হজের নামে গিয়ে অপরাধে জড়ানো-১৫১ জনকে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি by ওমর ফারুক

জের নামে বিদেশে গিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারে_এমন আশঙ্কা থেকে এবার ২৮৯ জনকে মনোনীত করার পরও হজে যেতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের মধ্যে বিমানে ওঠার আগমুহূর্তে ১৫১ জনের যাত্রা স্থগিত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মহিলাও রয়েছেন। প্রত্যাখ্যাতদের মধ্যে একজন কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি চাকরির উদ্দেশ্যেই হজ ভিসায় সৌদি আরব যাচ্ছিলেন।বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের স্পেশাল পুলিশ সুপার নাফিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিভিন্ন অভিযোগে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটকে দেওয়া হয়েছে।


এ ছাড়া অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী জালিয়াতি করে সৌদি আরবে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছিল।' পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উপ-পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, 'দেশে অজ্ঞান ও মলম পার্টি, পকেটমার দলের অনেক সদস্য ধরা পড়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, তারা হজের নামে সৌদি আরবে গিয়ে অপরাধ করে থাকে। অনেকে জানিয়েছে, ধরা পড়ার পর সৌদি আরবে জেলও খেটে এসেছে।'
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এখনো সৌদি আরবের কারগারে অজ্ঞান পার্টির কয়েকজন সদস্য অন্তরীণ রয়েছে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ গলাকাটা পাসপোর্ট ব্যবহার করে সৌদি আরবে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকেই আছে হজের ভিসা নিয়ে সেখানে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে। এতে দুই-তিন মাসেই কয়েক লাখ টাকা আয় করে পরে দেশে ফেরে। এ কারণেই যারা হজ করতে যাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
যে ১৫১ জনকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন_চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কেউছিয়া গ্রামের আবু মুছার ছেলে মো. শহীদুল ইসলাম (৩২)। তিনি হজের ভিসা নিয়ে অক্টোবর মাসে যাওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসার পর ইমিগ্রেশন পুলিশ তাঁকে ফিরিয়ে দেয়। তাঁর পাসপোর্ট নম্বর ই-১৩৩৫০৮০। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্বীকার করেন, সৌদি আরবে চাকরি করার জন্যই যাচ্ছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে সৌদি আরবের ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণেই তিনি এভাবে যাচ্ছিলেন। তিনি জানান, চট্টগ্রামের ফ্লাই ওয়ার্ল্ড নামের একটি এজেন্সির মাধ্যমে এই ভিসা করিয়েছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁর বাবা বর্তমানে সৌদি আরবে চাকরি করছেন।
এ তালিকায় রয়েছেন_রাজধানীর দক্ষিণ কাফরুলের ৪৫৩/৩ নম্বর বাড়ির সিদ্দিক বাগির মেয়ে সোহেলি বেগমও। তাঁর পাসপোর্ট নম্বর এএ-৫২৩১২২১। গতকাল দুপুরে কাফরুলের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির সদস্যরাও কেউ ছিলেন না। পাশের বাড়ির এক মহিলা জানান, সোহেলি বেগম স্বামীর সঙ্গে ধানমণ্ডিতে বসবাস করেন। তাঁর কাছ থেকে সোহেলি বেগমের নম্বর নিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বললে সোহেলি জানান, 'আমি আমার বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য বাবার সঙ্গে হজে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাবার মস্তিকে সমস্যা দেখা দেওয়ায় যেতে পারেননি। এ কারণে আমি নিজেই যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে যাই। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর পুলিশ আমার সঙ্গে মহরম (কোনো পুরুষ আত্মীয়) না থাকায় আমাকে আটকে দেয়। আমি যেতে পারিনি।' তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সোহেলি অন্য উদ্দেশ্যেই সৌদি আরব যাচ্ছিলেন।
ফিরিয়ে দেওয়াদের মধ্যে আরো রয়েছেন নাটোরের লালপুরের কুজিপুকুর গ্রামের আবদুল আজিজ সরকারের ছেলে মো. ওমর ফারুক; মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানার দুলিহাটা গ্রামের মজিবুর রহমান ভুঁইয়া, তাঁর পাসপোর্ট নম্বর ই-১৩০২৩৩৬। টঙ্গিবাড়ীর শিমুলিয়া গ্রামের মো. আনছার আলী মালের ছেলে মো. রুবেল মাল, তাঁর পাসপোর্ট নম্বর ই-১৩৩৮৯০৯। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের পালপাড়া গ্রামের আশরাফ খানের ছেলে আবু হোসেন। পাসপোর্ট নম্বর এবি-৫২১৬৫২২। নরসিংদীর শিবপুরের সাদারচর গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে রবিউল আক্তার, তাঁর পাসপোর্ট নম্বর এফ-০৬৫১৭৭৩। ফিরিয়ে দেওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাত্রী ছিলেন কঙ্বাজার ও চট্টগ্রাম এলাকার।
সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক যুবক আবেদনকারী আছেন, তাঁদের বাবা-মা হজে যাননি। তাঁর অর্থিক সংগতিও হজে যাওয়ার মতো নয়। এমনকি তিনি নামাজও পড়েন না। অনেক অবেদনকারীকে দেখা গেছে, তাঁদের আয়ের উৎস খুবই কম। মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। ঋণ নিয়ে তিনি হজে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার এমন অনেক নারীকেও পাওয়া গেছে, যাঁরা তরুণী। নিয়মানুযায়ী মেয়েদের রক্তের সম্পর্কের কোনো পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে হজে যাওয়ার কথা। কিন্তু কাউকে না নিয়ে কেউ একাই চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, হাজিদের ব্যাগে ব্লেড মেরে টাকা নেওয়া, পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়া, ফেরার জন্য হজ ফ্লাইট শেষ হওয়ার তিন-চার মাস পর দেশে ফেরাদের ব্যাপারে পুলিশ আগেই ডাটা বেইস তৈরি করে রেখেছিল। তাঁদের মধ্যে সহস্রাধিক ব্যক্তি এবারও হজে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তবে ভিসাই পাননি তাঁরা। আবার এমন অনেকেই আছেন, তাঁর স্ত্রী না, সন্তান না, কিন্তু স্ত্রী-সন্তান সাজিয়ে হজে যাচ্ছেন। তাঁদেরও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এবার হজ করার জন্য এক লাখ সাত হাজার ৩৭২ জন আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে ভিসা পেয়েছেন এক লাখ পাঁচ হাজার ৮৯৬ জন। তাঁদের মধ্য থেকে গত বুধবার শেষ ফ্লাইটসহ গত ৩৩ দিনে এক লাখ পাঁচ হাজার ৬১৭ জন সৌদি আরবে গেছেন। ভিসাপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে ২৮৯ জনকে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় আটকে দেওয়া হয়। আবেদন করার পরপরই আবেদন করা ব্যক্তিদের বিষয়ে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) থেকে তাঁদের যাওয়ার উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা হয়। দুই হাজার ৫৭৬ জনকে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধ বিরূপ প্রতিবেদন দাখিলের কারণে তাঁরা কেউ ভিসাই পাননি। অন্যদের ভিসা দেওয়া হয়।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ভিসা পাওয়ার পরও হজযাত্রীদের যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে আগে কোনো অপরাধের প্রমাণ আছে কি না এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হয়। এবারই প্রথম ডবল চেক করা হলো। বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৪০ বছরের নিচে, তাঁদের ব্যাপারে বেশি খোঁজখবর নেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.