শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য by সুকোমল বড়ুয়া
আজ
শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা। এক পুণ্যময় তিথি। বৌদ্ধজীবন নানা কারণে অর্থবহ এবং
গুরুত্বপূর্ণ। এ তিথিতে গৌতমবুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি
গ্রহণ করেন। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু ও সন্ন্যাসী- এ চার দৃশ্য দেখে
রাজকুমার সিদ্ধার্থ এ তিথিতে গৃহত্যাগ করেন। ছয় বছর কঠোর তপস্যার পর
বুদ্ধত্ব লাভ করে তিনি এ পূর্ণিমা তিথিতে সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে তার
নবধর্ম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন। পরে একই পূর্ণিমা তিথিতে তিনি
মাতৃদেবীকে সদ্ধর্ম দেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। এ পূর্ণিমাতেই
বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা,
বর্ষাবাস ও উপোসথ এ তিনটি বিষয় একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বৌদ্ধদের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে বর্ষাবাস হল অন্যতম। ভিক্ষুগণ বর্ষায় আবাস
গ্রহণ করেন বলেই এর নাম বর্ষাবাস। এটি বৌদ্ধ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৌদ্ধমতে ঋতু তিনটি। যথা- গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত। চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস গ্রীষ্ম ঋতু; শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাস বর্ষা ঋতু এবং অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গ–ন মাস হেমন্ত ঋতু। ঋতুগুলোর মধ্যে বর্ষায় বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির জলে নালা-ডোবা জলে ভরে যায়। পথ-ঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যায়। পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ, মশা ও সরীসৃপের উপদ্রব অনেক বেড়ে যায়। তখন এদিক-ওদিক ঘুরতে গেলে কাপড় ভিজে যায়। এতে সিক্ত বসন পরতে ও শুকাতে কষ্ট হয়। তাই আকাশের নিচে যেখানে-সেখানে ভিক্ষুদের বাস না করে বুদ্ধ বর্ষাবাস গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বর্ষাবাস গ্রহণ করা হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে এবং এটা শেষ হয় আশ্বিনী পূর্ণিমাতে। সুতরাং আষাঢ়ী পূর্ণিমাই বর্ষাবাস গ্রহণের পুণ্যতিথি। এ তিথিতে গৃহীরাও তিন মাসের জন্য উপোস ব্রত গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ পারমার্থিক জীবন গঠনের জন্য তারা শুরু করেন তিন মাসব্যাপী বিদ্যা, ধ্যান ও প্রজ্ঞানুশীলন ভাবনা।
বৌদ্ধ বিনয় মতে যে ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন করেন তিনি কঠিন চীবর লাভের উপযুক্ততা লাভ করেন। এছাড়া কঠিন চীবর গ্রহণের কোনোরূপ বৈধতা থাকে না। ভিক্ষুদের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয়ের জন্যও বর্ষাবাস গণনা করা হয়। জš§গত বয়স গণনা করে ভিক্ষুদের বয়স নির্ধারণ করা হয় না। বর্ষাবাস প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য নানা স্থানে গড়ে ওঠে সংঘারাম, বিহার ও আবাসস্থল। এগুলো বিদ্যাচর্চা, ধ্যানচর্চা ও ধর্ম-বিনয় শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। আজকের আধুনিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর উৎসস্থল হল প্রাচীন বৌদ্ধবিহার, মঠ, মন্দির ও সংঘারাম থেকে। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ওই আশ্রমগুলোতে। পরে গুরুগৃহে গিয়ে শাস্ত্র শিক্ষা করা হতো। এ জন্যই প্রাচীন বিদ্যা শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
বর্ষাবাস আড়ম্বরপূর্ণ উৎসবের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। ওইদিন পূর্বাহ্নে বুদ্ধপূজা ও ভিক্ষুদের জন্য নানা আহার্য ও দানীয় সামগ্রী নিয়ে সকালে বিহারে মিলিত হয় বৌদ্ধ নর-নারী, যুবক-যুবতী ও বালক-বালিকারা। ভিক্ষুর কাছ থেকে তারা পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করে। যথাসাধ্য দানীয় সামগ্রী ও অর্থ দান করে। অপরাহেœ বিহারে কিংবা গৃহে প্রত্যাবর্তন করে মৈত্রী ভাবনা, অনিত্য ভাবনা, সমথ ভাবনা অথবা বিদর্শন ভাবনায় মনোনিবেশ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভাবগত পুঁথি পাঠও করা হয়ে থাকে। সেদিন বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। ভিক্ষুগণ বুদ্ধের সামনে কিংবা সীমায় গিয়ে বর্ষাবাস গ্রহণের মন্ত্র উচ্চারণ করেন। এ সময়ে বৌদ্ধ গৃহী ও ভিক্ষুরা আত্মসংযমে তৎপর থাকেন।
বর্ষাব্রত একটি পবিত্র এবং অনুকরণীয় অধিষ্ঠান। কোনো মারাÍক পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে কোনো ভিক্ষু বর্ষাবাসব্রত ভঙ্গ করতে পারেন না। সংঘ এবং সামাজিক প্রয়োজন ব্যতীত বর্ষাব্রত ভঙ্গ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বৌদ্ধ বিনয় শাস্ত্রে উল্লেখ আছে সাতটি জরুরি কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বর্ষাবাসে নিজ বিহার থেকে বাইরে গিয়ে অবস্থান করতে পারবেন। যেমন- ভিক্ষু-শ্রামণ অসুস্থ হলে, শাসনের ক্ষতি হলে, সংঘকর্মে, বাসস্থানে বন্যজন্তু কিংবা ডাকাতদের উপদ্রব হলে, বাসস্থান ভেঙে গেলে, পুড়ে গেলে, বিহারের দায়ক-দায়িকার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হলে।
বর্ষাব্রত গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হল যে স্থানে ধ্যান-সমাধি করা যায়। ধর্ম-বিনয় শিক্ষা, বিদ্যাচর্চা এবং ধ্যানের কোনো অন্তরায় হয় না এমন স্থানেই বর্ষাব্রত গ্রহণের উপযুক্ত স্থান। বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে কোনো স্থানে বর্ষাব্রত গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। অতীতে বুদ্ধের সময়ে যেসব স্থানে বর্ষাব্রতের জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল সেগুলোর মধ্যে পূর্বারাম, রাজকারাম, ন্যাগ্রোধারাম, গয়া, উরুবেলা, নালন্দা, সাকেত ও উজ্জয়িনীয় নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও গুহাবাসের মধ্যে ছিল গোতমক কন্দর, তিন্থক তপোরাম এবং ইন্দ্রশালা প্রভৃতি। বৌদ্ধধর্মে উপোসথের গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বে বলেছি পূর্ণিমা ও বর্ষাবাসের কার্যক্রমের সঙ্গে উপোসথ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্মীয় জীবনযাপনের লক্ষ্যে বৌদ্ধধর্মে উপোসথের প্রবর্তন করা হয়েছে। উপোসথ হল ধর্মময় জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ শিবির।
পালি ‘উপোসথ’ শব্দ থেকে উপবাস শব্দের উৎপত্তি। উপোসথ শব্দের ব্যুৎপত্তি করা হয়েছে ‘উপবসথ’ শব্দ থেকে। এখানে উপ একটি উপসর্গ। এর অর্থ হল নিকটে এবং বসথ অর্থ হলো বাস করা। সুতরাং উপবসথ শব্দের অর্থ হল নিকটে বসে কিংবা পাশাপাশি বসে ধর্ম শ্রবণ করা। অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোসথিকগণ এ সময় দান, শীল, ভাবনা করে আধ্যাÍিক জীবন গঠন করে। বৌদ্ধমতে উপোসথ চার প্রকার। যথা : প্রতিজাগর উপোসথ, গোপাল উপোসথ, নির্গ্রন্থ উপোসথ এবং আর্য উপোসথ। আর্য শ্রাবকদের পালনীয় উপোসথই আর্য উপোসথ। আর্য উপোসথধারীগণ অষ্টশীলের মধ্যে কোনো শীল ভঙ্গ করেন না। উপোসথিক প্রাণিহত্যা করেন না। অপ্রদত্তবস্তু গ্রহণ করেন না। মিথ্যা ভাষণ করেন না। মাদকদ্রব্য সেবন করেন না। ব্রহ্মচর্য আচরণ করেন। কামাচার করেন না। রাতে আহার গ্রহণ করেন না। মালাধারণ ও সুগন্ধদ্রব্য ব্যবহার করেন না। কোনো উঁচু আসনে শয়ন কিংবা উপবেশন করেন না। এগুলো অষ্টাঙ্গ উপোসথিকের অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য।
উপোসথ আত্মশাসন, আত্মসংযম ও চিত্ত-সাধনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বৌদ্ধজীবনে এটি হচ্ছে প্রজ্ঞা ও ধ্যান সাধনার জন্য মহৎ কাজ। দুঃখের নিবৃত্তির জন্য এ উপোসথ বৌদ্ধজীবন পদ্ধতিতে অত্যন্ত কার্যকর।
চলুন আমরা আজ সবাই এই বর্ষাবাসের তাৎপর্য অনুধাবন করি এবং আত্মসংযম, আত্মজ্ঞান ও আত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হই। সমাজ দেশ তথা বিশ্বকে আমরা মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করি। সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু- জগতের সকল জীব সুখী হোক। ভবতু সব্ব মঙ্গলং- সকলের মঙ্গল লাভ হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়–য়া : সাবেক চেয়ারম্যান পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
বৌদ্ধমতে ঋতু তিনটি। যথা- গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত। চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস গ্রীষ্ম ঋতু; শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাস বর্ষা ঋতু এবং অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গ–ন মাস হেমন্ত ঋতু। ঋতুগুলোর মধ্যে বর্ষায় বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির জলে নালা-ডোবা জলে ভরে যায়। পথ-ঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যায়। পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ, মশা ও সরীসৃপের উপদ্রব অনেক বেড়ে যায়। তখন এদিক-ওদিক ঘুরতে গেলে কাপড় ভিজে যায়। এতে সিক্ত বসন পরতে ও শুকাতে কষ্ট হয়। তাই আকাশের নিচে যেখানে-সেখানে ভিক্ষুদের বাস না করে বুদ্ধ বর্ষাবাস গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বর্ষাবাস গ্রহণ করা হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে এবং এটা শেষ হয় আশ্বিনী পূর্ণিমাতে। সুতরাং আষাঢ়ী পূর্ণিমাই বর্ষাবাস গ্রহণের পুণ্যতিথি। এ তিথিতে গৃহীরাও তিন মাসের জন্য উপোস ব্রত গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ পারমার্থিক জীবন গঠনের জন্য তারা শুরু করেন তিন মাসব্যাপী বিদ্যা, ধ্যান ও প্রজ্ঞানুশীলন ভাবনা।
বৌদ্ধ বিনয় মতে যে ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন করেন তিনি কঠিন চীবর লাভের উপযুক্ততা লাভ করেন। এছাড়া কঠিন চীবর গ্রহণের কোনোরূপ বৈধতা থাকে না। ভিক্ষুদের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয়ের জন্যও বর্ষাবাস গণনা করা হয়। জš§গত বয়স গণনা করে ভিক্ষুদের বয়স নির্ধারণ করা হয় না। বর্ষাবাস প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য নানা স্থানে গড়ে ওঠে সংঘারাম, বিহার ও আবাসস্থল। এগুলো বিদ্যাচর্চা, ধ্যানচর্চা ও ধর্ম-বিনয় শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। আজকের আধুনিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর উৎসস্থল হল প্রাচীন বৌদ্ধবিহার, মঠ, মন্দির ও সংঘারাম থেকে। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ওই আশ্রমগুলোতে। পরে গুরুগৃহে গিয়ে শাস্ত্র শিক্ষা করা হতো। এ জন্যই প্রাচীন বিদ্যা শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
বর্ষাবাস আড়ম্বরপূর্ণ উৎসবের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। ওইদিন পূর্বাহ্নে বুদ্ধপূজা ও ভিক্ষুদের জন্য নানা আহার্য ও দানীয় সামগ্রী নিয়ে সকালে বিহারে মিলিত হয় বৌদ্ধ নর-নারী, যুবক-যুবতী ও বালক-বালিকারা। ভিক্ষুর কাছ থেকে তারা পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করে। যথাসাধ্য দানীয় সামগ্রী ও অর্থ দান করে। অপরাহেœ বিহারে কিংবা গৃহে প্রত্যাবর্তন করে মৈত্রী ভাবনা, অনিত্য ভাবনা, সমথ ভাবনা অথবা বিদর্শন ভাবনায় মনোনিবেশ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভাবগত পুঁথি পাঠও করা হয়ে থাকে। সেদিন বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। ভিক্ষুগণ বুদ্ধের সামনে কিংবা সীমায় গিয়ে বর্ষাবাস গ্রহণের মন্ত্র উচ্চারণ করেন। এ সময়ে বৌদ্ধ গৃহী ও ভিক্ষুরা আত্মসংযমে তৎপর থাকেন।
বর্ষাব্রত একটি পবিত্র এবং অনুকরণীয় অধিষ্ঠান। কোনো মারাÍক পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে কোনো ভিক্ষু বর্ষাবাসব্রত ভঙ্গ করতে পারেন না। সংঘ এবং সামাজিক প্রয়োজন ব্যতীত বর্ষাব্রত ভঙ্গ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বৌদ্ধ বিনয় শাস্ত্রে উল্লেখ আছে সাতটি জরুরি কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বর্ষাবাসে নিজ বিহার থেকে বাইরে গিয়ে অবস্থান করতে পারবেন। যেমন- ভিক্ষু-শ্রামণ অসুস্থ হলে, শাসনের ক্ষতি হলে, সংঘকর্মে, বাসস্থানে বন্যজন্তু কিংবা ডাকাতদের উপদ্রব হলে, বাসস্থান ভেঙে গেলে, পুড়ে গেলে, বিহারের দায়ক-দায়িকার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হলে।
বর্ষাব্রত গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হল যে স্থানে ধ্যান-সমাধি করা যায়। ধর্ম-বিনয় শিক্ষা, বিদ্যাচর্চা এবং ধ্যানের কোনো অন্তরায় হয় না এমন স্থানেই বর্ষাব্রত গ্রহণের উপযুক্ত স্থান। বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে কোনো স্থানে বর্ষাব্রত গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। অতীতে বুদ্ধের সময়ে যেসব স্থানে বর্ষাব্রতের জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল সেগুলোর মধ্যে পূর্বারাম, রাজকারাম, ন্যাগ্রোধারাম, গয়া, উরুবেলা, নালন্দা, সাকেত ও উজ্জয়িনীয় নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও গুহাবাসের মধ্যে ছিল গোতমক কন্দর, তিন্থক তপোরাম এবং ইন্দ্রশালা প্রভৃতি। বৌদ্ধধর্মে উপোসথের গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বে বলেছি পূর্ণিমা ও বর্ষাবাসের কার্যক্রমের সঙ্গে উপোসথ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্মীয় জীবনযাপনের লক্ষ্যে বৌদ্ধধর্মে উপোসথের প্রবর্তন করা হয়েছে। উপোসথ হল ধর্মময় জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ শিবির।
পালি ‘উপোসথ’ শব্দ থেকে উপবাস শব্দের উৎপত্তি। উপোসথ শব্দের ব্যুৎপত্তি করা হয়েছে ‘উপবসথ’ শব্দ থেকে। এখানে উপ একটি উপসর্গ। এর অর্থ হল নিকটে এবং বসথ অর্থ হলো বাস করা। সুতরাং উপবসথ শব্দের অর্থ হল নিকটে বসে কিংবা পাশাপাশি বসে ধর্ম শ্রবণ করা। অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোসথিকগণ এ সময় দান, শীল, ভাবনা করে আধ্যাÍিক জীবন গঠন করে। বৌদ্ধমতে উপোসথ চার প্রকার। যথা : প্রতিজাগর উপোসথ, গোপাল উপোসথ, নির্গ্রন্থ উপোসথ এবং আর্য উপোসথ। আর্য শ্রাবকদের পালনীয় উপোসথই আর্য উপোসথ। আর্য উপোসথধারীগণ অষ্টশীলের মধ্যে কোনো শীল ভঙ্গ করেন না। উপোসথিক প্রাণিহত্যা করেন না। অপ্রদত্তবস্তু গ্রহণ করেন না। মিথ্যা ভাষণ করেন না। মাদকদ্রব্য সেবন করেন না। ব্রহ্মচর্য আচরণ করেন। কামাচার করেন না। রাতে আহার গ্রহণ করেন না। মালাধারণ ও সুগন্ধদ্রব্য ব্যবহার করেন না। কোনো উঁচু আসনে শয়ন কিংবা উপবেশন করেন না। এগুলো অষ্টাঙ্গ উপোসথিকের অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য।
উপোসথ আত্মশাসন, আত্মসংযম ও চিত্ত-সাধনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বৌদ্ধজীবনে এটি হচ্ছে প্রজ্ঞা ও ধ্যান সাধনার জন্য মহৎ কাজ। দুঃখের নিবৃত্তির জন্য এ উপোসথ বৌদ্ধজীবন পদ্ধতিতে অত্যন্ত কার্যকর।
চলুন আমরা আজ সবাই এই বর্ষাবাসের তাৎপর্য অনুধাবন করি এবং আত্মসংযম, আত্মজ্ঞান ও আত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হই। সমাজ দেশ তথা বিশ্বকে আমরা মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করি। সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু- জগতের সকল জীব সুখী হোক। ভবতু সব্ব মঙ্গলং- সকলের মঙ্গল লাভ হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়–য়া : সাবেক চেয়ারম্যান পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
No comments