এখনো যে চিনি তা নয়। তবে
জেনে গেছি। যেমন জেনে গেছে কোটি কোটি ভারতীয়।
না দেখে, না
চিনে স্রেফ খানিকটা জেনে শোভন সরকারকে বহু দূর থেকে আমি একটা সেলাম
ঠুকেছি। আমার ধারণা, আমারই মতো হয়তো আরও লাখো-কোটি ভারতবাসী শোভন সরকারকে
সেলাম জানিয়েছেন।
শোভন সরকার বাঙালি কি না ঠিক বলতে পারব না। কারণ, তাঁকে তো আমি চিনিই না। তা ছাড়া তিনি এখন প্রায় পলাতকই বলা যায়। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিন দিন আগে পর্যন্তও তিনি ছিলেন আমার-আপনার মতোই একজন সাধারণ পাবলিক, আমাদের দেশের চলতি ভাষায় যাদের ‘আম আদমি’ বা ‘আমজনতা’ বলা হয়। নাম ‘শোভন’ ও পদবি ‘সরকার’ দুটোই হিন্দু বাঙালির কাছে খুবই ‘কমন’। তাই বঙ্গসমাজে বেজায় বিতর্ক উঠেছে তাঁর বাঙালিত্ব ঘিরে। অবশ্য শোভন সরকারের রাজ্য উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলা এবং তাঁর ডেরা ওই জেলার দণ্ডিয়া খেরা গ্রাম ঘুরে এসে কেউ কেউ বলছেন, উনি নাকি বাঙালি নন, উনি আদতে জাট। সে যা-ই হোক, জাতপাত নিয়ে আমার আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই। শোভন সরকার একজন সাধু। যাবতীয় জাগতিক সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে আজ বহুদিন। দণ্ডিয়া খেরা গ্রামে উনিশ শতকের যে দুর্গের সন্নিহিত শিবমন্দির চত্বরে তাঁর আশ্রম ও বসবাস, সেখানকার মাটির তলায় এক হাজার টন সোনা মজুত আছে বলে সম্প্রতি তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছেন এবং তা রাষ্ট্রও হয়ে গেছে। এমনই তা জানাজানি হয়েছে যে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই) ও জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (জিএসআই) টনক নড়ে গেছে। নড়েচড়ে বসেছে মহামান্য ভারত সরকারও। তিনের সম্মিলিত প্রচেষ্টার নিট রেজাল্ট, দুর্গ চত্বরে এএসআই ঢাকঢোল পিটিয়ে খননকাজ শুরু করে দিয়েছে। আগ্রহ ও উত্তেজনা এতটাই যে শচীন টেন্ডুলকারের বিদায়বেলার দ্বিশততম টেস্ট ম্যাচের আকর্ষণও আপাতত ফিকে।
শোভন সরকারকে সেলাম জানানোর কারণটা সম্ভবত বুদ্ধিমান পাঠক-পাঠিকা এবার কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন। শোভন সরকার শুধু নিজেই স্বপ্ন দেখেননি, তিনি এ দেশের ১২০ কোটি জনতাকেও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। স্বপ্ন এ-ক হা-জা-র টন সোনার! এ সেই স্বপ্ন, যা ‘ইলেকশন মোড’-এ চলে যাওয়া ভারতের যাবতীয় রাজনৈতিক কচকচানিকে অবলীলায় দূরে ঠেলে দিয়েছে। এই স্বপ্ন কংগ্রেস না বিজেপি, ইউপিএ না এনডিএ, নরেন্দ্র মোদি বনাম রাহুল গান্ধী, এসব বিতর্ককে ‘ঝিন্দের বন্দী’র রহমত আলীর হুংকারের মতো ‘তফাত যাও’ বলতে পেরেছে। এ সেই স্বপ্ন, যা আপাতত ভুলিয়ে দিয়েছে কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআইয়ের দাখিল করা এফআইআরে শিল্পপতি কুমার মঙ্গলম বিড়লার নাম থাকা ও প্রধানমন্ত্রীর নাম না-থাকা নিয়ে গড়ে ওঠা বিতর্ক, চাপা দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পাকিস্তানের ক্রমাগত গুলি চালানোর ফলে বেড়ে ওঠা ক্ষোভ ও ক্রোধ, ভুলিয়ে রেখেছে শীতকালীন সবজি ওঠা সত্ত্বেও অগ্নিমূল্য বাজারের ছেঁকা এবং আসন্ন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের সম্ভাব্য ফলের চুলচেরা বিশ্লেষণ। বহুচেনা জগতের বহুচর্চিত একঘেয়ে আলোচনার অভ্যাস ছেড়ে সবাই হঠাৎ কী অদ্ভুতভাবে তাল তাল সোনার আগাম আবির্ভাবের সুখস্বপ্নে বিভোর থাকতে ভালোবাসছে। ছোট-বড় মানুষের ছোট-বড় শখ-আহ্লাদ, ছোট-বড় সুখ-দুঃখ, আশা, ব্যথা, বেদনা, আনন্দ, হিংসা, শত্রুতা, ভেদাভেদ, হানাহানি সবকিছু ভুলে ভাবতে ভালোবাসছে, মাটির তলা থেকে উদ্ধার হওয়া টন টন সোনা কীভাবে এক লহমায় বদলে দেবে তাদের দৈনন্দিন জীবন। অযোধ্যায় চোখধাঁধানো প্রতিশ্রুত রাম মন্দির যা করতে পারেনি, শোভন সরকারের স্বপ্ন সার্থক হলে নিমেষের মধ্যে ভারতে সেই রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে! শোভন সরকার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে ভারতবাসীর মন আচমকাই ফুরফুরে করে দিয়েছেন। এ কি চাট্টিখানি কথা? সেলাম তাঁকে করতেই হবে!
নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরোয়, এক হাজার টন সোনার মাহাত্ম্য তাদের বোঝার কথা নয়। তবু বিশালত্বটা যে কী, নানাজনে নানাভাবে তা বোঝাতে শুরু করেছে। সোনার যে মজুত ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকে রয়েছে, তার পরিমাণ কমবেশি ৫৫৮ টন। অর্থাৎ শোভন সরকারের স্বপ্ন সার্থক হলে ভারতের মজুত সোনা এক লাফে তিন গুণ বেড়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আম আদমি যাদের আমেরিকা বলে বোঝে, তাদের সবকিছুই খুব বেশি বেশি। সুতরাং, সোনার মজুতও যে তাদের আর সব দেশের চেয়ে বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। ভারতের তুলনায় তো বটেই, অন্যদের তুলনাতেও তারা অনেক কদম এগিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মজুত সোনা আট হাজার টনেরও বেশি। ওদের বাদ দিলে পৃথিবীতে আর মাত্র সাতটি দেশ রয়েছে যাদের মজুত সোনার পরিমাণ এক হাজার টন বা তার বেশি। অর্থাৎ সোনা মজুতের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান নবম। টপ টেনের মধ্যে এই থাকাটা মোটেই ফেলনা নয়। এবার এই এক হাজার টন এসে গেলে কে জানে আমরা চার-পাঁচ নম্বরেও চলে আসতে পারি। ঠিক এই সময়ে ১০ গ্রাম সোনার বাজারমূল্য ৩০ হাজার রুপি। এক হাজার টন সোনার দাম তাই অন্তত তিন লাখ কোটি রুপি! পরিমাণটা ঠিক কত? এই টাকা হাতে এলে দেশের ১২০ কোটি মানুষের প্রত্যেকের পকেটে আড়াই হাজার রুপি অনায়াসে গুঁজে দেওয়া যাবে। শুধু কি তাই? ভারতে দিনে ২ দশমিক ৩ টন সোনা আমদানি করা হয়। এই সোনা পাতালপুরি থেকে সরকারের পকেটে এলে ৪৩৪ দিন এক ভরি সোনাও ভারতকে আমদানি করতে হবে না। আর তেমনটা সত্যি হলে ভারতের অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম দিব্যি কুম্ভকর্ণ হয়ে যেতে পারেন। টানা ছয় মাস ঘুমোনোর জন্য তাঁকে নাকে তেলও দিতে হবে না। কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ঠিকঠাক করতে তাঁকে যেভাবে লেজে-গোবরে হতে হচ্ছে, শোভন সরকারের স্বপ্ন সত্যি হলে তা এক তুড়িতে উবে যাবে। কিংবা সোনিয়া গান্ধী। খাদ্য সুরক্ষা আইন তো তাঁরই ‘ব্রেন চাইল্ড’। এই রাজসূয় যজ্ঞ সমাধা করতে তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে বছরে বাড়তি ৯০ হাজার কোটি রুপি জোগাড় করতে হবে। শোভন সরকার একাই টানা সাড়ে তিন বছরের জন্য দেশের গরিবদের মধুসূদন দাদা হয়ে যাবেন, সোনিয়ার কাছে মুশকিল আসান।
দণ্ডিয়া খেরা গ্রামটি গঙ্গার তীরে। সেখানকার রাজা ছিলেন রাও বক্স সিং। উনবিংশ শতকে সেখানে দুর্গ স্থাপিত হয়েছিল। সেই দুর্গেই শিবমন্দির। শোভন সরকার তাঁরই পূজারি। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় রাজা রাও বক্স সিং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁদের পারিবারিক সম্পদকে ব্রিটিশদের হাত থেকে রক্ষা করতে ওই দুর্গের জমিতেই তা পুঁতে দেওয়া হয়। সেই রাজাই নাকি শোভন সরকারের স্বপ্নে এসে তাঁকে এক হাজার টন সোনা থাকার কথা জানিয়ে দেন। লোকে বলছে, শোভন সরকার খবরটি দেন কেন্দ্রের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিমন্ত্রী চরণদাস মোহান্তকে। মোহান্ত আবার শোভন সরকারের ভক্ত কাম শিষ্য। অতঃপর দেশের পর্যটনের মানচিত্রে দণ্ডিয়া খেরা রীতিমতো একটা নাম।
শুক্রবার থেকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের খননকাজ শুরু হয়েছে। তার আগে জিওলজিক্যাল সার্ভে একটা অনুসন্ধান চালিয়েছিল। তাদের মনে হয়েছে ওখানে মাটির তলায় কিছু একটা ধাতু নাকি রয়েছে। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষজন যখন এই স্বপ্নাদেশ, এই খোঁড়াখুঁড়ি, এই আজগুবি সোনার খাজানা এবং তাতে এএসআইয়ের সাড়া দেওয়া নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করছে, কেউ কেউ সরকারের কাণ্ডজ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তুলছে, দণ্ডিয়া খেরার মানুষজন তখন সেসব থোড়াই কেয়ার করছে। ফি-দিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত দুর্গ ও মন্দির ঘিরে মেলা মানুষের জটলা। যত মানুষ তত মজা। দেদার বিকোচ্ছে চা-পকোড়া। ডাল-ভাতের হোটেলও খোলা হচ্ছে। মানুষের আগ্রহ যত বাড়ছে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পুলিশের কাজ। দেশ-বিদেশের টিভি চ্যানেলের ওবি ভ্যান দিন-রাত দাঁড়িয়ে থাকছে। কেউ ময়দান ছাড়তে রাজি নয়। কে জানে, স্বপ্ন তো সত্যিও হয়! তা ছাড়া, কে না জানে, ‘ইন্ডিয়া ইজ অ্যা ল্যান্ড অব মিরাক্যাল!’
তিন বছর আগে ২০১০ সালে ‘পিপলি লাইভ’ নামে একটা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল। ঋণগ্রস্ত কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতার ওপর সেটা ছিল একটা চমৎকার ব্যঙ্গাত্মক ছবি। গল্পের প্রধান চরিত্র আত্মহত্যা করলে ঋণমুক্ত হবে। এই সিদ্ধান্তের কথা রটে গেলে আত্মহত্যার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারের জন্য সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সোনার খাজানার সন্ধানও সে রকম হতে চলেছে। তা ছাড়া হবে নাই-বা কেন? উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদব নিজে তাঁর বিশ্বস্ত দূত পাঠিয়েছেন শোভন সরকারের কাছে। শুরু হয়ে গেছে জল্পনা, এক হাজার টন সোনা কার পাওনা হবে? রাজ্যের নাকি কেন্দ্রের? নাকি ভাগাভাগি হবে?
রাজনীতি যে একেবারেই নেই, তা অবশ্য নয়। শোভন সরকারের মতো স্বপ্ন নরেন্দ্র মোদিও দেখছেন। প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্ন। তিনি কংগ্রেসকে বলেছেন, সুইস ব্যাংকে রাখা টাকা ফেরত আনলে সোনার খাজানার দরকারই পড়বে না। এ নিয়েও রগড় কম হচ্ছে না।
খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হতে অন্তত দিন ১৫। এই রকমই বলা হচ্ছে। শোভন সরকারের হাল তারপর কী হবে সে নিয়ে এখন গবেষণা করা অর্থহীন। আপাতত তাঁকে সেলাম এ রকম একটা স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর জন্য, দৈনন্দিন জীবনকে একটু অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য। হোক না স্বপ্ন। স্বপ্নই তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments