ইসলামী ব্যাংকের গুরুতর সব ঋণ অনিয়ম by মনজুর আহমেদ
ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায়
গুরুতর ঋণ অনিয়ম চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাহাজ তৈরির প্রতিষ্ঠান
আনন্দ শিপইয়ার্ডের আটটি জাহাজ রপ্তানির নিশ্চয়তাপত্র বা গ্যারান্টি দিয়েছিল
এই ব্যাংক।
অথচ একটি জাহাজও রপ্তানি হয়নি।
চুক্তিগুলো বাতিল হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা গ্যারান্টির পুরো অর্থ সুদ-আসলেই নিয়ে গেছে। আর ক্রেতাদের কাছ থেকে যে অর্থ অগ্রিম পাওয়া গিয়েছিল, তা-ও গ্রাহককে হাতিয়ে নেওয়ার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের মালিকদেরই আরেক প্রতিষ্ঠান জেরিনা কম্পোজিট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজও ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে ঋণসীমার বেশি অর্থ তুলে নিয়েছে। এ কোম্পানিতে অবশ্য আনন্দ শিপইয়ার্ডের একাধিক মালিকের শেয়ার ১৯ শতাংশ পর্যন্ত। ১৯ শতাংশে শেয়ার সীমাবদ্ধ রাখার কারণে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুসারে কোম্পানিটিকে আনন্দ শিপইয়ার্ড বা এর মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলা যাচ্ছে না। এ কৌশলের ফলে খেলাপি ঋণের কোনো দায়ও তাঁদের ঘাড়ে এসে পড়বে না।
এ দুই কোম্পানিতে ইসলামী ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণ দায় তৈরি হয়েছে প্রায় পৌনে ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আনন্দ শিপইয়ার্ডের ৪৩৪ কোটি ২২ লাখ টাকা খেলাপি হওয়ার কথা থাকলেও হাইকোর্টের নির্দেশ থাকায় এ অর্থকে খেলাপি বলা যাচ্ছে না। আর জেরিনা কম্পোজিট টেক্সটাইলের বকেয়া প্রায় ১৪০ কোটি টাকা (৩১ মার্চ ভিত্তিতে)।
আনন্দ শিপইয়ার্ডকে বিধি ভেঙে ঋণ দেওয়ার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক, অঞ্চলপ্রধান এবং ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়নকারী হিসেবে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে বলেছে। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরিদউদ্দীন আহমেদও এ অনিয়মের দায় এড়াতে পারেন না বলে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান এমডিকে চিঠি দিয়ে এসব নির্দেশনা দিয়েছে।
ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো বিল্ডট্রেড কালার প্রিন্ট, মার্ক টেরি লিমিটেড, নোডটেক্স ফ্যাশন, আমার দেশ পাবলিকেশন ও সাকিবুন্নাহার বস্ত্রবিতান। এসব ঋণ অনিয়মে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ঋণগুলোকে খেলাপি চিহ্নিত করে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এসব বাস্তবায়ন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতেও বলা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংককে নতুন করে বিপুল অঙ্কের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলে নিট মুনাফা একেবারেই কমে যাবে বলে ব্যাংক সূত্র জানায়।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে গতকাল রোববার বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটা ব্যাখ্যা পাঠাবেন। তিনি আশা করছেন, ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংক সন্তুষ্ট হবে।
আবদুল মান্নান আরও বলেন, তাঁদের বিনিয়োগের বিপরীতে ১০০ ভাগ সম্পদ রয়েছে। সমস্যাটা হয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। তবে আটটির মধ্যে একটি জাহাজ এখন চলছে, একটি ৯৩ ভাগ নির্মাণ শেষ হয়েছে, আরও দুটির ৭৫ ভাগ নির্মাণ শেষ হয়েছে। আর বাকিগুলোর কাঁচামাল হাতে আছে। জাহাজগুলো নির্মাণ শেষ হলে পুরো টাকা ব্যাংকে চলে আসবে।
আনন্দ শিপইয়ার্ড: বিধিমালা লঙ্ঘন করে ইসলামী ব্যাংক আটটি জাহাজ রপ্তানির জন্য আনন্দ শিপইয়ার্ডকে ২৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রায় গ্যারান্টি দিয়েছিল।
জাহাজ রপ্তানির আদেশ বা চুক্তির আগে বিদেশি প্রতিষ্ঠান জাহাজ কেনার জন্য দরপত্র দিয়েছিল কি না অথবা দরপত্রদাতা ওই পণ্যের আমদানিকারক বা ব্যবহারকারী বা ব্যবসায়ী কি না, তা নিশ্চিত না হয়েই ইসলামী ব্যাংক গ্যারান্টি বা বন্ড দেয়। আবার প্রতিষ্ঠানটির ১০টি জাহাজ তৈরির সক্ষমতা আছে কি না, তা-ও বিবেচনা করেনি ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক বৈদেশিক গ্যারান্টি দিলেও পর্যাপ্ত জামানত রাখেনি। ক্রেতাদের পাঠানো অগ্রিম অর্থ আবার গ্রাহককে দিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনো যাচাই-বাছাই বা অগ্রগতি না দেখে। এভাবে অর্থছাড়ের মাধ্যমে আনন্দ শিপইয়ার্ডকে অর্থ হাতিয়ে নিতে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে।
আনন্দ শিপইয়ার্ড আটটি জাহাজের একটিও রপ্তানি করতে পারেনি বলে চুক্তির শর্তানুযায়ী বিদেশি ক্রেতা গ্যারান্টির সব অর্থ কেটে নিয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক আনন্দ শিপইয়ার্ডের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারেনি। অনিয়ম এখানেই শেষ নয়। এরপর ব্যাংক অগ্রিমের অর্থকে অনিয়ম করে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে রূপান্তর করেছে।
যোগাযোগ করা হলে আনন্দ শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ হেল বারী বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে সেই সময় জাহাজগুলোর চালান নিতে ক্রেতা তাদের ব্যাংক থেকে অর্থায়ন পায়নি। তিনি বলেন, ক্রেতারা গ্যারান্টির যে অর্থ নিয়ে গেছে, তা আনন্দ শিপইয়ার্ডের মামলার কারণে রিজার্ভে রয়ে গেছে। এটাও ফেরত নিয়ে আসা যাবে।
আবদুল্লাহ হেল বারী বলেন, তাঁদের পর্যাপ্ত সম্পদ রয়েছে। নির্মিত জাহাজগুলো ‘স্টকলট’ হয়েছে মাত্র। এগুলো একসময় বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে।
আগের ঘটনা: এর আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল ২০১১ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ডের প্রায় ১৫০ কোটি টাকাসহ ইসলামী ব্যাংকের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ বিরূপভাবে শ্রেণীকরণ করে দেয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করে ব্যাংক ও কোম্পানি। অসম্মানজনকভাবে এ ঘটনা নিষ্পত্তি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের তৎকালীন একজন মহাব্যবস্থাপক তাঁর নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি প্রত্যাখ্যান করে পদত্যাগ করেছিলেন।
জেরিনা কম্পোজিট টেক্সটাইল: কোম্পানিটির জন্য ব্যাংকের বিনিয়োগের মঞ্জুরি সীমা ছিল যথাক্রমে ৪০ কোটি ও ২৬ কোটি টাকা। কিন্তু শাখা অনিয়ম করে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ তোলার সুযোগ দিয়েছে। মার্চ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল যথাক্রমে ৯৬ কোটি ৬৭ লাখ ও ৪৩ কোটি ২১ লাখ টাকার ঋণ স্থিতি পেয়েছে।
এ বিষয়ে আবদুল্লাহ হেল বারী বলেন, তাঁদের এ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলটি এখন আস্তে আস্তে না লাভ না লোকসানে (ব্রেক ইভেন) রয়েছে। এখানে বড় লাভ হবে। আগামী বছরেই তিনি আস্তে আস্তে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারবেন।
বিল্ডট্রেড কালার কোট: এ কোম্পানিকেও সীমা অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠিতে বলেছে, বিনিয়োগ হিসাবটিতে মোট বকেয়া ৭২ কোটি পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে সাড়ে ২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা নিম্নমান পর্যায়ে খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার কথা। কিন্তু শাখা মাত্র চার কোটি ৪২ লাখ টাকা নিম্নমান দেখাচ্ছে। শাখা ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে গ্রাহককে বেশি আর্থিক সুবিধা দিয়েছে।
আমার দেশ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আমার দেশ পাবলিকেশনের নামে লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট (এলটিআর) সৃষ্টির সময় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এসময় পণ্য গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা-ও জানাতে পারেনি শাখা। এভাবে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকার এলটিআর সৃষ্টি করা হলেও এতে কোনো মুনাফা নির্ধারণ করা হয়নি। প্রধান কার্যালয়ের মঞ্জুরিপত্রে মুনাফার হার সাড়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দিলেও শাখা মুনাফাসহ মোট দায় হিসাব করেনি। এতে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ দায় কম করা হয়েছে।
এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় সাকিবুন্নাহার বস্ত্রবিতানের হিসাবে কাগুজে লেনদেন দেখিয়ে অর্থ তোলার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চুক্তিগুলো বাতিল হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা গ্যারান্টির পুরো অর্থ সুদ-আসলেই নিয়ে গেছে। আর ক্রেতাদের কাছ থেকে যে অর্থ অগ্রিম পাওয়া গিয়েছিল, তা-ও গ্রাহককে হাতিয়ে নেওয়ার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের মালিকদেরই আরেক প্রতিষ্ঠান জেরিনা কম্পোজিট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজও ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে ঋণসীমার বেশি অর্থ তুলে নিয়েছে। এ কোম্পানিতে অবশ্য আনন্দ শিপইয়ার্ডের একাধিক মালিকের শেয়ার ১৯ শতাংশ পর্যন্ত। ১৯ শতাংশে শেয়ার সীমাবদ্ধ রাখার কারণে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুসারে কোম্পানিটিকে আনন্দ শিপইয়ার্ড বা এর মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলা যাচ্ছে না। এ কৌশলের ফলে খেলাপি ঋণের কোনো দায়ও তাঁদের ঘাড়ে এসে পড়বে না।
এ দুই কোম্পানিতে ইসলামী ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণ দায় তৈরি হয়েছে প্রায় পৌনে ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আনন্দ শিপইয়ার্ডের ৪৩৪ কোটি ২২ লাখ টাকা খেলাপি হওয়ার কথা থাকলেও হাইকোর্টের নির্দেশ থাকায় এ অর্থকে খেলাপি বলা যাচ্ছে না। আর জেরিনা কম্পোজিট টেক্সটাইলের বকেয়া প্রায় ১৪০ কোটি টাকা (৩১ মার্চ ভিত্তিতে)।
আনন্দ শিপইয়ার্ডকে বিধি ভেঙে ঋণ দেওয়ার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক, অঞ্চলপ্রধান এবং ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়নকারী হিসেবে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে বলেছে। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরিদউদ্দীন আহমেদও এ অনিয়মের দায় এড়াতে পারেন না বলে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান এমডিকে চিঠি দিয়ে এসব নির্দেশনা দিয়েছে।
ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো বিল্ডট্রেড কালার প্রিন্ট, মার্ক টেরি লিমিটেড, নোডটেক্স ফ্যাশন, আমার দেশ পাবলিকেশন ও সাকিবুন্নাহার বস্ত্রবিতান। এসব ঋণ অনিয়মে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ঋণগুলোকে খেলাপি চিহ্নিত করে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এসব বাস্তবায়ন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতেও বলা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংককে নতুন করে বিপুল অঙ্কের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলে নিট মুনাফা একেবারেই কমে যাবে বলে ব্যাংক সূত্র জানায়।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে গতকাল রোববার বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটা ব্যাখ্যা পাঠাবেন। তিনি আশা করছেন, ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংক সন্তুষ্ট হবে।
আবদুল মান্নান আরও বলেন, তাঁদের বিনিয়োগের বিপরীতে ১০০ ভাগ সম্পদ রয়েছে। সমস্যাটা হয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। তবে আটটির মধ্যে একটি জাহাজ এখন চলছে, একটি ৯৩ ভাগ নির্মাণ শেষ হয়েছে, আরও দুটির ৭৫ ভাগ নির্মাণ শেষ হয়েছে। আর বাকিগুলোর কাঁচামাল হাতে আছে। জাহাজগুলো নির্মাণ শেষ হলে পুরো টাকা ব্যাংকে চলে আসবে।
আনন্দ শিপইয়ার্ড: বিধিমালা লঙ্ঘন করে ইসলামী ব্যাংক আটটি জাহাজ রপ্তানির জন্য আনন্দ শিপইয়ার্ডকে ২৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রায় গ্যারান্টি দিয়েছিল।
জাহাজ রপ্তানির আদেশ বা চুক্তির আগে বিদেশি প্রতিষ্ঠান জাহাজ কেনার জন্য দরপত্র দিয়েছিল কি না অথবা দরপত্রদাতা ওই পণ্যের আমদানিকারক বা ব্যবহারকারী বা ব্যবসায়ী কি না, তা নিশ্চিত না হয়েই ইসলামী ব্যাংক গ্যারান্টি বা বন্ড দেয়। আবার প্রতিষ্ঠানটির ১০টি জাহাজ তৈরির সক্ষমতা আছে কি না, তা-ও বিবেচনা করেনি ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক বৈদেশিক গ্যারান্টি দিলেও পর্যাপ্ত জামানত রাখেনি। ক্রেতাদের পাঠানো অগ্রিম অর্থ আবার গ্রাহককে দিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনো যাচাই-বাছাই বা অগ্রগতি না দেখে। এভাবে অর্থছাড়ের মাধ্যমে আনন্দ শিপইয়ার্ডকে অর্থ হাতিয়ে নিতে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে।
আনন্দ শিপইয়ার্ড আটটি জাহাজের একটিও রপ্তানি করতে পারেনি বলে চুক্তির শর্তানুযায়ী বিদেশি ক্রেতা গ্যারান্টির সব অর্থ কেটে নিয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক আনন্দ শিপইয়ার্ডের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারেনি। অনিয়ম এখানেই শেষ নয়। এরপর ব্যাংক অগ্রিমের অর্থকে অনিয়ম করে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে রূপান্তর করেছে।
যোগাযোগ করা হলে আনন্দ শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ হেল বারী বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে সেই সময় জাহাজগুলোর চালান নিতে ক্রেতা তাদের ব্যাংক থেকে অর্থায়ন পায়নি। তিনি বলেন, ক্রেতারা গ্যারান্টির যে অর্থ নিয়ে গেছে, তা আনন্দ শিপইয়ার্ডের মামলার কারণে রিজার্ভে রয়ে গেছে। এটাও ফেরত নিয়ে আসা যাবে।
আবদুল্লাহ হেল বারী বলেন, তাঁদের পর্যাপ্ত সম্পদ রয়েছে। নির্মিত জাহাজগুলো ‘স্টকলট’ হয়েছে মাত্র। এগুলো একসময় বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে।
আগের ঘটনা: এর আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল ২০১১ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ডের প্রায় ১৫০ কোটি টাকাসহ ইসলামী ব্যাংকের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ বিরূপভাবে শ্রেণীকরণ করে দেয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করে ব্যাংক ও কোম্পানি। অসম্মানজনকভাবে এ ঘটনা নিষ্পত্তি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের তৎকালীন একজন মহাব্যবস্থাপক তাঁর নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি প্রত্যাখ্যান করে পদত্যাগ করেছিলেন।
জেরিনা কম্পোজিট টেক্সটাইল: কোম্পানিটির জন্য ব্যাংকের বিনিয়োগের মঞ্জুরি সীমা ছিল যথাক্রমে ৪০ কোটি ও ২৬ কোটি টাকা। কিন্তু শাখা অনিয়ম করে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ তোলার সুযোগ দিয়েছে। মার্চ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল যথাক্রমে ৯৬ কোটি ৬৭ লাখ ও ৪৩ কোটি ২১ লাখ টাকার ঋণ স্থিতি পেয়েছে।
এ বিষয়ে আবদুল্লাহ হেল বারী বলেন, তাঁদের এ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলটি এখন আস্তে আস্তে না লাভ না লোকসানে (ব্রেক ইভেন) রয়েছে। এখানে বড় লাভ হবে। আগামী বছরেই তিনি আস্তে আস্তে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারবেন।
বিল্ডট্রেড কালার কোট: এ কোম্পানিকেও সীমা অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠিতে বলেছে, বিনিয়োগ হিসাবটিতে মোট বকেয়া ৭২ কোটি পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে সাড়ে ২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা নিম্নমান পর্যায়ে খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার কথা। কিন্তু শাখা মাত্র চার কোটি ৪২ লাখ টাকা নিম্নমান দেখাচ্ছে। শাখা ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে গ্রাহককে বেশি আর্থিক সুবিধা দিয়েছে।
আমার দেশ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আমার দেশ পাবলিকেশনের নামে লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট (এলটিআর) সৃষ্টির সময় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এসময় পণ্য গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা-ও জানাতে পারেনি শাখা। এভাবে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকার এলটিআর সৃষ্টি করা হলেও এতে কোনো মুনাফা নির্ধারণ করা হয়নি। প্রধান কার্যালয়ের মঞ্জুরিপত্রে মুনাফার হার সাড়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দিলেও শাখা মুনাফাসহ মোট দায় হিসাব করেনি। এতে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ দায় কম করা হয়েছে।
এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় সাকিবুন্নাহার বস্ত্রবিতানের হিসাবে কাগুজে লেনদেন দেখিয়ে অর্থ তোলার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
No comments