আশা ও আশঙ্কার ইউপি নির্বাচন by বদিউল আলম মজুমদার
প্রায় দীর্ঘ তিন বছর প্রতীক্ষার পর মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথম দফায় ২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল উপকূলীয় এলাকার ৫৯৬টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হবে। ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া এবং এগুলোর বাছাইও শেষ হয়েছে। পরবর্তী সময়ে মে-জুন মাসে বাকি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের মনে অনেক আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, একই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে অনেক আশঙ্কা।
অনেক গড়িমসির পর নির্বাচন যে হচ্ছে, তা-ই আমাদের আশাবাদী করে তুলছে। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে অনেক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। মানুষ যেখানে, সমস্যাও সেখানে এবং সেগুলোর সমাধানও হওয়া আবশ্যক মানুষের দোরগোড়ার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে, তাই গ্রামীণ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বেই জনগণের অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের পথ সুগম হতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা ‘সাবসিডিয়ারিটি প্রিন্সিপল’ (Subsidiarity principle) বলে একটি তত্ত্ব ব্যবহার করেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হলো, যেহেতু অধিকাংশ সমস্যা স্থানীয়; যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামো নির্মাণ, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চা, এমনকি জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা—এগুলোর সমাধানও হতে হবে স্থানীয়ভাবে। বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান এবং উন্নয়ন-প্রক্রিয়া বেগবান করার মাধ্যমে—নীতি-সহায়তাও (policy assistance) অবশ্য এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, আমাদের সংবিধান [অনুচ্ছেদ ৫৯(২)] জনকল্যাণমূলক সব সরকারি সেবা প্রদান (public service) এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত সব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছে।
সাবসিডিয়ারিটি প্রিন্সিপল অনুযায়ী, সর্বপ্রথমেই সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত সর্বনিম্ন পর্যায়ে, সর্বনিম্ন স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। যেসব সমস্যা সর্বনিম্ন (ইউনিয়ন) পর্যায়ে সমাধান করা যায় না, কেবল সেগুলোর সমাধান হতে হবে তার পরবর্তী (উপজেলা) স্তরে। বাকি সমস্যাগুলো পরবর্তী (জেলা) স্তরে। এর পরও যেসব সমস্যা বাকি থাকে, সেগুলোর সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। তাই সাবসিডিয়ারিটি তত্ত্ব কাজে লাগালে, রাষ্ট্র পরিচালনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা হয়ে পড়ে অত্যন্ত সীমিত, যদিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমন ব্যবস্থায় প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, বহির্বাণিজ্য, অর্থ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ইত্যাদিই মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের দায়দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে, স্বাধীনতার মাসে স্মরণ করা প্রয়োজন যে সাবসিডিয়ারিটি তত্ত্বই ছিল ‘ছয় দফা’ আন্দোলনের মূল ভিত্তি। আমাদের সংবিধানে স্থানীয় সরকার-সম্পর্কিত বলিষ্ঠ বিধান অন্তর্ভুক্ত করার পেছনেও ছিল এমনই একটি চেতনা। তাই আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বস্তুত ইতিহাসের শিক্ষা হলো, যে সমাজে মূলত নিজের শক্তি ও সামর্থ্যকে পুঁজি করে নাগরিকেরা তাদের ভাগ্যোন্নয়নের কারিগর হতে পেরেছে এবং রাষ্ট্র একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে এগিয়ে এসেছে, সেখানেই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। জন-অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নকে ‘আন্দোলনে’ পরিণত করতে পারলেই মানুষ তাদের ভাগ্যোন্নয়নের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ পায় এবং তাদের সফলতাও নিশ্চিত হয়। জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির সমস্যারও সমাধান করা যায়। আর একটি জন-অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমেই তা সম্ভব। বলা বাহুল্য, উন্নয়নকে আন্দোলনে পরিণত করার প্রচেষ্টা ইউনিয়ন পর্যায় থেকেই শুরু হতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। তাই আসন্ন নির্বাচন আমাদের সামনে আশার আলো প্রজ্বলিত করে।
সৌভাগ্যবশত স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চা এবং উন্নয়নকে আন্দোলনে পরিণত করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ আইনে রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯-এর ৪-৭ ধারায় ‘ওয়ার্ডসভা’র একটি যুগান্তকারী বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলোর মধ্যে একমাত্র এটিই বর্তমান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই বিধান কার্যকর হলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে বছরে অন্তত দুবার ভোটারদের মুখোমুখি হতে বাধ্য হবেন। স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন পরিচালনা, বাজেট প্রণয়ন ও প্রকাশে জনগণের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন সরকারি স্কিমের কতগুলো পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে (যেমন—বয়স, ভূমির মালিকানা, শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা, বৈধব্য ইত্যাদি) ‘উপকারভোগী’ নির্ধারণ ওয়ার্ডসভার আইনানুগ দায়িত্ব। স্থানীয় গণমানুষের নেতা হিসেবে নবনির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিরা, তাঁদের সহযোগী হিসেবে ইউনিয়নের ‘স্ট্যান্ডিং’ বা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এবং একদল সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্টের (যেমন—স্বেচ্ছাব্রতী-উজ্জীবকের) অনুঘটকসুলভ প্রচেষ্টায় ওয়ার্ডসভা কার্যকর এবং সত্যিকারার্থেই উন্নয়ন একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হবে ইউনিয়নের জনগণকে প্রণোদিত ও সংগঠিত করা, যাতে প্রত্যেকেই তাদের ভাগ্যোন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং একক ও যৌথভাবে কার্যক্রম হাতে নেয়।
প্রসঙ্গত, এ ধরনের গণকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা পরিচালনায় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং আমরা মনে করি যে একটি সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমেই তৃণমূলের জনগণের জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পসহ অন্যান্য উদ্যোগ ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। একই সঙ্গে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টির পদক্ষেপগুলোও সত্যিকারের সুফল বয়ে আনবে।
আমরা আরও আশাবাদী হতে চাই যে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় থেকে একঝাঁক নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে, যাঁরা নিজেরা তাঁদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন। নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকার ফলপ্রসূতা অবশ্য নির্ভর করবে তাঁদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের আয়োজনের ওপর। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের টালবাহানার অভিজ্ঞতা থেকে এ ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া দুরূহ। এ ছাড়া আমাদের দেখা অনুযায়ী, যে প্রশিক্ষণ তাঁদের দেওয়া হয়েছে তা কাজে লাগিয়ে তাঁরা পদ্ধতিগতভাবে এবং পেশাদারির ভিত্তিতে উপজেলা পরিষদ পরিচালনা করতে পারছেন না। তাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে নির্বাচিতদের জন্য দ্রুততার সঙ্গে প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে এবং সেই প্রশিক্ষণ হতে হবে মানসম্মত ও পরিষদকে কার্যকর করার জন্য উপযোগী।
নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আরও প্রয়োজন হবে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সত্যিকারের ক্ষমতা, দায়দায়িত্ব ও সম্পদ ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা হলেই এ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপায়িত হবে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না, যদিও একটি সুদূরপ্রসারী বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি ছাড়া ‘পল্লী জীবনে গতিশীলতা’ অর্জন, যা আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদের অন্যতম অঙ্গীকার, তা সম্ভবপর নয়। আশা করি, সরকার এ ব্যাপারে নতুন করে ভাববে।
নির্বাচন ঘিরে অন্য একটি আশঙ্কার বিষয় হলো, নির্বাচনী বিধিবিধানকে উপেক্ষা করে পৌরসভা নির্বাচনের মতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দলভিত্তিক করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হবে। দলভিত্তিক নির্বাচনের কারণে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় কিন্তু কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন—এমন ব্যক্তিরা পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়েছেন, ফলে প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। এ ছাড়া মনোনয়ন-বাণিজ্য ইত্যাদি কারণে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং নির্বাচিতও হয়েছেন। এমন অবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। তা সত্ত্বেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় হবে, তা আশা করা যায় না। কারণ ইতিমধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন, যদিও নির্বাচন কমিশন বলেই যাচ্ছে যে বিদ্যমান বিধিবিধান অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরেকটি বিষয় নিয়েও আমরা আশাবাদী হতে পারছি না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের একটি হলফনামার মাধ্যমে তাঁদের আয়ের উৎস, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অপরাধী কর্মকাণ্ডের বিবরণ, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সম্পদ ও দায়-দেনার হিসাব, আয়কর বিবরণী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়েছে। একই ধরনের বাধ্যবাধকতা কাজ করেছে উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যদিও নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা উপজেলা আইন থেকে এ বিধান রহিত করা হয়েছে। তথ্য প্রদানের এমন বিধান সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এমন বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির বিষয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনকে সম্মত করাতে পারিনি। আমাদের বোধগম্য নয়, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরে সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের জন্য যদি প্রার্থীদের তথ্য প্রদান অপরিহার্য হয়, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন! এ ছাড়া আদালত এ ধরনের তথ্যপ্রাপ্তিকে ভোটারদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, কারণ ভোটাররা তাঁদের বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করেন ভোটের মাধ্যমে। আর নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণের এখতিয়ার কারোরই নেই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে আমরা অন্য একটি কারণেও আশঙ্কিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোর লাগামহীন দলবাজির কারণে তৃণমূল পর্যায়ে প্রায় সব নিয়মনীতি ভেঙে পড়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনেক কাজ এখন দলীয় নেতা-কর্মীরাই সম্পাদন করেন, ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে একধরনের অরাজকতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একধরনের লুটপাটের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তাই বিরাজমান বেসামাল অবস্থাকে নবনির্বাচিতদের পক্ষে সামলে আনা সহজ হবে না। তাই ইউনিয়ন পরিষদের ভবিষ্যৎ নিয়েই আমরা চিন্তিত।
পরিশেষে, আমরা আশা করি যে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু এ ব্যাপারেও আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভবপর নয়। কয়েক সপ্তাহ আগে নির্বাচন কমিশন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে একটি সংলাপে ডেকেছিল, কিন্তু বড় দলগুলোর একটিও এতে সাড়া দেয়নি। এ ঘটনা যদি দলগুলোর পক্ষ থেকে সহযোগিতার নমুনা হয়, তাহলে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের আশঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে বৈকি! তবু পুরো জাতির ভবিষ্যতের খাতিরে আমরা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে আশাবাদী হতে চাই। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তাঁরা এ ব্যাপারে যথার্থ ভূমিকা রাখবেন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
অনেক গড়িমসির পর নির্বাচন যে হচ্ছে, তা-ই আমাদের আশাবাদী করে তুলছে। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে অনেক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। মানুষ যেখানে, সমস্যাও সেখানে এবং সেগুলোর সমাধানও হওয়া আবশ্যক মানুষের দোরগোড়ার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে, তাই গ্রামীণ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বেই জনগণের অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের পথ সুগম হতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা ‘সাবসিডিয়ারিটি প্রিন্সিপল’ (Subsidiarity principle) বলে একটি তত্ত্ব ব্যবহার করেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হলো, যেহেতু অধিকাংশ সমস্যা স্থানীয়; যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামো নির্মাণ, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চা, এমনকি জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা—এগুলোর সমাধানও হতে হবে স্থানীয়ভাবে। বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান এবং উন্নয়ন-প্রক্রিয়া বেগবান করার মাধ্যমে—নীতি-সহায়তাও (policy assistance) অবশ্য এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, আমাদের সংবিধান [অনুচ্ছেদ ৫৯(২)] জনকল্যাণমূলক সব সরকারি সেবা প্রদান (public service) এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত সব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছে।
সাবসিডিয়ারিটি প্রিন্সিপল অনুযায়ী, সর্বপ্রথমেই সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত সর্বনিম্ন পর্যায়ে, সর্বনিম্ন স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। যেসব সমস্যা সর্বনিম্ন (ইউনিয়ন) পর্যায়ে সমাধান করা যায় না, কেবল সেগুলোর সমাধান হতে হবে তার পরবর্তী (উপজেলা) স্তরে। বাকি সমস্যাগুলো পরবর্তী (জেলা) স্তরে। এর পরও যেসব সমস্যা বাকি থাকে, সেগুলোর সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। তাই সাবসিডিয়ারিটি তত্ত্ব কাজে লাগালে, রাষ্ট্র পরিচালনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা হয়ে পড়ে অত্যন্ত সীমিত, যদিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমন ব্যবস্থায় প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, বহির্বাণিজ্য, অর্থ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ইত্যাদিই মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের দায়দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে, স্বাধীনতার মাসে স্মরণ করা প্রয়োজন যে সাবসিডিয়ারিটি তত্ত্বই ছিল ‘ছয় দফা’ আন্দোলনের মূল ভিত্তি। আমাদের সংবিধানে স্থানীয় সরকার-সম্পর্কিত বলিষ্ঠ বিধান অন্তর্ভুক্ত করার পেছনেও ছিল এমনই একটি চেতনা। তাই আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বস্তুত ইতিহাসের শিক্ষা হলো, যে সমাজে মূলত নিজের শক্তি ও সামর্থ্যকে পুঁজি করে নাগরিকেরা তাদের ভাগ্যোন্নয়নের কারিগর হতে পেরেছে এবং রাষ্ট্র একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে এগিয়ে এসেছে, সেখানেই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। জন-অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নকে ‘আন্দোলনে’ পরিণত করতে পারলেই মানুষ তাদের ভাগ্যোন্নয়নের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ পায় এবং তাদের সফলতাও নিশ্চিত হয়। জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির সমস্যারও সমাধান করা যায়। আর একটি জন-অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমেই তা সম্ভব। বলা বাহুল্য, উন্নয়নকে আন্দোলনে পরিণত করার প্রচেষ্টা ইউনিয়ন পর্যায় থেকেই শুরু হতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। তাই আসন্ন নির্বাচন আমাদের সামনে আশার আলো প্রজ্বলিত করে।
সৌভাগ্যবশত স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চা এবং উন্নয়নকে আন্দোলনে পরিণত করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ আইনে রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯-এর ৪-৭ ধারায় ‘ওয়ার্ডসভা’র একটি যুগান্তকারী বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলোর মধ্যে একমাত্র এটিই বর্তমান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই বিধান কার্যকর হলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে বছরে অন্তত দুবার ভোটারদের মুখোমুখি হতে বাধ্য হবেন। স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন পরিচালনা, বাজেট প্রণয়ন ও প্রকাশে জনগণের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন সরকারি স্কিমের কতগুলো পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে (যেমন—বয়স, ভূমির মালিকানা, শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা, বৈধব্য ইত্যাদি) ‘উপকারভোগী’ নির্ধারণ ওয়ার্ডসভার আইনানুগ দায়িত্ব। স্থানীয় গণমানুষের নেতা হিসেবে নবনির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিরা, তাঁদের সহযোগী হিসেবে ইউনিয়নের ‘স্ট্যান্ডিং’ বা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এবং একদল সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্টের (যেমন—স্বেচ্ছাব্রতী-উজ্জীবকের) অনুঘটকসুলভ প্রচেষ্টায় ওয়ার্ডসভা কার্যকর এবং সত্যিকারার্থেই উন্নয়ন একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হবে ইউনিয়নের জনগণকে প্রণোদিত ও সংগঠিত করা, যাতে প্রত্যেকেই তাদের ভাগ্যোন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং একক ও যৌথভাবে কার্যক্রম হাতে নেয়।
প্রসঙ্গত, এ ধরনের গণকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা পরিচালনায় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং আমরা মনে করি যে একটি সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমেই তৃণমূলের জনগণের জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পসহ অন্যান্য উদ্যোগ ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। একই সঙ্গে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টির পদক্ষেপগুলোও সত্যিকারের সুফল বয়ে আনবে।
আমরা আরও আশাবাদী হতে চাই যে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় থেকে একঝাঁক নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে, যাঁরা নিজেরা তাঁদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন। নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকার ফলপ্রসূতা অবশ্য নির্ভর করবে তাঁদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের আয়োজনের ওপর। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের টালবাহানার অভিজ্ঞতা থেকে এ ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া দুরূহ। এ ছাড়া আমাদের দেখা অনুযায়ী, যে প্রশিক্ষণ তাঁদের দেওয়া হয়েছে তা কাজে লাগিয়ে তাঁরা পদ্ধতিগতভাবে এবং পেশাদারির ভিত্তিতে উপজেলা পরিষদ পরিচালনা করতে পারছেন না। তাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে নির্বাচিতদের জন্য দ্রুততার সঙ্গে প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে এবং সেই প্রশিক্ষণ হতে হবে মানসম্মত ও পরিষদকে কার্যকর করার জন্য উপযোগী।
নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আরও প্রয়োজন হবে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সত্যিকারের ক্ষমতা, দায়দায়িত্ব ও সম্পদ ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা হলেই এ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপায়িত হবে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না, যদিও একটি সুদূরপ্রসারী বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি ছাড়া ‘পল্লী জীবনে গতিশীলতা’ অর্জন, যা আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদের অন্যতম অঙ্গীকার, তা সম্ভবপর নয়। আশা করি, সরকার এ ব্যাপারে নতুন করে ভাববে।
নির্বাচন ঘিরে অন্য একটি আশঙ্কার বিষয় হলো, নির্বাচনী বিধিবিধানকে উপেক্ষা করে পৌরসভা নির্বাচনের মতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দলভিত্তিক করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হবে। দলভিত্তিক নির্বাচনের কারণে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় কিন্তু কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন—এমন ব্যক্তিরা পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়েছেন, ফলে প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। এ ছাড়া মনোনয়ন-বাণিজ্য ইত্যাদি কারণে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং নির্বাচিতও হয়েছেন। এমন অবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। তা সত্ত্বেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় হবে, তা আশা করা যায় না। কারণ ইতিমধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন, যদিও নির্বাচন কমিশন বলেই যাচ্ছে যে বিদ্যমান বিধিবিধান অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরেকটি বিষয় নিয়েও আমরা আশাবাদী হতে পারছি না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের একটি হলফনামার মাধ্যমে তাঁদের আয়ের উৎস, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অপরাধী কর্মকাণ্ডের বিবরণ, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সম্পদ ও দায়-দেনার হিসাব, আয়কর বিবরণী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়েছে। একই ধরনের বাধ্যবাধকতা কাজ করেছে উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যদিও নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাস করা উপজেলা আইন থেকে এ বিধান রহিত করা হয়েছে। তথ্য প্রদানের এমন বিধান সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এমন বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির বিষয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনকে সম্মত করাতে পারিনি। আমাদের বোধগম্য নয়, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরে সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের জন্য যদি প্রার্থীদের তথ্য প্রদান অপরিহার্য হয়, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন! এ ছাড়া আদালত এ ধরনের তথ্যপ্রাপ্তিকে ভোটারদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, কারণ ভোটাররা তাঁদের বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করেন ভোটের মাধ্যমে। আর নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণের এখতিয়ার কারোরই নেই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে আমরা অন্য একটি কারণেও আশঙ্কিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোর লাগামহীন দলবাজির কারণে তৃণমূল পর্যায়ে প্রায় সব নিয়মনীতি ভেঙে পড়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনেক কাজ এখন দলীয় নেতা-কর্মীরাই সম্পাদন করেন, ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে একধরনের অরাজকতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একধরনের লুটপাটের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তাই বিরাজমান বেসামাল অবস্থাকে নবনির্বাচিতদের পক্ষে সামলে আনা সহজ হবে না। তাই ইউনিয়ন পরিষদের ভবিষ্যৎ নিয়েই আমরা চিন্তিত।
পরিশেষে, আমরা আশা করি যে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু এ ব্যাপারেও আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভবপর নয়। কয়েক সপ্তাহ আগে নির্বাচন কমিশন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে একটি সংলাপে ডেকেছিল, কিন্তু বড় দলগুলোর একটিও এতে সাড়া দেয়নি। এ ঘটনা যদি দলগুলোর পক্ষ থেকে সহযোগিতার নমুনা হয়, তাহলে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের আশঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে বৈকি! তবু পুরো জাতির ভবিষ্যতের খাতিরে আমরা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে আশাবাদী হতে চাই। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তাঁরা এ ব্যাপারে যথার্থ ভূমিকা রাখবেন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments