জয়-পরাজয় থেকে উভয়কেই শিক্ষা নিতে হবে by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি
দলের জনপ্রিয় প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও
শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে জনগণকে তাৎক্ষণিকভাবে
অভিনন্দন জানানো হয়; অভিনন্দন জানানো হয় নবনির্বাচিত মেয়রদেরও। কিন্তু এখন
প্রধানমন্ত্রী নতুন কথা বলছেন- মানুষ চোর-ডাকাতদের ভোট দিয়েছে। যারা
নির্বাচিত হয়েছে, তারা দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী বলে গাল-মন্দ করছেন। এমন
কথা বলে প্রধানমন্ত্রী জনমতের প্রতি সম্মান দেখাননি। তার এ কথায় মানুষ কষ্ট
পাবে, ক্ষুব্ধ হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ এমন কথা কেন বলছেন? এসব বলার উদ্দেশ্য হল, তার দলের নেতাকর্মীদের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। কারণ এ পরাজয় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সর্বস্তরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কেন দলের জনপ্রিয় মেয়র প্রার্থীরা এভাবে গোহারা হারলেন, এর জন্য কারা দায়ী- এসবই এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নিত্যদিনের আলোচনা। এ আলোচনা থেকেই হারের কারণ বেরিয়ে আসছে। বলাবলি হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিপজ্জনক খেলা ও সবকিছুতে তালগোল পাকিয়ে ফেলার কারণেই সিটি নির্বাচনে দলের জনপ্রিয় প্রার্থীরা এমন শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছেন।
জাতীয় রাজনীতির প্রভাবেই যদি পাঁচ মেয়র প্রার্থী হেরে থাকেন, তাহলে এর দায় প্রধানমন্ত্রী এড়াতে পারেন না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়; তার ইচ্ছার বাইরে রাজনীতিতে কোনো কিছু ঘটার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। হেফাজতের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানোর একটি ঘটনাই চূড়ান্তভাবে জাতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। গভীর রাতের বিভীষিকাময় ও নারকীয় এ ঘটনা সারাদেশের মানুষকে স্তম্ভিত ও হতবাক করেছে। এখানে কত নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরেছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে- সর্বত্রই এ আলোচনা। এমন বৈরী পরিবেশে কোনো নির্বাচনে জয়লাভ করা অকল্পনীয় ব্যাপার। রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো ভাষায় এ পরিবেশকে নির্বাচনের জন্য অনকূল বলা নিঃসন্দেহে বোকামি। সুতরাং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের চুলচেরা কারণ অনুসন্ধান করলে এর দায় ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের ওপরই বর্তাবে।
এ সরকারের আমলে জনগণ বিভিন্নভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। শেয়ার মার্কেট থেকে কারসাজির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এ টাকা এ দেশের গ্রাম-গঞ্জ ও মফস্বল শহরের অতি সাধারণ মানুষের। ৩৫ লাখ পরিবারের প্রায় দেড় কোটি মানুষ শেয়ার মার্কেটে নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কি জীবন থাকতে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? আর্থিক ক্ষতি কি মানুষ সহজে ভুলতে পারে? এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমেও লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল দিতে দিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। উল্লেখ্য, এক ঘোর আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ী কয়েক দিন আগে আমাকে জানালেন, তার বাসার বিদ্যুৎ বিল আগে আসত ২০০০ টাকা, এখন চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে আসে ৮০০০ হাজার টাকা। এ মাত্রাতিরিক্ত বিলের জন্য তিনি বর্তমান সরকারকেই দায়ী করছেন। অন্যদিকে কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু না হওয়ার দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না। হলমার্কের হাজার কোটি টাকা লুটপাটের দায়ও জনগণ মনে করে সরকারের। এসব মোটা দাগের ব্যর্থতা ও কেলেংকারি নিয়ে ভোটের রাজনীতিতে কীভাবে এগিয়ে থাকা যায়, এটি বোধগম্য নয়। এ ধরনের ব্যর্থতা ও কেলেংকারি নিয়েই তো চারদলীয় জোট সরকার জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তাহলে বর্তমান সরকার কী করে জনগণের রায় প্রত্যাশা করে? জনগণের রায় পেতে হলে তাদের মনজয় করতে হবে। উল্টাপাল্টা কথা বললে জনগণ আরও ক্ষুব্ধ হবে। তখন এই বিক্ষুব্ধ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। একদিকে মানুষের কাছে ভুল সংশোধনের সুযোগ চাওয়া অন্যদিকে জনগণের ওপর দোষারোপ করা রাজনীতিকদের জন্য কি শোভনীয়? পরাজয়ের জন্য জনগণের ওপর দোষারোপ না করে নিজেদের ব্যর্থতা খুঁজে বের করতে হবে; নিজেদের সংশোধন হতে হবে। তাহলেই কেবল সামনে সম্ভাবনা তৈরি হবে। মানুষ ক্ষমতাসীনদের নতুন চোখে দেখবে।
বলাবাহুল্য, মিডিয়াবান্ধব মানুষ গণমাধ্যমের ওপর দমননীতিও ভালোভাবে নেয়নি। কয়েকটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে সরকার মানুষের বিরাগবাজন হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হাত দিয়ে সরকার চরম ভুল করেছে। গণতন্ত্রের লেবাসধারী কোনো সরকার গণমাধ্যমের সঙ্গে এমন বৈরী আচরণ করতে পারে না। এর ফল সরকার ভোটের রাজনীতিতে পাচ্ছে। জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে- এটি হয়তো সরকার ভুলে গিয়েছিল। এখন গণেশ উল্টে যাওয়ায় তাদের বোধোদয় হতে শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষনেতারা জনগণকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘আমাদের ভুল সংশোধনের সুযোগ দিন।’ কিন্তু তার আগে গণমাধ্যমের ওপর দমননীতি বন্ধ করতে হবে। সম্প্রচার আটকে রাখা ও বন্ধ টিভি চ্যানেল পুনরায় সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পত্রিকা প্রকাশের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে গণমাধ্যমের বিরাগভাজন হওয়া আর নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা সমান কথা।
অন্যদিকে বিরোধী দলের এ জয়ে আনন্দের কিছু নেই। রাজনৈতিকভাবে এ জয়ের তাৎপর্য তেমন নেই। এ জয় কেবল সরকারের ব্যর্থতার ফসল, ব্যর্থতা দূর করতে পারলে সামনে ভোটের ফল ভিন্নও হতে পারে। আর পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরেছে বলে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের ভবিষ্যৎ সব সম্ভাবনা উবে গেছে- এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। প্রতিকূলতা কাটিয়ে, যথাসময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো দল আওয়ামী লীগ- এটি ভেবেই বিএনপিকে পথ চলতে হবে। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, যে কোনো সম্ভাবনা ধূলিসাৎ করে দেয়ার যথেষ্ট কারণ বিএনপির অভ্যন্তরে বিদ্যমান আছে। তাই বিজয়ের আনন্দে গা না ভাসিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। বিএনপির ভেতরের সব বিভেদরেখা মুছে ফেলতে হবে, বহিষ্কৃত ও নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের দলের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। নয়তো সামনে বিএনপির জন্য অনিবার্য চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
অন্যান্য দাবি নিয়ে জনমনে দ্বিমত থাকলেও নির্দলীয় সরকারের দাবি বিরোধী দলের নিরেট গণতান্ত্রিক দাবি। এ দাবির প্রতি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, যে দাবির প্রতি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে, সে দাবিতে সরকারের টনক নড়ছে না কেন; এটি বিএনপিকে আগে ভাবতে হবে। রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ ছাড়া অধিকার আদায় অসম্ভব- এ নির্মোহ সত্যটি বিরোধী দলকে উপলব্ধি করতে হবে। অধিকার আদায়ে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সব মেশিনারি সক্রিয় করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সরকারকে বড় ধরনের কোনো চাপে ফেলতে পারেনি। এর জন্য দায়ী বিএনপি নিজেই। বিএনপিতে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক, জনবিচ্ছিন্ন, নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিরা ঢুকে পড়েছে; তাই এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেন না।
লক্ষণীয়, ১/১১’র দখল ও নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর বিএনপি পুনর্গঠনে জোরেশোরে হাত দেয়া হয়। ২০০৯ সালে জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির কাউন্সিল। ওই কাউন্সিল থেকে দুুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে খুব বড় পরিসরে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। জনশ্র“তি আছে, ৩৮৬ সদস্যের এ কমিটির ৯৫ ভাগ সদস্যই নিষ্ক্রিয়। জাতীয় রাজনীতির কোনো দৃশ্যপটে তাদের পদচারণা পরিলক্ষিত হয় না, এমনকি দলীয় চেয়ারপারসনকে বর্তমান সরকার কর্তৃক তার বাড়ি থেকে জোর করে উচ্ছেদের সময়ও একটা মিছিল পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। তারা পদ-পদবি নিয়ে বীরের বেশে ঘরে বসে আছেন এবং অন্তহীন আশায় বুক বেঁধে আছেন বিএনপি ক্ষমতায় যাবে আর তারা লোভনীয় রাষ্ট্রীয় পদ পেয়ে বসে যাবেন চেয়ারে।
অরাজনৈতিক ও জনবিচ্ছিন্ন মানুষ দিয়ে আর যাই হোক রাজনীতি হয় না। বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হতে হবে। সাহসী ও রাজনৈতিক ভাবাপন্ন সংগঠকদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে নিজের দলকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। নয়তো পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণ যে অভূতপূর্ব শক্তি বিএনপিকে জুগিয়েছে তা ম্লান হয়ে যাবে।
শোনা যাচ্ছে, ঈদের পর নাকি বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। ওই কাউন্সিলে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে এমন যুগোপযোগী নেতৃত্বকে সামনে আনা প্রয়োজন বলে বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীরা মনে করেন। দেশে এখন উগ্র রাজনীতির আস্ফালন চলছে। এখন সুযোগ হয়েছে বিএনপির উদার ও মধ্যপন্থী রাজনীতি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার। সুযোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে নিজের পরিচয় ফুটিয়ে তোলার। আশা করি বিএনপি নেতৃত্ব বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন এবং সেভাবে নিজেদের তৈরি করবেন। যাতে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিজয়কে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে সামনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ এমন কথা কেন বলছেন? এসব বলার উদ্দেশ্য হল, তার দলের নেতাকর্মীদের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। কারণ এ পরাজয় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সর্বস্তরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কেন দলের জনপ্রিয় মেয়র প্রার্থীরা এভাবে গোহারা হারলেন, এর জন্য কারা দায়ী- এসবই এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নিত্যদিনের আলোচনা। এ আলোচনা থেকেই হারের কারণ বেরিয়ে আসছে। বলাবলি হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিপজ্জনক খেলা ও সবকিছুতে তালগোল পাকিয়ে ফেলার কারণেই সিটি নির্বাচনে দলের জনপ্রিয় প্রার্থীরা এমন শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছেন।
জাতীয় রাজনীতির প্রভাবেই যদি পাঁচ মেয়র প্রার্থী হেরে থাকেন, তাহলে এর দায় প্রধানমন্ত্রী এড়াতে পারেন না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়; তার ইচ্ছার বাইরে রাজনীতিতে কোনো কিছু ঘটার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। হেফাজতের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানোর একটি ঘটনাই চূড়ান্তভাবে জাতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। গভীর রাতের বিভীষিকাময় ও নারকীয় এ ঘটনা সারাদেশের মানুষকে স্তম্ভিত ও হতবাক করেছে। এখানে কত নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরেছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে- সর্বত্রই এ আলোচনা। এমন বৈরী পরিবেশে কোনো নির্বাচনে জয়লাভ করা অকল্পনীয় ব্যাপার। রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো ভাষায় এ পরিবেশকে নির্বাচনের জন্য অনকূল বলা নিঃসন্দেহে বোকামি। সুতরাং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের চুলচেরা কারণ অনুসন্ধান করলে এর দায় ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের ওপরই বর্তাবে।
এ সরকারের আমলে জনগণ বিভিন্নভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। শেয়ার মার্কেট থেকে কারসাজির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এ টাকা এ দেশের গ্রাম-গঞ্জ ও মফস্বল শহরের অতি সাধারণ মানুষের। ৩৫ লাখ পরিবারের প্রায় দেড় কোটি মানুষ শেয়ার মার্কেটে নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কি জীবন থাকতে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? আর্থিক ক্ষতি কি মানুষ সহজে ভুলতে পারে? এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমেও লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল দিতে দিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। উল্লেখ্য, এক ঘোর আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ী কয়েক দিন আগে আমাকে জানালেন, তার বাসার বিদ্যুৎ বিল আগে আসত ২০০০ টাকা, এখন চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে আসে ৮০০০ হাজার টাকা। এ মাত্রাতিরিক্ত বিলের জন্য তিনি বর্তমান সরকারকেই দায়ী করছেন। অন্যদিকে কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু না হওয়ার দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না। হলমার্কের হাজার কোটি টাকা লুটপাটের দায়ও জনগণ মনে করে সরকারের। এসব মোটা দাগের ব্যর্থতা ও কেলেংকারি নিয়ে ভোটের রাজনীতিতে কীভাবে এগিয়ে থাকা যায়, এটি বোধগম্য নয়। এ ধরনের ব্যর্থতা ও কেলেংকারি নিয়েই তো চারদলীয় জোট সরকার জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তাহলে বর্তমান সরকার কী করে জনগণের রায় প্রত্যাশা করে? জনগণের রায় পেতে হলে তাদের মনজয় করতে হবে। উল্টাপাল্টা কথা বললে জনগণ আরও ক্ষুব্ধ হবে। তখন এই বিক্ষুব্ধ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। একদিকে মানুষের কাছে ভুল সংশোধনের সুযোগ চাওয়া অন্যদিকে জনগণের ওপর দোষারোপ করা রাজনীতিকদের জন্য কি শোভনীয়? পরাজয়ের জন্য জনগণের ওপর দোষারোপ না করে নিজেদের ব্যর্থতা খুঁজে বের করতে হবে; নিজেদের সংশোধন হতে হবে। তাহলেই কেবল সামনে সম্ভাবনা তৈরি হবে। মানুষ ক্ষমতাসীনদের নতুন চোখে দেখবে।
বলাবাহুল্য, মিডিয়াবান্ধব মানুষ গণমাধ্যমের ওপর দমননীতিও ভালোভাবে নেয়নি। কয়েকটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে সরকার মানুষের বিরাগবাজন হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হাত দিয়ে সরকার চরম ভুল করেছে। গণতন্ত্রের লেবাসধারী কোনো সরকার গণমাধ্যমের সঙ্গে এমন বৈরী আচরণ করতে পারে না। এর ফল সরকার ভোটের রাজনীতিতে পাচ্ছে। জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে- এটি হয়তো সরকার ভুলে গিয়েছিল। এখন গণেশ উল্টে যাওয়ায় তাদের বোধোদয় হতে শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষনেতারা জনগণকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘আমাদের ভুল সংশোধনের সুযোগ দিন।’ কিন্তু তার আগে গণমাধ্যমের ওপর দমননীতি বন্ধ করতে হবে। সম্প্রচার আটকে রাখা ও বন্ধ টিভি চ্যানেল পুনরায় সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পত্রিকা প্রকাশের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে গণমাধ্যমের বিরাগভাজন হওয়া আর নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা সমান কথা।
অন্যদিকে বিরোধী দলের এ জয়ে আনন্দের কিছু নেই। রাজনৈতিকভাবে এ জয়ের তাৎপর্য তেমন নেই। এ জয় কেবল সরকারের ব্যর্থতার ফসল, ব্যর্থতা দূর করতে পারলে সামনে ভোটের ফল ভিন্নও হতে পারে। আর পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরেছে বলে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের ভবিষ্যৎ সব সম্ভাবনা উবে গেছে- এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। প্রতিকূলতা কাটিয়ে, যথাসময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো দল আওয়ামী লীগ- এটি ভেবেই বিএনপিকে পথ চলতে হবে। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, যে কোনো সম্ভাবনা ধূলিসাৎ করে দেয়ার যথেষ্ট কারণ বিএনপির অভ্যন্তরে বিদ্যমান আছে। তাই বিজয়ের আনন্দে গা না ভাসিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। বিএনপির ভেতরের সব বিভেদরেখা মুছে ফেলতে হবে, বহিষ্কৃত ও নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের দলের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। নয়তো সামনে বিএনপির জন্য অনিবার্য চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
অন্যান্য দাবি নিয়ে জনমনে দ্বিমত থাকলেও নির্দলীয় সরকারের দাবি বিরোধী দলের নিরেট গণতান্ত্রিক দাবি। এ দাবির প্রতি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, যে দাবির প্রতি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে, সে দাবিতে সরকারের টনক নড়ছে না কেন; এটি বিএনপিকে আগে ভাবতে হবে। রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ ছাড়া অধিকার আদায় অসম্ভব- এ নির্মোহ সত্যটি বিরোধী দলকে উপলব্ধি করতে হবে। অধিকার আদায়ে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সব মেশিনারি সক্রিয় করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সরকারকে বড় ধরনের কোনো চাপে ফেলতে পারেনি। এর জন্য দায়ী বিএনপি নিজেই। বিএনপিতে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক, জনবিচ্ছিন্ন, নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিরা ঢুকে পড়েছে; তাই এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেন না।
লক্ষণীয়, ১/১১’র দখল ও নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর বিএনপি পুনর্গঠনে জোরেশোরে হাত দেয়া হয়। ২০০৯ সালে জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির কাউন্সিল। ওই কাউন্সিল থেকে দুুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে খুব বড় পরিসরে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। জনশ্র“তি আছে, ৩৮৬ সদস্যের এ কমিটির ৯৫ ভাগ সদস্যই নিষ্ক্রিয়। জাতীয় রাজনীতির কোনো দৃশ্যপটে তাদের পদচারণা পরিলক্ষিত হয় না, এমনকি দলীয় চেয়ারপারসনকে বর্তমান সরকার কর্তৃক তার বাড়ি থেকে জোর করে উচ্ছেদের সময়ও একটা মিছিল পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। তারা পদ-পদবি নিয়ে বীরের বেশে ঘরে বসে আছেন এবং অন্তহীন আশায় বুক বেঁধে আছেন বিএনপি ক্ষমতায় যাবে আর তারা লোভনীয় রাষ্ট্রীয় পদ পেয়ে বসে যাবেন চেয়ারে।
অরাজনৈতিক ও জনবিচ্ছিন্ন মানুষ দিয়ে আর যাই হোক রাজনীতি হয় না। বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হতে হবে। সাহসী ও রাজনৈতিক ভাবাপন্ন সংগঠকদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে নিজের দলকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। নয়তো পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণ যে অভূতপূর্ব শক্তি বিএনপিকে জুগিয়েছে তা ম্লান হয়ে যাবে।
শোনা যাচ্ছে, ঈদের পর নাকি বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। ওই কাউন্সিলে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে এমন যুগোপযোগী নেতৃত্বকে সামনে আনা প্রয়োজন বলে বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীরা মনে করেন। দেশে এখন উগ্র রাজনীতির আস্ফালন চলছে। এখন সুযোগ হয়েছে বিএনপির উদার ও মধ্যপন্থী রাজনীতি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার। সুযোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে নিজের পরিচয় ফুটিয়ে তোলার। আশা করি বিএনপি নেতৃত্ব বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন এবং সেভাবে নিজেদের তৈরি করবেন। যাতে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিজয়কে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে সামনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments