একান্ত পাথেয় by কে জি মোস্তফা

কেউ কেউ বলে অলৌকিকতা এক ধরনের ভ্রান্তি। কিন্তু বস্তু জগতের উপরিস্তরে একটা কিছু রয়েছে যাকে বলা হয় ‘সেকেন্ড অর্ডার মিনিং’। অনুভূতি দিয়ে যার স্বাদ নেয়া হয়। অনুভূতির সেই অভিজ্ঞতা বাস্তবতার ঊর্ধ্বে সত্যিসত্যি অন্য এক বাস্তবতাকে শনাক্ত করতে পারে।

জীবনের অতল সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ অসম্পূর্ণ কিন্তু অসমাপ্ত নয়। সময়ের স্রোতে যে জীবন ভেসে যায়, যে ঘটনা একবারের বেশি ঘটে না, তার কিন্তু কোনো ভারই নেই, কঠিন পরীক্ষা বা বিচারের থেকে সে মুক্ত। অলৌকিকভাবে এই সত্যকে মুহূর্তের জন্য কেউ কেউ দেখতে পায়, যদিও আবার ফিরে যেতে হয় নিজের গণ্ডিতে। খুঁজতে থাকে পুনরাবৃত্তি। দৈবক্রমে আমার জীবনে এমন দু’একটি অভিজ্ঞতা ঘটেছে যার তুলনা সহজে পাওয়া যায় না। ১৯৪৭/১৯৪৮ সালের কথা। আমরা পাঁচজন মহসীন-বৃত্তি পরীক্ষা দিতে শহরে যাওয়ার জন্য ট্রেনের অপেক্ষায়। সঙ্গে রয়েছেন কোচিং স্যার। ট্রেন আসার শব্দ শুনে যাত্রীসাধারণ নড়েচড়ে উঠল। স্টেশন জুড়ে হৈ-হল্লা। সেই কোলাহলের মধ্যে অপরিচ্ছন্ন বেশভূষায় হঠাত্ এক ব্যক্তি আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করতে লাগল। কাছে এসে চিত্কার করে বলল, যা তুই বৃত্তি পেয়ে যাবি। এরই মধ্যে ট্রেনও এসে পড়ল। ভিড়ের মধ্যে ফকিরবাবা উধাও। ট্রেনে আমাকে নিয়ে শুরু হলো হাসিঠাট্টা-মশকরা। সাধারণত আমাদের স্কুল থেকে প্রতিবার দু’জনকে মনোনীত করা হয় বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। পায় একজনই। সেবার নানা কারণে আমিসহ পাঁচজনকে মনোনীত করা হয়েছিল। আমার স্থান ছিল পঞ্চম। কিন্তু কী আশ্চর্য, ফার্স্টবয় আর আমি শেষ পর্যন্ত বৃত্তি পেয়ে গেলাম! কেউ কেউ বলবেন,বাজ পড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। আমি কিন্তু সেভাবে দেখিনি।
আরেকটি ঘটনা। ষাট দশকের প্রথমদিকে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গীতিকার হিসেবে চিত্রালীতে আমার ছবি ছাপা হয়েছিল। পাশাপাশি নায়ক-নায়িকাদের। কারা জানি এ খবর আমার অভিভাবকদের নজরে পৌঁছায়। বংশলতিকায় আমি পীরবংশের ছেলে। আমি বুঝি পথভ্রষ্ট হয়ে গেছি। এখন উদ্ধারের একমাত্র উপায় আমার বিয়ের ব্যবস্থা করা। তোড়জোড় করে প্রায় পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হলো। পাত্রী ঢাকায় থাকে ভাইয়ের বাসায়। আনুষ্ঠানিক দেখাশোনার পর দিন-তারিখ ঠিক হবে। ঘটনাচক্রে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তখন ঢাকায়। নির্দিষ্ট দিনক্ষণে তাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলাম। দেখা-সাক্ষাতের পর দু’জনেরই মন ভীষণ খারাপ। বন্ধু রুষ্ট হয়ে বলল, তুই যদি এখানে বিয়ে করিস, আমি গলায় দড়ি দেব। আমি তো অসহায়। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। অপ্রত্যাশিতভাবে খবর এলো, বাবা মত পাল্টেছেন, এখানে বিয়ে হবে না। কী কারণ! নোয়াখালীর চৌমুহনীতে তখন পীর হাফেজ মহিউদ্দীন সাহেব জীবিত। সাদাসিধে মানুষ, দু চোখে ঠিকরে পড়া আলোর ঝলকানি। হঠাত্-হঠাত্ রেগে যেতেন। কোনো কারণে কারও উপর রেগে গেলে ইট-পাটকেল নিয়ে পিছু ধাওয়া করতেন। ওই সময় একদিন আমার বাবা তার সামনে দিয়ে যেতেই হঠাত্ তিনি এমন ক্ষেপে উঠলেন, দৌড়ে পালিয়ে বাবা কোনো রকমে বেঁচে যান। বাবার মনে নতুন চিন্তা, এ বিয়ে নিশ্চয় অমঙ্গল বয়ে আনবে। তিনি তত্ক্ষণাত্ মত পাল্টিয়ে ফেললেন।
এমনি ছিল পীর হাফেজ মহিউদ্দীন সাহেবের প্রতি স্থানীয়দের ভক্তি ও আস্থা। তার অনেক অলৌকিক ঘটনা লোকের মুখে মুখে। বর্তমানে তার মাজার বেগমগঞ্জ থানার এখলাসপুরে, যেখানে আজও অগণিত ভক্তের সমাবেশ ঘটে, অনুষ্ঠিত হয় দোয়া-মাহফিল। আধুনিক দৃষ্টিতে অলৌকিকতার উপাদান অবাস্তব, অসত্য মনে হয়; কিন্তু বলা যেতে পারে অতি সত্য। জ্ঞানেরও রাজনীতি আছে এবং সেই রাজনীতির ভালো-মন্দ আমরা বিচার করব আমাদের অবস্থান থেকেই। আমাদের পঠন-পাঠন, উপলব্ধি, বোধ বহুলাংশে চরিত্রনির্ভর। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আকর্ষিত করে অদ্ভুত কিছু মুখ বা চরিত্র। অজানা নয়, অনামা। জাগতিক ব্যাপারে এরা নির্লিপ্ত উদাসীন। মনের দিক থেকে সমাজ-সংসার, সব মানবিক সম্পর্কের বাইরে। প্রত্যেকে নিঃসঙ্গ, গভীরভাবে একা।
যাই হোক জীবনের সব অভিজ্ঞতা আর পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যায় না। কিছু রয়ে যায় একান্ত ব্যক্তিগত। ব্যক্তির সঙ্গেই বিনাশ হয় তার, আর কারও কাজে লাগে না। নিষ্কর্মা, নস্ফিলা এই অভিজ্ঞতার জন্যই তবু বাঁচতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় ভালোবাসতে।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.