শুধু ইউরো নয়, গণতন্ত্রও হুমকির মুখে by অমর্ত্য সেন
গণতন্ত্রের অনুশীলনে দুনিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছে ইউরোপ। সেখানে আজ আর্থিক অগ্রাধিকারের পেছনের দরজা দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দুর্দশায় নিপতিত। অথচ, এ বিষয়টি যতটা মনোযোগ দাবি করে, ততটা পাচ্ছে না। এটা উদ্বেগজনক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রেটিং এজেন্সিগুলোর ভূমিকা বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে ইউরোপের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কীভাবে উত্তরোত্তর দুর্বল হতে পারল—এসব গুরুতর বিষয় গুরুত্বের দাবি রাখে। ইউরোপের রাজনীতির জমিনে বহু জায়গায় এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রেটিং এজেন্সি এখন অবাধে প্রভুত্ব ফলিয়ে বেড়ায়।
দুটি স্বতন্ত্র বিষয়কে আলাদা করে বিবেচনা জরুরি। প্রথমটা, গণতান্ত্রিক অগ্রাধিকারগুলোর অবস্থানবিষয়ক। ওয়াল্টার ব্যাজট ও জন স্টুয়ার্ট মিল যাকে দেখেছেন ‘আলাপ-আলোচনার পথে শাসন পরিচালনার’ প্রয়োজনীয়তা হিসেবে, সেটাও এর আওতাভুক্ত। ধরুন, আমরা মেনে নিলাম যে কী করতে হবে সে ব্যাপারে ক্ষমতাধর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের বাস্তবসম্মত বোঝাপড়া আছে। তাহলে তা বরং গণতান্ত্রিক সংলাপে তাদের কথা শোনার দাবি জোরালো করবে। কিন্তু তাদের কথা শোনা আর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রেটিং এজেন্সিগুলোকে কর্তৃত্ব করতে দেওয়া তো এক জিনিস নয়।
দ্বিতীয়ত, সঙ্গিন রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিনায়কেরা যে আত্মত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছেন, তা সেসব দেশের চূড়ান্ত টেকসই এনে দেবে এবং আর্থিক একীভবনের সংস্কারশূন্য ছাঁচের ভেতরে ইউরো অব্যাহত থাকা এবং ইউরো ক্লাবের অপরিবর্তিত সদস্যপদ নিশ্চিত করবে—তেমনটা ঘটা বেশ কঠিন। রেটিং এজেন্সিগুলো যেভাবে আর্থিক সমস্যার কারণ নির্ণয় করে, তাতে যথার্থ সত্য উঠে আসে না। মনে রাখা ভালো যে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের আগে আগে রেটিং এজেন্সিগুলো কর্তৃক আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যয়নের রেকর্ড এতটাই জঘন্য ছিল যে মার্কিন কংগ্রেসে এদের বিচার করা উচিত কি না, তা নিয়ে আন্তরিক বিতর্ক হয়েছিল।
ইউরোপের বড় অংশই এখন সরকারের ব্যয় অনেক কমিয়ে দ্রুত ঘাটতি কমানোর চেষ্টারত। এ অবস্থায় যে নীতি নেওয়া হচ্ছে তার সম্ভাব্য প্রভাব সরকারের রাজস্ব সৃষ্টির ওপর কী হবে, তা বাস্তবভিত্তিকভাবে যাচাই-বাছাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘আত্মত্যাগ’-এর মতো উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের নিশ্চয় মাদকতা আছে। এটাই ‘যথার্থ’ কাঁচুলির দর্শন: ‘এটা পরে ম্যাডামের যদি একটুও আরাম লাগে, তাহলে ম্যাডামের নিশ্চয়ই এর থেকে ছোট সাইজেরটা দরকার।’ অবশ্য, আর্থিক যথার্থতার দাবিকে যদি তাৎক্ষণিক ব্যয় হ্রাসের সঙ্গে যান্ত্রিকভাবে সম্পর্কিত করা হয়, তাহলে এর ফল হতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকেই মেরে ফেলা।
এই আশঙ্কা ব্রিটেন থেকে গ্রিস পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে খাটে। গ্রিস বা পর্তুগালের মতো অপেক্ষাকৃত সঙ্গিন অবস্থায় পড়া দেশের ওপর কী ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া যায়, তার পক্ষে কতগুলো স্পষ্ট আপাতগ্রাহ্য অজুহাতের জোগান দেয় ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে ‘রক্ত, ঘাম ও অশ্রু’ কৌশলের সর্বজনীনতা। এর ফলে, আর্থিক বাজারে সঞ্চারিত ভীতি মোকাবিলার মতো ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক স্বর ইউরোপের ভেতর দানা বাঁধা কঠিন হয়ে পড়ে।
বৃহত্তর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন স্পষ্টতর অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা। সরকারের রাজস্ব সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা গভীরভাবে বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত। প্রবৃদ্ধি ও সরকারের রাজস্বের মধ্যে দৃঢ় সূত্র থাকার বিষয়টি চীন ও ভারত থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল পর্যন্ত বিশ্বের বহু দেশে দেখা গেছে।
এ ক্ষেত্রেও ইতিহাস থেকে শেখার আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে বহু দেশে সরকারের বিরাট ঋণের বোঝা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই বোঝা শিগগিরই কমে যায় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে। অনুরূপভাবে, প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ক্ষমতায় এসেই ১৯৯২ সালে বিশাল ঘাটতির মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মেয়াদেই সেই সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। দ্রুতগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ কাজে বিরাট সহযোগিতা করেছে।
গণতন্ত্র হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা ব্রিটেনের ক্ষেত্রে খাটে না। কেননা, এসব নীতি গ্রহণকারী সরকার গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে শক্তিশালী হয়ে এসেছে। নির্বাচনের সময় বলা হয়নি অথচ এখন বলা হচ্ছে এমন কোনো নীতি গ্রহণ করতে গেলে সেটা নিয়ে কিছু তর্ক-বিতর্ক হয়, সেই স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে বিজয়ীরা পেয়েই থাকে। তাতে আরও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা কমে না, এমনকি ব্রিটেনের মতো জায়গাতেও। তবে, ব্রিটেনের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণপ্রবণ নীতি কেমন করে গ্রিসের ওপর আরও কঠোর নীতি আরোপের অজুহাত তৈরি করে, সেটাও চিহ্নিত করা দরকার।
ইউরোভুক্ত কয়েকটি দেশ এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে কেমন করে এল? অধিকতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীভবন ছাড়াই একটি যৌথ মুদ্রার দিকে ধাবিত হওয়ার খামখেয়াল অবশ্যই এর পেছনে কাজ করেছে—গ্রিস বা পর্তুগালের মতো দেশ অতীতে অর্থনৈতিক চুক্তি ভঙ্গ করার ঘটনা স্মরণে রাখা সত্ত্বেও। এখন গ্রিক সরকার রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে। তা সত্ত্বেও সম্ভবপর সবকিছু করছে। কিন্তু গ্রিসের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আবশ্যপালনীয় শর্তাবলি এথেন্স বেদনাক্লিষ্ট হূদয়ে মেনে নেওয়ার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় না এসব ব্যবস্থা ও এসবের সময় নির্বাচন কতটা বিজ্ঞজনোচিত হয়েছে, তা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ইউরোপের ঐক্যের জোরালো সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি ইউরোর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলাম—সে কথা মনে করে এখন সান্ত্বনা খুঁজতে চাই না। ইউরোর ব্যাপারে আমার আশঙ্কা অংশত এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশ তাদের আর্থিক নীতি ও বিনিময়মূল্য সমন্বয়ের স্বাধীনতা পরিত্যাগ করার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এই স্বাধীনতা অতীতে বহু দেশকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে; আর্থিক বাজার স্থিতিশীল করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে গিয়ে মানুষের জীবনকে অস্থিতিশীল করে তোলার যে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, সেটা ঠেকিয়েছে। সেই আর্থিক নীতির স্বাধীনতা পরিত্যাগ করা যেত যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ইউরোপ একীভূত হয়ে উঠত (যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে যেমন একীভবন ঘটেছে)। কিন্তু ইউরো-অঞ্চলের আধাখেঁচড়া একীভবন বিপর্যয়ের পথই তৈরি করেছে। অসংলগ্ন আর্থিক একীভবনের এক সঙ্গিন কর্মসূচিকে ধারণ করতে তৈরি করা হয়েছে এক সম্মিলিত গণতান্ত্রিক ইউরোপের অপূর্ব রাজনৈতিক ধারণা।
এখন ইউরো-অঞ্চলের পুনর্বিন্যাসের সমস্যা হবে নানাবিধ। তবে কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা হতে হবে। যে সংকীর্ণ চিন্তা অতীতে ভয়ানক ফল বয়ে এনেছে, সেই সংকীর্ণতাপ্রসূত অর্থনৈতিক ঝড়ে ইউরোপকে ভেসে যেতে দেওয়া যাবে না। রেটিং এজেন্সিগুলোর একতরফা হুকুম জারি করার অপ্রতিরুদ্ধ ক্ষমতা অনতিবিলম্বে কমানোর মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হতে হবে। এসব এজেন্সির রেকর্ড জঘন্য হওয়ার পর এগুলোকে শৃঙ্খলার ভেতর নিয়ে আসা কঠিন। তবে সমাধানের কাজ চলার সময় (বিশেষত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়) অর্থনৈতিক আস্থার প্রশ্নে বড় পার্থক্য রচে দিতে পারে বৈধ সরকারের সুপ্রতিফলিত স্বর। ইউরোপের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রান্তিকীকরণ ঠেকানো আশু কর্তব্য। ইউরোপের গণতন্ত্র ইউরোপের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সারা দুনিয়ার জন্যও।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অমর্ত্য সেন: নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ।
দুটি স্বতন্ত্র বিষয়কে আলাদা করে বিবেচনা জরুরি। প্রথমটা, গণতান্ত্রিক অগ্রাধিকারগুলোর অবস্থানবিষয়ক। ওয়াল্টার ব্যাজট ও জন স্টুয়ার্ট মিল যাকে দেখেছেন ‘আলাপ-আলোচনার পথে শাসন পরিচালনার’ প্রয়োজনীয়তা হিসেবে, সেটাও এর আওতাভুক্ত। ধরুন, আমরা মেনে নিলাম যে কী করতে হবে সে ব্যাপারে ক্ষমতাধর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের বাস্তবসম্মত বোঝাপড়া আছে। তাহলে তা বরং গণতান্ত্রিক সংলাপে তাদের কথা শোনার দাবি জোরালো করবে। কিন্তু তাদের কথা শোনা আর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রেটিং এজেন্সিগুলোকে কর্তৃত্ব করতে দেওয়া তো এক জিনিস নয়।
দ্বিতীয়ত, সঙ্গিন রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিনায়কেরা যে আত্মত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছেন, তা সেসব দেশের চূড়ান্ত টেকসই এনে দেবে এবং আর্থিক একীভবনের সংস্কারশূন্য ছাঁচের ভেতরে ইউরো অব্যাহত থাকা এবং ইউরো ক্লাবের অপরিবর্তিত সদস্যপদ নিশ্চিত করবে—তেমনটা ঘটা বেশ কঠিন। রেটিং এজেন্সিগুলো যেভাবে আর্থিক সমস্যার কারণ নির্ণয় করে, তাতে যথার্থ সত্য উঠে আসে না। মনে রাখা ভালো যে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের আগে আগে রেটিং এজেন্সিগুলো কর্তৃক আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যয়নের রেকর্ড এতটাই জঘন্য ছিল যে মার্কিন কংগ্রেসে এদের বিচার করা উচিত কি না, তা নিয়ে আন্তরিক বিতর্ক হয়েছিল।
ইউরোপের বড় অংশই এখন সরকারের ব্যয় অনেক কমিয়ে দ্রুত ঘাটতি কমানোর চেষ্টারত। এ অবস্থায় যে নীতি নেওয়া হচ্ছে তার সম্ভাব্য প্রভাব সরকারের রাজস্ব সৃষ্টির ওপর কী হবে, তা বাস্তবভিত্তিকভাবে যাচাই-বাছাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘আত্মত্যাগ’-এর মতো উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের নিশ্চয় মাদকতা আছে। এটাই ‘যথার্থ’ কাঁচুলির দর্শন: ‘এটা পরে ম্যাডামের যদি একটুও আরাম লাগে, তাহলে ম্যাডামের নিশ্চয়ই এর থেকে ছোট সাইজেরটা দরকার।’ অবশ্য, আর্থিক যথার্থতার দাবিকে যদি তাৎক্ষণিক ব্যয় হ্রাসের সঙ্গে যান্ত্রিকভাবে সম্পর্কিত করা হয়, তাহলে এর ফল হতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকেই মেরে ফেলা।
এই আশঙ্কা ব্রিটেন থেকে গ্রিস পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে খাটে। গ্রিস বা পর্তুগালের মতো অপেক্ষাকৃত সঙ্গিন অবস্থায় পড়া দেশের ওপর কী ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া যায়, তার পক্ষে কতগুলো স্পষ্ট আপাতগ্রাহ্য অজুহাতের জোগান দেয় ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে ‘রক্ত, ঘাম ও অশ্রু’ কৌশলের সর্বজনীনতা। এর ফলে, আর্থিক বাজারে সঞ্চারিত ভীতি মোকাবিলার মতো ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক স্বর ইউরোপের ভেতর দানা বাঁধা কঠিন হয়ে পড়ে।
বৃহত্তর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন স্পষ্টতর অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা। সরকারের রাজস্ব সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা গভীরভাবে বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত। প্রবৃদ্ধি ও সরকারের রাজস্বের মধ্যে দৃঢ় সূত্র থাকার বিষয়টি চীন ও ভারত থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল পর্যন্ত বিশ্বের বহু দেশে দেখা গেছে।
এ ক্ষেত্রেও ইতিহাস থেকে শেখার আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে বহু দেশে সরকারের বিরাট ঋণের বোঝা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই বোঝা শিগগিরই কমে যায় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে। অনুরূপভাবে, প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ক্ষমতায় এসেই ১৯৯২ সালে বিশাল ঘাটতির মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মেয়াদেই সেই সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। দ্রুতগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ কাজে বিরাট সহযোগিতা করেছে।
গণতন্ত্র হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা ব্রিটেনের ক্ষেত্রে খাটে না। কেননা, এসব নীতি গ্রহণকারী সরকার গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে শক্তিশালী হয়ে এসেছে। নির্বাচনের সময় বলা হয়নি অথচ এখন বলা হচ্ছে এমন কোনো নীতি গ্রহণ করতে গেলে সেটা নিয়ে কিছু তর্ক-বিতর্ক হয়, সেই স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে বিজয়ীরা পেয়েই থাকে। তাতে আরও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা কমে না, এমনকি ব্রিটেনের মতো জায়গাতেও। তবে, ব্রিটেনের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণপ্রবণ নীতি কেমন করে গ্রিসের ওপর আরও কঠোর নীতি আরোপের অজুহাত তৈরি করে, সেটাও চিহ্নিত করা দরকার।
ইউরোভুক্ত কয়েকটি দেশ এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে কেমন করে এল? অধিকতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীভবন ছাড়াই একটি যৌথ মুদ্রার দিকে ধাবিত হওয়ার খামখেয়াল অবশ্যই এর পেছনে কাজ করেছে—গ্রিস বা পর্তুগালের মতো দেশ অতীতে অর্থনৈতিক চুক্তি ভঙ্গ করার ঘটনা স্মরণে রাখা সত্ত্বেও। এখন গ্রিক সরকার রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে। তা সত্ত্বেও সম্ভবপর সবকিছু করছে। কিন্তু গ্রিসের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আবশ্যপালনীয় শর্তাবলি এথেন্স বেদনাক্লিষ্ট হূদয়ে মেনে নেওয়ার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় না এসব ব্যবস্থা ও এসবের সময় নির্বাচন কতটা বিজ্ঞজনোচিত হয়েছে, তা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ইউরোপের ঐক্যের জোরালো সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি ইউরোর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলাম—সে কথা মনে করে এখন সান্ত্বনা খুঁজতে চাই না। ইউরোর ব্যাপারে আমার আশঙ্কা অংশত এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশ তাদের আর্থিক নীতি ও বিনিময়মূল্য সমন্বয়ের স্বাধীনতা পরিত্যাগ করার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এই স্বাধীনতা অতীতে বহু দেশকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে; আর্থিক বাজার স্থিতিশীল করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে গিয়ে মানুষের জীবনকে অস্থিতিশীল করে তোলার যে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, সেটা ঠেকিয়েছে। সেই আর্থিক নীতির স্বাধীনতা পরিত্যাগ করা যেত যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ইউরোপ একীভূত হয়ে উঠত (যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে যেমন একীভবন ঘটেছে)। কিন্তু ইউরো-অঞ্চলের আধাখেঁচড়া একীভবন বিপর্যয়ের পথই তৈরি করেছে। অসংলগ্ন আর্থিক একীভবনের এক সঙ্গিন কর্মসূচিকে ধারণ করতে তৈরি করা হয়েছে এক সম্মিলিত গণতান্ত্রিক ইউরোপের অপূর্ব রাজনৈতিক ধারণা।
এখন ইউরো-অঞ্চলের পুনর্বিন্যাসের সমস্যা হবে নানাবিধ। তবে কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা হতে হবে। যে সংকীর্ণ চিন্তা অতীতে ভয়ানক ফল বয়ে এনেছে, সেই সংকীর্ণতাপ্রসূত অর্থনৈতিক ঝড়ে ইউরোপকে ভেসে যেতে দেওয়া যাবে না। রেটিং এজেন্সিগুলোর একতরফা হুকুম জারি করার অপ্রতিরুদ্ধ ক্ষমতা অনতিবিলম্বে কমানোর মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হতে হবে। এসব এজেন্সির রেকর্ড জঘন্য হওয়ার পর এগুলোকে শৃঙ্খলার ভেতর নিয়ে আসা কঠিন। তবে সমাধানের কাজ চলার সময় (বিশেষত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়) অর্থনৈতিক আস্থার প্রশ্নে বড় পার্থক্য রচে দিতে পারে বৈধ সরকারের সুপ্রতিফলিত স্বর। ইউরোপের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রান্তিকীকরণ ঠেকানো আশু কর্তব্য। ইউরোপের গণতন্ত্র ইউরোপের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সারা দুনিয়ার জন্যও।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অমর্ত্য সেন: নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ।
No comments