কোরবানি হাটে শেয়ারবাজার ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব : হাটে গরু আছে ক্রেতা নেই : আজ থেকে জমার আশা ইজারাদারদের by আলাউদ্দিন আরিফ

র মাত্র দুই দিন পর ঈদুল আজহা। এরই মধ্যে ঢাকার হাটগুলো জমে ওঠার কথা। অথচ হাটে গবাদিপশুর সংখ্যা অনুসারে ক্রেতা নেই। কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে গরু, মোষ ও খাসি তোলা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু ক্রেতার উপস্থিতি নগণ্য। গাবতলী হাটে কিছু গরু বিক্রি হলেও গতকাল পর্যন্ত নগরীর অস্থায়ী হাটগুলো ছিল সুনসান। ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে হাটের মাইকে অবিরাম প্রচারণা চালাচ্ছেন ইজারাদাররা। কিন্তু সাড়া মিলছে না। আজ থেকে পুরোদমে বেচাবিক্রি আশা করছেন ইজাদাররা। তারা আরও বলছেন, এবার কোরবানির পশুর হাট আশানুরূপ জমবে না।


কারণ শেয়ারবাজারের ক্রমাগত ধসে প্রায় ১৫ লাখ বিনিয়োগকারীর নিঃস্ব অবস্থা, জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেরই বেতন হয়নি। ফলে এবার পশুর চাহিদা তুলনামূলক কম থাকবে।
গতকাল দুপুরে মতিঝিল ব্যাংক পাড়ায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক ঘুরে দেখা গেছে টাকার হাহাকার। গ্রাহকদের বড় চেকগুলোর বিপরীতে চাহিদামত টাকা দিতে পারছিল না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তার প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ৮ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। বেতন-বোনাসের জন্য প্রয়োজন প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। মার্কেটে তার পাওনা আছে অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি। ৫টি ব্যাংকে ওই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট আছে। গতকাল কোনো ব্যাংকই ২ কোটি টাকার চেকও রিসিভ করেনি। খুচরা টাকা মিলিয়ে ৪ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। বাকি টাকার চিন্তায় অস্থির হয়ে বসে ছিলেন ওই এমডি। প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার, চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্টসহ ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়েছেন টাকা সংগ্রহের জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এমডি এই প্রতিবেদকে জানান, চাহিদার অর্ধেকেরও কম টাকা সংগ্রহ হয়েছে। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও বোনাস দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারা বড় গ্রাহক, আগে থেকেই ব্যাংকে বিষয়টি জানানো আছে। এরপরও ব্যাংক বলছে টাকা নেই। এতে ওই প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৮ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঈদ আনন্দে যে কালো মেঘের ছায়া পড়েছে এমডির অবস্থা দেখে সেটা সহজে অনুমান করা যায়। এমডি বলেন, অ্যাকাউন্টে টাকা আছে। এরপরও যদি ব্যাংক থেকে না পাওয়া যায় তাহলে কী করার আছে। কারওয়ানবাজার পান্থপথ এলাকায় কয়েকটি ব্যাংকে দেখা গেছে, ৫০ হাজার টাকার উপরে চেক রিসিভ করছে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ঈদের আগে গতকালই ছিল ব্যাংক লেনদেনের শেষ দিন। টাকার অভাবে এ রকমই অবস্থা ছিল অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের।
এদিকে প্রায় ১৫ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে শেয়ারবাজারে। শেয়ারের ক্রমে দরপতনে তাদের অনেকেই এখন নিঃস্ব। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় তাদেরও ঈদ আনন্দ ধ্বংস হয়ে গেছে। মতিঝিলে আল আরাফা ব্রোকারেজ হাউসে লেনদেন করেন মো. আনোয়ার হোসেন। গতকাল তিনি জানান, অন্যান্য বছর একটি গরু ও দুটি খাসি কোরবানি দিতেন। কিন্তু এবার যা অবস্থা তাতে কোরবানি দেবেন কি না এখনও সিদ্ধান্ত নেননি। সন্তানদের মন রক্ষায় শেষ পর্যন্ত হয়তো কোরবানি দেবেন। কিন্তু এতে অনাবিল আনন্দ থাকবে না।
গাবতলী হাটের প্রবীণ ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি নূরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান জানান, শেয়ারবাজারের দরপতনের প্রভাব পড়েছে কোরবানির বাজারেও। ফলে এবার গরু বিক্রি হবে তুলনামূলক অনেক কম। তাছাড়া এখন বর্ডার খোলা। দেশীয় গরুর পাশাপাশি ভারতীয় প্রচুর গরু আসছে। বাজারে গরুর অভাব নেই। অভাব শুধু ক্রেতার।
বাংলাদেশ টেনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মো. হারুণ চৌধুরী জানান, প্রতি বছর কোরবানিতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার চামড়া পাওয়া যায়। এবার জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষের যা অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে চামড়াও এবার কম পাওয়া যাবে। ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে আগে যারা ৬-৭টি করে পশু কোরবানি দিতেন তারা ২-৩টি আর যারা একটি দিতেন তারাও হয়তো ভাগিদারসহ কোরবানি দেবেন। সব মিলিয়ে এবার পশু কম বিক্রি ও কোরবানিও কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নগরীতে যারা অস্থায়ী হাট বসিয়েছেন তারা বলছেন, ঢাকায় মূলত ক্রেতারা নামেন ঈদের একদিন আগে। গতকাল পর্যন্ত অফিস-আদালত খোলা ছিল। আজ কিছু ক্রেতা হাটে আসবেন। তারা দরদাম যাচাই করে সুবিধামত পেলে গরু কিনে নেবেন। শনিবার থেকে পুরোদমে হাট জমে ওঠার আশা ইজারাদারদের।
গাবতলী হাটের অবস্থা : গতকাল গাবতলী হাট ঘুরে বিত্র ঈদুল আজহার মাত্র ২ দিন বাকি থাকলেও রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাটে এখনও পুরোমাত্রায় বিক্রি শুরু হয়নি। টুকটাক বেচাকেনা চলেছে। তবে এসব কেনাকাটার বেশিরভাগই ছিল বেপারীদের মধ্যে। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, রাজশাহীর পাইকারদের কাছ থেকে গরু কিনেছে মৌসুমি বেপারীরা। সেগুলোর কোনটি গাবতলীতেই রাখছেন। কোনটি বেশি দামে বেচার আশায় অন্য হাটে নিয়ে যাচ্ছেন। খুচরাভাবে যারা কোরবানির উদ্দেশে গবাদিপশু কিনবেন তাদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
হাজি নূরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন বেপারী জানান, অন্যান্য বছর এ সময় হাটে যে সংখ্যক গরু আসে এবার এসেছে তার তুলনায় কম। পথে পথে দুর্ভোগ, যানজট ও পশুবাহী যানবাহনগুলোতে চাঁদাবাজির কারণে অনেকে গরু আনার উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছেন। হাট পরিচালনা কমিটির সদস্যরা আশা করছেন, আজকালের মধ্যেই হাটে পর্যাপ্তসংখ্যক পশু তোলা হবে। বেপারীরা বলেন, মোকামে যে দামে তারা গরু কিনেছেন তার চাইতেও অনেক কম দাম বলছে ক্রেতারা। তার ওপর পরিবহন খরচ ও হাটের খরচ তো আছে।
গাবতলীর হাটে তোলা হয়েছে ফরিদপুরের আনোয়ার মন্ডলের একটি ষাঁড়। এর দাম হাঁকা হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। অস্ট্রেলিয়ান জাতের গরুটির দাম গতকাল পর্যন্ত ৮ লাখ উঠেছে বলে মালিক দাবি করেছেন। এত দাম কেন—জানতে চাইলে আনোয়ার মন্ডল বলেন, বড় এই গরুটির সঙ্গে প্রায় ১ লাখ টাকা দামের আরেকটি গরু ফ্রি। হাটে অন্য কয়েকজন বেপারীও একটি বড় গরু কিনলে একটি ছোট গরু এবং একটি খাসির সঙ্গে একটি খাসি ফ্রি অথবা গরুর সঙ্গে খাসি ফ্রি দেয়ার কথা জানান।
গাবতলী হাটে এবার একটি মাত্র উট দেখা গেছে। উটের মালিক জানান, গতবছর যে ১২টি উট তোলা হয়েছে তারই একটি এটি। গতবার ১০টি বিক্রি হয়েছে, দুটি ছিল। একটি উট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এক বছর ধরে এই উটটি হাটেই লালন-পালন করেছেন। দাম চাইছেন ৪ লাখ টাকা। আজ আরও ৭টি উট আসবে বলে বেপারীরা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার গাবতলী হাটে ২৮টি গরু তুলেছেন বেপারী রহিম বাদশা। দরদাম হয়েছে। ১৫টির মতো গরুও বিক্রিও হয়েছে। তবে তার সবগুলোই অন্য বেপারীদের কাছে। এগুলো বিক্রি করে আবার গরু আনার ইচ্ছে তার। একই অবস্থা আরেক বেপারী মো. সিদ্দিকের। ১০টি গরু নিয়ে দুই দিন আগে এসেছেন তিনি। সাধারণ ক্রেতা বা ব্যবসায়ী কারও কাছে একটিও বিক্রি করতে পারেননি।
গরু বিক্রির ব্যাপারে রয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। ক্রেতার অভিযোগ, বিক্রেতারা বেশি দাম চাচ্ছেন। বিক্রেতা বলছেন যানবাহন খরচ, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং পথে পথে চাঁদাবাজির কারণে হাটে এসে গরুর দাম বাড়িয়ে চাইতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
দুপুরে গাবতলী হাটে গরু কিনতে যান মিরপুর বাগবাড়ীর বাসিন্দা ব্যবসায়ী আলহাজ আবুল হোসেন। বড় আকারের একটি গরুর দাম জানতে চাইলে বেপারী আবু বকর ৩ লাখ টাকা হাঁকলেন। সাইদ আহমেদ ১ লাখ টাকা দাম বললেন। প্রায় আধঘণ্টা পর আমিনবাজারের আরেক ব্যবসায়ী মঈন আহমেদ একই গরুর দাম জানতে চাইলে এবার বেপারী দাম চাইলেন ৪ লাখ টাকা। আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে দামের এই হেরফের কেন—জানতে চাইলে বেপারী আবু বকর নিজেই বললেন, যে দামে বিক্রি করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ক্রেতারা তার অর্ধেকেরও কম বলে। এজন্য বেশি দাম চাইছি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দাম কম-বেশি যা-ই চাওয়া হচ্ছে, সে অনুযায়ী বেচতে পারছেন না বেপারীরা। এ কারণে অনেক বেপারী কম লাভে গরু বিক্রি করছেন, আবার কেউ বিক্রি করছেন না। তবে বড় গরুর ক্ষেত্রে বেশি দাম হাঁকা হলেও ছোট গরুর দাম কমই চাওয়া হচ্ছে বলে জানান একাধিক বিক্রেতা।
বেপারী আবদুল হালিম জানান, তার কাছে থাকা সবচেয়ে বড় গরুটির দাম হাঁকা হচ্ছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং সবচেয়ে ছোট গরুটির দাম হাঁকা হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। অথচ ক্রেতারা বড়টির দাম বলছে দেড় লাখ টাকা এবং ছোটটির দাম বলছে ৩০ হাজার টাকা—যা মোকামে তার কেনা দামের চাইতেও অনেক কম।
গতকাল গাবতলী হাটে দেশি গরুর তুলনায় ভারতীয় গরুর আধিক্য দেখা গেছে। বেপারীরা জানালেন, এ বছর সীমান্ত খোলা। ফলে নির্ভয়ে এবং অবাধে ভারত থেকে গরু আনতে পারছে বেপারীরা।
গাবতলী পশুর হাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সাইদুল ইবনে হাসিব বলেন, হাটে ৬ থেকে ৭ হাজার গরু আর প্রায় দুই হাজার ছাগল নতুন করে তোলা হচ্ছে। আজ-কালের মধ্যে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। এখান থেকে রাজধানীর বিভিন্ন হাটে নেয়ার জন্য বেপারীরাও আসছেন। তিনি বলেন, খুচরা ক্রেতাদের মধ্যে যাদের পশু রাখার জায়গা আছে, তারা পশু কিনছেন। কেউ কেউ যাচ্ছে বাজার যাচাই করতে। আজ থেকে বিক্রি জমবে বলে আশা তাদের।

No comments

Powered by Blogger.