শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি আর কতদিন? by আবদুল লতিফ মণ্ডল
সরকার ৩৪৫ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে
পদোন্নতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদের মধ্যে ৩২৬ জনের পদোন্নতির
প্রজ্ঞাপন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ১৮ জুলাই জারি করেছে। এদের সবাইকে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।
অবশিষ্ট ১৯ জন লিয়েনে থাকায় লিয়েন শেষে তাদের পদোন্নতি কার্যকর হবে। ১৯
জুলাইয়ের দৈনিকগুলোতে এ পদোন্নতির খবর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। কোনো
কোনো দৈনিকে এটিকে লিড নিউজ করা হয়। ১৯ জুলাইয়ের দৈনিক ইত্তেফাকে বলা
হয়েছে, যুগ্মসচিবের অনুমোদিত ৩৬৮টি পদের একটিও শূন্য নেই। বরং আড়াইশ’
কর্মকর্তা আগে থেকেই অতিরিক্ত রয়েছেন। সে হিসেবে যুগ্মসচিবের ৩৬৮টি
অনুমোদিত পদের বিপরীতে এ মুহূর্তে যুগ্মসচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯৪ জনে।
লিয়েনে থাকা ১৯ জনের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি করা হলে যুগ্মসচিবের সংখ্যা
হবে ৭১৩ জন, অর্থাৎ অনুমোদিত পদের প্রায় দ্বিগুণ। পত্রিকাটিতে আরও বলা
হয়েছে, যুগ্মসচিব পদে ৩৪৫ জনের পদোন্নতি একটি রেকর্ড। বর্তমান সরকার বা তার
আগে অন্য কোনো সরকার একসঙ্গে এত সংখ্যক কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব পদে
পদোন্নতি দেয়নি। ১৯ জুলাইয়ের যুগান্তরে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের সময়ে এর
আগে যুগ্মসচিব পদে ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পদোন্নতি দেয়া হয় ২৭১ জন, ২০১০
সালের ২১ নভেম্বর ১৫৮ জন ও গত বছর ৮ ফেব্র“য়ারি ২৬৪ জন। একই তারিখের দ্য
ডেইলি স্টারে বলা হয়েছে, `The
government yesterday elevated 345 deputy secretaries to the rank of
joint secretary in a large scale promotion in the civil administration.
The promotion was due but was made against no vacant posts. As many as
625 joint secretaries are already serving against the approved 250
posts. So, the newly promoted officials are not likely to get new
posting.'কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি
অধিকার হিসেবে বিবেচিত। এ শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষতা, সততা, কোনো
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বা সহায়তা না করা। তবে পদোন্নতি হতে হবে
অনুমোদিত পদের শূন্যপদের বিপরীতে। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা
থেকে আমরা এটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের
প্রথম দুই দশকে এর ব্যত্যয় খুঁজে পাওয়া কঠিন।
গত বিশ বছর পালাক্রমে দেশ শাসনের মাধ্যমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অন্যান্য বহু অনিয়মের সঙ্গে প্রশাসনে সৃষ্টি করেছে অনেক অনিয়মের এবং তারা সযতেœ সেগুলো লালনপালন করে আসছে। শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি প্রদানের প্রথা মূলত চালু হয় ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে। অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের দাবি গণআন্দোলনে রূপ নিলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের এক বছর পার না হতেই ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে বিএনপি সরকার প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে সাতশ’র বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। কেবল যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। একসঙ্গে সচিবালয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে এর আগে পদোন্নতি প্রদানের নজির ছিল না। ফলে এটি একটি মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়। দলীয়করণের অভিযোগ ছাড়াও পত্রপত্রিকায় এ পদোন্নতিকে ‘গণপদোন্নতি’ বলে অভিহিত করা হয়। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের পদায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শূন্যপদ না থাকায় বহুসংখ্যক কর্মকর্তাকে, বিশেষ করে উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে কমবেশি এক বছর পর্যন্ত ওএসডি হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে (তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়) ফেলা রাখা হয়। তারা বেতন-ভাতা ও অন্য সুযোগ-সুবিধাদি ভোগ করলেও তাদের কোনো কাজ দেয়া হয়নি। ফলে ঘটে সরকারি অর্থের অপচয়।
১৯৯২ সালে বিএনপি প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই ‘গণপদোন্নতির’ যে নজির সৃষ্টি করে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তা যতœসহকারে অনুসরণ করে। গত বিশ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে ‘নিষ্ঠার’ সঙ্গে এ অনিয়মটি চালু রেখেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ গত ১৮ জুলাই শূন্যপদ ছাড়াই তিনশ’র অধিক উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি প্রদান। তাই এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি আর কত দিন?
শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি প্রদান বা পদোন্নতি জমিয়ে রেখে একসঙ্গে দলবেঁধে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- এক. শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি প্রদান প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক ও আর্থিক নিয়মের সুস্পষ্ট লংঘন। পদের অভাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওএসডি বা কর্মহীন অবস্থায় ফেলে রাখা দক্ষ জনশক্তি ও অর্থের অপচয়। এটি সুশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দুই. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, শূন্যপদ না থাকায় ১৮ জুলাই যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের আগের পদেই থাকতে হবে। এর ফলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বেশ কিছুদিন তাদের সমমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হবে। এতে একদিকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের উদ্দীপনা কমে যেতে পারে এবং অন্যদিকে আশংকা রয়েছে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার। এছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে তাকে পদোন্নতিপূর্ব পদের দায়িত্ব পালন করতে বলা প্রশাসনে প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার পরিপন্থী। প্রশাসনিক নিয়ম ও নীতিমালা অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা তার এক বা দুই ধাপ উপরের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রশাসনিক ভাষায় একে বলা হয় চলতি দায়িত্ব পালন। তিন. একসঙ্গে দলবেঁধে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদোন্নতি দেরি হলে পদোন্নতি প্রত্যাশী যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়, যা তাদের কাজের উৎসাহকে ব্যাহত করে। এছাড়া একসঙ্গে অনেক কর্মকর্তার পদোন্নতি প্রদানকে ক্ষমতাসীন দল বা জোট তাদের কৃতিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এর সঙ্গে প্রশাসনকে দলীয়করণের একটি বাসনা লুকানো থাকে। চার. মন্ত্রণালয়/বিভাগের অধীনে রয়েছে অধিদফতর, পরিদফতর, কর্পোরেশন ইত্যাদি। সচিবালয়ের মাঝারি বা উপরের স্তরে শূন্যপদ না থাকার পরও পদোন্নতি দেয়া হলে তার প্রভাব এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় পড়তে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় শূন্যপদ না থাকলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কখনও পদোন্নতি প্রদানে রাজি হয় না। শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও যদি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পদোন্নতি প্রদানের দাবি ওঠে, তখন মন্ত্রণালয়গুলো কী করবে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বলা হয়, চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির মাপকাঠি হবে মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আনা হবে সংস্কার। এসব লক্ষ্য অর্জনে ক্ষমতাসীন সরকার উদ্যোগ নেয় সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের। উদ্যোগটি বিভিন্ন মহলের প্রশংসা লাভ করে। আইনটির খসড়া একাধিকবার প্রণীত হয়। আশা জাগে, দেরিতে হলেও চার দশক পর একটি সাংবিধানিক নির্দেশনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সংবিধানে বলা হয়েছে, সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে জাতীয় সংসদ আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ করতে পারবে (অনুচ্ছেদ ১৩৩)। আশা পূরণ হল না। এখন নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের আমলে সিভিল সার্ভিস আইনটি হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি বড় ধরনের নির্বাচনী অঙ্গীকার অবাস্তবায়িত রয়ে গেল। বিএনপিও তাদের শাসনামলে সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আসলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেউ চায় না প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা আসুক। তারা কেউ চায় না মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর প্রশাসন গড়ে উঠুক। কারণ এটা করা হলে প্রশাসনকে দলীয়করণে তা একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, দেশের উন্নয়নের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম শর্ত দক্ষ, নিরপেক্ষ ও গণমুখী প্রশাসন এবং এটা সম্ভব হবে যদি দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থেকে প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্পন্ন করা যায় এবং প্রশাসনকে সরকারি সিদ্ধান্তগুলো নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। দেশে গণতন্ত্রের বিকাশেও এ রকম একটি প্রশাসন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
গত বিশ বছর পালাক্রমে দেশ শাসনের মাধ্যমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অন্যান্য বহু অনিয়মের সঙ্গে প্রশাসনে সৃষ্টি করেছে অনেক অনিয়মের এবং তারা সযতেœ সেগুলো লালনপালন করে আসছে। শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি প্রদানের প্রথা মূলত চালু হয় ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে। অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের দাবি গণআন্দোলনে রূপ নিলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের এক বছর পার না হতেই ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে বিএনপি সরকার প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে সাতশ’র বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। কেবল যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। একসঙ্গে সচিবালয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে এর আগে পদোন্নতি প্রদানের নজির ছিল না। ফলে এটি একটি মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়। দলীয়করণের অভিযোগ ছাড়াও পত্রপত্রিকায় এ পদোন্নতিকে ‘গণপদোন্নতি’ বলে অভিহিত করা হয়। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের পদায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শূন্যপদ না থাকায় বহুসংখ্যক কর্মকর্তাকে, বিশেষ করে উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে কমবেশি এক বছর পর্যন্ত ওএসডি হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে (তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়) ফেলা রাখা হয়। তারা বেতন-ভাতা ও অন্য সুযোগ-সুবিধাদি ভোগ করলেও তাদের কোনো কাজ দেয়া হয়নি। ফলে ঘটে সরকারি অর্থের অপচয়।
১৯৯২ সালে বিএনপি প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই ‘গণপদোন্নতির’ যে নজির সৃষ্টি করে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তা যতœসহকারে অনুসরণ করে। গত বিশ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে ‘নিষ্ঠার’ সঙ্গে এ অনিয়মটি চালু রেখেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ গত ১৮ জুলাই শূন্যপদ ছাড়াই তিনশ’র অধিক উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি প্রদান। তাই এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি আর কত দিন?
শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি প্রদান বা পদোন্নতি জমিয়ে রেখে একসঙ্গে দলবেঁধে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- এক. শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি প্রদান প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক ও আর্থিক নিয়মের সুস্পষ্ট লংঘন। পদের অভাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওএসডি বা কর্মহীন অবস্থায় ফেলে রাখা দক্ষ জনশক্তি ও অর্থের অপচয়। এটি সুশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দুই. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, শূন্যপদ না থাকায় ১৮ জুলাই যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের আগের পদেই থাকতে হবে। এর ফলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বেশ কিছুদিন তাদের সমমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হবে। এতে একদিকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের উদ্দীপনা কমে যেতে পারে এবং অন্যদিকে আশংকা রয়েছে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার। এছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে তাকে পদোন্নতিপূর্ব পদের দায়িত্ব পালন করতে বলা প্রশাসনে প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার পরিপন্থী। প্রশাসনিক নিয়ম ও নীতিমালা অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা তার এক বা দুই ধাপ উপরের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রশাসনিক ভাষায় একে বলা হয় চলতি দায়িত্ব পালন। তিন. একসঙ্গে দলবেঁধে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদোন্নতি দেরি হলে পদোন্নতি প্রত্যাশী যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়, যা তাদের কাজের উৎসাহকে ব্যাহত করে। এছাড়া একসঙ্গে অনেক কর্মকর্তার পদোন্নতি প্রদানকে ক্ষমতাসীন দল বা জোট তাদের কৃতিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এর সঙ্গে প্রশাসনকে দলীয়করণের একটি বাসনা লুকানো থাকে। চার. মন্ত্রণালয়/বিভাগের অধীনে রয়েছে অধিদফতর, পরিদফতর, কর্পোরেশন ইত্যাদি। সচিবালয়ের মাঝারি বা উপরের স্তরে শূন্যপদ না থাকার পরও পদোন্নতি দেয়া হলে তার প্রভাব এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় পড়তে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় শূন্যপদ না থাকলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কখনও পদোন্নতি প্রদানে রাজি হয় না। শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও যদি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পদোন্নতি প্রদানের দাবি ওঠে, তখন মন্ত্রণালয়গুলো কী করবে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বলা হয়, চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির মাপকাঠি হবে মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আনা হবে সংস্কার। এসব লক্ষ্য অর্জনে ক্ষমতাসীন সরকার উদ্যোগ নেয় সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের। উদ্যোগটি বিভিন্ন মহলের প্রশংসা লাভ করে। আইনটির খসড়া একাধিকবার প্রণীত হয়। আশা জাগে, দেরিতে হলেও চার দশক পর একটি সাংবিধানিক নির্দেশনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সংবিধানে বলা হয়েছে, সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে জাতীয় সংসদ আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ করতে পারবে (অনুচ্ছেদ ১৩৩)। আশা পূরণ হল না। এখন নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের আমলে সিভিল সার্ভিস আইনটি হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি বড় ধরনের নির্বাচনী অঙ্গীকার অবাস্তবায়িত রয়ে গেল। বিএনপিও তাদের শাসনামলে সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আসলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেউ চায় না প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা আসুক। তারা কেউ চায় না মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর প্রশাসন গড়ে উঠুক। কারণ এটা করা হলে প্রশাসনকে দলীয়করণে তা একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, দেশের উন্নয়নের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম শর্ত দক্ষ, নিরপেক্ষ ও গণমুখী প্রশাসন এবং এটা সম্ভব হবে যদি দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থেকে প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্পন্ন করা যায় এবং প্রশাসনকে সরকারি সিদ্ধান্তগুলো নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। দেশে গণতন্ত্রের বিকাশেও এ রকম একটি প্রশাসন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments