মামলা: মন্ত্রীর ভাই বাচ্চু ও এপিএসসহ আসামি ১৪-আসামিদের মধ্যে আ'লীগের ১১, বিএনপির ২ by শাহেদ চৌধুরী,
নরসিংদী পৌরসভার মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু ও এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে নরসিংদী মডেল থানায় ৩০২/৩৪/১০৯ দণ্ডবিধিতে মামলা হয়েছে। মামলা নং-৬। মামলায় জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক আহমদ এবং শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আসামির তালিকায় আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল মতিন সরকার ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া।
আসামিদের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগের এবং দু'জন বিএনপির। অন্যজন প্রেসকর্মী। লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল বাদী হয়ে গতকাল রাত ১২টায় এ মামলা করেন।
মামলায় আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। বাচ্চু জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। বাড়ি রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ ইউনিয়নে। মামলায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদকে ৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে। দ্বিতীয় আসামি করা হয়েছে নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকারকে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। বাড়ি নরসিংদী শহরের দত্তপাড়ায়। তার ভাই আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকারকেও আসামি করা হয়েছে। মামলার ৮নং আসামি করা হয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতা মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে তারেক আহমদকে। তিনি গত পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেনের প্রতিপক্ষ ছিলেন। তার বাড়ি বানিয়াছল এলাকায়। তারেক নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি। তিনি হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামকেও মামলার আসামি করা হয়েছে।
লোকমান হত্যার অভিযোগে বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতার করা হলেও
তাকে মামলায় আসামি করা হয়নি। এ মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল
এজাহারে বলেছেন, তার বড় ভাই লোকমান হোসেন নরসিংদী পৌরসভার বর্তমান মেয়র। তিনি পরপর দু'দফায় বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ মেয়র হিসেবে দু'দফায় গোল্ড মেডেল পেয়েছেন লোকমান হোসেন। তিনি মিউনিসিপাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ঢাকা বিভাগের সভাপতি, বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি নরসিংদী পৌরসভার সর্বস্তরের জনগণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাস্তাঘাটসহ শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে পৌরসভাকে আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করেছেন। তার রাজনৈতিক উত্থান দেখে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তারা প্রায়ই লোকমান হোসেনকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করতেন। টেলিফোনেও বিভিন্ন সময় হুমকি দিতেন। আসন্ন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে লোকমান হোসেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। পক্ষান্তরে সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু নিজেও ওই পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন; কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে এবং লোকমান হোসেনের জনসমর্থনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন। আবদুল মতিন সরকার এবং তারেক আহমদ বিগত পৌরসভা নির্বাচনে লোকমান হোসেনের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিতেন। লোকমান হোসেনের রাজনৈতিক উত্থান এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এই প্রভাবশালীদের সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রভাবশালী তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। লোকমান হোসেন এ নিয়ে তার পরিবারের সদস্য ও কিছু হিতাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে আলোচনাও করেন। এ ধরনের শত্রুতার জের হিসেবে তাকে খুন করা হয়েছে। এ জন্য দায়ীরা হলেন_ ১. সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু (পিতা- মৃত আফছার উদ্দিন, বাড়ি- রায়পুরার আদিয়াবাদে, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য), ২. আবদুল মতিন সরকার (পিতা- মৃত সালাহউদ্দিন সালু সরকার, বাড়ি- দত্তপাড়া, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি), ৩. মোবারক হোসেন মোবা (পিতা- মৃত জজ মিয়া, বাড়ি- পশ্চিম কান্দাপাড়া, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক), ৪. মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা- মৃত আবদুল জব্বার ভূঁইয়া, বাড়ি- দত্তপাড়া, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি; লোকমান হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন), ৫. নুরুল ইসলাম (পিতা- মৃত ডা. আমিনুল ইসলাম, বাড়ি- বৌয়াকুড়, শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক), ৬. মনোয়ার হোসেন খান মঈন (পিতা- মৃত বেলায়েত হোসেন খান, বাড়ি- মধ্য কান্দাপাড়া, স্থানীয় রহমান প্রেসের কর্মচারী), ৭. হিরণ মিয়া (পিতা- মৃত আজিজ মিয়া, বাড়ি- খেলানগর, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী), ৮. তারেক আহমদ (পিতা- মৃত মৌলভি তোফাজ্জল হোসেন, বাড়ি- বানিয়াছল, জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), ৯. মাসুদুর রহমান মুরাদ (পিতা- মৃত আবদুর রশিদ মাস্টার, বাড়ি- রায়পুরার আদিয়াবাদ, ডাক ও টেলিযোগযোগমন্ত্রীর এপিএস, আওয়ামী লীগ কর্মী), ১০. কবির সরকার (পিতা- রহমান সরকার, বাড়ি- মহিলা কলেজের পাশে, স্থানীয় যুবলীগ নেতা)। এ ১০ আসামি পরস্পরের যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে লোকমান হোসেনকে খুন করার জন্য চারজনকে নির্দেশ দেন। তারা হলো_ ১. আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার (পিতা- মৃত সালাহউদ্দিন সরকার ওরফে সালু সরকার, বাড়ি- দত্তপাড়া, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা), ২. মিয়া মোঃ মনজুর (পিতা- মৃত আবদুর রশিদ, বাড়ি- দত্তপাড়া, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা), ৩. আমির হোসেন আমু (পিতা- মৃত আজিজ মিয়া, বাড়ি- ভেলানগর, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী), ৪. মামুন (পিতা- মৃত মানিক মিয়া, বাড়ি- ভেলানগর, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী) এবং অজ্ঞাতপরিচয় সাত-আটজন।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে এজাহারে বলেছেন, তার ভাই পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে নরসিংদী সদর রোডের জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে বসে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতাকর্মীর সঙ্গে জেলা সম্মেলন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। রাত আনুমানিক ৮টায় আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার, মিয়া মোঃ মনজুর, আমির হোসেন আমু, মামুন ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও সাত-আট সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে আসে। এ সময় উপস্থিত লোকজনের সামনে আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে লোকমান হোসেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ওই গুলি লোকমান হোসেনের বুকের বাঁ পাশের উপরিভাগে বিদ্ধ হয় এবং তিনি গুরুতর আহত হন। মিয়া মোঃ মনজুর হত্যার উদ্দেশ্যে তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করলে তা লোকমান হোসেনের পেটের বাঁ পাশে নাভির নিচে বিদ্ধ হয় এবং তিনি গুরুতর জখম হন। আমির হোসেন আমু তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করলে তা লোকমান হোসেনের ডান বাহুতে বিদ্ধ হয়। মামুন তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করলে সেটা লোকমান হোসেনের পেটের বাঁ পাশের নাভির নিচে বিদ্ধ হয়। আরেক অজ্ঞাতপরিচয় আসামি তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালালে সেটা লোকমান হোসেনের পেটের বাঁ পাশে নাভির নিচে বিদ্ধ হয়। লোকমান হোসেন ওই সময় চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন আশপাশের ও জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের অস্থায়ী কার্যালয়ে থাকা লোকজন আসামিদের ধাওয়া করলে তারা ফাঁকা গুলি করে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্বদিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন নরসিংদী সদর হাসপাতালে লোকমান হোসেনকে নিয়ে যায়। এ সংবাদ পাওয়ার পর তার ভাই কামরুজ্জামান কামরুল লোকজন নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যান এবং অ্যাম্বুলেন্সযোগে গুরুতর আহত অবস্থায় লোকমান হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। নরসিংদী থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় লোকমান হোসেন তার ভাই কামরুজ্জামান কামরুলকে তার ওপর হামলার পুরো ঘটনার বিবরণ দেন। পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত প্রায় ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ঢাকার শাহবাগ থানা পুলিশ লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে এবং পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে লোকমান হোসেনের মরদেহ নরসিংদীর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
কামরুজ্জামান এজাহারে বলেছেন, বৈদ্যুতিক আলো থাকায় আশপাশের লোকজন ও দলীয় কার্যালয়ে উপস্থিত সবাই লোকমান হোসেনকে হত্যা করার ঘটনা দেখেছেন। তিনি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছেন।
বিএনপি নেতা খোকনের জামিন নামঞ্জুর : লোকমান হোসেন হত্যাকা ে জড়িত সন্দেহে মঙ্গলবার রাতে ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করা বিএনপি নেতা ও নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনের জামিন নামঞ্জুর করা হয়েছে। তাকে নরসিংদী জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্য পাঁচজন_ জাহেদুল ইসলাম, তৌহিদ সরকার, সঞ্জীব দাস, সোহেল ও সাজ্জাদ হোসেন নরসিংদী জেলা কারাগারে রয়েছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খায়রুল কবীর খোকনকে কড়া পুলিশ পাহারায় নরসিংদীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশিকুল খবীরের আদালতে আনা হলে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা ভিড় জমায়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ ছিল সীমিত। খোকনের জামিন নামঞ্জুর হয়। পুলিশ তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করলেও আদালত তা মঞ্জুর না করে ৯ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেন।
মামলায় আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। বাচ্চু জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। বাড়ি রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ ইউনিয়নে। মামলায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদকে ৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে। দ্বিতীয় আসামি করা হয়েছে নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকারকে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। বাড়ি নরসিংদী শহরের দত্তপাড়ায়। তার ভাই আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকারকেও আসামি করা হয়েছে। মামলার ৮নং আসামি করা হয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতা মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে তারেক আহমদকে। তিনি গত পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেনের প্রতিপক্ষ ছিলেন। তার বাড়ি বানিয়াছল এলাকায়। তারেক নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি। তিনি হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামকেও মামলার আসামি করা হয়েছে।
লোকমান হত্যার অভিযোগে বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতার করা হলেও
তাকে মামলায় আসামি করা হয়নি। এ মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল
এজাহারে বলেছেন, তার বড় ভাই লোকমান হোসেন নরসিংদী পৌরসভার বর্তমান মেয়র। তিনি পরপর দু'দফায় বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ মেয়র হিসেবে দু'দফায় গোল্ড মেডেল পেয়েছেন লোকমান হোসেন। তিনি মিউনিসিপাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ঢাকা বিভাগের সভাপতি, বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি নরসিংদী পৌরসভার সর্বস্তরের জনগণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাস্তাঘাটসহ শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে পৌরসভাকে আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করেছেন। তার রাজনৈতিক উত্থান দেখে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তারা প্রায়ই লোকমান হোসেনকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করতেন। টেলিফোনেও বিভিন্ন সময় হুমকি দিতেন। আসন্ন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে লোকমান হোসেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। পক্ষান্তরে সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু নিজেও ওই পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন; কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে এবং লোকমান হোসেনের জনসমর্থনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন। আবদুল মতিন সরকার এবং তারেক আহমদ বিগত পৌরসভা নির্বাচনে লোকমান হোসেনের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিতেন। লোকমান হোসেনের রাজনৈতিক উত্থান এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এই প্রভাবশালীদের সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রভাবশালী তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। লোকমান হোসেন এ নিয়ে তার পরিবারের সদস্য ও কিছু হিতাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে আলোচনাও করেন। এ ধরনের শত্রুতার জের হিসেবে তাকে খুন করা হয়েছে। এ জন্য দায়ীরা হলেন_ ১. সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু (পিতা- মৃত আফছার উদ্দিন, বাড়ি- রায়পুরার আদিয়াবাদে, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য), ২. আবদুল মতিন সরকার (পিতা- মৃত সালাহউদ্দিন সালু সরকার, বাড়ি- দত্তপাড়া, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি), ৩. মোবারক হোসেন মোবা (পিতা- মৃত জজ মিয়া, বাড়ি- পশ্চিম কান্দাপাড়া, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক), ৪. মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা- মৃত আবদুল জব্বার ভূঁইয়া, বাড়ি- দত্তপাড়া, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি; লোকমান হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন), ৫. নুরুল ইসলাম (পিতা- মৃত ডা. আমিনুল ইসলাম, বাড়ি- বৌয়াকুড়, শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক), ৬. মনোয়ার হোসেন খান মঈন (পিতা- মৃত বেলায়েত হোসেন খান, বাড়ি- মধ্য কান্দাপাড়া, স্থানীয় রহমান প্রেসের কর্মচারী), ৭. হিরণ মিয়া (পিতা- মৃত আজিজ মিয়া, বাড়ি- খেলানগর, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী), ৮. তারেক আহমদ (পিতা- মৃত মৌলভি তোফাজ্জল হোসেন, বাড়ি- বানিয়াছল, জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), ৯. মাসুদুর রহমান মুরাদ (পিতা- মৃত আবদুর রশিদ মাস্টার, বাড়ি- রায়পুরার আদিয়াবাদ, ডাক ও টেলিযোগযোগমন্ত্রীর এপিএস, আওয়ামী লীগ কর্মী), ১০. কবির সরকার (পিতা- রহমান সরকার, বাড়ি- মহিলা কলেজের পাশে, স্থানীয় যুবলীগ নেতা)। এ ১০ আসামি পরস্পরের যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে লোকমান হোসেনকে খুন করার জন্য চারজনকে নির্দেশ দেন। তারা হলো_ ১. আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার (পিতা- মৃত সালাহউদ্দিন সরকার ওরফে সালু সরকার, বাড়ি- দত্তপাড়া, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা), ২. মিয়া মোঃ মনজুর (পিতা- মৃত আবদুর রশিদ, বাড়ি- দত্তপাড়া, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা), ৩. আমির হোসেন আমু (পিতা- মৃত আজিজ মিয়া, বাড়ি- ভেলানগর, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী), ৪. মামুন (পিতা- মৃত মানিক মিয়া, বাড়ি- ভেলানগর, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী) এবং অজ্ঞাতপরিচয় সাত-আটজন।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে এজাহারে বলেছেন, তার ভাই পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে নরসিংদী সদর রোডের জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে বসে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতাকর্মীর সঙ্গে জেলা সম্মেলন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। রাত আনুমানিক ৮টায় আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার, মিয়া মোঃ মনজুর, আমির হোসেন আমু, মামুন ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও সাত-আট সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে আসে। এ সময় উপস্থিত লোকজনের সামনে আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফুল সরকার তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে লোকমান হোসেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ওই গুলি লোকমান হোসেনের বুকের বাঁ পাশের উপরিভাগে বিদ্ধ হয় এবং তিনি গুরুতর আহত হন। মিয়া মোঃ মনজুর হত্যার উদ্দেশ্যে তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করলে তা লোকমান হোসেনের পেটের বাঁ পাশে নাভির নিচে বিদ্ধ হয় এবং তিনি গুরুতর জখম হন। আমির হোসেন আমু তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করলে তা লোকমান হোসেনের ডান বাহুতে বিদ্ধ হয়। মামুন তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করলে সেটা লোকমান হোসেনের পেটের বাঁ পাশের নাভির নিচে বিদ্ধ হয়। আরেক অজ্ঞাতপরিচয় আসামি তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালালে সেটা লোকমান হোসেনের পেটের বাঁ পাশে নাভির নিচে বিদ্ধ হয়। লোকমান হোসেন ওই সময় চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন আশপাশের ও জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের অস্থায়ী কার্যালয়ে থাকা লোকজন আসামিদের ধাওয়া করলে তারা ফাঁকা গুলি করে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্বদিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন নরসিংদী সদর হাসপাতালে লোকমান হোসেনকে নিয়ে যায়। এ সংবাদ পাওয়ার পর তার ভাই কামরুজ্জামান কামরুল লোকজন নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যান এবং অ্যাম্বুলেন্সযোগে গুরুতর আহত অবস্থায় লোকমান হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। নরসিংদী থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় লোকমান হোসেন তার ভাই কামরুজ্জামান কামরুলকে তার ওপর হামলার পুরো ঘটনার বিবরণ দেন। পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত প্রায় ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ঢাকার শাহবাগ থানা পুলিশ লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে এবং পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে লোকমান হোসেনের মরদেহ নরসিংদীর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
কামরুজ্জামান এজাহারে বলেছেন, বৈদ্যুতিক আলো থাকায় আশপাশের লোকজন ও দলীয় কার্যালয়ে উপস্থিত সবাই লোকমান হোসেনকে হত্যা করার ঘটনা দেখেছেন। তিনি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছেন।
বিএনপি নেতা খোকনের জামিন নামঞ্জুর : লোকমান হোসেন হত্যাকা ে জড়িত সন্দেহে মঙ্গলবার রাতে ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করা বিএনপি নেতা ও নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনের জামিন নামঞ্জুর করা হয়েছে। তাকে নরসিংদী জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্য পাঁচজন_ জাহেদুল ইসলাম, তৌহিদ সরকার, সঞ্জীব দাস, সোহেল ও সাজ্জাদ হোসেন নরসিংদী জেলা কারাগারে রয়েছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খায়রুল কবীর খোকনকে কড়া পুলিশ পাহারায় নরসিংদীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশিকুল খবীরের আদালতে আনা হলে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা ভিড় জমায়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ ছিল সীমিত। খোকনের জামিন নামঞ্জুর হয়। পুলিশ তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করলেও আদালত তা মঞ্জুর না করে ৯ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেন।
No comments