আলোচনা- একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র by সাযযাদ কাদির

ম্বে, বোম্বে, বম্বাই, বোম্বাই, মুম্বাই, মুম্বই ( সাতটি দ্বীপের এই নগরী আর এর চলচ্চিত্র জগৎ বলিউডের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক পুরনো। রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই, প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস. (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস), সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩) চাকরি উপলক্ষে ঐ প্রদেশে ছিলেন দীর্ঘদিন (১৮৬৫-১৮৯৭)। সে অভিজ্ঞতার আলোকে দু'টি বইও লিখেছেন "বোম্বাই চিত্র" (১৮৮৯) ও "আমার বোম্বাই প্রবাস" (১৯১৫)। "বোম্বাই রায়ত" নামের বইটি সঙ্কলিত হয়েছে পরে, ১৯৮৬ সালে।
সত্যেন্দ্রনাথের আলোকপ্রাপ্তা স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (১৮৫০-১৯৪১) বাঙালিনীদের শাড়ি পরা শিখিয়েছেন ঐ প্রদেশ থেকেই শিখে এসে। সমীর সেনগুপ্ত লিখেছেন, "বোম্বাই গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী হিন্দি বা ইংরেজি বলতে না পারায় অসুবিধের মধ্যে পড়েছিলেন খুবই। তাছাড়া স্ত্রীলোকের বাইরে বেরোবার উপযুক্ত শোভন পরিচ্ছদেরও সমস্যা ছিল। নানা পরীক্ষার পর পার্সী শাড়ি ও জামার নমুনায় এবং গুজরাটি মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরে তার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটিয়ে (ডান কাঁধের বদলে বাঁ কাঁধে অাঁচল নিয়ে) তার পোশাকের সমস্যার সমাধান করা হলো (এই পোশাকই কালক্রমে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনো বাঙালি মেয়েদের সার্বজনিক পোশাক হয়ে দাঁড়ালো।" (রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন ২০০৫)।
মারাঠিনীরা শাড়ি পরেন মালকোঁচা দিয়ে। ওভাবে শাড়ির কোঁচা দু' পায়ের মাঝ দিয়ে টেনে নিয়ে পেছনে না গুঁজে জ্ঞানদানন্দিনী দিলেন ছেড়ে, ব্যবস্থা করলেন সে কোঁচা সামলাবার। সেই থেকে শুরু বাঙালিনীদের শাড়ি পরার আধুনিক কায়দা-কেতা।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কন্যা, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভাইঝি, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী (১৮৭৩-১৯৬০) লিখেছেন, "মা যখন বোম্বাই থেকে পাসর্ী মেয়েদের শাড়ি পরা একটু বদলসদল করে আমাদের মেয়েদের পরনের উপযোগী করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন_ যে কেউ যদি শিখতে চায় তো জোড়াসাঁকোয় এলে শিখিয়ে দেবেন ( তখন বিহারী গুপ্ত মশায়ের স্ত্রী সৌদামিনী গুপ্তা একজন শিক্ষার্থিনী হয়ে এসেছিলেন শুনেছি।" ('স্মৃতিসম্পুট')
জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর এক জা, উন্মাদ রোগগ্রস্ত বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৫-১৯১৫)-এর স্ত্রী, প্রফুলস্নময়ী দেবীও লিখেছেন, "তিনি (জ্ঞানদানন্দিনী দেবী) প্রথমে বম্বে হইতে আসিয়া শাড়ির নীচে পায়জামা পরা, সায়া পরা, জামা পরা ও বম্বে ধরনের শাড়ি পরা আমাদের পরিবারের মধ্যে প্রচলন করিয়াছিলেন। তাই দেখিয়া বাহিরের অন্যান্য লোকেরা তাঁহার অনুকরণ করিতে থাকেন।" ('আমাদের কথা', প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৩২)
শাড়ির কথা বললাম, খুঁজলে এ রকম আরো অনেক সূত্র পাওয়া যাবে বোম্বাই-বাংলা সম্পর্কের। সেকালে একটু বড়সড় ফলমূল, শাক-সবজি, তরি-তরকারির পরিচিত ছিল 'বোম্বাই' বা 'বোম্বাইয়া' নামে। বোম্বাই লিচু, বোম্বাই মুলা তখন কে না খেয়েছেন! বোম্বাই হলুদও ছিল। তবে সে নামকরণ হয়তো ছিল বড় আকারের যে কোনও কিছুকেই বোম্বাইয়া মনে করার কারণে। ঐ হলুদ পরে নাম পেয়েছে 'পাটনাই'। এভাবে ছিল বোম্বাই আলু, বোম্বাই মিষ্টিঃ। আরো কত কি! আমাদের বিন্দুবাসিনী স্কুলের শহীদ স্যার, রিয়াজ স্যার, কাগমারী কলেজের প্রিন্সিপাল জলিল স্যার বক্তৃতা করতেন অলঙ্কার বহুল ইংরেজিতে। ঐ ভাষা পরিচিত ছিল 'বোম্বাস্টিক ইংলিশ' নামে। এভাবে আড়ম্বর ও আতিশয্য পূর্ণ সব কিছু ছিল বোম্বাস্টিক। বোম্বাস্টিক কথা, বোম্বাস্টিক গল্পঃ। ফাঁকা বুলিও ছিল 'বোম্বাস্টিক ডায়লগ'। আর ছিল বোম্বেটে। বোম্বেটে মানে ডাকাত। আবার বোম্বেটে ডাকাত বলতে ঐ এলাকার (আরব সাগরের) জলদসু্যদেরও বোঝাতো। হার্জের অাঁকায় ও লেখায় সৃষ্ট টিনটিন-কাহিনী "বোম্বেটে জাহাজ" পড়ার অনেক আগে তাদের রক্ত হিম করা নৃশংসতার কাহিনী আমরা পড়েছি পাঁচকড়ি দে, দীনেন্দ্রকুমার রায়, শশধর দত্ত, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, স্বপনকুমার প্রমুখের রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজে। 'বোম্বেটের কবলে' বা 'বোম্বেটেদের খপ্পরে' ( এ ধরনের নামের কত বই পড়েছি)! আরো আছে বোম্বাস্টিক ব্যাপার। ছোটবেলায় এক থুত্থুরে বুড়ো দেখেছিলাম, শুনেছিলাম তিনি বোম্বাই হাজি। সে কি রকম? সেকালে হজ্বযাত্রীদের জাহাজ ছাড়তো বোম্বাই থেকে। সে জাহাজে চড়ে হজ্বে যেতে বহু লোক ট্রেনে, নৌকায়, পায়ে হেঁটে যেতেন সেখানে। কিন্তু পথে দেরি হওয়ায় সময়মতো পেঁৗছতে না পেরে অনেকেই দেখতে পেতেন ( সে জাহাজ ছেড়ে গেছে আগেই)। অল্পের জন্যও জাহাজে ওঠার সুযোগ হারাতেন অনেকে। তারা হতাশ হয়ে আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফিরতেন বাড়িতে। ঐ বুড়ো ছিলেন তেমন হতভাগা একজন। বোম্বাই থেকে ফিরে আসা হজ্বযাত্রী। এরা পরিচিত হতেন 'বোম্বাই হাজী' নামে। এ হয়তো ছিল সান্ত্বনা, তবে দেখেছি তারা সম্মান কিছু কম পেতেন না। তাদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও শ্রমস্বীকারের মর্যাদা দিতো সবাই। এদেরই একজন কোন আশায় বোম্বাই ছিলেন কিছু দিন। থাকতে থাকতে ভালবেসে ফেলেন বোম্বাইয়া গান। বলিউডি হিন্দি ফিল্ম সং। দেশে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে আসেন এক গাদা গ্রামোফোন রেকর্ড। তারপর চোঙওয়ালা কলের গান কিনে দিন-রাত মজে থাকেন সেসব নিয়ে। হোটেল খুলে সেখানেও বাজাতে থাকেন ঐ হিন্দি-উর্দু গান। প্রথম দিকে না হলেও পরে শ্রোতা বাড়ে সেসব গানের। ক্রমে ভিড় জমে হোটেলে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে চাচার গানের কথা। লোকের মুখে মুখে এ গানের নামও হয়ে যায় 'চাচার গান'। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে চাচার গান ছাড়া হোটেল চালানোর কথা ভাবতেও পারেন না কেউ। এখনও সে রীতি অব্যাহত আছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয়। সেকালে হিট-সুপারহিট চাচার গান ছিল (ম্যয় বন কা পঞ্ছি (অশোক কুমার ও দেবিকা রানী, অছুত কন্যা, ১৯৩৬); ইয়ামুনা জলি খেলু খেলা (মীনাক্ষী, ব্র?হ্মচারী, ১৯৩৮); ইক তুম না হুই তো কেয়া হুয়া (মতিলাল, তিন সও দিন কে বাদ, ১৯৩৮); আন বাসে পরদেশ সজনওয়া (সুরেন্দ্র ও জ্যোতি, জীবন সাথি, ১৯৩৯); আব কিস লিয়ে কাল কি বাত (শান্তা হুবলিকর, আদমি, ১৯৩৯); চানা জোর গরম (অরুণ কুমার, বন্ধন, ১৯৪০); চলি রে মেরে নাও (অশোক কুমার, ঝুলা, ১৯৪১); পাপিহা রে (পারুল ঘোষ), ধীরে ধীরে আ রে বাদল (অশোক কুমার, কিসমত, ১৯৪৩); আব তো নাহিঁ দুনিয়া মেঁ আপনা ঠিকানা (নূরজাহান, নাদান, ১৯৪৩); মোরে গলি মোরে রাজা (সুরাইয়া, সংযোগ, ১৯৪৩); দো নয়না মাতোয়ারে (কে. এল. সায়গল, মেরি বহেন, ১৯৪৪); আখিয়াঁ মিলা কে জিয়া ভরমা কে চলে নাহিঁ জানা (জোহরাবাই আমবালেওয়ালি, রত্তন, ১৯৪৪); আওয়াজ দে কাহাঁ হ্যায় (নূরজাহান ও সুরেন্দ্র, আনমোল ঘড়ি, ১৯৪৬); জব দিল হি টুট গ্যয়া (কে. এল. সায়গল, শাহজাহান, ১৯৪৬); জওয়ানি কি রেল চলে যাই রে (গীতা দত্ত, লতা মঙ্গেশকর ও চিতলকর রামচন্দ্র), মার কাটারি মর যানা (আমিরবাই কর্ণাটকি, শেহনাই, ১৯৪৭); বলো মোরে পায়েল (গীতা দত্ত, সুহাগ রাত, ১৯৪৮); ঝুম ঝুম কে নাচো আজ (মুকেশ, আনদাজ, ১৯৪৯); হাওয়া মেঁ উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা (লতা মঙ্গেশকর, বরসাত, ১৯৪৯); লা-রা-লাপপা লাই রাখাদা (লতা মঙ্গেশকর, এক থি লাড়কি, ১৯৪৯); আয়েগা আনেওয়ালা (লতা মঙ্গেশকর, মহল, ১৯৪৯); ইয়ে দুনিয়া রূপ কি চোর (শামশাদ বেগম, শবনম, ১৯৪৯); তেরি দুনিয়া মেঁ দিল লাগতা নাহিঁ (মুকেশ, বাঁওরে নৈন, ১৯৫০); তারা রি ইয়ারা রি (সুরাইয়া ও মোহাম্মদ রফি, দসতান, ১৯৫০); গোরে গোরে ও বাঁকে ছোড়ে (লতা মঙ্গেশকর ও আমিরবাই কর্ণাটকি, সমাধি, ১৯৫০); শাম ঢলে খিড়কি তলে (লতা মঙ্গেশকর ও চিতলকর রামচন্দ্র, আলবেলা, ১৯৫১) প্রভৃতি।
চাচার গানের সূত্র ধরে চাচার ছবি অর্থাৎ বলিউডি হিন্দি ছবিও জায়গা করে নেয় এ দেশে। সেই দর্শকপ্রিয়তার শুরু অশোক কুমার ও মমতাজ শান্তি অভিনীত "কিসমত" থেকে। পরে অশোক কুমার ও মধুবালা অভিনীত "মহল" সেই দর্শকপ্রিয়তাকে পৌঁছে দেয় তুঙ্গে। আমাদের এখানে নারগিস, সুরাইয়া, মমতাজ, শাকিলা, মীনা, আশা, লতা, ঊষা, খুরশিদ, পারুল প্রভৃতি নামের যে ছড়াছড়ি এর নেপথ্যে রয়েছে বলিউডি ছবির নায়িকা-গায়িকাদের নামের প্রভাব। আর নায়কদের প্রভাব তো সর্বব্যাপী। অশোক কুমারের প্রভাবে শুরু হয় ফুল হাতা শার্ট গুটিয়ে পরা আর রিং করে করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া। রাজকাপুরের প্রভাবে শুরু হয় ফুল প্যান্ট গুটিয়ে পরা। দিলীপ কুমার প্রভাব ফেলেন চুলের ছাঁটে। নাম হয় দিলীপ কাট। পরে আসে উত্তম (কুমার) কাট। প্যান্ট-শার্ট পরায় বৈচিত্র্য আনেন দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না আনেন কলার বিশিষ্ট পাঞ্জাবি। আর বলিউডি নায়িকাদের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও অন্যান্য ড্রেস থেকে হেয়ার স্টাইল পর্যন্ত কত কিছুর কতখানি প্রভাব পড়েছে আমাদের সুন্দরীদের ওপর তা বলার জন্য হিসাব করতে হয় না আর। বস্নাউজের হাতা কতখানি বাড়বে বা কমবে, নাভির নিচে শাড়ি কতখানি নামবে বা উঠবে ( ওদের দেখেই সে হিসাব নেয়ার নিয়ম অব্যাহত আছে এখনও)। তবে সবই একতরফা নয়। আদানের সঙ্গে সঙ্গে প্রদানও কম নেই একেবারে। অশোক কুমার, কিশোর কুমার, অনিল বিশ্বাস, পান্নালাল ঘোষ, পারুল ঘোষ, উৎপল দত্ত, মিঠুন চক্রবতর্ী, সুস্মিতা সেন জন্মসূত্রে সম্পর্কিত বরিশালের সঙ্গে। শচীনদেব বর্মণ ও রাহুলদেব বর্মণ কুমিলস্নার সন্তান। বিমল রায় মানিকগঞ্জের। গীতা দত্ত শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের। স্মৃতিরেখা বিশ্বাস খুলনার ভরসাপুরের। অনীতা গুহ, রাখী, প্রেমা নারায়ণ টাঙ্গাইলের সাকরাইলের। অপরেশ, বাঁশরী ও বাপ্পী লাহিড়ী সিরাজগঞ্জের। বাংলার রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, রাগপ্রধান ও লোক সংগীত শুধু নয় ঢাকাই বিয়ের আসরের গানও জায়গা করে নিয়েছে বলিউডি গানে। 'রাত ভর রইয়ো সাভেরে চলে যাইয়ো', 'যিসকো বিবি মোটি' প্রভৃতি গান ওইসব আসরেরই সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যেরও যথেষ্ট কদর আছে বলিউডে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, বিমল কর, নবেন্দু ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, মহাশ্বেতা দেবী, ঋতি্বক ঘটক প্রমুখের গল্প-উপন্যাসের ভিত্তি হয়েছে বহু বলিউডি ছবি। অনেকে হয়তো জানেন না অশোক কুমার, সুমিত্রা দেবী, রুমা গাঙ্গুলি (গুহঠাকুরতা) অভিনীত "সমর" (১৯৫০) বঙ্কিমচন্দ্রের "রজনী" উপন্যাসের চিত্ররূপ, রবীন্দ্রনাথের "চার অধ্যায়" উপন্যাসের চিত্ররূপ দেব আনন্দ, গীতা বালী অভিনীত "জলজলা" (১৯৫২), মহাশ্বেতা দেবীর "লায়লী আশমানের আয়না"র চিত্ররূপ দিলীপ কুমার, বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত "সংঘর্ষ" (১৯৬৮)। উদাহরণ দীর্ঘ করা যায় আরো। কিন্তু থাক। যারা অপসংস্কৃতির ধুয়া তোলেন তারা এসবের খবর রাখেন না হয়তো। তাদের অনেকে শুনলে নিশ্চয়ই অবাক হবেন যে শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীনসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক রীতিমতো পোকা ছিলেন বলিউডি ছবি ও গানের। হিন্দি ছবির নন্দিত নেপথ্য গায়ক মুকেশের মৃতু্যতে (২৭ অগস্ট, ১৯৭৬) দৈনিক বাংলায় এক বিশেষ কলাম লিখেছিলেন শামসুর রাহমান।
খান আতাউর রহমান, চাষী নজরুল ইসলাম ও আরো অনেকে বলিউডের আকর্ষণে অনেকদিন কাটিয়েছেন মুম্বইতে। আর আমি তো মজেছি সেই ১৯৫৫ সালে! ক্লাশ ফোরের ইঁচড়ে পাকা পুঁচকে ছোড়া আমি গিয়েছিলাম কালী সিনেমায় "জীবনতারা" (১৯৫১) দেখতে। হিন্দিতে ডাব করা মাদ্রাজের ছবি। নায়ক জীবন ও নায়িকা তারা চরিত্রে রূপ দিয়েছিলেন টি আর মহালিঙ্গম ও টি আর রাজকুমারী। এখন আর সেই পোকা নেই আমি। এখন ছবি দেখি বেছে বেছে। আমার সর্বশেষ ভাল লাগা ছবি অভিষেক চৌবের "ইশকিয়া" (আরশাদ ওয়ারসি, বিদ্যা বালন, নাসিরুদ্দিন শাহ, সলমান শহিদ)। এ ছবির একটি গান, রাহাত ফতেহ আলি খানের গাওয়া "দিল তো বাচ্চা হ্যায়", প্রায়ই গুণগুণ করি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিপুল সমর্থন-সহযোগিতা যুগিয়েছে বলিউড। শরণাথর্ী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে মুক্তহস্তে দান ছাড়াও শিল্পী-কলাকুশলীরা ভারত জুড়ে অনুষ্ঠান করে তহবিল সংগ্রহ করেছেন দুর্গতদের ত্রাণে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুষ্ঠান করে সবচেয়ে বেশি অর্থ দান করেছে ওয়াহিদা রেহমান ট্রুপ। স্বাধীনতার পর এ ট্রুপকে আমন্ত্রণ জানানো, সম্মান দেখানো ছিল আমাদের কর্তব্য। দুঃখের বিষয় আমরা তা করিনি এখনও। অবশ্য সেই সময়ের অনেক বন্ধুকেই হয়তো ভুলে গেছি আমরা। আই এস জোহর ১৯৭১ সালেই নির্মাণ করেছিলেন "জয় বাংলাদেশ" নামের ছবি। এতে অভিনয় করেছিলেন অম্বিকা জোহর, রাজীব জোহর, কবরী, মধুমালতী, দিলীপ দত্ত, আই এস জোহর প্রমুখ। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন কল্যাণজি আনন্দজি। সর্বশেষ আশুতোষ গোয়ারিকর তৈরি করেছেন "খেলেঁ হাম জি জান সে"। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কাহিনী ভিত্তিক এ ছবিতে অভিনয় করেছেন অভিষেক বচ্চন, দীপিকা পাড়-কোন, বিশাখা সিং প্রমুখ। গত ৩ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবির সংগীত পরিচালক সোহেল সেন। মনে পড়ে ঢাকা ভিত্তিক এক ছবিও তৈরি হয়েছিল বলিউডে ( সেই ১৯৫৬ সালে। "ঢাকে কি মলমল" নামের ওই ছবির নায়ক-নায়িকা ছিলেন কিশোর কুমার ও মধুবালা। চাচার গানে ভরপুর সে ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন ও. পি. নায়ার। আর আমাদের ঢাকার চলচ্চিত্র তো স্বাধীনতার পর থেকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছে বলিউডকেই। স্বাধীনতার আগে কলকাতার ছবির যে ধারাবাহিকতা দেখা গিয়েছিল তার অবসান ঘটে জহিরুল ইসলামের "রংবাজ" (১৯৭৩) হিট হওয়ার পর থেকে। তখন থেকে চলছে বলিউডি নাচ-গানে ভরপুর অ্যাকশন-ফাইটিং ছবির জয়জয়কার!
বিজয়ের পর পর পিলখানায় ভারতীয় সৈন্যদের মনোরঞ্জনে অনুষ্ঠান করেছিল নারগিস ট্রুপ। ঐ ট্রুপে অনেক তারকার মধ্যে ছিলেন লতা মঙ্গেশকরও। সেদিন তিনি বিশেষভাবে গেয়েছিলেন "আয়েগা আনেওয়ালা" গানটি। অনুষ্ঠানে সবাইকে মাতোয়ারা করেছিলেন নৃত্যশিল্পী মধুমতী। তার সেই নৃত্যউচ্ছল ছবি ছাপা হয়েছিল "চিত্রালী"র প্রচ্ছদ জুড়ে। নারগিসের মা জদ্দনবাই একাধিকবার অনুষ্ঠান করেছেন ঢাকায়। সেকালের নায়িকা সিতারা দেবী (পরিচালক-প্রযোজক কে আসিফ-এর স্ত্রী) নাচে তালিম পেয়েছেন ময়মনসিংহ-মুক্তাগাছার রাজবাড়িতে।
বলিউডের নায়কদের মধ্যে সুনীল দত্ত (১৯২৯-২০০৫), নারগিসের স্বামী, ঢাকায় এসেছিলেন আশির দশকে। তার প্রযোজিত-অভিনীত "দর্দ কা রিশতা" (১৯৮২) দান করে গিয়েছেন এ দেশের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় সাহায্যার্থে। গায়ক-নায়ক তালাত মাহমুদ (১৯২৪-১৯৯৮) ঢাকা এসেছিলেন ১৯৬০ সালে। তার আগমনের স্মৃতি রয়ে গেছে "রাজধানীর বুকে" (১৯৬০) ছবির "তোমাকে লেগেছে এত যে ভাল চাঁদ বুঝি তা জানে" গানটিতে। তালাত মাহমুদকে অবশ্য আধা বাঙালিই বলা চলে। তিনি আসলে কলকাতার 'তপন কুমার'। তার এক বোন ঢাকায় থাকতেন স্বামীর চাকরিসূত্রে। আজিমপুর কলোনির এক ফ্ল্যাটে তাদের দেখেছি ১৯৬৯-'৭০ সালে। সায়রা বানুর নানা চাকরিসূত্রে ছিলেন ঢাকা-চট্টগ্রামে। এ কারণে তিনি, তার মা নাসিম বানু ও নানি শামশাদ বেগম বেশ কয়েক বছর ছিলেন এই দু' শহরে। এই শামশাদ বেগমও একজন গায়িকা, তবে সেই বিখ্যাত গায়িকা শামশাদ বেগম নন।
দিলীপ কুমার ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৯৫ সালের ২২ জানুয়ারি। জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল তার জন্য। সেখানে নিজের অভিনয় জীবন ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অল্পকথায় অনেক বলেছিলেন তিনি। সেদিন অনেক কিছু জেনেছি, ক্ষুদ্র জ্ঞানে বোঝার চেষ্টাও করেছি অনেক। শিল্প ও জীবন কিভাবে একাকার হয়ে যায় তা তাকে দেখে বুঝেছি সেদিন। তিনি একজন মহান অভিনেতাই শুধু নন, অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী একজন জীবনশিল্পীও বটে। বলিউডের আরেক মহানায়ক শাহরুখ খানও ঢাকা এসেছিলেন এই সেদিন ( গত ১০ ডিসেম্বর)। ধুমধাড়াক্কা অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন আয়োজকদের চাহিদা পূরণ করে। তিনি নৃত্যকুশল অভিনেতা। শাম্মী কাপুর, জিতেন্দ্র, মিঠুন চক্রবতর্ী প্রমুখের পর তিনিই এক্ষেত্রে সেরা। তবে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে পারিনি সেভাবে। বোম্বেটের এলাকায়, আরব সাগরের বুকে, সোমালিয়ার জলদসু্যদের কবলে পড়া বাংলাদেশী জাহাজ "জাহানমণি"ও তার ২৬ জন আরোহীর কথা ভেবে মন ছিল খারাপ। ভাবছিলাম, এসব ক্ষেত্রে কি করতে পারি আমরা? কি করতে পারে আমাদের নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী। খবরে দেখলাম, আমাদের নৌবাহিনী প্রধান এক আমন্ত্রণে গিয়েছেন অপহরণস্থল লাক্ষ্যা দ্বীপের কাছাকাছি এক দেশ শ্রীলঙ্কায়। না, "জাহানমণি" ও ২৬ জন বাংলাদেশীদের উদ্ধারে এগিয়ে যায়নি কেউ।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকেছে, দূর থেকে দেখেছে সবকিছু। আমাদের সরকারেরও তো ভাবখানা এমন যে, কিছু করার নেই। কিন্তু সত্যিই কি কিছু করার নেই? একজন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ জানান, সরকারের উচিত ছিল মিশর ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত দু'জনকে সোমালিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া। সেখানে একজনকে পাঠানো। জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছেও পাঠানো উচিত ছিল বিশেষ প্রতিনিধিকে। কিন্তু দেশবাসীর কথা কে আর কি ভাবে! আমাদের সঙ্গে বলিউডের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর থেকে। শেষ যে হিন্দি ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল তার নাম "পরবরিশ" (রাজ কাপুর, মালা সিনহা, মেহমুদ; ১৯৫৮)। তখন বলিউড ছাড়াও মাদ্রাজ, কলকাতা, লাহোর, করাচির হিন্দি-উদর্ু-বাংলা ছবি চলতো আমাদের প্রেক্ষাগৃহে। স্বাধীনতার পর বন্ধ হয়ে যায় লাহোর-করাচির ছবি। এরপর প্রেক্ষাগৃহগুলো দর্শকশূন্য হতে শুরু করে, এখন দেশ প্রেক্ষাগৃহশূন্য হতে শুরু করেছে। কারণ যোগান নেই দর্শক চাহিদা অনুযায়ী। একটা সময় হয়তো আসবে যখন আমরা চলচ্চিত্রশূন্যও হয়ে পড়বো! বলিউডের ছবি কিন্তু একশ্রেণীর প্রেক্ষাগৃহে সীমিত পর্যায়ে প্রদর্শিত হয়ে আসছে বলে শুনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন উৎসবেও দেখানো হয় সেসব ছবি। পাবনায় সুচিত্রা সেন উৎসব হয়েছে কিছু দিন আগে।
আশা করছি এরপর আয়োজন করা হবে "বলিউডে সুচিত্রা সেন" উৎসব। তখন অনেকে দেখতে পাবেন দেবদাস (১৯৫৫), মুসাফির, চম্পাকলি (১৯৫৭), সরহদ, বম্বাই কা বাবু (১৯৬০), মমতা (১৯৬৬), অাঁধি (১৯৭৫)। ১৯৬৫ সালের আগে বলিউডের ছবি যেভাবে আমাদের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে চলেছে সেভাবে আবার চলুক এটাই আমার দাবি। অনেকে বলছেন, সেভাবে চললে ক্ষতি হবে আমাদের চলচ্চিত্রের। এ আশঙ্কা অমূলক। যখন বলিউডের ছবি ছাড়াও কলকাতা, মাদ্রাজ, লাহোর, করাচি, হলিউডের ছবি দেদার চলেছে তখনই তো উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে আমাদের চলচ্চিত্রের। প্রতিবছর বেড়ে চলেছে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ( ১৯৬০ সালে ২, '৬১ সালে ৪, '৬২ সালে ৫, '৬৩ সালে ৫, '৬৪ সালে ১৬।
আসলে বলিউডকে ঠেকিয়ে রাখা হবে একটি আত্মঘাতী কাজ। একটির পর একটি প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে চললে আমাদের চলচ্চিত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া দেশের সাধারণ মানুষ এমনিতেই বিনোদন বঞ্চিত। এ কারণে ব্যর্থ হয়ে গেছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। অপরাধ ও মাদকাসক্তি বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এ অবস্থায় বিনোদন বঞ্চনাকে আরো তীব্র করে তোলার কোনও হেতু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রশ্ন জাগে, যেখানে বলিউডের প্রবেশ আছে পাকিস্তান, চীনসহ সব দেশে, সেখানে কেবল আমাদের মতো বলিউডপ্রিয় দর্শকদের দেশে কেন থাকবে না? মনে পড়ে বিটিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বরেণ্য অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা বলেছিলেন, 'বলিউডের ছবি এ দেশে চললে ক্ষতি হবে ১০-১২ জনের, লাভ হবে কোটি-কোটি মানুষের।' আমরা এখন লাভ দেখবো কার?
============================
পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ সাযযাদ কাদির
কবি ও সাংবাদিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.