১৬টি অপ্রীতিকর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সরকারের কাছে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের চিঠি র্যাবে বাহিনীগুলোর দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে by কামরুল হাসান ও গোলাম মর্তুজা
সশস্ত্র বাহিনী থেকে পুলিশের বিশেষ
ব্যাটালিয়ন র্যাবে প্রেষণে আসা সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত সদস্যদের
দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়েই চলেছে। কর্মস্থলে দুই বাহিনীর সদস্যরা পরস্পরকে সহ্য
করতে পারছেন না। একে অপরের কাজে বাধা দিচ্ছেন, কোথাও কোথাও হাতাহাতি
পর্যন্ত হয়েছে।
এসব নিয়ে মামলা ও সাধারণ ডায়েরি করার ঘটনাও ঘটেছে।
র্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এমন ১৬টি অপ্রীতিকর ঘটনার বিবরণ দিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ভেতরে সেনা-বিদ্বেষ থাকায় সশস্ত্র বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) থেকে আসা কর্মকর্তাদের নির্দেশ তাঁরা মানতে চান না। এ পরিস্থিতি নিরসনে র্যাবকে পুলিশ থেকে পৃথক করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি বিশেষায়িত বা অভিজাত বাহিনী করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কিন্তু র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, র্যাব তো পুলিশেরই একটা অংশ। র্যাবের মধ্য থেকে কেউ তো পৃথক্করণের কথা বলতে পারেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তা ছাড়া বলার মতো এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোন বাহিনী কীভাবে চলবে, সেটা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ব্যাপার।’
তবে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, র্যাবে প্রেষণে আসা সেনা কর্মকর্তারা আইন বোঝেন না। ফৌজদারি আইন, পুলিশ প্রবিধান সম্পর্কে তাঁদের ধারণা যেকোনো পুলিশ সদস্যের চেয়ে অনেক কম। নবীন সেনা কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রে মামলাও লিখতে পারেন না। র্যাব কর্মকর্তারা আইন না বুঝে আইনের বাইরে কোনো কাজ করতে বললে পুলিশ কর্মকর্তারা সেটা করতে চান না বলে অনেক সময়ই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, ক্রসফায়ার ছাড়া র্যাবের তেমন কোনো সাফল্য তাঁরা দেখেন না। আর ক্রসফায়ার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনের মধ্যে থেকে হয় না। এ ছাড়া র্যাবে পুলিশ বাহিনী থেকে আসা কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা এখনো ঠিক করা হয়নি। পুলিশ সদস্যদের প্রাপ্য পদে বসানো হয় না। সর্বশেষ পরিদর্শকেরা প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকেরা দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হওয়ায় এ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে।
মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় এবং মারাত্মক অপরাধ দমনের জন্য ২০০৪ সালে চারদলীয় জোট সরকার ব্যাটালিয়ন আইন সংশোধন করে র্যাব গঠন করে। এতে পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা প্রেষণে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই র্যাবের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের হাতে। জঙ্গি দমন, দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নির্মূল, মাদক উদ্ধারে র্যাবের বিশেষ সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের মতো ঘটনা র্যাবকে বিতর্কিতও করেছে।
কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, র্যাব গঠনের পর থেকেই র্যাবের ভেতরে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসা সদস্যদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলে আসছে। পুলিশ সুপার (এসপি) পদের কর্মকর্তারা র্যাবে অধিনায়কত্ব পান না বলে র্যাবে চাকরি করতে চান না।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের অধীনে থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের মতো করে অভিযান চালাতে পারে না বিশেষায়িত বাহিনীগুলো। র্যাবের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। যেহেতু র্যাব ও পুলিশ একই কাজ করে, তাই এখানে পেশাগত প্রতিযোগিতা ও জেলাসি থাকতেই পারে। সে ক্ষেত্রে র্যাবের অনেক কিছুতেই বিলম্ব হতে পারে। আর সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলে র্যাবের কাজ আরও গতিশীল হবে।
যেসব ঘটনা ঘটেছে: ওই প্রতিবেদনে র্যাবের পক্ষ থেকে যে ১৬টি ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়, তার মধ্যে একটি হলো: বিমানবন্দরে সংঘটিত একটি ঘটনা। র্যাব গোয়েন্দা বিমানবন্দর থেকে এক আসামিকে আটক করে গাড়িতে তোলার সময় বিমানবন্দরে কর্মরত আর্মড পুলিশের এক কনস্টেবল এ দৃশ্য ভিডিও করেন। র্যাব সদস্যরা এতে বাধা দিলে ওই কনস্টেবল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর মতিঝিলে ২০১০ সালের ২০ জুন র্যাব-৪-এর কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মেহেদি ইমাম ও ল্যান্স করপোরাল নকীবুজ্জামানকে মারধর করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। পরে কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
তবে ওই ঘটনা নিয়ে সে সময় পুলিশ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ওই দিন শহরে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলের কারণে দৈনিক বাংলা এলাকায় প্রচণ্ড যানজট ছিল। এর মধ্যেই র্যাবের গাড়িটি সংকেত না মেনে চলে যাচ্ছিল। কর্তব্যরত একজন ট্রাফিক কনস্টেবল গাড়িটি থামালে র্যাব কর্মকর্তা ট্রাফিক কনস্টেবলকে চড় মারেন। পরে কর্তব্যরত সার্জেন্ট ও অন্য কনস্টেবলরা ওই কর্মকর্তাকে মতিঝিল থানায় নিয়ে যান। পরিচয় পাওয়ার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা বলা হয়, ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা একজন এএসপি র্যাবে কর্মরত একজন স্কোয়াড্রন লিডারকে চড় মারেন। একপর্যায়ে মামলা দিয়ে তাঁকে জেলে ঢোকানোরও হুমকি দেন।
২০১১ সালের ৩ নভেম্বর র্যাবের এক কর্মকর্তাকে নামিয়ে দিয়ে একটি সরকারি গাড়ি হাজারীবাগ থানার সামনে দাঁড়ালে সেখানে দায়িত্বরত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) গাড়িটি সরাতে বলেন। গাড়িটি র্যাবের বলে জানালে ওই এএসআই র্যাবের গাড়ির চালককে চড় মারেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে ঘটনাটি মিটমাট করে দেন।
গত বছরের ২ মে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদের সহযোগী ড. আবু ইউসুফকে গ্রেপ্তারের পর উত্তর খান থানায় নেওয়া হলে কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) নানা ধরনের টালবাহানা করেন। তিনি র্যাব সদস্যদের সামনে আবু ইউসুফকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাঁকে মারধর করা হয়েছে কি না। এমনকি থানায় যাওয়া সব র্যাব সদস্যের মাতৃবাহিনীর (যে বাহিনী থেকে র্যাবে এসেছে) ঠিকানা ও ফোন নম্বর নিয়ে তবেই আসামি গ্রহণ করেন। আরও অনেক আসামির ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটেছে।
এতে বলা হয়, গত বছরের ২২ এপ্রিল বনানী থানায় একটি মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা সরাসরি চিঠি দিয়ে মোহাম্মদপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডারকে ডেকে পাঠান। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এভাবে কাউকে ডাকার বিধান নেই।
কিছু পুলিশ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে অভিযোগ: চিঠিতে পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা বাহিনীর শৃঙ্খলা মানতে চান না। র্যাবে আসার পর থেকেই তাঁরা বদলির জন্য তদবির শুরু করে দেন। আবার অনেক কর্মকর্তা বছরের পর বছর র্যাবে আছেন। তাঁদের বদলি করা হয় না। এ রকম ১৮ কর্মকর্তার একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত এসপি থেকে সদ্য এসপি হয়ে র্যাব থেকে বদলি হয়ে যাওয়া এক কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, ওই পুলিশ কর্মকর্তা র্যাবে আসার পর থেকে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি অধস্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। বিভিন্ন সন্ত্রাসীর সঙ্গে তিনি গোপন সম্পর্ক গড়ে তোলেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় করেন। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয়নি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদের এক কর্মকর্তা র্যাবে এসে জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালকের পদে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। তিনি উপপরিচালকের পদের পরিচয়পত্র তৈরির জন্য চাপ দেন।
আরেকজন এএসপি পর্যায়ের কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, ওই কর্মকর্তা জয়দেবপুরে নকল সিডির বিরুদ্ধে অভিযান করে ফেরার পর তাঁর দলের লোকজন আটক করা সিডি আবার বিক্রি করে দেন। এ ঘটনা ধরা পড়ে।
আরেক এএসপির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ওই কর্মকর্তা র্যাবে আসার পর কোনো কাজ করতে চান না। তাঁকে একাধিক স্থানে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সর্বত্র কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দিয়ে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বেতন স্কেল অনুসারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদের কর্মকর্তা উপপরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু এ পদে সেনাবাহিনীর মেজরদের নিয়োগ দেওয়া হয়, আর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদেও কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক হিসেবে। এ কারণে পুলিশ সদস্যরা কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
র্যাবে থাকা সশস্ত্র বাহিনীর মূল্যায়ন: চিঠিতে আরও বলা হয়, র্যাবে আসা সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সব সময় সেনা-বিদ্বেষ কাজ করে। এমনকি পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারাও র্যাবের সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতা করতে চান না। বাৎসরিক পুলিশ পদক প্রদানসহ পুলিশ সদর দপ্তরের বিভিন্ন কমিটিতেই র্যাব সদস্য রাখা হয় না। এমনকি র্যাবের জন্য কালো গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হলেও দেওয়া হয় নীল রঙের গাড়ি। র্যাবে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেওয়া হলে তা কেউ কানে তোলেন না। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে করা জিডি ও মামলা নিয়ে র্যাব থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁদের বিপাকে পড়তে হয়। র্যাবকে পুলিশের জন্য ‘ডাম্পিং স্টেশন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে বেশি বয়সী, হূদেরাগী, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন—এমন পুলিশ সদস্যদের পাঠানো হয়। তাঁরা গিয়ে কোনো কাজ করতে চান না।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, এ অবস্থা নিরসনে র্যাবকে পুলিশের অধীনে না রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে রাখা হলে এর কাজের গতি ও সুনাম বৃদ্ধি পাবে। না হলে পুলিশের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করতে র্যাবও পুলিশের মতো দুর্নীতিতে ঝুঁকে পড়বে।
র্যাব বিধি অনুসারে ৪৪ শতাংশ পুলিশ বাহিনী, ৪৪ শতাংশ সশস্ত্র বাহিনী, ৬ শতাংশ বিজিবি (অধুনা বিডিআর), ৪ শতাংশ আনসার ও ভিডিপি, ১ শতাংশ কোস্টগার্ড এবং সিভিল প্রশাসন থেকে ১ শতাংশ জনবল নিয়ে র্যাব গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে বাহিনীতে মোট জনবলের মধ্যে ৪২ দশমিক ১৯ শতাংশ পুলিশ ও আর ৪০ দশমিক ৪৭ শতাংশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য আছেন। অবশ্য কর্মকর্তা পদে বেশির ভাগই এসেছেন সশস্ত্র বাহিনী থেকে।
র্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এমন ১৬টি অপ্রীতিকর ঘটনার বিবরণ দিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ভেতরে সেনা-বিদ্বেষ থাকায় সশস্ত্র বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) থেকে আসা কর্মকর্তাদের নির্দেশ তাঁরা মানতে চান না। এ পরিস্থিতি নিরসনে র্যাবকে পুলিশ থেকে পৃথক করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি বিশেষায়িত বা অভিজাত বাহিনী করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কিন্তু র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, র্যাব তো পুলিশেরই একটা অংশ। র্যাবের মধ্য থেকে কেউ তো পৃথক্করণের কথা বলতে পারেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তা ছাড়া বলার মতো এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোন বাহিনী কীভাবে চলবে, সেটা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ব্যাপার।’
তবে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, র্যাবে প্রেষণে আসা সেনা কর্মকর্তারা আইন বোঝেন না। ফৌজদারি আইন, পুলিশ প্রবিধান সম্পর্কে তাঁদের ধারণা যেকোনো পুলিশ সদস্যের চেয়ে অনেক কম। নবীন সেনা কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রে মামলাও লিখতে পারেন না। র্যাব কর্মকর্তারা আইন না বুঝে আইনের বাইরে কোনো কাজ করতে বললে পুলিশ কর্মকর্তারা সেটা করতে চান না বলে অনেক সময়ই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, ক্রসফায়ার ছাড়া র্যাবের তেমন কোনো সাফল্য তাঁরা দেখেন না। আর ক্রসফায়ার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনের মধ্যে থেকে হয় না। এ ছাড়া র্যাবে পুলিশ বাহিনী থেকে আসা কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা এখনো ঠিক করা হয়নি। পুলিশ সদস্যদের প্রাপ্য পদে বসানো হয় না। সর্বশেষ পরিদর্শকেরা প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকেরা দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হওয়ায় এ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে।
মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় এবং মারাত্মক অপরাধ দমনের জন্য ২০০৪ সালে চারদলীয় জোট সরকার ব্যাটালিয়ন আইন সংশোধন করে র্যাব গঠন করে। এতে পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা প্রেষণে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই র্যাবের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের হাতে। জঙ্গি দমন, দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নির্মূল, মাদক উদ্ধারে র্যাবের বিশেষ সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের মতো ঘটনা র্যাবকে বিতর্কিতও করেছে।
কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, র্যাব গঠনের পর থেকেই র্যাবের ভেতরে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসা সদস্যদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলে আসছে। পুলিশ সুপার (এসপি) পদের কর্মকর্তারা র্যাবে অধিনায়কত্ব পান না বলে র্যাবে চাকরি করতে চান না।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের অধীনে থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের মতো করে অভিযান চালাতে পারে না বিশেষায়িত বাহিনীগুলো। র্যাবের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। যেহেতু র্যাব ও পুলিশ একই কাজ করে, তাই এখানে পেশাগত প্রতিযোগিতা ও জেলাসি থাকতেই পারে। সে ক্ষেত্রে র্যাবের অনেক কিছুতেই বিলম্ব হতে পারে। আর সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলে র্যাবের কাজ আরও গতিশীল হবে।
যেসব ঘটনা ঘটেছে: ওই প্রতিবেদনে র্যাবের পক্ষ থেকে যে ১৬টি ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়, তার মধ্যে একটি হলো: বিমানবন্দরে সংঘটিত একটি ঘটনা। র্যাব গোয়েন্দা বিমানবন্দর থেকে এক আসামিকে আটক করে গাড়িতে তোলার সময় বিমানবন্দরে কর্মরত আর্মড পুলিশের এক কনস্টেবল এ দৃশ্য ভিডিও করেন। র্যাব সদস্যরা এতে বাধা দিলে ওই কনস্টেবল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর মতিঝিলে ২০১০ সালের ২০ জুন র্যাব-৪-এর কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মেহেদি ইমাম ও ল্যান্স করপোরাল নকীবুজ্জামানকে মারধর করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। পরে কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
তবে ওই ঘটনা নিয়ে সে সময় পুলিশ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ওই দিন শহরে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলের কারণে দৈনিক বাংলা এলাকায় প্রচণ্ড যানজট ছিল। এর মধ্যেই র্যাবের গাড়িটি সংকেত না মেনে চলে যাচ্ছিল। কর্তব্যরত একজন ট্রাফিক কনস্টেবল গাড়িটি থামালে র্যাব কর্মকর্তা ট্রাফিক কনস্টেবলকে চড় মারেন। পরে কর্তব্যরত সার্জেন্ট ও অন্য কনস্টেবলরা ওই কর্মকর্তাকে মতিঝিল থানায় নিয়ে যান। পরিচয় পাওয়ার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা বলা হয়, ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা একজন এএসপি র্যাবে কর্মরত একজন স্কোয়াড্রন লিডারকে চড় মারেন। একপর্যায়ে মামলা দিয়ে তাঁকে জেলে ঢোকানোরও হুমকি দেন।
২০১১ সালের ৩ নভেম্বর র্যাবের এক কর্মকর্তাকে নামিয়ে দিয়ে একটি সরকারি গাড়ি হাজারীবাগ থানার সামনে দাঁড়ালে সেখানে দায়িত্বরত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) গাড়িটি সরাতে বলেন। গাড়িটি র্যাবের বলে জানালে ওই এএসআই র্যাবের গাড়ির চালককে চড় মারেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে ঘটনাটি মিটমাট করে দেন।
গত বছরের ২ মে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদের সহযোগী ড. আবু ইউসুফকে গ্রেপ্তারের পর উত্তর খান থানায় নেওয়া হলে কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) নানা ধরনের টালবাহানা করেন। তিনি র্যাব সদস্যদের সামনে আবু ইউসুফকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাঁকে মারধর করা হয়েছে কি না। এমনকি থানায় যাওয়া সব র্যাব সদস্যের মাতৃবাহিনীর (যে বাহিনী থেকে র্যাবে এসেছে) ঠিকানা ও ফোন নম্বর নিয়ে তবেই আসামি গ্রহণ করেন। আরও অনেক আসামির ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটেছে।
এতে বলা হয়, গত বছরের ২২ এপ্রিল বনানী থানায় একটি মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা সরাসরি চিঠি দিয়ে মোহাম্মদপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডারকে ডেকে পাঠান। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এভাবে কাউকে ডাকার বিধান নেই।
কিছু পুলিশ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে অভিযোগ: চিঠিতে পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা বাহিনীর শৃঙ্খলা মানতে চান না। র্যাবে আসার পর থেকেই তাঁরা বদলির জন্য তদবির শুরু করে দেন। আবার অনেক কর্মকর্তা বছরের পর বছর র্যাবে আছেন। তাঁদের বদলি করা হয় না। এ রকম ১৮ কর্মকর্তার একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত এসপি থেকে সদ্য এসপি হয়ে র্যাব থেকে বদলি হয়ে যাওয়া এক কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, ওই পুলিশ কর্মকর্তা র্যাবে আসার পর থেকে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি অধস্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। বিভিন্ন সন্ত্রাসীর সঙ্গে তিনি গোপন সম্পর্ক গড়ে তোলেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় করেন। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয়নি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদের এক কর্মকর্তা র্যাবে এসে জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালকের পদে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। তিনি উপপরিচালকের পদের পরিচয়পত্র তৈরির জন্য চাপ দেন।
আরেকজন এএসপি পর্যায়ের কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, ওই কর্মকর্তা জয়দেবপুরে নকল সিডির বিরুদ্ধে অভিযান করে ফেরার পর তাঁর দলের লোকজন আটক করা সিডি আবার বিক্রি করে দেন। এ ঘটনা ধরা পড়ে।
আরেক এএসপির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ওই কর্মকর্তা র্যাবে আসার পর কোনো কাজ করতে চান না। তাঁকে একাধিক স্থানে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সর্বত্র কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দিয়ে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বেতন স্কেল অনুসারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদের কর্মকর্তা উপপরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু এ পদে সেনাবাহিনীর মেজরদের নিয়োগ দেওয়া হয়, আর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদেও কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক হিসেবে। এ কারণে পুলিশ সদস্যরা কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
র্যাবে থাকা সশস্ত্র বাহিনীর মূল্যায়ন: চিঠিতে আরও বলা হয়, র্যাবে আসা সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সব সময় সেনা-বিদ্বেষ কাজ করে। এমনকি পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারাও র্যাবের সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতা করতে চান না। বাৎসরিক পুলিশ পদক প্রদানসহ পুলিশ সদর দপ্তরের বিভিন্ন কমিটিতেই র্যাব সদস্য রাখা হয় না। এমনকি র্যাবের জন্য কালো গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হলেও দেওয়া হয় নীল রঙের গাড়ি। র্যাবে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেওয়া হলে তা কেউ কানে তোলেন না। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে করা জিডি ও মামলা নিয়ে র্যাব থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁদের বিপাকে পড়তে হয়। র্যাবকে পুলিশের জন্য ‘ডাম্পিং স্টেশন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে বেশি বয়সী, হূদেরাগী, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন—এমন পুলিশ সদস্যদের পাঠানো হয়। তাঁরা গিয়ে কোনো কাজ করতে চান না।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, এ অবস্থা নিরসনে র্যাবকে পুলিশের অধীনে না রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে রাখা হলে এর কাজের গতি ও সুনাম বৃদ্ধি পাবে। না হলে পুলিশের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করতে র্যাবও পুলিশের মতো দুর্নীতিতে ঝুঁকে পড়বে।
র্যাব বিধি অনুসারে ৪৪ শতাংশ পুলিশ বাহিনী, ৪৪ শতাংশ সশস্ত্র বাহিনী, ৬ শতাংশ বিজিবি (অধুনা বিডিআর), ৪ শতাংশ আনসার ও ভিডিপি, ১ শতাংশ কোস্টগার্ড এবং সিভিল প্রশাসন থেকে ১ শতাংশ জনবল নিয়ে র্যাব গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে বাহিনীতে মোট জনবলের মধ্যে ৪২ দশমিক ১৯ শতাংশ পুলিশ ও আর ৪০ দশমিক ৪৭ শতাংশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য আছেন। অবশ্য কর্মকর্তা পদে বেশির ভাগই এসেছেন সশস্ত্র বাহিনী থেকে।
No comments