সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান হবে by এমএম আকাশ
যুগান্তর : রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
এম এম আকাশ : রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতিতে যে কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা তখনই দেখা দেয় যখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে হরতাল, অবরোধ, রাজপথে হানাহানি-এসব অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে। এগুলো বাড়তে থাকলে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর চলতে পারে না, থমকে দাঁড়ায়- সড়ক-নৌ ইত্যাদি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; শ্রমজীবী মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক উৎপাদনশীল কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়- কখন কী হবে বলা মুশকিল হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগও থমকে থাকে। বিনিয়োগকারীরা ভাবেন, আচ্ছা দেখি কী হয়, তারপর আবার অর্থ বিনিয়োগ করব। সুতরাং রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা বা সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ রাজনৈতিক অস্থিরতা চিরস্থায়ী হয় কি? না, তা চিরস্থায়ী হয় না। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতাই আবার এ অস্থিরতাবিরোধী একটা অগণতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে এবং তারা পর্যায়ক্রমে কিছুদিনের জন্য একটা শৃংখলা বিধানের চেষ্টা করে। তখন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বা বিভিন্ন দলের মধ্যে যারা লুটপাট করেছিল, তারা পিছিয়ে যায় এবং সাময়িক একটা শান্তির ভাব সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে, আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, তারাও আবার একটা অগণতান্ত্রিক নিয়ম-আচরণ, দুর্নীতি, নিজেদের দল তৈরি ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হয়। তখন আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মানে, নিকট অতীতের চলমান প্যাটার্ন অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে আমরা স্থায়ীভাবে সহজে মুক্তি পাচ্ছি না এবং তার কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা (আপেক্ষিক অর্থে) থেকেও আমরা সহজে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাচ্ছি না। একমাত্র তখনই মুক্তি পাওয়া সম্ভব, যখন এখানে গণমুখী সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া তখনই সম্ভব, যখন রাজনীতিকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক ফায়দা লোটার পুঁজিবাদী লুটপাটমূলক যে ব্যবস্থা - সে ব্যবস্থা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব।
যুগান্তর : আগামীতে বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মানব সম্পদ রফতানিতে আমরা যাতে এগিয়ে থাকতে পারি তার জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হবে?
এম এম আকাশ :বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে যেটা হবে তা হল, বিশ্বের যেসব অঞ্চলে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে সেসব অঞ্চলে শ্রমিকের যে চাহিদা সৃষ্টি হবে তা হবে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা। এখন আমাদের দেশ থেকে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণ করা হয়। এসব দেশ এখন মধ্য আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে বা হওয়ার চেষ্টা করছে। ওই সব দেশে প্রচুর পুঁজি আছে। সেই তুলনায় তাদের নিজস্ব শ্রমিক কম। এখনও পর্যন্ত সেসব দেশে অদক্ষ শ্রমিকের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। সেই অদক্ষ শ্রমিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জুড়ি নেই। উল্লিখিত দেশগুলোয় বাংলাদেশের তুলনায় বেতন বেশি বলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক সেখানে গিয়ে সেসব কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যদি কেবল অদক্ষ মানব না পাঠিয়ে দক্ষ মানব সম্পদ পাঠাতে চাই তাহলে অদক্ষ কর্মীদের দক্ষ কর্মীতে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশ গমনে ইচ্ছুক কর্মীদের প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা দ্রুত চাকরিতে যোগদান করে তাদের দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাবে। সামগ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক কর্মীদের দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে। শিক্ষা বাজেটের একটি অংশ এ খাতে ব্যয় করলে শিক্ষা বাজেট ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ যাদের জন্য এ খাতের অর্থ ব্যয় হবে তাদের প্রেরিত রেমিটেন্সে আগামীতে সাধারণ শিক্ষার বিভিন্ন কর্মসূচি প্রসারিত করা যাবে।
যুগান্তর : দুর্নীতি দেশের উন্নয়নে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে?
এম এম আকাশ : দুর্নীতি যারা করছে, তারা যদি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করে তাহলে এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদনশীল কাজের মধ্য দিয়ে কিছু লোকের বেকারত্ব দূর হয়, কিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যেটা সমস্যা- যারা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর কালো টাকা উপার্জন করছেন, তাদের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা সেটা সাদা করার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু তারপরও তারা সেটা করছেন না। তারা ওই টাকাটা অন্য কোথাও পাচার করে দিচ্ছেন। তার মানে, আমাদের দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের দ্বিগুণ ক্ষতি। একটি হল দুর্নীতির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কিছু লোক টাকা সঞ্চয় করে ধনী হয়ে গেল, দ্বিতীয়ত সে ধনীর অর্থ দেশে বিনিয়োজিত হল না। অন্যান্য দেশে পুঁজির আদিম সঞ্চয় পর্বে এর ঠিক উল্টোটাই ঘটেছিল- ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভারতবর্ষ থেকে অর্থ লুট করে নিয়ে ব্রিটেনে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। আর আমাদের পুঁজিপতিরা বাংলাদেশ থেকে টাকা লুট করে নিয়ে কানাডায় বাড়ি কেনেন। এ কারণে আমাদের দেশে দুর্নীতির একটা ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে টাকাটা অল্পসংখ্যক লোকের পকেটে যায়, তারপর তা দেশের বাইরে চলে যায়।
যুগান্তর : উচ্চ প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি- এসবের সুফল কারা পাচ্ছে? এসবের সুফল প্রান্তিক জনগণের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করার জন্য কী করণীয়?
এম এম আকাশ : আমাদের দেশে যে প্রবৃদ্ধি হয়, সে প্রবৃদ্ধির প্রকৃতি যদি শ্রমঘন হয় তাহলে কিছু কর্মসংস্থান হয়। আর প্রবৃদ্ধির প্রকৃতি যদি পুঁজিঘন হয় তাহলে কর্মসংস্থান তুলনামূলকভাবে কম হয়। এখন পর্যন্ত যেহেতু আমরা শ্রমঘন পর্যায়ের প্রবৃদ্ধিতেই আছি (যদিও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বা ‘দাতা’ দেশগুলো এখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও কখনো কখনো চাপিয়ে দেয়), সুতরাং প্রবৃদ্ধি যদি হয় তাহলে কিছু কর্মীর কর্মসংস্থান হয়। যে কারণে আমরা লক্ষ্য করেছি ২০০০ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার প্রতিবছর ১.৭ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট হারে কমেছে। কিন্তু বৈষম্যের ব্যাপারটা- পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী স্থির থাকার কথা বলা হলেও আমার মনে হয় এখানে আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে।
প্রবৃদ্ধির কিছু ফল চুইয়ে পড়ে দরিদ্ররা পাচ্ছে। কিন্তু এটা তারা আরও অনেক বেশি পেতে পারত যদি প্রবৃদ্ধি সমতাধর্মী হতো; সুযোগ-সুবিধাগুলো সবার হাতের নাগালে থাকত- সুশাসন, বিদ্যুৎ এসব যদি নিশ্চিত করা যেত। সুতরাং আমার বিবেচনায়, বর্তমানে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এবং যে গতিতে দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে- প্রবৃদ্ধির প্রকৃতি আরও সমতা অভিমুখী হলে এবং সুশাসন নিশ্চিত হলে দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য আরও অনেক বেশি আসত।
যুগান্তর : দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কী কী লক্ষ্য সামনে রেখে এগোতে হবে?
এম এম আকাশ : দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দরকার অর্থনীতির বর্ধিষ্ণু খাতগুলো চিহ্নিত করা। ১৯৯৫ সালের পর আমাদের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপর চলে গেছে। এর আগে সব সময় আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশের নিচে। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় আমরা এখন ৬-৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আমাদের বর্ধিষ্ণু চারটি খাতের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে। বর্ধিষ্ণু চারটি খাতের একটি হল কৃষি। আমাদের কৃষকরা অব্যাহতভাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদনে তারা সফল হয়েছেন বলেই আমদানির ওপর নির্ভর না করেই আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে কৃষিবিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং আমাদের কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে। সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি খাতে ভর্তুকি ও ঋণ প্রদানে উদারতা প্রদর্শন উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। সরকারের এ মনোভাব অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
সরকার যাতে কৃষি খাতে কম মনোযোগী হয় এ ব্যাপারে বিদেশী চাপ রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত না থাকলে কৃষিপণ্যে বিদেশের ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়বে। আমার মনে হয়, বিদেশীদের আত্মঘাতী পরামর্শ অনুসরণ না করাই বাঞ্ছনীয় হবে। দ্বিতীয়ত, গার্মেন্ট খাতে আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। চীন ও ভারত যেসব দেশে গার্মেন্ট পণ্য রফতানি করত সেসব দেশের অনেকগুলো বাংলাদেশের জন্য ছেড়ে দিচ্ছে। সেই জায়গায় যদি আমাদের ঢুকতে হয়, তাহলে কোয়ালিটির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কোয়ালিটি বাড়াতে হলে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, ‘লিড টাইম’ কমাতে হবে। গার্মেন্টে দুর্ঘটনাগুলো যাতে না ঘটে সেজন্য যেসব বিনিয়োগ দরকার সেসব তাদের করতে হবে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করে তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার বিস্তৃত ও বহুমুখী করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুবন্দোবস্ত করতে হবে।
এখন উপজেলা পর্যায়ে ছোটখাটো অকৃষি উৎপাদন খাত গড়ে উঠেছে, যাদের আমরা বলি এসএমই- স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ। সার্ভিস সেক্টর, ট্রান্সপোর্ট, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ- এসব জায়গায় এক ধরনের পুঁজির অভাব রয়েছে, জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং মার্কেটিং সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। এসব অসুবিধা দূর করার জন্য সরকারকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। যেহেতু কৃষকের হাতে টাকা আছে সুতরাং তারা উপজেলা সদরে এসে এসএমইর পণ্যগুলো কিনছেন। তারা আমদানিকৃত বিলাস পণ্য কেনেন না, তারা এসএমইর পণ্যই কেনেন। চীনে যেমন গ্রামীণ শিল্প ও গ্রামীণ কৃষি পরস্পর পরিপূরকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সে ধরনের একটা কৌশল আমাদের নিতে হবে। তাহলে গ্রামগুলো একটু উন্নত হবে। এখন গ্রাম-শহরে যে বৈষম্য বিদ্যমান, তা কিছুটা কমে আসবে।
যুগান্তর : আন্তর্জাতিক সূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান যাতে ওপরের দিকে থাকে তার জন্য কী করণীয়?
এম এম আকাশ : বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যদি আমরা উন্নততর সূচকে নিতে চাই, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো- তাহলে সেখানে আর্থিক সংস্থান বৃদ্ধি খুব জরুরি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও গুরুত্ব আরও বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে সর্বস্তরে যেভাবে শিক্ষা বিস্তৃত হয়েছে, সেভাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি। অর্থাৎ শিক্ষার মানটা আমাদের বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। শিক্ষকের দক্ষতা বাড়াতে হলে শিক্ষকের প্রাপ্ত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে তাদের গবেষণার মান বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে যেখানে একটি রুমে চারজন শিক্ষার্থীকে মেঝেতে থাকতে হয়, পানির মতো ডাল পান করে জীবনধারন করতে হয়- এ ধরনের পরিবেশে শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভালো ফলাফল নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সুতরাং বিদ্যমান আবাসন সংকট দূর করতে হবে, শিক্ষাবৃত্তির অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে, নতুন বইপত্র লিখতে হবে, নতুন বইপত্র সংগ্রহের সুব্যবস্থা করতে হবে। সামগ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
যুগান্তর : সাবির্ক দিক বিবেচনায় আমাদের কী ধরনের জ্বালানি ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়ানো উচিত?
এম এম আকাশ : আমাদের অন্যতম জ্বালানি-গ্যাসের মজুদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানির অন্যান্য উপকরণের ব্যবহারে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর কী প্রভাব পড়ে- সে বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। কয়লা-বিদ্যুতে আমরা যেতে পারি, কিন্তু সুন্দরবন বা অপুরণীয় কোনো ক্ষতির বিনিময়ে নয়।
যুগান্তর : বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনুমান করা যায়, আগামীতেও এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে?
এম এম আকাশ : যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্ট মন্দা আমাদের দেশে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকশিল্পের বাজার যেটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সে ক্ষতিটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি ইউরোপ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে আমাদের রফতানির গতিমুখ পরিবর্তন করে। উন্নত দেশে মন্দার ফলে ওই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে উন্নত দেশে আমরা যেসব পণ্য রফতানি করি, সেসব পণ্যের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উন্নত দেশ থেকে আসা বৈদেশিক অনুদান কমে যায়। মন্দার প্রভাব সত্ত্বেও আমাদের গার্মেন্ট খাতে এ বছরেও রফতনি ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গার্মেন্ট খাতে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও আমাদের তৈরি পোশাক খাতে রফতানির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
একসময় উন্নয়ন বাজেটের একটি বড় অংশের জন্য বৈদেশিক অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হতো। সে ধরনের চরম নির্ভরশীলতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছি। এখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ১.২ বিলিয়ন ডলার না দিলে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা ওই অর্থ মালয়েশিয়া থেকে আনতে পারি। আমাদের দুই মাসের রেমিট্যান্সে পদ্মা সেতুর মতো ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্বমন্দার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য দরকার একটা শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়। সেটা আমাদের আছে। সুতরাং এ নিয়ে আমাদের বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
যুগান্তর : সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে কী করণীয়?
এম এম আকাশ : সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য দরকার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ- এদের প্রদত্ত মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদের সঙ্গে বাউল সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখতে পারলে যারা আমাদের সংস্কৃতিতে বিকৃতি ও অসহিষ্ণুতা ছড়াতে চায়, তাদের অপতৎপরতা রোধ করা সম্ভব হবে। তখন আবদুল করিম বয়াতির ভাষায় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এটা না বলে এখন কী সুন্দর দিন কাটাইতেছি- এটা বলতে পারব।
এ অবস্থার সৃষ্টি হলেই আমাদের সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধগুলো ফিরে আসবে। আর তার সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতিকে আমরা এখন কমন স্ট্যান্ডার্ড ধরে নিয়েছি এবং আমরা অনেকে মনে করি, ঘুষ যে চাকরিতে আছে সেই চাকরিতে যাওয়াই শ্রেয়। আমরা অনেকে মনে করি, ঘুষটা খুব একটা অন্যায় কাজ নয়; এটার নামও বদলে দেয়া হয়েছে- উপরি। এই যে মূল্যবোধের একটা অবক্ষয় হয়েছে এবং খুব বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা দুর্নীতির উদাহরণ তৈরি করছে- এ অবস্থা থেকেও আমাদের মুক্ত হতে হবে। আর সেটার জন্য দরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
এম এম আকাশ : রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতিতে যে কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা তখনই দেখা দেয় যখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে হরতাল, অবরোধ, রাজপথে হানাহানি-এসব অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে। এগুলো বাড়তে থাকলে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর চলতে পারে না, থমকে দাঁড়ায়- সড়ক-নৌ ইত্যাদি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; শ্রমজীবী মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক উৎপাদনশীল কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়- কখন কী হবে বলা মুশকিল হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগও থমকে থাকে। বিনিয়োগকারীরা ভাবেন, আচ্ছা দেখি কী হয়, তারপর আবার অর্থ বিনিয়োগ করব। সুতরাং রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা বা সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ রাজনৈতিক অস্থিরতা চিরস্থায়ী হয় কি? না, তা চিরস্থায়ী হয় না। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতাই আবার এ অস্থিরতাবিরোধী একটা অগণতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে এবং তারা পর্যায়ক্রমে কিছুদিনের জন্য একটা শৃংখলা বিধানের চেষ্টা করে। তখন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বা বিভিন্ন দলের মধ্যে যারা লুটপাট করেছিল, তারা পিছিয়ে যায় এবং সাময়িক একটা শান্তির ভাব সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে, আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, তারাও আবার একটা অগণতান্ত্রিক নিয়ম-আচরণ, দুর্নীতি, নিজেদের দল তৈরি ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হয়। তখন আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মানে, নিকট অতীতের চলমান প্যাটার্ন অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে আমরা স্থায়ীভাবে সহজে মুক্তি পাচ্ছি না এবং তার কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা (আপেক্ষিক অর্থে) থেকেও আমরা সহজে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাচ্ছি না। একমাত্র তখনই মুক্তি পাওয়া সম্ভব, যখন এখানে গণমুখী সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া তখনই সম্ভব, যখন রাজনীতিকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক ফায়দা লোটার পুঁজিবাদী লুটপাটমূলক যে ব্যবস্থা - সে ব্যবস্থা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব।
যুগান্তর : আগামীতে বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মানব সম্পদ রফতানিতে আমরা যাতে এগিয়ে থাকতে পারি তার জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হবে?
এম এম আকাশ :বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে যেটা হবে তা হল, বিশ্বের যেসব অঞ্চলে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে সেসব অঞ্চলে শ্রমিকের যে চাহিদা সৃষ্টি হবে তা হবে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা। এখন আমাদের দেশ থেকে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণ করা হয়। এসব দেশ এখন মধ্য আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে বা হওয়ার চেষ্টা করছে। ওই সব দেশে প্রচুর পুঁজি আছে। সেই তুলনায় তাদের নিজস্ব শ্রমিক কম। এখনও পর্যন্ত সেসব দেশে অদক্ষ শ্রমিকের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। সেই অদক্ষ শ্রমিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জুড়ি নেই। উল্লিখিত দেশগুলোয় বাংলাদেশের তুলনায় বেতন বেশি বলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক সেখানে গিয়ে সেসব কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যদি কেবল অদক্ষ মানব না পাঠিয়ে দক্ষ মানব সম্পদ পাঠাতে চাই তাহলে অদক্ষ কর্মীদের দক্ষ কর্মীতে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশ গমনে ইচ্ছুক কর্মীদের প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা দ্রুত চাকরিতে যোগদান করে তাদের দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাবে। সামগ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক কর্মীদের দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে। শিক্ষা বাজেটের একটি অংশ এ খাতে ব্যয় করলে শিক্ষা বাজেট ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ যাদের জন্য এ খাতের অর্থ ব্যয় হবে তাদের প্রেরিত রেমিটেন্সে আগামীতে সাধারণ শিক্ষার বিভিন্ন কর্মসূচি প্রসারিত করা যাবে।
যুগান্তর : দুর্নীতি দেশের উন্নয়নে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে?
এম এম আকাশ : দুর্নীতি যারা করছে, তারা যদি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করে তাহলে এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদনশীল কাজের মধ্য দিয়ে কিছু লোকের বেকারত্ব দূর হয়, কিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যেটা সমস্যা- যারা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর কালো টাকা উপার্জন করছেন, তাদের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা সেটা সাদা করার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু তারপরও তারা সেটা করছেন না। তারা ওই টাকাটা অন্য কোথাও পাচার করে দিচ্ছেন। তার মানে, আমাদের দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের দ্বিগুণ ক্ষতি। একটি হল দুর্নীতির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কিছু লোক টাকা সঞ্চয় করে ধনী হয়ে গেল, দ্বিতীয়ত সে ধনীর অর্থ দেশে বিনিয়োজিত হল না। অন্যান্য দেশে পুঁজির আদিম সঞ্চয় পর্বে এর ঠিক উল্টোটাই ঘটেছিল- ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভারতবর্ষ থেকে অর্থ লুট করে নিয়ে ব্রিটেনে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। আর আমাদের পুঁজিপতিরা বাংলাদেশ থেকে টাকা লুট করে নিয়ে কানাডায় বাড়ি কেনেন। এ কারণে আমাদের দেশে দুর্নীতির একটা ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে টাকাটা অল্পসংখ্যক লোকের পকেটে যায়, তারপর তা দেশের বাইরে চলে যায়।
যুগান্তর : উচ্চ প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি- এসবের সুফল কারা পাচ্ছে? এসবের সুফল প্রান্তিক জনগণের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করার জন্য কী করণীয়?
এম এম আকাশ : আমাদের দেশে যে প্রবৃদ্ধি হয়, সে প্রবৃদ্ধির প্রকৃতি যদি শ্রমঘন হয় তাহলে কিছু কর্মসংস্থান হয়। আর প্রবৃদ্ধির প্রকৃতি যদি পুঁজিঘন হয় তাহলে কর্মসংস্থান তুলনামূলকভাবে কম হয়। এখন পর্যন্ত যেহেতু আমরা শ্রমঘন পর্যায়ের প্রবৃদ্ধিতেই আছি (যদিও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বা ‘দাতা’ দেশগুলো এখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও কখনো কখনো চাপিয়ে দেয়), সুতরাং প্রবৃদ্ধি যদি হয় তাহলে কিছু কর্মীর কর্মসংস্থান হয়। যে কারণে আমরা লক্ষ্য করেছি ২০০০ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার প্রতিবছর ১.৭ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট হারে কমেছে। কিন্তু বৈষম্যের ব্যাপারটা- পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী স্থির থাকার কথা বলা হলেও আমার মনে হয় এখানে আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে।
প্রবৃদ্ধির কিছু ফল চুইয়ে পড়ে দরিদ্ররা পাচ্ছে। কিন্তু এটা তারা আরও অনেক বেশি পেতে পারত যদি প্রবৃদ্ধি সমতাধর্মী হতো; সুযোগ-সুবিধাগুলো সবার হাতের নাগালে থাকত- সুশাসন, বিদ্যুৎ এসব যদি নিশ্চিত করা যেত। সুতরাং আমার বিবেচনায়, বর্তমানে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এবং যে গতিতে দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে- প্রবৃদ্ধির প্রকৃতি আরও সমতা অভিমুখী হলে এবং সুশাসন নিশ্চিত হলে দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য আরও অনেক বেশি আসত।
যুগান্তর : দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কী কী লক্ষ্য সামনে রেখে এগোতে হবে?
এম এম আকাশ : দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দরকার অর্থনীতির বর্ধিষ্ণু খাতগুলো চিহ্নিত করা। ১৯৯৫ সালের পর আমাদের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপর চলে গেছে। এর আগে সব সময় আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশের নিচে। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় আমরা এখন ৬-৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আমাদের বর্ধিষ্ণু চারটি খাতের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে। বর্ধিষ্ণু চারটি খাতের একটি হল কৃষি। আমাদের কৃষকরা অব্যাহতভাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদনে তারা সফল হয়েছেন বলেই আমদানির ওপর নির্ভর না করেই আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে কৃষিবিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং আমাদের কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে। সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি খাতে ভর্তুকি ও ঋণ প্রদানে উদারতা প্রদর্শন উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। সরকারের এ মনোভাব অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
সরকার যাতে কৃষি খাতে কম মনোযোগী হয় এ ব্যাপারে বিদেশী চাপ রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত না থাকলে কৃষিপণ্যে বিদেশের ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়বে। আমার মনে হয়, বিদেশীদের আত্মঘাতী পরামর্শ অনুসরণ না করাই বাঞ্ছনীয় হবে। দ্বিতীয়ত, গার্মেন্ট খাতে আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। চীন ও ভারত যেসব দেশে গার্মেন্ট পণ্য রফতানি করত সেসব দেশের অনেকগুলো বাংলাদেশের জন্য ছেড়ে দিচ্ছে। সেই জায়গায় যদি আমাদের ঢুকতে হয়, তাহলে কোয়ালিটির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কোয়ালিটি বাড়াতে হলে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, ‘লিড টাইম’ কমাতে হবে। গার্মেন্টে দুর্ঘটনাগুলো যাতে না ঘটে সেজন্য যেসব বিনিয়োগ দরকার সেসব তাদের করতে হবে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করে তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার বিস্তৃত ও বহুমুখী করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুবন্দোবস্ত করতে হবে।
এখন উপজেলা পর্যায়ে ছোটখাটো অকৃষি উৎপাদন খাত গড়ে উঠেছে, যাদের আমরা বলি এসএমই- স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ। সার্ভিস সেক্টর, ট্রান্সপোর্ট, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ- এসব জায়গায় এক ধরনের পুঁজির অভাব রয়েছে, জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং মার্কেটিং সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। এসব অসুবিধা দূর করার জন্য সরকারকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। যেহেতু কৃষকের হাতে টাকা আছে সুতরাং তারা উপজেলা সদরে এসে এসএমইর পণ্যগুলো কিনছেন। তারা আমদানিকৃত বিলাস পণ্য কেনেন না, তারা এসএমইর পণ্যই কেনেন। চীনে যেমন গ্রামীণ শিল্প ও গ্রামীণ কৃষি পরস্পর পরিপূরকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সে ধরনের একটা কৌশল আমাদের নিতে হবে। তাহলে গ্রামগুলো একটু উন্নত হবে। এখন গ্রাম-শহরে যে বৈষম্য বিদ্যমান, তা কিছুটা কমে আসবে।
যুগান্তর : আন্তর্জাতিক সূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান যাতে ওপরের দিকে থাকে তার জন্য কী করণীয়?
এম এম আকাশ : বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যদি আমরা উন্নততর সূচকে নিতে চাই, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো- তাহলে সেখানে আর্থিক সংস্থান বৃদ্ধি খুব জরুরি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও গুরুত্ব আরও বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে সর্বস্তরে যেভাবে শিক্ষা বিস্তৃত হয়েছে, সেভাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি। অর্থাৎ শিক্ষার মানটা আমাদের বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। শিক্ষকের দক্ষতা বাড়াতে হলে শিক্ষকের প্রাপ্ত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে তাদের গবেষণার মান বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে যেখানে একটি রুমে চারজন শিক্ষার্থীকে মেঝেতে থাকতে হয়, পানির মতো ডাল পান করে জীবনধারন করতে হয়- এ ধরনের পরিবেশে শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভালো ফলাফল নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সুতরাং বিদ্যমান আবাসন সংকট দূর করতে হবে, শিক্ষাবৃত্তির অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে, নতুন বইপত্র লিখতে হবে, নতুন বইপত্র সংগ্রহের সুব্যবস্থা করতে হবে। সামগ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
যুগান্তর : সাবির্ক দিক বিবেচনায় আমাদের কী ধরনের জ্বালানি ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়ানো উচিত?
এম এম আকাশ : আমাদের অন্যতম জ্বালানি-গ্যাসের মজুদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানির অন্যান্য উপকরণের ব্যবহারে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর কী প্রভাব পড়ে- সে বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। কয়লা-বিদ্যুতে আমরা যেতে পারি, কিন্তু সুন্দরবন বা অপুরণীয় কোনো ক্ষতির বিনিময়ে নয়।
যুগান্তর : বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনুমান করা যায়, আগামীতেও এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে?
এম এম আকাশ : যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্ট মন্দা আমাদের দেশে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকশিল্পের বাজার যেটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সে ক্ষতিটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি ইউরোপ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে আমাদের রফতানির গতিমুখ পরিবর্তন করে। উন্নত দেশে মন্দার ফলে ওই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে উন্নত দেশে আমরা যেসব পণ্য রফতানি করি, সেসব পণ্যের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উন্নত দেশ থেকে আসা বৈদেশিক অনুদান কমে যায়। মন্দার প্রভাব সত্ত্বেও আমাদের গার্মেন্ট খাতে এ বছরেও রফতনি ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গার্মেন্ট খাতে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও আমাদের তৈরি পোশাক খাতে রফতানির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
একসময় উন্নয়ন বাজেটের একটি বড় অংশের জন্য বৈদেশিক অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হতো। সে ধরনের চরম নির্ভরশীলতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছি। এখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ১.২ বিলিয়ন ডলার না দিলে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা ওই অর্থ মালয়েশিয়া থেকে আনতে পারি। আমাদের দুই মাসের রেমিট্যান্সে পদ্মা সেতুর মতো ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্বমন্দার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য দরকার একটা শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়। সেটা আমাদের আছে। সুতরাং এ নিয়ে আমাদের বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
যুগান্তর : সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে কী করণীয়?
এম এম আকাশ : সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য দরকার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ- এদের প্রদত্ত মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদের সঙ্গে বাউল সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখতে পারলে যারা আমাদের সংস্কৃতিতে বিকৃতি ও অসহিষ্ণুতা ছড়াতে চায়, তাদের অপতৎপরতা রোধ করা সম্ভব হবে। তখন আবদুল করিম বয়াতির ভাষায় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এটা না বলে এখন কী সুন্দর দিন কাটাইতেছি- এটা বলতে পারব।
এ অবস্থার সৃষ্টি হলেই আমাদের সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধগুলো ফিরে আসবে। আর তার সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতিকে আমরা এখন কমন স্ট্যান্ডার্ড ধরে নিয়েছি এবং আমরা অনেকে মনে করি, ঘুষ যে চাকরিতে আছে সেই চাকরিতে যাওয়াই শ্রেয়। আমরা অনেকে মনে করি, ঘুষটা খুব একটা অন্যায় কাজ নয়; এটার নামও বদলে দেয়া হয়েছে- উপরি। এই যে মূল্যবোধের একটা অবক্ষয় হয়েছে এবং খুব বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা দুর্নীতির উদাহরণ তৈরি করছে- এ অবস্থা থেকেও আমাদের মুক্ত হতে হবে। আর সেটার জন্য দরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
No comments