রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র ও সমরাস্ত্র ক্রয় চুক্তি
পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক শেষে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই ॥ সমর সম্ভার ও পরমাণু প্রকল্পের জন্য দেড় শ’ কোটি ডলারের ঋণ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়সহ ৩টি চুক্তি ও ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে এই চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর পর এই প্রথম রাশিয়ার আমন্ত্রণে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নিতে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান রাশিয়া সফরে গেলেন।দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের এক ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হোটেল লবিতে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি রুশ প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করেছি যে, বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সহায়তা অব্যাহত থাকবে।’ দুই দেশের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে। এটা শুধু পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বা সামরিক সরঞ্জাম কেনা নয়, এটা বাংলাদেশকে দেয়া রাশিয়ার অর্থনৈতিক সহায়তা।’
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, ‘আমাদের দু’ দেশের সম্পর্ককে আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রূপপুরে এক হাজার মেগাওয়াটের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে চুক্তি সইয়ের আগে ক্রেমলিনে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। পরে তাঁদের উপস্থিতিতেই দুই দেশের কর্মকর্তারা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেন। পরমাণু বিদ্যুত প্রকল্পে প্রস্ততিমূলক কাজে অর্থায়নে সহযোগিতার চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদ। রাশিয়ার পক্ষে সই করেন দেশটির অর্থ উপমন্ত্রী সার্গেই স্তোরচাক।
এই চুক্তি অনুযায়ী, পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার (চার হাজার কোটি টাকা) ঋণ পাবে বাংলাদেশ।
বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে কত খরচ হবে, তা নির্ধারণে কারিগরি গবেষণার জন্য আগামী দুই বছর এই অর্থ ব্যয় করা হবে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাসংবলিত রাশিয়া থেকে সর্বাধুনিক তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি দিয়ে সরকার রূপপুরে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে গত নবেম্বরে রাশিয়ার পারমাণবিক জ্বালানি সংস্থা রোসাটমের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি করে বাংলাদেশ। ওই চুক্তি অনুযায়ী অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে রুশ সরকার এবং কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করবে এবং ব্যবহৃত জ্বালানিও ফেরত নেবে তারা। বিদ্যুত কেন্দ্রের মেয়াদ হবে ৬০ বছর। পরে তা আরও ২০ বছর বাড়ানো যাবে।
এদিকে সামরিক অস্ত্র ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণে ১০০ কোটি ডলারের (আট হাজার কোটি টাকা) সমরাস্ত্র কিনবে বাংলাদেশ। আট হাজার কোটি টাকার এই কেনাকাটার জন্য অগ্রিম হিসাবে রাশিয়াকে ঋণের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৮শ’ কোটি টাকা দিতে হবে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে কেনাকাটার প্রক্রিয়া শেষ করার সময়সীমা ধরা হয়েছে।
জানা গেছে, সেনাবাহিনীর জন্য সাত ধরনের এবং বিমানবাহিনীর জন্য চার ধরনের সমরাস্ত্র কেনা হবে। সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্রের তালিকায় রয়েছে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মিসাইল মেতিস-এম-১ ও করনেট-ই সাঁজোয়া যান বিটিআর-৮০ ও বিটিআর-৮০-কে; স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লঞ্চার এজিএস-৩০, নৌপথে সাঁজোয়া যান ও ট্যাঙ্ক পারাপারের উপযোগী পিপি-৯১ পন্টুন ও ট্যাঙ্কের মাধ্যমে পরিচালিত এমটিইউ-৯০ সেতু। বিমানবাহিনীর কেনাকাটার তালিকায় রয়েছে ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ জঙ্গী বিমান, সামরিক পণ্য পরিবহন উপযোগী এমআই১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার, গামা-ডিই/গামা-সি১ই রাডার ও কাস্তা-২ই২ রাডার।
এছাড়া কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন ও বিচার এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিষয়ে ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।
তিন দিনের এই সফরে সোমবার মস্কো পৌঁছে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান প্রধানমন্ত্রী। সোমবার সকালে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে মস্কোর সময় বিকেল ৩টায় রাশিয়ার রাজধানীতে পৌঁছান শেখ হাসিনা। শেরেমেতিয়েভা বিমানবন্দরে নামার পর লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় তাঁকে। সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল তাঁকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। এই সময় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়।
বিমানবন্দরে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইগর ভøাদিমিরোভিচ। রাশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এসএম সাইফুল হকও ছিলেন সেখানে।
প্রধানমন্ত্রী বুধবার সকালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন এবং বাংলাদেশ-রাশিয়া সহযোগিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে বক্তৃতা দেবেন।
দুপুরে রাশিয়ার আণবিক শক্তি কর্পোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক সের্গেই কিরিয়েনকোর সঙ্গে বৈঠক করবেন শেখ হাসিনা। পরে তিনি ক্রেমলিন জাদুঘর ও গ্যাজপ্রম কার্যালয় পরিদর্শন করবেন। বুধবার রাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ায় শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সফর এটি। এর আগে ২০১০ সালের নবেম্বরে বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ফোরামের সম্মেলনে যোগ দিতে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সেন্ট পিটার্সবুর্গে গিয়েছিলেন তিনি। তবে রাশিয়ার সরকারের আমন্ত্রণে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের ঘটনা ঘটল ৪০ বছর পর।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নয়নের প্রশংসায় রুশ মন্ত্রী ॥ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন রাশিয়ার যোগাযোগ ও গণমাধ্যমমন্ত্রী নিকোলাই নিকিফোরভ। তিনি এ খাতে বাংলাদেশকে আরও সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
মঙ্গলবার মস্কোয় প্রেসিডেন্ট হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন। সফরের দ্বিতীয় দিনে শীর্ষ বৈঠকের আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন রুশ যোগাযোগমন্ত্রী। সে সময় রুশ মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে খুব দ্রুত এগিয়েছে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে রাশিয়া ২০০৯ সাল থেকে সহযোগিতা করে আসছে। এই খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, চলতি বছর থেকে রুশ একটি কোম্পানি বাংলাদেশে ওয়ারলেস ইন্টারনেট সেবায় কাজ শুরু করবে।
এ বৈঠক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেসসচিব বিজনলাল দেব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রাশিয়ার অগ্রগতির চিত্র সরেজমিন দেখে সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাতেও রুশ মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত চার বছরে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ মোঃ ওয়াহিদ উজ্জামান।
রুশ সৈনিকদের প্রতি শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা ॥ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বেলা পৌনে ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী মস্কোয় রুশ সৈনিকদের সমাধিস্থলে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সে সময় তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার দুই মেয়ে রেজওয়ানা সিদ্দিকী টিউলিপ ও আজমিনা সিদ্দিকী রুপন্তী তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী সমাধিস্থলে পৌঁছলে প্রথমে রাশিয়ার সমরসঙ্গীত বাজানো হয়। এরপর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন শেখ হাসিনা। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তিনি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় দুই দেশের জাতীয়সঙ্গীত বাজানো হয়। একদল চৌকস সেনাসদস্য গার্ড অভিবাদন জানায়।
No comments