আলোচনা- 'সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক' by মোস্তফা কামাল

জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে গত রবিবার থেকে। বিরোধী দল বিএনপি যথারীতি সংসদ বর্জন অব্যাহত রেখেছে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, তাঁরা এ অধিবেশনে যোগ দেবেন না। সংসদের সপ্তম অধিবেশন শুরুর আগেই স্পিকার আবদুল হামিদ বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে আনতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি গত শনিবার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুককে ডেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি বিরোধীদলীয় নেতাকে সংসদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশেষ বার্তায় স্পিকার বলেছেন, বিরোধী দল সংসদে এলে সব বিষয় আলোচনা করতে পারবে, এমনকি সেনানিবাসের বাড়ি এবং বিরোধীদলীয় নেতার ছেলেদের ইস্যু নিয়েও আলোচনা করতে পারবে। এ সময় বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ আগের দাবিদাওয়ার সঙ্গে খালেদা জিয়ার বাড়ির বিষয়টিও শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। (কালের কণ্ঠ, ৫ ডিসেম্বর ২০১০)।
এর আগে ষষ্ঠ অধিবেশনেও বিএনপি যোগদান করেনি। তখন বিএনপি সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে ১২ দফা শর্ত দিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিরোধী দলকে হয়রানি এবং খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর প্যারোল বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ইস্যু, আসন বণ্টন নিয়ে জটিলতা, বিডিআর বিদ্রোহ, টিপাইমুখ বাঁধ, আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সারা দেশের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আবার আলোচনার সুযোগ দেওয়া প্রভৃতি বিষয় শর্তযুক্ত করা হয়েছে।
বিএনপির দেওয়া শর্তগুলো নিয়ে সংসদেই আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সংসদে যোগদান না করে শুধু শর্ত দিয়ে বসে থাকলে কী ফল হবে? এতে বরং সরকারি দল একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নবম জাতীয় সংসদের ছয়টি অধিবেশন শেষ হয়েছে, যার কার্যদিবস ছিল ১৬৯ দিন। বিএনপি এর মধ্যে মাত্র ৪৬ দিন অংশ নিয়েছে। টানা অংশ নিয়েছে ৪৪ কার্যদিবস। বিরোধীদলীয় নেতা অংশ নিয়েছেন মাত্র পাঁচ দিন। অথচ সংসদ অধিবেশন চলাকালে সংসদে প্রতি ঘণ্টায় ব্যয় হয় প্রায় ৯ লাখ টাকা। এ তথ্য নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তবে সংসদ অধিবেশন চালু থাকলে যে বিপুল অঙ্কের রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হয় তা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এটা জেনেও বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না। তবে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যরা নিয়মিত সংসদীয় কমিটিগুলোর বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন।
স্বৈরশাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংসদ বর্জনের রাজনীতি পরিত্যাগ করার ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। কিন্তু বারবারই তাঁরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন।
পঞ্চম জাতীয় সংসদের ২২ অধিবেশনে ৪০০ কার্যদিবস ছিল। এর মধ্যে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ১৩৫ কার্যদিবস অনুপস্থিত ছিল। বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ১৩৫ কার্যদিবস। সপ্তম সংসদে ২৩ অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল ৩৮২। এর মধ্যে বিরোধী দল বিএনপি ১৬৩ কার্যদিবস অনুপস্থিত ছিল। সপ্তম সংসদে খালেদা জিয়া মাত্র ২৮ কার্যদিবস উপস্থিত ছিলেন। অষ্টম সংসদে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ২২৩ কার্যদিবস অনুপস্থিত ছিল এবং উপস্থিত ছিল ১৫০ কার্যদিবস। তখন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা মাত্র ৪৫ কার্যদিবস উপস্থিত ছিলেন। কাজেই সংসদ বর্জনের এ অপসংস্কৃতি নতুন নয়।
২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও প্রধান দুই দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিরোধী দলে থাকলেও তাঁরা সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবেন। অথচ বিরোধী দল সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতিই ধরে রেখেছে।
সংসদে যোগ না দিয়েও সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা। অবশ্য সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে উভয় দলের সংসদ সদস্যরাই একাট্টা। দেশের জাতীয় স্বার্থ কিংবা অন্য কোনো ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য না থাকলেও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে সরকারি ও বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সব সরকারের আমলেই এমপিরা বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ পেয়ে আসছেন। এমপিদের গাড়িবিলাস নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু তার পরও তাদের চাহিদা বিলাসবহুল গাড়ি লাগবেই। গরিবের ঘোড়ারোগ যাকে বলে! গরিব দেশের মন্ত্রী-এমপিদের বিলাসবহুল গাড়িতে না চড়লে ইজ্জত থাকে না। এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় গণমাধ্যমের ওপর মিডিয়ার তুখোড় সমালোচনাও সহ্য করতে হয়েছে।
আমরা জানি, সাম্প্রতিক সময়ে এমপিদের সুযোগ-সুবিধা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে একজন এমপির বেতন ২৭ হাজার ৫০০ টাকা। তাঁদের বেতন সম্পূর্ণ আয়করমুক্ত। পারিতোষিক ছাড়াও বিভিন্ন সুবিধা পাবেন এমপিরা। তাঁরা নির্বাচনী এলাকার খরচ বাবদ সাড়ে সাত হাজার, যানবাহন ভাতা ৪০ হাজার (নতুন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে), নির্বাচনী এলাকার অফিস খরচ বাবদ ৯ হাজার টাকা পাবেন। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে যোগদানের জন্য প্রতিদিন ৮০০, বীমা বাবদ ১০ লাখ, ঐচ্ছিক অনুদান বাবদ দুই লাখ, আবাসিক টেলিফোন ভাতা বাবদ মাসে সাত হাজার ৮০০ টাকা পাবেন।
এমপিরা বর্তমানে শুল্কমুক্ত একটি সিডান কার বা জিপ আমদানির সুবিধা পান। এ ক্ষেত্রে একজন এমপি পর্যায়ক্রমে একাধিক মেয়াদে নির্বাচিত হলে তিনি একটি গাড়ি আমদানির সুবিধা গ্রহণের সাত বছর পর এমপি থাকাকালে পরবর্তী গাড়ি আমদানির সুযোগ পাবেন। সংসদের এক অধিবেশনে এক বৈঠক থেকে অন্য বৈঠকের বিরতি সাত দিনের বেশি হলে এমপিরা ভ্রমণভাতা পান না। এ বিধান বাদ দেওয়া হয়েছে। দেশের ভেতরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে বিমান, রেল, স্টিমার কিংবা বিআরটিসি বাস ভ্রমণের জন্য এমপিরা ভ্রমণ পাস পান। পাস না নিলে ৭৫ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
এসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চয়ই দরিদ্র দেশটির এমপিদের জন্য নেহাত কম নয়। তাঁরা সুযোগ-সুবিধা নেবেন অথচ সংসদে যাবেন না তা তো হতে পারে না। তাঁরা যদি সংসদ অধিবেশনে যোগদান না-ই করেন তাহলে সুবিধা-সুবিধা কেন নেবেন? এ বিষয়ে উভয় দলের এমপিরাই বলেছেন, সুযোগ-সুবিধা নেওয়া নাকি তাঁদের অধিকার। তাহলে কি সংসদে না যাওয়াও তাঁদের অধিকার? সেই অনৈতিক অধিকার কি তারা প্রয়োগ করবেন?
সংসদ বর্জনের এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে মনে করি। সংসদ বর্জনের এই ধারা চলতে থাকলে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না। গণতন্ত্র স্থায়ী ভিত্তি পাবে না। এটা ঠিক, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সচল সংসদের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক দেশে সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সংসদ, রাজপথ নয়। কিন্তু এমপিরা কখনোই সংসদকে সেই গুরুত্বের জায়গায় স্থান দেননি। সব সময়ই সংসদকে অবহেলা, অবজ্ঞা করা হয়েছে। আমরা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও ভেতরে ভেতরে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করি। আর এ কারণে আমাদের গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খাচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশেও সংসদে জুতা, চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। তার পরও তাঁরা সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা করতে সংসদে ছুটে যান। অথচ আমাদের এখানে আমরা কী দেখি! সংসদ অধিবেশনে সুযোগ পেলেই জাতীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়। নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে সংসদ অধিবেশনকে উত্তপ্ত করা হয়। এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বিরোধী দল সংসদে যোগদান না করে সরকারি দলকে একতরফা রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ করে দিচ্ছে। গণতন্ত্রে বিরোধী দল সব সময়ই ছায়া সরকারের দায়িত্ব পালন করে থাকে। আমাদের দেশের বিরোধী দল সেই ভূমিকা থেকে অনেক দূরে।
বিরোধী দলকে সংসদে রাখার ব্যাপারে সরকারি দলকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। বিরোধী দলবিহীন সংসদ অকার্যকর_এটা সরকারি দলকে উপলব্ধি করতে হবে। সরকারি ও বিরোধী দলের সক্রিয় অংশগ্রহণে সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে_এটাই সবার প্রত্যাশা।
==========================
আলোচনা- 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ, তারপর?  আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব'  স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'  খবর, কালের কণ্ঠের- আগেই ধ্বংস মহাস্থানগঃ হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ বন্ধ  কেয়ার্নের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তির পেছনেও জ্বালানি উপদেষ্টা  উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আত্মসমর্পণ  সবুজ মাঠ পেরিয়ে  আলোচনা- 'আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস'  আলোচনা- 'একটি 'উজ্জ্বল ভাবমূর্তির' এভারেস্ট থেকে পতন  গল্পালোচনা- 'আসি আসি করে আশিতে আসবে!'  রাষ্ট্র ও রাজনীতিঃ সবুজ মাঠ পেরিয়ে  স্মরণ- 'রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে'  স্মরণ- 'জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী'  আলোচনা- 'প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্যায়'  আলোচনা- 'কর্মপরিবেশঃ স্বর্গে তৈরি'  গল্পালোচনা- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...’  আন্তর্জাতিক- উইকিলিকসঃ হাটে হাঁড়ি ভাঙা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  গল্পসল্প- ওরা ধান কুড়ানির দল  শিক্ষা- আদিবাসী পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই  জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অর্থের মূল উৎস সৌদি আরব  রাজনৈতিক আলোচনা- এমন বন্ধু থাকলে...  শিল্প-অর্থনীতি শেয়ারবাজারের সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্ব  সাক্ষাৎকার- খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বিকল্প উপায় খুঁজতা হবে  খবর, প্রথম আলোর-  দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখবেন না  মার্কিন কূটনীতিকদের গোপন তারবার্তাঃ পাকিস্তানে জঙ্গি নির্মূলে ১০-১৫ বছর লাগবে  অধ্যাপক ইউনূসের অর্থ স্থানান্তর : গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাখ্যা  শিল্প-অর্থনীতি 'সময় এসেছে মাথা তুলে দাঁড়াবার'  প্রকৃতি- 'কিয়োটো প্রটোকল ভেস্তে যাচ্ছে, কানকুনে কী হবে?  আলোচনা- 'মেয়েদের লাঞ্ছনা বন্ধ করতে কঠোর হতে হবে'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আগ্নেয়গিরির ওপরে পিকনিক'  আলোচনা- 'হিমালয়ের কোলে এক টুকরো দক্ষিণ এশিয়া'  স্মরণ- 'মানুষের জন্য যিনি জেগে থাকতেন'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আবার আসিব ফিরে!'  আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন'


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যর
লেখকঃ মোস্তফা কামাল
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক


এই অলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.