খোকনকে গ্রেফতারের নিন্দা : নিজেদের গৃহবিবাদের দায় বিএনপির ওপর চাপাতে চায় সরকার - খালেদা জিয়া

রসিংদীর পৌর মেয়র হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদের দায় বিএনপির ওপর চাপাতে সরকার ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্পাদক খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দেয়া এক বিবৃতিতে গতকাল তিনি এ অভিযোগ করেন। এদিকে নরসিংদীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গতকাল জামিন আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন।


বিরতিতে খালেদা জিয়া আরও বলেন, অন্যায়, অসত্ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আইনানুগ প্রক্রিয়া ছাড়াই খোকনকে গ্রেফতার করে সারাদিন বসিয়ে রেখে সন্ধ্যায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৫৪ ধারায় আটক দেখানো হয়েছে। একজন রাজপথের পরীক্ষিত নেতাকে বেআইনিভাবে গ্রেফতার ও পাঁচদিনের রিমান্ড চেয়ে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে এ সরকার তাদের স্বৈরাচারী মনোভাব প্রদর্শন করেছে।
তিনি বলেন, নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেদের গৃহবিবাদের দায় বিএনপির ওপর চাপানোর ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যেই আওয়ামী সরকার খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পৌর মেয়র লোকমানকে হত্যার পর নরসিংদীতে সংঘটিত শাসক দলের নেতাকর্মীদের তাণ্ডবলীলা নজিরবিহীন। খালেদা জিয়া বলেন, সেখানে বাড়িঘর, বাস, ট্রেন, সরকারি ভবন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত। সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে বরং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে চক্রান্তের জাল বুনে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আওয়ামী সরকার দেশ পরিচালনায় জনস্বার্থের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে গুম, খুন ও অপহরণের ওপর নির্ভর করার জন্যই সমাজে ভয়ঙ্কর নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী দুঃশাসনের ফলে মানুষের প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। সরকারের গণবিরোধী নীতির ফলে জনদুর্ভোগ সীমাহীন আকার ধারণ করেছে বলেই জনদৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বানোয়াট অজুহাত খাড়া করে আন্দোলনরত বিরোধী দলের ওপর তারা দোষ চাপাচ্ছে। শুধু সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতিচর্চার কারণেই শাসক দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তাদের অন্দর মহলের হিংসাত্মক রেষারেষিতে অসংখ্য নেতাকর্মী হতাহত হয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে গণতান্ত্রিক চেতনার চরম অভাবের কারণেই আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদের পথ ধরে এগোচ্ছে, যার ফলে উন্নয়ন ও জনকল্যাণকে মাটি চাপা দিয়ে তারা মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে অর্থনৈতিক চরম দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তাই নিজেদের অপকর্ম ঢাকা দেয়ার জন্যই নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে বিরোধী দলের নেতাদের ওপর ক্ষমতার জোরে হামলা-মামলার অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। অতীতে এদের কাছে গণতন্ত্র কখনওই নিরাপদ থাকেনি এবং হানাহানিই এদের রাজনৈতিক দর্শন বলে বিএনপি চেয়ারপার্সন উল্লেখ করেন।
বেগম জিয়া নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানান এবং প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানান। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকনের রিমান্ড আবেদন বাতিল করে তার আশু মুক্তি দাবি করেন।
মন্ত্রীর সঙ্গে কোন্দলেই নরসিংদী মেয়র খুন - বিএনপি : নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কোন্দলকে দায়ী করেছে বিএনপি। গতকাল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দায় আড়াল করতেই খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি খোকনকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার দাবিও জানান।
মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মুখোশধারী ব্যক্তিদের গুলিতে নিহত হন নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন। ওই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য খায়রুল করিব খোকনকে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়।
নয়া পল্টনে সংবাদ সম্মেলনে রিজভী আরও বলেন, পত্র-পত্রিকা ও নিজস্ব সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, কমিটি গঠন নিয়ে এক মন্ত্রীর সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফসল পৌর মেয়র হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞ। নরসিংদী জ্বলছে, অথচ সরকার নির্বিকার। তিনি বলেন, উল্টো বিএনপির কেন্দ্রীয় শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খোকনকে কোনো মামলা ছাড়া ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। এটা সরকারের গভীর চক্রান্ত।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমানের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর দ্বন্দ্ব চলছিল। সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন রিজভী। লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর শহরের ডাকবাংলো ভাংচুর করে বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগকর্মীরা। রাজিউদ্দিন রাজু শহরে গেলে এ ডাকবাংলোয় থাকেন। এছাড়া রাজুর ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িও ভাংচুর হয়েছে।
ডাকসুর সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) খোকনের মুক্তি দাবি করে রিজভী বলেন, ট্রেনে আগুন, সার্কিট হাউস ভাংচুরসহ পুরো জেলায় যে তাণ্ডব চলছে, সেদিকে সরকারের কোনো নজর নেই। বরং তারা ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র করছে।
যে মন্ত্রীকে নিয়ে অভিযোগ করছেন, তার গ্রেফতার দাবি করছেন কিনা—প্রশ্ন করা হলে রিজভী বলেন, এ ঘটনা ক্ষমতাসীন দলের বিবাদের জের। এর সঙ্গে যে বা যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। ক্ষমতাসীন দলকে বলব, হানাহানি বন্ধ করুন। বিরোধী দলকে জড়ানোর চক্রান্ত থেকে বিরত থাকুন।
লোকমান হত্যার পরদিন এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসে আগুন দেয়ার ঘটনার পরও সরকারের নিষ্ক্রিয়তা তুলে ধরে গত বছর সিরাজগঞ্জে ট্রেনে আগুনের পর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের তুলনা করেন রিজভী।
তিনি বলেন, তখন ট্রেন দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা কয়েকটি বগিতে আগুন দিলে আমাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সরকার মামলা দিয়েছিল। কিন্তু এগারসিন্দুর ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনার দুদিন চলে গেলেও এখনও কোনো মামলা হয়নি।
স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করা হবে না খোকনের : স্বজনদের সঙ্গে ঈদ পালন করা হবে না ডাকসু’র সাবেক জিএস, বিএনপির কেন্দ্রীয় শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনের। রিমান্ডের শুনানি শেষে খোকনের জামিন নামঞ্জুর করে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে নরসিংদীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় জেলা কারাগার থেকে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে করে খোকনকে আদালতে আনা হয়। এ সময় খোকনের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লা মিয়াসহ অন্যান্য আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
শুনানিতে খোকনের পক্ষে আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লা মিয়া ও অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারের নেতৃত্বে শতাধিক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত হন। অন্যদিকে জামিনের বিরোধিতা করেন এপিপি অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান শফিক। পরে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ম্যাজিস্ট্রেট আশিকুল কবির আগামী ৯ নভেম্বর ফের রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য এবং জামিন নামঞ্জুর করে খোকনকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ সময় আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে বিক্ষোভ করেন।
পরে আদালতের বাইরে এসে খোকনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লা মিয়া বলেন, পৌর মেয়র লোকমান হোসেন আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের কারণে খুন হয়েছেন। এ হত্যার সঙ্গে জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবির খোকনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ হত্যার মোটিভ অন্যদিকে নেয়ার জন্যই খোকনকে জড়ানো হয়েছে।
আইনজীবীরা সাংবাদিকদের আরও বলেন, এখনও মামলার জন্মই হয়নি, অথচ জিডির বলে গ্রেফতার দেখিয়ে খায়রুল কবির খোকনকে অযথা হয়রানি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে খোকনের মুক্তির দাবিতে দুইদিন ধরে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সভা, সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যাহত রেখেছে বিএনপি নেতাকর্মীরা।
নরসিংদীর বেলাবো, শিবপুর ও মাধবদীতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খোকনের আটকের বিরোধিতা করে তার নিঃশর্ত মুক্তি ও নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের প্রকৃত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হয়। তারা বিনা অপরাধে খায়রুল কবির খোকনকে আটকের জন্য তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে নরসিংদী শহরের সদর রোডে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন লোকমান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় রাত ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার পাঁচ ঘণ্টার মাথায় মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে খোকনকে আটক করেন।

No comments

Powered by Blogger.