আলোয় ভুন ভরাঃ ইউরোপের এক মনোরম শহর বুধভা by কাজী জহিরুল ইসলাম
পৃথিবীতে যদি কোনো স্বর্গ থাকে তাহলে সেই স্বর্গের নাম বুধভা। পৃথিবীর এত দেশ ঘুরেছি, এত শহর চষে বেড়িয়েছি, বুধভা’র চেয়ে সুন্দর কোনো স্থান আমি কখনও দেখিনি। অড্রিয়াটিকের অন্য পাড়ে, বারি থেকে জাহাজে চড়লেই মন্টেনিগ্রোর রাজধানী পোদগোরিত্সাল। মন্টেনিগ্রোতে রয়েছে অসংখ্য ট্যুরিস্ট স্পট।
উলচিন, হার্জেক নবি এবং বুধভাতেই সবচেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তিন জায়গাতেই যাব, তবে আস্তানা গড়ব বুধভাতেই। মন্টেনিগ্রো ছিল সাবেক যুগোস্লাভিয়া এবং পরে সার্বিয়ার একটি প্রভিন্স, ৩ জুন ২০০৬ মন্টেনিগ্রোর সংসদ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়।
আড়াই হাজার বছরের পুরনো শহর বুধভা’র কেন্দ্রীয় বাস স্টেশনে নেমেই আমরা এক এজেন্টের সহায়তায় একটি বাসা ভাড়া করে ফেললাম। বাসা আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ছাদের ওপর একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। ঘরের দরজা পেরুলেই বিশাল ছাদের উঠোন, উঠোনের ডানদিকে যতদূর চোখ যায় সুনীল অড্রিয়াটিকের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর বাঁদিকে আকাশছোঁয়া কালো পর্বতশৃঙ্গ। পর্বতশৃঙ্গটি এত উঁচু যে রাতের বেলায় যখন পাহাড়ের ওপর থেকে গাড়িগুলো নেমে আসে, তখন গাড়ির হেডলাইটগুলোকে মনে হয় যেন সারিবদ্ধ তারকারাজি আকাশ থেকে নেমে আসছে। প্রথম রাতে এই দৃশ্য দেখে আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না এগুলো গাড়ির সারি।
জামা-কাপড় বদলে আমরা নেমে এলাম বিচে। ও-মা, এ যেন সারা দুনিয়ার মানুষের এক মহামিলন মেলা। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছে বুধভা’র বিচে। সমুদ্র যেন এখানে পর্যটকদের জন্য হৃদয় উজাড় করা সীমাহীন সৌন্দর্য আর ভালোবাসা মেলে ধরেছে। তাই মাইল মাইল পথ হেঁটে বেড়ানো যায় সমুদ্রের ভেতর। কয়েক একর জল দড়ির বাঁধ দিয়ে একটি হাওয়াই জাহাজ অপারেট করছে এক ট্যুরিস্ট কোম্পানি। দশ মিনিটের রাইড পঞ্চাশ ইউরো। পালাক্রমে আমরা দু’জনই চড়লাম, গ্লাইডিং করে আকাশ থেকে দেখে এলাম বুধভা শহর। আর তখনই ঠিক করে ফেলি, বিচের চেয়েও সুন্দর জায়গা রয়েছে শহরের অন্যদিকে। ছুটলাম সেখানে। কী আজব এক শহর! শহরের ভেতরে আরও একটি ছোট্ট শহর। যেন প্রকাণ্ড দেয়ালবেষ্টিত এক সুবিশাল দুর্গ, ভেতরে ছোট ছোট অসংখ্য কুঠুরি। সেসব কুঠুরি ঠাসা নানান রকম হস্তশিল্পে। চারু ও কারুশিল্পের বিশাল বিপুল সম্ভারের পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। রয়েছে অসংখ্য খাবারের পশরাও। এটা হলো বুধভা’র প্রাচীন শহর, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ৫০০ বিসিতে এ শহরের গোড়াপত্তন করেন গ্রিক ফিনিশিয়ান রাজপুত্র কাডমুস। তিনি ছিলেন রাজা আগেনরের ছেলে এবং ফিনিক্স ও ইউরোপার ভাই। গ্রিক মাইথলোজি থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। রাজপুত্র কাডমুস গ্রিস থেকে নির্বাসিত হয়ে তার ও তার স্ত্রী হারমোনিয়ার বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজছিলেন, অবশেষে তিনি বুধভাকেই বেছে নেন।
দেশটির নাম মন্টেনিগ্রো কেন হলো? এ প্রশ্নের জবাব অবশ্য আমি আগেই পেয়েছিলাম আমার এক মন্টেনিগ্রান সহকর্মীর কাছে। মন্টে শব্দের অর্থ হলো মাউন্টেন, নিগ্রো মানে কালো। পুরো দেশটি অসংখ্য কালো এবং সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গবেষ্টিত বলেই এর নাম হয়েছে মন্টেনিগ্রো। কিন্তু এই শহরের নাম বুধভা কেন হলো? এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই আবিষ্কার করে ফেললাম। ওল্ড টাউন থেকে বেরুলেই টাউনের প্রধান ফটকের সামনে এক সুবিশাল স্কয়ার, আর ঠিক স্কয়ারের মাঝখানে এক সুবিশাল ভাস্কর্য। আমার স্ত্রী মুক্তি বলল, দেখ তো এটা কার ভাস্কর্য? আরে এ তো বুদ্ধ, গৌতম বুদ্ধ। তখনই আমি নিশ্চিত হই, বুদ্ধের নামানুসারেই এই জায়গার নাম হয়েছে বুধভা। এতে আমার আর সন্দেহের লেশমাত্রও রইল না।
পরদিন সকালে একটি বোট ভাড়া করে ছুটলাম অড্রিয়াটিকের বুকে, আজ আমরা এই সমুদ্রটাকে জয় করে ফেলব। বোটম্যান বলল, সেইন্ট স্টিভেন দ্বীপে যাবেন? আমরা বললাম, যেখানে খুশি নিয়ে যাও। মুক্তি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ও আসলে কিছুটা ভয়ও পাচ্ছে, সাঁতার জানে না তো। বোটম্যান বলল, ম্যাডাম ভয়ের কিছু নেই, যেখানেই পড় তুমি ডুববে না, আর আমি তো আছিই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আমাদের নিয়ে এলো সেইন্ট স্টিভেন দ্বীপে। এ যেন এক চিরশান্তির দ্বীপ, ছোট্ট এক চিলতে, যেন সুবিশাল এক পাথরের চাঁই পড়ে আছে অড্রিয়াটিকের বুকে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর জেনে গেলাম ওপরে শুধু এক পাথরের চাঁই মনে হলেও, এর পেটের ভেতর রয়েছে একটি পাঁচতারা হোটেল। বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। এই হোটেলে অবকাশ যাপন করতে আসেন পৃথিবীর সব সেরা চলচ্চিত্র তারকা। হলিউডের এমন কোনো সেরা তারকা নেই যিনি এই সেইন্ট স্টিভেনে আসেননি। রুম ভাড়া শুনে আমাদের মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। কিছুটা সময় সেইন্ট স্টিভেনের চূড়োয়, একটি গাছের নিচে, নীল সুইমিংপুলের পাশে, আশ্চর্য সুন্দর পরিবেশে কিছুক্ষণ অতিবাহিত করে আমরা ফিরে এলাম আমাদের রিজার্ভ বোটে। এরপর ছুটতে শুরু করলাম হার্জেক নবির দিকে।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
আড়াই হাজার বছরের পুরনো শহর বুধভা’র কেন্দ্রীয় বাস স্টেশনে নেমেই আমরা এক এজেন্টের সহায়তায় একটি বাসা ভাড়া করে ফেললাম। বাসা আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ছাদের ওপর একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। ঘরের দরজা পেরুলেই বিশাল ছাদের উঠোন, উঠোনের ডানদিকে যতদূর চোখ যায় সুনীল অড্রিয়াটিকের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর বাঁদিকে আকাশছোঁয়া কালো পর্বতশৃঙ্গ। পর্বতশৃঙ্গটি এত উঁচু যে রাতের বেলায় যখন পাহাড়ের ওপর থেকে গাড়িগুলো নেমে আসে, তখন গাড়ির হেডলাইটগুলোকে মনে হয় যেন সারিবদ্ধ তারকারাজি আকাশ থেকে নেমে আসছে। প্রথম রাতে এই দৃশ্য দেখে আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না এগুলো গাড়ির সারি।
জামা-কাপড় বদলে আমরা নেমে এলাম বিচে। ও-মা, এ যেন সারা দুনিয়ার মানুষের এক মহামিলন মেলা। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছে বুধভা’র বিচে। সমুদ্র যেন এখানে পর্যটকদের জন্য হৃদয় উজাড় করা সীমাহীন সৌন্দর্য আর ভালোবাসা মেলে ধরেছে। তাই মাইল মাইল পথ হেঁটে বেড়ানো যায় সমুদ্রের ভেতর। কয়েক একর জল দড়ির বাঁধ দিয়ে একটি হাওয়াই জাহাজ অপারেট করছে এক ট্যুরিস্ট কোম্পানি। দশ মিনিটের রাইড পঞ্চাশ ইউরো। পালাক্রমে আমরা দু’জনই চড়লাম, গ্লাইডিং করে আকাশ থেকে দেখে এলাম বুধভা শহর। আর তখনই ঠিক করে ফেলি, বিচের চেয়েও সুন্দর জায়গা রয়েছে শহরের অন্যদিকে। ছুটলাম সেখানে। কী আজব এক শহর! শহরের ভেতরে আরও একটি ছোট্ট শহর। যেন প্রকাণ্ড দেয়ালবেষ্টিত এক সুবিশাল দুর্গ, ভেতরে ছোট ছোট অসংখ্য কুঠুরি। সেসব কুঠুরি ঠাসা নানান রকম হস্তশিল্পে। চারু ও কারুশিল্পের বিশাল বিপুল সম্ভারের পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। রয়েছে অসংখ্য খাবারের পশরাও। এটা হলো বুধভা’র প্রাচীন শহর, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ৫০০ বিসিতে এ শহরের গোড়াপত্তন করেন গ্রিক ফিনিশিয়ান রাজপুত্র কাডমুস। তিনি ছিলেন রাজা আগেনরের ছেলে এবং ফিনিক্স ও ইউরোপার ভাই। গ্রিক মাইথলোজি থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। রাজপুত্র কাডমুস গ্রিস থেকে নির্বাসিত হয়ে তার ও তার স্ত্রী হারমোনিয়ার বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজছিলেন, অবশেষে তিনি বুধভাকেই বেছে নেন।
দেশটির নাম মন্টেনিগ্রো কেন হলো? এ প্রশ্নের জবাব অবশ্য আমি আগেই পেয়েছিলাম আমার এক মন্টেনিগ্রান সহকর্মীর কাছে। মন্টে শব্দের অর্থ হলো মাউন্টেন, নিগ্রো মানে কালো। পুরো দেশটি অসংখ্য কালো এবং সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গবেষ্টিত বলেই এর নাম হয়েছে মন্টেনিগ্রো। কিন্তু এই শহরের নাম বুধভা কেন হলো? এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই আবিষ্কার করে ফেললাম। ওল্ড টাউন থেকে বেরুলেই টাউনের প্রধান ফটকের সামনে এক সুবিশাল স্কয়ার, আর ঠিক স্কয়ারের মাঝখানে এক সুবিশাল ভাস্কর্য। আমার স্ত্রী মুক্তি বলল, দেখ তো এটা কার ভাস্কর্য? আরে এ তো বুদ্ধ, গৌতম বুদ্ধ। তখনই আমি নিশ্চিত হই, বুদ্ধের নামানুসারেই এই জায়গার নাম হয়েছে বুধভা। এতে আমার আর সন্দেহের লেশমাত্রও রইল না।
পরদিন সকালে একটি বোট ভাড়া করে ছুটলাম অড্রিয়াটিকের বুকে, আজ আমরা এই সমুদ্রটাকে জয় করে ফেলব। বোটম্যান বলল, সেইন্ট স্টিভেন দ্বীপে যাবেন? আমরা বললাম, যেখানে খুশি নিয়ে যাও। মুক্তি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ও আসলে কিছুটা ভয়ও পাচ্ছে, সাঁতার জানে না তো। বোটম্যান বলল, ম্যাডাম ভয়ের কিছু নেই, যেখানেই পড় তুমি ডুববে না, আর আমি তো আছিই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আমাদের নিয়ে এলো সেইন্ট স্টিভেন দ্বীপে। এ যেন এক চিরশান্তির দ্বীপ, ছোট্ট এক চিলতে, যেন সুবিশাল এক পাথরের চাঁই পড়ে আছে অড্রিয়াটিকের বুকে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর জেনে গেলাম ওপরে শুধু এক পাথরের চাঁই মনে হলেও, এর পেটের ভেতর রয়েছে একটি পাঁচতারা হোটেল। বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। এই হোটেলে অবকাশ যাপন করতে আসেন পৃথিবীর সব সেরা চলচ্চিত্র তারকা। হলিউডের এমন কোনো সেরা তারকা নেই যিনি এই সেইন্ট স্টিভেনে আসেননি। রুম ভাড়া শুনে আমাদের মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। কিছুটা সময় সেইন্ট স্টিভেনের চূড়োয়, একটি গাছের নিচে, নীল সুইমিংপুলের পাশে, আশ্চর্য সুন্দর পরিবেশে কিছুক্ষণ অতিবাহিত করে আমরা ফিরে এলাম আমাদের রিজার্ভ বোটে। এরপর ছুটতে শুরু করলাম হার্জেক নবির দিকে।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments