মানসম্মত নির্মাণকাজের প্রয়োজনীয়তা by ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া
জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে বাংলাদেশকে ১৬
দফা করণীয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ
ও ভবন নির্মাণের মান নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে।
তাই আমাদের ভবন নির্মাণ ও আগুন নিয়ন্ত্রণ, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক শর্ট
সার্কিট বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের ধারণা থাকা জরুরি। সেটা বুঝতেই আমার এ
লেখা। সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত
সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে ভবনধসে এত বিপুল প্রাণহানির
নজির একমাত্র ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনা ছাড়া আর নেই। এ
দুর্ঘটনায় ১১২৭ জন নিহত এবং জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ২৪৩৮ জনকে। রানা
প্লাজার দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে এখন অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার
অবস্থা।
বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ ভবন কোনো ধরনের ডিজাইন ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। এসব ভবনে যেমন নেই কোনো ডিজাইন, তেমনি ছিল না কোনো সুষ্ঠু তদারকি। নির্মাণ সামগ্রীর মানও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এসব ভবন কোনো একদিন যে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবে, এটাই স্বাভাবিক। একটি ভবন নির্মাণ করতে গেলে অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। সয়েল টেস্ট থেকে শুরু করে ভবনের নকশা, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, ইলেক্ট্রিক্যাল ডিজাইন, প্লাম্বিং ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন প্রভৃতি বিষয় জড়িয়ে থাকে। একটি ভবন নির্মাণের আগে ডিজাইন বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিল্ডিং ডিজাইন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এখনো অনেকে মনে করেন বিল্ডিং ডিজাইন মূলত স্থাপত্য নকশা (Architechtural plan)। একজন স্থপতিকে দিয়ে এই নকশা করিয়ে নেওয়াটাই হলো ডিজাইন। বাকি কাজটা সম্পূর্ণ নির্মাণ শ্রমিকদের। এটা সম্পূর্ণ আত্মঘাতী একটা ধারণা। একজন স্থপতি যেটি করেন সেটি হলো বিল্ডিংয়ের নকশা। বিল্ডিংটি কয় তলা হবে, প্রতি তলায় কয়টি কামরা হবে; বাথরুম, কিচেন, বারান্দার অবস্থান কোথায় হবে, সিঁড়ি কোথায় হবে, পার্কিং সুবিধা থাকবে কি না, থাকলে কতগুলো পার্কিং থাকবে এবং সর্বোপরি বিল্ডিংয়ের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ তথা নান্দনিক সৌন্দর্য কেমন হবে- এ বিষয়গুলো একজন স্থপতি নির্ধারণ করে থাকেন। এরপর আসে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজ। একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যিনি স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজে যথেষ্ট অভিজ্ঞ- স্থপতির করা নকশা নিয়ে ডিজাইন করা শুরু করবেন। কংক্রিটের শক্তিমাত্রা কত হবে, স্লাবের পুরুত্ব কত হবে, স্লাবের ভেতরে কী পরিমাণ রড দিতে হবে, বিম-কলামের আকৃতি কেমন হবে, বিম-কলামের ভেতরে কী পরিমাণ রড দিতে হবে, ফাউন্ডেশন কেমন হবে, পাইলিং লাগবে কি লাগবে না- এ বিষয়গুলো একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার নির্ধারণ করবেন। পাশাপাশি বাতাসের চাপ এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ভবনটি কতটা সক্ষম, এ বিষয়টিও স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ শেষ হওয়ার পর আসে ইলেক্ট্রিক্যাল এবং প্লাম্বিং ইঞ্জিনিয়ারের কাজ। এ ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে বিল্ডিংয়ের বৈদ্যুতিক সার্কিট থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সরবরাহ-সংক্রান্ত সব ডিজাইন করাতে হয়। একই সঙ্গে একজন প্লাম্বিং ইঞ্জিনিয়ার বিল্ডিংয়ের পানি সরবরাহ থেকে শুরু করে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ডিজাইন করবেন। এভাবে একটি বিল্ডিংয়ের সব ডিজাইন সম্পন্ন হওয়ার পর দক্ষ নির্মাণ শ্রমিকদের দিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্মাণ সামগ্রীর গুণগত মান ঠিক আছে কি না, ডিজাইন অনুযায়ী সব কিছু সম্পন্ন হচ্ছে কি না এবং সব বিষয়ে একজন দক্ষ সাইট ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে কি না, এগুলোও বিবেচনার বিষয়।
এগুলো তো হলো নিয়মের কথা। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে একজন স্থপতিকে দিয়ে শুধু নকশা পর্যন্তই করানো হয়ে থাকে। বাকি সব কাজ নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্মাণ শ্রমিকরা তাদের আন্দাজমতো বিম-কলামের আকৃতি নির্ধারণ করেন। সেখানে কি পরিমাণ রড দিতে হবে, কংক্রিট বানাতে কী পরিমাণ সিমেন্ট, বালু, খোয়া এবং পানি লাগবে, এগুলো তাঁরাই নির্ধারণ করে দেন। খুব বেশি হলে সেখানে একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীকে রাখা হয়, যিনি নির্মাণকাজের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে দেন। শুধু বহুতল ভবনগুলো ছাড়া স্বল্প উচ্চতাসম্পন্ন বেশির ভাগ ভবনই এভাবে নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন কোনো স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সহায়তা না নিয়ে কেবল রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে সব কিছু করে ফেলা হয়, ঠিক তেমনি বৈদ্যুতিক লাইনের কাজগুলো একজন ইলেক্ট্রিশিয়ানের মাধ্যমে এবং প্লাম্বিংয়ের বিষয়গুলো একজন স্যানিটারি মিস্ত্রিকে ডেকে করিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে প্রায়ই ভবনধসের মতো ঘটনা থেকে শুরু করে শর্ট সার্কিট থেকে অগি্নকাণ্ড এবং সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো কেন নিয়ম অনুযায়ী ভবনগুলো নির্মাণ করা হয় না? এর পেছনে অনেক সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। তবে ভবন মালিকদের ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে ডিজাইন করাতে না চাওয়ার প্রবণতাই মুখ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি ভুল ধারণা বিদ্যমান যে বিল্ডিং বোধ হয় মিস্ত্রিকে দিয়েই তৈরি করে ফেলা যায়। প্রকৌশলীকে দিয়ে ডিজাইন করানো বা তাঁর সহায়তা নেওয়াটাকে অনেকেই বাড়তি খরচ বলে মনে করেন। একজন ভবন মালিক দুই কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করতে পারেন, অথচ তিনি দুই লাখ টাকা ডিজাইনের জন্য খরচ করতে চান না। এর থেকেও দুঃখজনক ব্যাপার হলো মাত্র ২০ হাজার টাকা খরচ করে মাটি পরীক্ষা করাতে না চাওয়া। অনেকেই বলে থাকেন, 'আমার জমির মাটি ভালো। সয়েল টেস্ট করানোর প্রয়োজন নেই।' অথচ সয়েল রিপোর্ট না পেলে একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন ডিজাইন করতে পারেন না- এই সহজ ব্যাপারটি ভবনের মালিক বুঝতে চান না।
ভবনের প্রকৌশলগত কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার। প্রথমেই দেখতে হবে যে ওই জায়গার মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে কি না। না হয়ে থাকলে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে। আর হয়ে থাকলে রিপোর্টটি সংগ্রহ করে তারপর ডিজাইনের কাজ শুরু করতে হবে। ডিজাইনের আগে যে বিষয়টি অবশ্যই জেনে নেওয়া দরকার, তা হলো কর্তৃপক্ষ কত তলা পর্যন্ত অনুমোদন দিয়েছে এবং ভবনটির ব্যবহার কী ধরনের হবে। অর্থাৎ ভবনটি কি শুধুই আবাসিক ভবন হবে, নাকি ভবিষ্যতে এটি স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট বা কারখানার গুদাম হিসেবেও ব্যবহৃত হবে- এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, প্রায়ই দেখা যায় আবাসিক হিসেবে নির্মিত ভবনটি অন্যভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায়ও এ বিষয়টি অনেকাংশে দায়ী। ভবনটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হলেও এখানে বেশ কিছু গার্মেন্ট কারখানা ছিল এবং এর ফলে প্রচুর লোক সমাগম হতো। এখানে অনেক ভারী যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছিল, যেগুলোর ভার বহন করার সামর্থ্য ভবনটির ছিল না। কাজেই ভবন মালিকদের এ বিষয়টি অবগত থাকা প্রয়োজন যে তাঁর ভবনটি প্রকৃতপক্ষে কিভাবে ব্যবহারের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে এবং অতিরিক্ত ভাড়া পাওয়ার আশায় তিনি যেন সেটিকে অন্যভাবে ব্যবহার না করেন।
ভবন নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে কংক্রিটের মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এটি হলো ভবন নির্মাণের সবচেয়ে জটিল একটি উপাদান, যার চরিত্র অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। কাজেই নির্মাণকাজের প্রতিটি ধাপে কংক্রিটের মান বজায় রাখা অপরিহার্য। হিসাব করে দেখা গেছে যে একটি কলামের বেলায় কংক্রিট শতকরা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভার নিয়ে থাকে। অন্যদিকে কংক্রিটের মাঝে স্টিলের রডগুলো সঠিকভাবে প্রোথিত থাকলে বাকি ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ভার রডগুলো বহন করতে সক্ষম হয়। অতএব বলা যেতে পারে, আরসিসি ভবনের বেলায় গরিষ্ঠভাগ ভার কংক্রিটই নিয়ে থাকে। সুতরাং কংক্রিটের মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যাবশ্যক। কংক্রিটে সিমেন্ট, বালু, খোয়া এবং পানির অনুপাত কেমন হবে, তা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার নির্ধারণ করে দেবেন এবং সাইটে এই অনুপাত মেনে কংক্রিট বানানো হচ্ছে কি না ও ঢালাইয়ের সময় সূক্ষ্ম ভুলত্রুটিগুলো এড়ানো সম্ভব হচ্ছে কি না তা যথাযথভাবে লক্ষ রাখতে হবে। ঢালাই করার পর কংক্রিট অবশ্যই সঠিকভাবে কমপ্যাক্ট করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভাইব্রেটর ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া কংক্রিট ঢালাইয়ের পর তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এটাকে প্রকৌশলগত পরিভাষায় বলা হয় কিউরিং করা। এগুলো প্রতিটি বিষয় কংক্রিটের পূর্ণ শক্তি অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যক। আমাদের দেশে যেসব সিমেন্ট প্রস্তুত হয়, তা অত্যন্ত গুণগত মানসম্পন্ন। এসব সিমেন্ট দিয়ে অনায়াসে তিন হাজার পিএসআই থেকে শুরু করে ৪৫০০ পিএসআই শক্তিমাত্রার কংক্রিট প্রস্তুত করা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত রডও অত্যন্ত উচ্চমানসম্পন্ন। কাজেই রডের ব্যাপারেও খুব বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে রড ঠিকমতো বাঁধা হচ্ছে কি না, বিমের রডগুলো সঠিকভাবে এবং নির্দেশিত জায়গায় কাটা হচ্ছে কি না, যেসব জায়গায় রড বাঁকানো হয়ে থাকে, সেসব জায়গায় ঠিকমতো বাঁকিয়ে স্থান করা হচ্ছে কি না এবং কংক্রিটের বাইরের পৃষ্ঠ থেকে রডের সঠিক ক্লিয়ার কভার বজায় থাকছে কি না, এ বিষয়গুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, শুধু কংক্রিট দিয়ে যেমন ভবন নির্মিত হয় না, ঠিক তেমনি শুধু রড দিয়ে ভবনের স্থায়িত্ব বাড়ানো যায় না। এই দুটো পদার্থের সঠিক এবং নিয়মতান্ত্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমেই কেবল একটি মানসম্মত নির্মাণকাজ সম্ভব হতে পারে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)।
বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ ভবন কোনো ধরনের ডিজাইন ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। এসব ভবনে যেমন নেই কোনো ডিজাইন, তেমনি ছিল না কোনো সুষ্ঠু তদারকি। নির্মাণ সামগ্রীর মানও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এসব ভবন কোনো একদিন যে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবে, এটাই স্বাভাবিক। একটি ভবন নির্মাণ করতে গেলে অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। সয়েল টেস্ট থেকে শুরু করে ভবনের নকশা, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, ইলেক্ট্রিক্যাল ডিজাইন, প্লাম্বিং ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন প্রভৃতি বিষয় জড়িয়ে থাকে। একটি ভবন নির্মাণের আগে ডিজাইন বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিল্ডিং ডিজাইন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এখনো অনেকে মনে করেন বিল্ডিং ডিজাইন মূলত স্থাপত্য নকশা (Architechtural plan)। একজন স্থপতিকে দিয়ে এই নকশা করিয়ে নেওয়াটাই হলো ডিজাইন। বাকি কাজটা সম্পূর্ণ নির্মাণ শ্রমিকদের। এটা সম্পূর্ণ আত্মঘাতী একটা ধারণা। একজন স্থপতি যেটি করেন সেটি হলো বিল্ডিংয়ের নকশা। বিল্ডিংটি কয় তলা হবে, প্রতি তলায় কয়টি কামরা হবে; বাথরুম, কিচেন, বারান্দার অবস্থান কোথায় হবে, সিঁড়ি কোথায় হবে, পার্কিং সুবিধা থাকবে কি না, থাকলে কতগুলো পার্কিং থাকবে এবং সর্বোপরি বিল্ডিংয়ের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ তথা নান্দনিক সৌন্দর্য কেমন হবে- এ বিষয়গুলো একজন স্থপতি নির্ধারণ করে থাকেন। এরপর আসে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজ। একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, যিনি স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজে যথেষ্ট অভিজ্ঞ- স্থপতির করা নকশা নিয়ে ডিজাইন করা শুরু করবেন। কংক্রিটের শক্তিমাত্রা কত হবে, স্লাবের পুরুত্ব কত হবে, স্লাবের ভেতরে কী পরিমাণ রড দিতে হবে, বিম-কলামের আকৃতি কেমন হবে, বিম-কলামের ভেতরে কী পরিমাণ রড দিতে হবে, ফাউন্ডেশন কেমন হবে, পাইলিং লাগবে কি লাগবে না- এ বিষয়গুলো একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার নির্ধারণ করবেন। পাশাপাশি বাতাসের চাপ এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ভবনটি কতটা সক্ষম, এ বিষয়টিও স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ শেষ হওয়ার পর আসে ইলেক্ট্রিক্যাল এবং প্লাম্বিং ইঞ্জিনিয়ারের কাজ। এ ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে বিল্ডিংয়ের বৈদ্যুতিক সার্কিট থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সরবরাহ-সংক্রান্ত সব ডিজাইন করাতে হয়। একই সঙ্গে একজন প্লাম্বিং ইঞ্জিনিয়ার বিল্ডিংয়ের পানি সরবরাহ থেকে শুরু করে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ডিজাইন করবেন। এভাবে একটি বিল্ডিংয়ের সব ডিজাইন সম্পন্ন হওয়ার পর দক্ষ নির্মাণ শ্রমিকদের দিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্মাণ সামগ্রীর গুণগত মান ঠিক আছে কি না, ডিজাইন অনুযায়ী সব কিছু সম্পন্ন হচ্ছে কি না এবং সব বিষয়ে একজন দক্ষ সাইট ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে কি না, এগুলোও বিবেচনার বিষয়।
এগুলো তো হলো নিয়মের কথা। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে একজন স্থপতিকে দিয়ে শুধু নকশা পর্যন্তই করানো হয়ে থাকে। বাকি সব কাজ নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্মাণ শ্রমিকরা তাদের আন্দাজমতো বিম-কলামের আকৃতি নির্ধারণ করেন। সেখানে কি পরিমাণ রড দিতে হবে, কংক্রিট বানাতে কী পরিমাণ সিমেন্ট, বালু, খোয়া এবং পানি লাগবে, এগুলো তাঁরাই নির্ধারণ করে দেন। খুব বেশি হলে সেখানে একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীকে রাখা হয়, যিনি নির্মাণকাজের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে দেন। শুধু বহুতল ভবনগুলো ছাড়া স্বল্প উচ্চতাসম্পন্ন বেশির ভাগ ভবনই এভাবে নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন কোনো স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সহায়তা না নিয়ে কেবল রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে সব কিছু করে ফেলা হয়, ঠিক তেমনি বৈদ্যুতিক লাইনের কাজগুলো একজন ইলেক্ট্রিশিয়ানের মাধ্যমে এবং প্লাম্বিংয়ের বিষয়গুলো একজন স্যানিটারি মিস্ত্রিকে ডেকে করিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে প্রায়ই ভবনধসের মতো ঘটনা থেকে শুরু করে শর্ট সার্কিট থেকে অগি্নকাণ্ড এবং সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো কেন নিয়ম অনুযায়ী ভবনগুলো নির্মাণ করা হয় না? এর পেছনে অনেক সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। তবে ভবন মালিকদের ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে ডিজাইন করাতে না চাওয়ার প্রবণতাই মুখ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি ভুল ধারণা বিদ্যমান যে বিল্ডিং বোধ হয় মিস্ত্রিকে দিয়েই তৈরি করে ফেলা যায়। প্রকৌশলীকে দিয়ে ডিজাইন করানো বা তাঁর সহায়তা নেওয়াটাকে অনেকেই বাড়তি খরচ বলে মনে করেন। একজন ভবন মালিক দুই কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করতে পারেন, অথচ তিনি দুই লাখ টাকা ডিজাইনের জন্য খরচ করতে চান না। এর থেকেও দুঃখজনক ব্যাপার হলো মাত্র ২০ হাজার টাকা খরচ করে মাটি পরীক্ষা করাতে না চাওয়া। অনেকেই বলে থাকেন, 'আমার জমির মাটি ভালো। সয়েল টেস্ট করানোর প্রয়োজন নেই।' অথচ সয়েল রিপোর্ট না পেলে একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন ডিজাইন করতে পারেন না- এই সহজ ব্যাপারটি ভবনের মালিক বুঝতে চান না।
ভবনের প্রকৌশলগত কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার। প্রথমেই দেখতে হবে যে ওই জায়গার মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে কি না। না হয়ে থাকলে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে। আর হয়ে থাকলে রিপোর্টটি সংগ্রহ করে তারপর ডিজাইনের কাজ শুরু করতে হবে। ডিজাইনের আগে যে বিষয়টি অবশ্যই জেনে নেওয়া দরকার, তা হলো কর্তৃপক্ষ কত তলা পর্যন্ত অনুমোদন দিয়েছে এবং ভবনটির ব্যবহার কী ধরনের হবে। অর্থাৎ ভবনটি কি শুধুই আবাসিক ভবন হবে, নাকি ভবিষ্যতে এটি স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট বা কারখানার গুদাম হিসেবেও ব্যবহৃত হবে- এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, প্রায়ই দেখা যায় আবাসিক হিসেবে নির্মিত ভবনটি অন্যভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায়ও এ বিষয়টি অনেকাংশে দায়ী। ভবনটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হলেও এখানে বেশ কিছু গার্মেন্ট কারখানা ছিল এবং এর ফলে প্রচুর লোক সমাগম হতো। এখানে অনেক ভারী যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছিল, যেগুলোর ভার বহন করার সামর্থ্য ভবনটির ছিল না। কাজেই ভবন মালিকদের এ বিষয়টি অবগত থাকা প্রয়োজন যে তাঁর ভবনটি প্রকৃতপক্ষে কিভাবে ব্যবহারের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে এবং অতিরিক্ত ভাড়া পাওয়ার আশায় তিনি যেন সেটিকে অন্যভাবে ব্যবহার না করেন।
ভবন নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে কংক্রিটের মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এটি হলো ভবন নির্মাণের সবচেয়ে জটিল একটি উপাদান, যার চরিত্র অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। কাজেই নির্মাণকাজের প্রতিটি ধাপে কংক্রিটের মান বজায় রাখা অপরিহার্য। হিসাব করে দেখা গেছে যে একটি কলামের বেলায় কংক্রিট শতকরা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভার নিয়ে থাকে। অন্যদিকে কংক্রিটের মাঝে স্টিলের রডগুলো সঠিকভাবে প্রোথিত থাকলে বাকি ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ভার রডগুলো বহন করতে সক্ষম হয়। অতএব বলা যেতে পারে, আরসিসি ভবনের বেলায় গরিষ্ঠভাগ ভার কংক্রিটই নিয়ে থাকে। সুতরাং কংক্রিটের মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যাবশ্যক। কংক্রিটে সিমেন্ট, বালু, খোয়া এবং পানির অনুপাত কেমন হবে, তা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার নির্ধারণ করে দেবেন এবং সাইটে এই অনুপাত মেনে কংক্রিট বানানো হচ্ছে কি না ও ঢালাইয়ের সময় সূক্ষ্ম ভুলত্রুটিগুলো এড়ানো সম্ভব হচ্ছে কি না তা যথাযথভাবে লক্ষ রাখতে হবে। ঢালাই করার পর কংক্রিট অবশ্যই সঠিকভাবে কমপ্যাক্ট করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভাইব্রেটর ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া কংক্রিট ঢালাইয়ের পর তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এটাকে প্রকৌশলগত পরিভাষায় বলা হয় কিউরিং করা। এগুলো প্রতিটি বিষয় কংক্রিটের পূর্ণ শক্তি অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যক। আমাদের দেশে যেসব সিমেন্ট প্রস্তুত হয়, তা অত্যন্ত গুণগত মানসম্পন্ন। এসব সিমেন্ট দিয়ে অনায়াসে তিন হাজার পিএসআই থেকে শুরু করে ৪৫০০ পিএসআই শক্তিমাত্রার কংক্রিট প্রস্তুত করা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত রডও অত্যন্ত উচ্চমানসম্পন্ন। কাজেই রডের ব্যাপারেও খুব বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে রড ঠিকমতো বাঁধা হচ্ছে কি না, বিমের রডগুলো সঠিকভাবে এবং নির্দেশিত জায়গায় কাটা হচ্ছে কি না, যেসব জায়গায় রড বাঁকানো হয়ে থাকে, সেসব জায়গায় ঠিকমতো বাঁকিয়ে স্থান করা হচ্ছে কি না এবং কংক্রিটের বাইরের পৃষ্ঠ থেকে রডের সঠিক ক্লিয়ার কভার বজায় থাকছে কি না, এ বিষয়গুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, শুধু কংক্রিট দিয়ে যেমন ভবন নির্মিত হয় না, ঠিক তেমনি শুধু রড দিয়ে ভবনের স্থায়িত্ব বাড়ানো যায় না। এই দুটো পদার্থের সঠিক এবং নিয়মতান্ত্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমেই কেবল একটি মানসম্মত নির্মাণকাজ সম্ভব হতে পারে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)।
No comments