বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস by মোহীত উল আলম

গত ১২ ডিসেম্বর রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেবি) বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করা হয়। তাতে পাঁচটি ভাগে বেবিগুলো বিন্যাস করে বলা হয়, প্রথম ভাগে যে আটটি বেবি আছে, তারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। দ্বিতীয় ভাগে আছে পাঁচটি বেবি, যাদের জমি কেনা হয়েছে এবং অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তৃতীয় ভাগে আছে নয়টি বেবি, যাদের নিজস্ব জমি ক্রয় সম্পন্ন হলেও অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। চতুর্থ ভাগে পড়েছে আরও নয়টি বেবি, যাদের নিজস্ব জায়গা থাকলেও তা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (বিমক) অনুমোদিত জায়গার চেয়ে কম। পঞ্চম বা শেষ ভাগে আছে ২২টি বেবি, যারা স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি করার কোনো উদ্যোগও নিচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার ও বিমকের কাছে বেবির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা। এটা আমার কাছে যৌক্তিক শর্ত মনে হয়, এবং সরকার যে এ শর্তটি পূরণ করার জন্য আরও পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছে, সেটাও সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়।
পর্যাপ্ত জমি ও আবাসন নিয়ে স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হতে পারে না। একটি বহুতল ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় হবে অথচ তার কয়েকটি তলায় থাকবে পোশাক তৈরির কারখানা বা অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা রেস্তোরাঁ, তাহলে কেমন করে উচ্চশিক্ষা প্রদানের পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকবে? অনেক বেবিতে শিক্ষকদের বসার জায়গা পর্যন্ত ঠিক নেই, কম্পিউটারসহ আধুনিক শিক্ষা প্রদান প্রযুক্তির কোনো ব্যবহার নেই, নেই শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষের ব্যবস্থা, কিন্তু হুড়মুড় করে ছাত্র ভর্তি করানো হচ্ছে, তাহলে সেখানে শিক্ষা প্রদানের নামে নিছক ব্যবসা করা হচ্ছে, সেটিও ঠিক। এসব সীমাবদ্ধতা পরিহার করানোর জন্য সরকারের তরফ থেকে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য যে বিধিমালা প্রণীত হয়েছে, সেগুলোকে সাধুবাদ জানানো যায়।
তবে, এ শর্তগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বিরাট কিছু সমস্যার মুখোমুখি সরকারকে হতে হবে। আমি যেহেতু একটি বেবির পূর্ণকালীন শিক্ষক, তাই আমি শর্তগুলোর কারণে বেবিগুলোর কী কী সমস্যা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করছি না। কারণ তা হবে পক্ষপাতমূলক, কিন্তু সর্বময় কর্তৃপক্ষ হিসেবে সরকারের কী কী অসুবিধার কথা বিবেচনায় আনা উচিত, সেদিক থেকে আলোচনাটা করছি।
আদর্শিকভাবে বাংলাদেশের সব বেবি এবং সবি (সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) হওয়া উচিত অক্সফোর্ড, কিংবা শান্তিনিকেতন বা ঢাবির মতো একর একর পরিসর নিয়ে। আদর্শিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অধ্যয়নিক ভবন থাকবে, শিক্ষক আবাসন থাকবে, শিক্ষার্থীর আবাস থাকবে, থাকবে খেলার মাঠ, বিজ্ঞান পরীক্ষাগার, নিজস্ব চিকিৎসাব্যবস্থা, আইটি ভবন, বিশাল গ্রন্থাগার, যার সঙ্গে থাকবে অনলাইন-সুবিধা এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শ্রেণীকক্ষ। ভারতীয় ইংরেজি সুলেখক অমিত চৌধুরীর আফটারনুন রাগা নামক একটি আত্মস্মৃতিমূলক উপন্যাস আছে, যাতে তাঁর অক্সফোর্ডে পড়ার সময়ের বর্ণনা আছে। এত চমৎকার করে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বর্ণনা করেছেন যে আমার নিজেরও দুঃখ হলো, একবার কেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য কপালে জুটল না। ইংল্যান্ডের শেকসপিয়ারের যেমন স্বপ্ন ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার (কিন্তু পড়তে পারেননি বলে যে শেকসপিয়ার অনুশোচনা করেছিলেন সে রকম কোনো প্রমাণ তাঁর লেখায় নেই), কিংবা বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার (তিনি পড়েছেনও), তেমনি আমার গাড়ির চালকের আপন ভাগনি, যে যশোর শিক্ষা বোর্ড থেকে দু-দুটো জিপিএ-৫ পেয়েছে, তারও স্বপ্ন হলো ঢাবিতে পড়ার। কাজেই বিশালকায় আয়তনসমৃদ্ধ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উচ্চাকাক্ষী শিক্ষার্থী পড়তে চাইবেই, এটি খুবই সংগত, এবং সরকারও যে শিক্ষার্থীদের এ স্বপ্নটার মূল্য দিচ্ছে, তার জন্যও তারা ধন্যবাদার্হ।
কিন্তু, দেশটা বাংলাদেশ, সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতায় একটি আক্ষেপজনক উক্তি আছে এ রকম যে, দ্রব্যমূল্যসহ সবকিছুর দাম বাড়ছে, শুধু দেশের সীমান্ত বাড়ছে না। কথাটার রাজনৈতিক ইঙ্গিত যা-ই থাক না কেন, লোকসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যে বিরাট চাপের মধ্যে আছে, সে কথাটা স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ পাহাড় খাচ্ছে, বন খাচ্ছে, নদী খাচ্ছে—সেটা এমনি এমনি খাচ্ছে না, বাধ্য হচ্ছে খেতে। চোখে কী দেখছি, আগে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে ভ্রমণ করার সময় বিচ্ছিন্নভাবে বহু মাইল দূরে দূরে এক একটা লোকালয় পড়ত। নৈশকালীন ভ্রমণের সময় বহু ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে নিদ্রাজড়িত ঢুলুনি চটকে যেত। কিন্তু এখন ভ্রমণ করুন, দিনে দেখবেন লোকালয়ের পর লোকালয় টানা শৃঙ্খলের মতো মহাসড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। হঠাৎ ফাঁক দিয়ে যে বিশাল শস্যপ্রান্তর দেখবেন, দিগন্তে আকাশপারে সবুজ গ্রাম দেখবেন, তার জো নেই। রাত্রিবেলায় তো আলোর মেলার থামাথামি নেই। আপনি ঘুমাতেই পারবেন না। আমি স্টিমারে করে একবার বরিশালে যাওয়ার সময়ও খেয়াল করলাম, নদীর পাড়গুলোতে একটানা লোকালয় গড়ে উঠেছে। যে লোকালয়গুলো গড়ে উঠছে খেতের জমি দখল করে। তার কারণ লোকসংখ্যার অত্যধিক চাপ। লোকসংখ্যার বিপক্ষে জায়গার অসংকুলান একটি বাস্তব সমস্যা। সেখানে বেবিগুলোকে এক একর অখণ্ড জমি ঢাকা শহরে, এবং ঢাকা শহরের বাইরে দুই একর জমি অর্জন করার শর্ত দিলে, আমি নিশ্চিত, এটা দেশের জনসংখ্যার রূপরেখার বিরুদ্ধে যাবে, যাবে শিক্ষার বিপক্ষেও। যদি ৪৩টি বেবি (যাদের ওপর এ শর্তটি বলবৎ হয়েছে) ৪৩ একর জমি কিনতে চায়, সেটা বাংলাদেশের জনসংখ্যা-ভূমির আনুপাতিক হারের প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এবং শুনেছি, আরও ৪৩টি বেবি অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। তাহলে লাগছে আরও ৪৩ একর। বেবিগুলোর পক্ষে এভাবে জমি খোঁজা, ক্রয় এবং বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর মনে হয় না। কারণ জমি কেনার পর মালিকানা ধরে রাখা কঠিন কাজ। দলিলদস্তাবেজ নিয়ে সৃষ্ট ঝামেলা থেকে ওকালতির পসার হবে, আদালত ব্যস্ত হবে, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। সরকারের পক্ষে হয়তো জমি সংগ্রহ সম্ভব, কারণ তার অধীনে অনেক খাসজমি আছে। সমাধান হবে, যদি বেবিগুলোর সঙ্গে বসে সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন খাসজমি বাজারদরে বেবি কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশব্যাপী সরকারি বিভিন্ন সংস্থার খালি জায়গা এমন এমন লোভনীয় অবস্থানে আছে, সরকার যদি সেগুলো থেকে বেবির জন্য জায়গা প্রদানের ব্যবস্থা করে, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থারও উন্নতি হবে, সরকারের অপচয়িত জায়গাগুলোরও একটি উন্নত ব্যবহার হবে।
সরকারের জন্য দ্বিতীয় হুমকিটি আরও মারাত্মক। ধরা যাক, বেবিগুলোর অর্ধেক বা তারও বেশি সরকারের শর্ত পূরণ করতে না পারার কারণে বন্ধ হয়ে গেল। বর্তমান সরকারি হিসাব বলছে, বেবিতে মোট শিক্ষার্থী দুই লাখ। তো অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে ধরি যে এক লাখ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। সাধারণত বেবিতে পাঠানো শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের পয়সার জোর থাকে সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাইরে পাঠাতে। তাহলে আবার সে ধারা শুরু হবে; আমাদের অপোগণ্ড গোছের বালক-বালিকারা বাইরে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের নামে মিছেমিছি বাবা-মায়ের ও দেশের টাকা নষ্ট করবে, কিন্তু বিদেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অচিরেই কোনো ডিগ্রি গ্রহণ না করে দেশে ফিরে আসবে এবং মা-বাবার দিক থেকে, যেখানে আগে কোনো সমস্যা ছিল না, সেখানে সমস্যা তৈরি করবে।
এ হুমকিটা এ জন্য প্রত্যক্ষ যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে আমরা জাতীয়ভাবে যতটা মানবসেবামূলক কর্ম মনে করি, আমাদের চেয়ে প্রাগ্রসর দেশ যেমন ভারত, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা তা মনে করে না। তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে একটি অর্থনৈতিক পণ্য মনে করে। নিজের দেশের সন্তানদের জন্য মনে না করলেও বিদেশি সন্তানদের জন্য তাই মনে করে। যেনতেনভাবে শুধু ভর্তি ফি এবং বেতন গ্রহণ করে বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করানোর জন্য তারা নিজেদের দেশ থেকে বের হয়ে এসে এখানে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, অফিস খুলছে, বিশেষজ্ঞ এনে নামকাওয়াস্তে ইন্টারভিউর মাধ্যমে ভর্তি করিয়ে নিচ্ছে। এভাবে ভর্তি হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের বিদেশে অবস্থানকালে তাদের দুর্বিষহ জীবনযাপনের কথা আমরা প্রতিদিন পত্রিকায় পড়ছি। কিন্তু টাকাটা পেয়ে গেছে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিদেশি নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে খুঁড়িয়ে চলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষার্থী এবং অনভিজ্ঞ কিন্তু উচ্চাকাক্ষী অভিভাবক মহলকে মৎস্য মনে করে যে ফাঁদে ফেলছে, আমাদের বেবিগুলোর অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গেলে সে ফাঁদটা তো আরও বড় হবে! সেটাও তো সরকারের জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করবে।
আমার মনে হয়, বড় জমি থাকলে, স্থায়ী আবাসন হলে, নিজস্ব ছাত্রাবাস থাকলে পড়ালেখার জোর বাড়বে, এ চিন্তা থেকে আমাদের বোধ হয় সরে আসার সময় হয়েছে। ঢাবি, চবি, রাবিসহ সব সবির গত ৪০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ‘বড় জমি, বড় শিক্ষা’র ধারণা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষদায়ক হয়েছে। সেগুলোকে সংরক্ষণ করাই সরকারের জন্য দায় হয়েছে। সবির পেছনে সরকারের খরচের তুলনায় উৎপাদন এত কম হয়েছে যে, ভয়ে ভয়ে বলছি, সবিগুলো শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে। ছাত্রাবাসগুলো হয়ে গেছে পেশিচর্চার নিরবচ্ছিন্ন কেন্দ্র।
‘বড় জমি, বড় পড়া’র ধারণা যদি আমরা ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, তাহলে সেই ঔপনিবেশিক ধারণা নিয়ে কেন আমরা এখনো সোচ্চার থাকব? বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা হতে হবে বাংলাদেশের জনবসতির চেহারার মতো গায়ে গায়ে লেগে; একসঙ্গে বিভিন্ন কর্ম চলবে, সঙ্গে শিক্ষাও চলবে। সরু রাস্তা, যানজট, বেসামাল গাড়ি চালনা ইত্যাকার কারণে শিক্ষাক্ষেত্রগুলো লোকালয়ের মূল কর্মকেন্দ্র থেকে দূরে না হওয়াই বাঞ্ছিত। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি আদর্শিক অবস্থানকে নতুন করে ঝালাই করে নিতে না পারার মতো বড় ব্যর্থতা আর হতে পারে না।
ড. মোহীত উল আলম: ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.