তারায় তারায় শুধু বোবা অন্ধকার... ব্য জুনান নাশিত
রুমানার দুই চোখে অন্ধকার। কোনোকালে সেখানে আলো ফুটবে কি না, তা ভবিতব্যই বলতে পারে। কিন্তু এখন ‘চিরজীবনের মোর ধ্রুবতারা-সম/ চিরপরিচয়-ভরা ঐ কালো চোখে’ যে বোবা অন্ধকার, তার ভার এত বেশি শুধু রুমানার জন্যই নয়, আমাদেরও বয়ে বেড়ানো ভীষণ দুঃসাধ্য। যে চোখ নিয়ে হাজারো কাব্য, সাহিত্য সে চোখ যখন মানুষরূপী হায়েনার হিংস্র ছোবলে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে, তখন এ বেদনা, এ কষ্ট, এ দুঃখ আর ক্ষোভ রাখার জায়গা কোথায়? আমার অন্তত জানা নেই।
রুমানা মনজুর চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে বিপুল বেদনা আর হতাশা সঙ্গে নিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন। ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। ডাক্তাররা তাঁর চোখ নিয়ে তেমন কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি। তাঁর বিশ্ব এখন আলোহীন গহিন অন্ধকারে ডুবে গেছে। কিন্তু কেন? কেন এমনটা হবে? কেন এমনটা হয়?
একবিংশ শতাব্দীর এ সভ্য দুনিয়ায় জীবনের পাল উড়িয়ে এ দেশের নারীরা যখন সব দিক জয়ে ব্যস্ত, তখন রুমানার ওপর চালানো বর্বরতার ব্যাখ্যা দেওয়া সত্যিই দুঃসাধ্য। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, রুমানার ওপর নির্দয় অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ পাওয়ার প্রথম দিকে কেউ কেউ এর যৌক্তিকতা খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে, রুমানার স্বামী সাইদের আটকের পরপরই তিনি যে সহজ ও চিরাচরিত কাজটি করে বসলেন, তাতে অতি উৎসাহী কিছু লোক বলেই বসেছিলেন, ‘দেখেছেন, বলেছিলাম না? এ রকম কিছু না থাকলে কি আর স্বামী ও রকম করে?’ নির্বোধদের ভোঁতা আক্রমণে শুধু ক্ষত বাড়ে না, গায়ে জ্বালা ধরে। রি রি করে। আরে, এ তো এক অতি সস্তা আলাপন!
আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি কেবল এবারই প্রথম নয়, সাইদ রুমানার গায়ে বরাবরই হাত তুলতেন। ৫ জুনের জঘন্য এ ঘটনার দিন কয়েক আগেও তিরি রড দিয়ে রুমানাকে পিটিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন, রুমানা একজন উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও স্বাবলম্বী হয়েও কেন নিজেকে রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হলেন? কেন তিনি দিনের পর দিন এ অসভ্য আচরণ সহ্য করলেন? কেন তিনি অনেক আগেই অসহনীয় এ দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এলেন না? কেন তিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না? কেন তাঁর মতো আত্মমর্যাদাশীল নারীকেও শিউরে ওঠার মতো দুর্বোধ্য হামলার শিকার হতে হয়? কেন তিনি স্বামী-সংসারকেই চরম বলে ভেবে নিজের জীবনকে তার বেদিতলে সঁপে দিলেন? (চোখ যাওয়া জীবন যাওয়ারই সমার্থক)। কেন তিনি ছিলেন তথাকথিত ‘ভালো স্ত্রী’ আর জীবনে ‘সুখী দাম্পত্যের সিল’ আঁটাতে এত তন্ময়?
এই অনেকগুলো কেনর উত্তরে বলতে হয়, আমাদের প্রচলিত সমাজ ও পরিবারই এ জন্য মূলত দায়ী। সমাজ ও পরিবারের এক অদৃশ্য শৃঙ্খল ও চাপ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, স্বাবলম্বী কিংবা সহায়হীন সব নারীকেই কমবেশি সহ্য করতে হয়। বলা যায়, করতে তাঁরা বাধ্য হন। কারণ একজন নারী তাঁর সংসার থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে কোনো রকম মর্যাদা নিয়েই বাঁচতে পারেন না। তাঁকে বাঁচতে দেওয়া হয় না। এমনকি পরিবারও কোনোভাবেই চায় না মেয়ে তার স্বামীর সংসার থেকে বেরিয়ে আসুক। সে রুমানার মতো উচ্চশিক্ষিতই হোক আর সহায়-সম্বলহীন প্রান্তিক কোনো নারীই হোক। উভয়কে নিয়ে সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য খুব একটা নজরে আসে না। তাই সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রুমানার মতো নারীদেরও পারিবারিক সম্মান, মর্যাদা আর প্রিয় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের টালমাটাল পরিস্থিতির আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত স্বামী-সংসারের তথাকথিত ঘেরাটোপকেই মেনে নিতে হয়। যেমনটা নিয়েছিলেন রুমানাও।
দেশে নারীশিক্ষার হার বেড়েছে। নারীরা এখন কর্মে নিযুক্ত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দিন দিনই তাঁদের স্বাবলম্বী হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে নারী সম্পর্কে সমাজ ও পরিবারে নানা ধরনের যে ট্যাবু প্রচলিত ছিল, তা আজও বহাল তবিয়তেই রয়েছে। বদলায়নি এতটুকু। বাহ্যিক একটা পরিবর্তনের ঢেউ লক্ষ করা গেলেও অন্তঃস্রোতে বয়ে চলেছে প্রথাগত সেই প্রাচীন ধারা। ফলে পরিস্থিতি দিন দিনই সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় অবশ্যই কাউকে না কাউকে ভাবতে হবে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম রুমানার দুটি চোখ নিয়ে। কারণ দিনের যাবতীয় কাজের ভিড়ে কেবলি রুমানার চোখ দুটির কথাই বেশি মনে পড়ে। ভারত থেকে ফিরে চোখে কালো চশমার রুমানা সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আমরা তা দেখেছি টিভিতে, পরদিনের পত্রপত্রিকায়।
শরীরের যেকোনো অঙ্গহানিই জীবনের জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে আসে। কিন্তু চোখ? চোখ হারানোর মতো পীড়াদায়ক কিছু আছে বলে মনে হয় না। শরীরের প্রতিটি অঙ্গই অত্যন্ত মূল্যবান, সন্দেহ নেই। কিন্তু চোখের অস্তিত্ব আমার কাছে আরও বেশি গুরুত্ববহ। শরীরের কোনো কোনো অঙ্গের অভাব পূরণে বিকল্পের সাহায্য নিতে পারি। কিন্তু চোখের বিকল্প কী? জানা আছে কারও?
চোখের ব্যবহারিক ভূমিকার কথা বাদই দিলাম, তার যে অপরিসীম অন্তর্গত অবদান আমাদের প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকায়, তা ভুলে যাই কী করে? রুমানা সম্ভবত আর কোনো দিনই দেখতে পাবেন না এই পৃথিবী আর প্রকৃতিকে, তার আপন সন্তানকে, বাবা, মা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবকে। দেখার গভীর আনন্দ থেকে তিনি হয়তো সারা জীবনের মতোই বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন। এই রুমানার জন্য আমাদের কোনো সমবেদনাই কি যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে? হবে না জানি। কিন্তু এটুকু অন্তত গভীরভাবে প্রয়োজন, হাসান সাইদের এমন কোনো শাস্তি, যাতে দ্বিতীয় কোনো পুরুষ স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার আগে অন্তত একবার ভাববে। আর রুমানার ভেতরের গুমরে ওঠা কান্নার দমকে বিদীর্ণ হতে হতে আমরাও কিছু হলেও সান্ত্বনা কিংবা স্বস্তি পাব।
জুনান নাশিত: কবি ও সাংবাদিক।
nashit_junan@yahoo.com
রুমানা মনজুর চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে বিপুল বেদনা আর হতাশা সঙ্গে নিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন। ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। ডাক্তাররা তাঁর চোখ নিয়ে তেমন কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি। তাঁর বিশ্ব এখন আলোহীন গহিন অন্ধকারে ডুবে গেছে। কিন্তু কেন? কেন এমনটা হবে? কেন এমনটা হয়?
একবিংশ শতাব্দীর এ সভ্য দুনিয়ায় জীবনের পাল উড়িয়ে এ দেশের নারীরা যখন সব দিক জয়ে ব্যস্ত, তখন রুমানার ওপর চালানো বর্বরতার ব্যাখ্যা দেওয়া সত্যিই দুঃসাধ্য। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, রুমানার ওপর নির্দয় অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ পাওয়ার প্রথম দিকে কেউ কেউ এর যৌক্তিকতা খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে, রুমানার স্বামী সাইদের আটকের পরপরই তিনি যে সহজ ও চিরাচরিত কাজটি করে বসলেন, তাতে অতি উৎসাহী কিছু লোক বলেই বসেছিলেন, ‘দেখেছেন, বলেছিলাম না? এ রকম কিছু না থাকলে কি আর স্বামী ও রকম করে?’ নির্বোধদের ভোঁতা আক্রমণে শুধু ক্ষত বাড়ে না, গায়ে জ্বালা ধরে। রি রি করে। আরে, এ তো এক অতি সস্তা আলাপন!
আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি কেবল এবারই প্রথম নয়, সাইদ রুমানার গায়ে বরাবরই হাত তুলতেন। ৫ জুনের জঘন্য এ ঘটনার দিন কয়েক আগেও তিরি রড দিয়ে রুমানাকে পিটিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন, রুমানা একজন উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও স্বাবলম্বী হয়েও কেন নিজেকে রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হলেন? কেন তিনি দিনের পর দিন এ অসভ্য আচরণ সহ্য করলেন? কেন তিনি অনেক আগেই অসহনীয় এ দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এলেন না? কেন তিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না? কেন তাঁর মতো আত্মমর্যাদাশীল নারীকেও শিউরে ওঠার মতো দুর্বোধ্য হামলার শিকার হতে হয়? কেন তিনি স্বামী-সংসারকেই চরম বলে ভেবে নিজের জীবনকে তার বেদিতলে সঁপে দিলেন? (চোখ যাওয়া জীবন যাওয়ারই সমার্থক)। কেন তিনি ছিলেন তথাকথিত ‘ভালো স্ত্রী’ আর জীবনে ‘সুখী দাম্পত্যের সিল’ আঁটাতে এত তন্ময়?
এই অনেকগুলো কেনর উত্তরে বলতে হয়, আমাদের প্রচলিত সমাজ ও পরিবারই এ জন্য মূলত দায়ী। সমাজ ও পরিবারের এক অদৃশ্য শৃঙ্খল ও চাপ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, স্বাবলম্বী কিংবা সহায়হীন সব নারীকেই কমবেশি সহ্য করতে হয়। বলা যায়, করতে তাঁরা বাধ্য হন। কারণ একজন নারী তাঁর সংসার থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে কোনো রকম মর্যাদা নিয়েই বাঁচতে পারেন না। তাঁকে বাঁচতে দেওয়া হয় না। এমনকি পরিবারও কোনোভাবেই চায় না মেয়ে তার স্বামীর সংসার থেকে বেরিয়ে আসুক। সে রুমানার মতো উচ্চশিক্ষিতই হোক আর সহায়-সম্বলহীন প্রান্তিক কোনো নারীই হোক। উভয়কে নিয়ে সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য খুব একটা নজরে আসে না। তাই সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রুমানার মতো নারীদেরও পারিবারিক সম্মান, মর্যাদা আর প্রিয় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের টালমাটাল পরিস্থিতির আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত স্বামী-সংসারের তথাকথিত ঘেরাটোপকেই মেনে নিতে হয়। যেমনটা নিয়েছিলেন রুমানাও।
দেশে নারীশিক্ষার হার বেড়েছে। নারীরা এখন কর্মে নিযুক্ত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দিন দিনই তাঁদের স্বাবলম্বী হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে নারী সম্পর্কে সমাজ ও পরিবারে নানা ধরনের যে ট্যাবু প্রচলিত ছিল, তা আজও বহাল তবিয়তেই রয়েছে। বদলায়নি এতটুকু। বাহ্যিক একটা পরিবর্তনের ঢেউ লক্ষ করা গেলেও অন্তঃস্রোতে বয়ে চলেছে প্রথাগত সেই প্রাচীন ধারা। ফলে পরিস্থিতি দিন দিনই সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় অবশ্যই কাউকে না কাউকে ভাবতে হবে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম রুমানার দুটি চোখ নিয়ে। কারণ দিনের যাবতীয় কাজের ভিড়ে কেবলি রুমানার চোখ দুটির কথাই বেশি মনে পড়ে। ভারত থেকে ফিরে চোখে কালো চশমার রুমানা সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আমরা তা দেখেছি টিভিতে, পরদিনের পত্রপত্রিকায়।
শরীরের যেকোনো অঙ্গহানিই জীবনের জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে আসে। কিন্তু চোখ? চোখ হারানোর মতো পীড়াদায়ক কিছু আছে বলে মনে হয় না। শরীরের প্রতিটি অঙ্গই অত্যন্ত মূল্যবান, সন্দেহ নেই। কিন্তু চোখের অস্তিত্ব আমার কাছে আরও বেশি গুরুত্ববহ। শরীরের কোনো কোনো অঙ্গের অভাব পূরণে বিকল্পের সাহায্য নিতে পারি। কিন্তু চোখের বিকল্প কী? জানা আছে কারও?
চোখের ব্যবহারিক ভূমিকার কথা বাদই দিলাম, তার যে অপরিসীম অন্তর্গত অবদান আমাদের প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকায়, তা ভুলে যাই কী করে? রুমানা সম্ভবত আর কোনো দিনই দেখতে পাবেন না এই পৃথিবী আর প্রকৃতিকে, তার আপন সন্তানকে, বাবা, মা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবকে। দেখার গভীর আনন্দ থেকে তিনি হয়তো সারা জীবনের মতোই বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন। এই রুমানার জন্য আমাদের কোনো সমবেদনাই কি যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে? হবে না জানি। কিন্তু এটুকু অন্তত গভীরভাবে প্রয়োজন, হাসান সাইদের এমন কোনো শাস্তি, যাতে দ্বিতীয় কোনো পুরুষ স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার আগে অন্তত একবার ভাববে। আর রুমানার ভেতরের গুমরে ওঠা কান্নার দমকে বিদীর্ণ হতে হতে আমরাও কিছু হলেও সান্ত্বনা কিংবা স্বস্তি পাব।
জুনান নাশিত: কবি ও সাংবাদিক।
nashit_junan@yahoo.com
No comments