জনমত জরিপ ও টেকসই গণতন্ত্রের স্বরূপ by তারেক শামসুর রেহমান
একটি
জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, এ
মুহূর্তে যদি ভোট হয়, তাহলে শতকরা ৫০ দশমিক ৩ ভাগ ভোট পড়বে বিএনপির ঘরে। আর
জামায়াতকে নিয়ে এই হার ৫৩ দশমিক ২০ ভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের
ভোটের হার ৩৬ দশমিক ৫০। বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম
ইউরোপে এ ধরনের জনমত জরিপ নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখে। বারাক ওবামা যখন
দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন জনমত জরিপই
জানিয়ে দিয়েছিল তিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফলে সেই জনমত
জরিপের প্রতিফলন ঘটেছিল। বাংলাদেশে এ ধরনের জনমত জরিপ নিয়ে নানা প্রশ্ন
আছে। সত্যিকার অর্থেই এ জনমতে সাধারণ মানুষের মতামত কতটুকু প্রতিফলিত হয়, এ
নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের
পরিপ্রেক্ষিতে এ জনমত জরিপ কিছুটা হলেও একটা আবেদন তুলবে। তবে বলতে দ্বিধা
নেই, এ জরিপ দিয়ে দেশের চলমান পরিস্থিতি বোঝা যাবে না।
বাংলাদেশে এখন ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে একটা শংকা তৈরি হয়েছে। আরও একটা শংকা তৈরি হয়েছে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। খোকা ‘দা-কুড়াল’ নিয়ে তৈরি থাকার জন্য বিএনপির কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি আসে তা হচ্ছে, এই ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বান বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনো অবদান রাখাবে কিনা? আমরা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ‘লগি-বৈঠা’ নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার খবরও জানি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই একই স্টাইলে আমরা প্রত্যক্ষ করছি ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বান। এর পেছনে হয়তো অনেকে যুক্তি দেবেন যে, ২০০৬ সালের ‘লগি-বৈঠার’ আহ্বানে যদি কোনো দোষ না হয়ে থাকে, তাহলে আজকের ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বানেও কোনো দোষ নেই! এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। যে কেউ এ ধরনের কর্মসূচির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে পারেন। এ ধরনের আহ্বান কোনো মতেই গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। গণতন্ত্র যে সহনশীলতার কথা বলে, এ ধরনের আহ্বানে সেই সহনশীলতা প্রকাশ পায় না। টেকসই গণতন্ত্র বিনির্মাণে এটা একটা বড় সমস্যা। এ ধরনের আহ্বান দেশে সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। সরকার এটাকে তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। এবং সরকার তা-ই করেছে। বিএনপি কার্যালয় কোরবানির পর থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। বিএনপিকে ২৫ অক্টোবরের জনসভা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকট নিরসনের আশা জাগালেও রাজধানীতে সব ধরনের মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিও বলছে, তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী অতীতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতের সঙ্গে একাÍ হয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্র“! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরও দুই টার্ম রাখার। কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই- শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কিনা? তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতিনির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন, তা টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা কি? বনমন্ত্রীর একটি বক্তব্য- বেগম জিয়া তালেবানদের নেতা! তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন, মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে, ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এ দুটি বক্তব্য এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায়, তা আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন না। বিগত নির্বাচনে নাসিম সাহেব অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। এখন আবার লাইম লাইটে আসতে চান। আবারও মন্ত্রী হতে চান! প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্যই এসব কথা বলা। প্রথমবারের মতো সংসদে আসা বনমন্ত্রীর বেগম জিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপর পক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ এক সময় ছিল, তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকদের কী শেখাচ্ছেন?
নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলেছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রধান বিরোধী দল ও জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হল কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সেটা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যার ওপর প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে, কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’- এ মানসিকতা পরিবর্তন করাও জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বেছে নিয়েছেন একদলীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লোকের অভাব নেই। রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। নির্বাচন হতেই পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৮৬ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় সেই নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য ওই সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। সে সময় সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। যারা ওই সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। বিতর্কের মুখে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সংসদের গুরুত্ব আছে একটি কারণে আর তা হচ্ছে, ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল এবং ওই তিনটি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দুবার বিজয়ী হয়ে (১৯৯৬, ২০০৮) সরকার গঠন করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন ইতিহাস। এ সরকার ভালো কী মন্দ ছিল, তা নিয়ে একসময় গবেষণা হবে। যে প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে তাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। আদালতের রায়ে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, অনির্বাচিত একটি সরকার গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এর পেছনে ‘সত্যতা’ যতটুকু আছে, তার চেয়েও বেশি ‘সত্য’ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আমরা টেকসই গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু একজন দলীয় প্রধানকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হেসেবে রেখে এবং তাকে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সরকার ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির (২০১৪) মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে। অপেক্ষা করছে বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য। নিঃসন্দেহে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের জন্য এটা একটা কঠিন সময়। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিকে উহ্য রেখে বিএনপি যদি নির্বাচনে যায় (?), তাহলে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হবে। বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেই জানিয়েছে।
এখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সে সংসদ কোনো সমাধান বের করতে পারবে না। ওই সংসদ তার টার্ম শেষ করতে না পারলেও তা টিকে থাকবে কিছুদিন। আমরা ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা চিন্তা করতে পারি। অনেকটা অংকের যোগফলের মতো বলে দেয়া যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই একটা ‘সমাধান’ বের হবে এবং আমরা নির্বাচনকালীন একটা সরকারের রূপরেখা পাব। তবে এ মুহূর্তে বলা কঠিন, সেই সরকারের রূপরেখা কী হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে শুধু নির্বাচন কমিশনারদের অতিকথনের কারণে। অতীতেও নির্বাচন কমিশন তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। তাদের সবার যেন একটা টার্গেট ছিল মিডিয়ায় পরিচিতি পাওয়া। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে মানসিকতা দরকার, তা কারও মধ্যেই নেই। ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা ফের ক্ষমতায় যাওয়ার যে ফন্দি, তা বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটিয়েছে। আমি তাই আশাবাদী হতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বসভায় টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সে রকম কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে এখন ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে একটা শংকা তৈরি হয়েছে। আরও একটা শংকা তৈরি হয়েছে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। খোকা ‘দা-কুড়াল’ নিয়ে তৈরি থাকার জন্য বিএনপির কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি আসে তা হচ্ছে, এই ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বান বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনো অবদান রাখাবে কিনা? আমরা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ‘লগি-বৈঠা’ নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার খবরও জানি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই একই স্টাইলে আমরা প্রত্যক্ষ করছি ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বান। এর পেছনে হয়তো অনেকে যুক্তি দেবেন যে, ২০০৬ সালের ‘লগি-বৈঠার’ আহ্বানে যদি কোনো দোষ না হয়ে থাকে, তাহলে আজকের ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বানেও কোনো দোষ নেই! এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। যে কেউ এ ধরনের কর্মসূচির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে পারেন। এ ধরনের আহ্বান কোনো মতেই গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। গণতন্ত্র যে সহনশীলতার কথা বলে, এ ধরনের আহ্বানে সেই সহনশীলতা প্রকাশ পায় না। টেকসই গণতন্ত্র বিনির্মাণে এটা একটা বড় সমস্যা। এ ধরনের আহ্বান দেশে সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। সরকার এটাকে তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। এবং সরকার তা-ই করেছে। বিএনপি কার্যালয় কোরবানির পর থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। বিএনপিকে ২৫ অক্টোবরের জনসভা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকট নিরসনের আশা জাগালেও রাজধানীতে সব ধরনের মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিও বলছে, তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী অতীতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতের সঙ্গে একাÍ হয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্র“! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরও দুই টার্ম রাখার। কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই- শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কিনা? তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতিনির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন, তা টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা কি? বনমন্ত্রীর একটি বক্তব্য- বেগম জিয়া তালেবানদের নেতা! তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন, মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে, ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এ দুটি বক্তব্য এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায়, তা আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন না। বিগত নির্বাচনে নাসিম সাহেব অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। এখন আবার লাইম লাইটে আসতে চান। আবারও মন্ত্রী হতে চান! প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্যই এসব কথা বলা। প্রথমবারের মতো সংসদে আসা বনমন্ত্রীর বেগম জিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপর পক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ এক সময় ছিল, তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকদের কী শেখাচ্ছেন?
নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলেছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রধান বিরোধী দল ও জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হল কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সেটা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যার ওপর প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে, কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’- এ মানসিকতা পরিবর্তন করাও জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বেছে নিয়েছেন একদলীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লোকের অভাব নেই। রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। নির্বাচন হতেই পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৮৬ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় সেই নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য ওই সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। সে সময় সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। যারা ওই সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। বিতর্কের মুখে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সংসদের গুরুত্ব আছে একটি কারণে আর তা হচ্ছে, ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল এবং ওই তিনটি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দুবার বিজয়ী হয়ে (১৯৯৬, ২০০৮) সরকার গঠন করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন ইতিহাস। এ সরকার ভালো কী মন্দ ছিল, তা নিয়ে একসময় গবেষণা হবে। যে প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে তাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। আদালতের রায়ে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, অনির্বাচিত একটি সরকার গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এর পেছনে ‘সত্যতা’ যতটুকু আছে, তার চেয়েও বেশি ‘সত্য’ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আমরা টেকসই গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু একজন দলীয় প্রধানকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হেসেবে রেখে এবং তাকে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সরকার ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির (২০১৪) মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে। অপেক্ষা করছে বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য। নিঃসন্দেহে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের জন্য এটা একটা কঠিন সময়। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিকে উহ্য রেখে বিএনপি যদি নির্বাচনে যায় (?), তাহলে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হবে। বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেই জানিয়েছে।
এখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সে সংসদ কোনো সমাধান বের করতে পারবে না। ওই সংসদ তার টার্ম শেষ করতে না পারলেও তা টিকে থাকবে কিছুদিন। আমরা ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা চিন্তা করতে পারি। অনেকটা অংকের যোগফলের মতো বলে দেয়া যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই একটা ‘সমাধান’ বের হবে এবং আমরা নির্বাচনকালীন একটা সরকারের রূপরেখা পাব। তবে এ মুহূর্তে বলা কঠিন, সেই সরকারের রূপরেখা কী হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে শুধু নির্বাচন কমিশনারদের অতিকথনের কারণে। অতীতেও নির্বাচন কমিশন তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। তাদের সবার যেন একটা টার্গেট ছিল মিডিয়ায় পরিচিতি পাওয়া। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে মানসিকতা দরকার, তা কারও মধ্যেই নেই। ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা ফের ক্ষমতায় যাওয়ার যে ফন্দি, তা বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটিয়েছে। আমি তাই আশাবাদী হতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বসভায় টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সে রকম কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments