শোডাউন করে শামীম ওসমানের হুঙ্কার : সবকিছু ওলটপালট করতে বেশি সময় লাগবে না : বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে আইভী জিতেছে

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত মেয়র প্রার্থী শামীম ওসমান বলেছেন, ‘নির্বাচনে কেউ জিতলে পরের তিন দিন তার মাথা গরম থাকে। তিন দিন গত হয়েছে। কেউ আপনাদের হুমকি দিলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। যারা হুমকি দেবে, তাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে যাব। গিয়ে আমি হুমকির জবাব দিয়ে আসব। এই কাজটা খুব ভালো পারি। পাঞ্জাবি খুলে এবার জিনসের প্যান্ট পরে নামব। আমরা সাচ্চা আওয়ামী লীগার। ক্ষমতায় এখনও আওয়ামী লীগ আছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী।


সব কিছু ওলট-পালট করে দিতে আমার বেশি সময় লাগবে না।’গতকাল বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে শো-ডাউন করেন শামীম। স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগের মাঠরাজনীতি নিজের দখলে রাখতেই তার এই হঠাত্ উদ্যোগ।
চিহ্নিত সন্ত্রাসী-ক্যাডারদের নিয়ে তিনি এক পদযাত্রায় অংশ নেন। এলাকাবাসীর মাঝে লিফলেট বিলি করেন। র্যালির আগে পৈতৃক বাসভবন হীরা মহলে এক কর্মিসভায় শামীম ওসমান আরও বলেন—‘নির্বাচনের আগে আমি বলেছি আইভীর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের যোগাযোগ আছে। আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামবে। বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন ঠেকাতে রাজপথে লোকজন নিয়ে মাঠে নেমে আইভীকে প্রমাণ করতে হবে আমরা মিথ্যা বলেছিলাম।’
শামীম দাবি করেন, গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, তুমি চাইলে ভোট কেন্দ্র দখল করে নির্বাচনে জিততে। সে ক্ষমতা তোমার রয়েছে। কিন্তু তা তুমি করোনি। সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
শামীম ওসমান আরও বলেন, বিগত সংসদ নির্বাচনে সিটি করপোরেশন এলাকায় বিএনপি-জামায়াত ভোট পেয়েছিল এক লাখ ১১ হাজার। এখন গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বিএনপি-জামায়াতের ভোট আরও বাড়ার কথা। সিটি নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ভোট কার বাক্সে পড়েছে। যেসব ভোটকেন্দ্রে ইভিএম ছিল সেখানে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘নির্বাচনে শামীমকে ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াত, মিডিয়া, বামপন্থী, মেনন, ইনু—সব এক হয়েছে। দুই পা কবরে চলে যাওয়া বুড়ো মুসাও। নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার পাশে গণভবনে আমার ছবি দেখে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার হতাশ হয়েছে। তারা মনে করেছিল, শামীম ওসমান নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন তারা আমার বিরুদ্ধে কোন চাল চালে কে জানে?’
সভায় ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর থেকে আসা লোকজনের সংখ্যাই ছিল বেশি। সভাশেষে শামীম পাঁচ-ছয় হাজার লোক নিয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় পথচারীদের কাছে প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়। কড়া পুলিশি প্রহরাও ছিল। শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ ক্যাডাররা পুরো র্যালি কর্ডন করে রাখে।
জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোনো বিশৃঙ্খলা করা হবে না—শামীম ওসমানের এ ধরনের প্রতিশ্রুতি পেয়েই তাকে রাস্তায় নামার অনুমতি দেয় পুলিশ।
‘চেঞ্জ ইমেজ, চেঞ্জ নারায়ণগঞ্জ’ স্লোগান নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে দখলে রাখতে মাঠে নামেন শামীম ওসমান। তিনি এক ডজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে নিয়ে এই শোডাউনের মাধ্যমে তার অবস্থান জানান দেন শহরবাসীকে। পরাজয়ের ৪ দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শহরে এ শো-ডাউন করেন। এর আগে ৪ থানা এলাকার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা করেন শামীম। ওই সময় শামীম তার অনুসারীদের ভীত না হয়ে মাঠে থাকার নির্দেশ দেন। বলেন, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি আমরাই করব। আর থানার নেতৃত্ব আপনাদের হাতেই থাকবে। এখানে তৃতীয় কারো কোনো স্থান নেই। কারণ, আমরা নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করলে অন্য কেউ এর হাল ধরবে না।
গতকাল সকালে শহরের চাষাঢ়ায় শামীম ওসমানের পৈতৃক বাড়ি হীরা মহলে এক মতবিনিময় সভা হয়। মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত সাধারণ কাউন্সিলরদের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, নূর হোসেন, শাহজালাল বাদল, আলী হোসেন আলা, শফিকুল ইসলাম এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের মধ্যে জান্নাতুল ফেরদৌস নীলা ও ইশরাত জাহান স্মৃতি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম সাইফুল্লাহ বাদল, সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী, বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রশিদসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
শামীম ওসমান তার বক্তব্যে আরও বলেন, আমি নির্বাচনে ফেল করতাম না। বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে আঁতাত করে প্রতিপক্ষ প্রার্থী ডা. আইভী পাস করেছে। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে আমাদের দলের একাধিক নেতা কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তার (শামীম ওসমান) পক্ষে সঠিকভাবে নেতাকর্মীরা কাজ করতে পারেনি। তবে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে যদি একজন করে প্রার্থী কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নিত তাহলে তাদের জয় ছিল নিশ্চিত।
এছাড়া টাকার কাছে বিক্রি হওয়া নারায়ণগঞ্জের কিছু কথিত বুদ্ধিজীবীর ঢালাও অপপ্রচার, কিছু মিডিয়ার বিরুদ্ধাচরণই তার পরাজয়কে নিশ্চিত করেছে বলে শামীম ওসমান অভিযোগ করেন। শামীম নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ করি। তার বংশধরদের কেউ পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসলে আমাদের পরবর্তী বংশধররা তাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ করবে। কারণ, আমাদের বাপ-দাদারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ করতো, আর আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ করি।
লিফলেটে শামীম ওসমান যা বলেছেন : র্যালি থেকে বিতরণ করা লিফলেটে বলা হয়েছে, গত ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য জানাই সাদর অভিনন্দন। আপনারা জানেন, এই নির্বাচনকে ঘিরে নানামুখী ষড়যন্ত্র হয়েছিল। শুধুমাত্র প্রগতিশীল ও স্বাধীনতার সপক্ষে কথা বলার অপরাধে বিএনপি প্রার্থীকে রাতের আঁধারে বসিয়ে দেয়া, নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ ও বক্তব্য দেয়া, কিছু মুখচেনা ও পয়সায় কেনা বুদ্ধিজীবীর ব্যাপক অপপ্রচার এবং আমাকে ও নারায়ণগঞ্জবাসীকে সন্ত্রাসী বানানোর শত চেষ্টা সত্ত্বেও আপনারা সুষ্ঠু নির্বাচনের যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, সেজন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। সর্বোপরি এত কিছুর পরেও আপনাদের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি, সেই ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার মতো নগণ্য মানুষের নেই। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের মাঝেই সৃষ্টিকর্তার বসবাস। তাই বাকি জীবনে আপনাদের খুশি করে আমি সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করতে চাই। নির্বাচনে যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন তাদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। যারা ভোট দেননি নিশ্চয়ই আমি তাদের মন জয় করতে পারিনি। তাদেরকেও জানাই আমার শ্রদ্ধা ও সালাম। আপনারা দোয়া করবেন, যাতে আগামী দিনে আপনাদের মন জয় করতে পারি। আমি অতীতে যেমন আপনাদের পাশে থেকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি, সকল অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম, তেমনি ভবিষ্যত্ দিনগুলোতেও আপনাদের পাশে থাকবো ইনশাল্লাহ। আমি একজন অতিসাধারণ মানুষ। আমার কোন ক্ষমতা নাই। তার পরেও আপনারা দোয়া করবেন আল্লাহ যেন আপনাদের সুখে-দুখে পাশে থেকে সেবার করার তৌফিক দেন। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি আধুনিক সুখী নারায়ণগঞ্জ গড়ে তুলি। আমাদের স্লোগান হোক ‘চেঞ্জ ইমেজ, চেঞ্জ নারায়ণগঞ্জ’। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন আপনাদের সকলের সহায় হোন। আপনাদেরই স্নেহধন্য —এ কে এম শামীম ওসমান।

No comments

Powered by Blogger.