গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন

কাগজের ওপর কাটাকুটি করতে করতে গালিব যেন একটি ঘোরের মধ্যে ঢুকলেন। বার বার লিখলেন আমি যে শহরে বাস করি তার নাম দিলিস্ন।

যে মহলস্নায় আমার ঘর তার নাম বিলিস্নযোঁরাও। দুটো বাক্য যতবারই লিখলেন ততবারই কাটলেন। কাটতে কাটতে কাগজের পৃষ্ঠা ভরে গেলো।
কালি লেপট গিয়ে হিজিবিজি রেখায় গোলকধাঁধার মতো দেখতে হলো পৃষ্ঠা। তিনি ভাবলেন, এই শহরে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। অলিগলি, পথঘাট, খোলা মাঠ, গাছপালা, ঘরবাড়ি-ঘরবাড়ি, ঘরবাড়ি।
ঘরবাড়ির ঠিকানা হয়ে যায় বিলিস্নযোঁরাও। তার আশপাশে লালকেলস্না থাকে। লালকেলস্নায় মোঘল সম্রাটরা থাকে। মোঘল সাম্রাজ্যের ঠিকানা হয় সে কেলস্না। সাম্রাজ্যের সম্রাট একজন কবি। কবি। এই শহরে গালিবইতো একা কবি- আকাশ সমান উঁচু মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গালিবইতো এই শহরের মুশায়রার সবচেয়ে বড় কণ্ঠ- তার মতো আর কে আছে?
তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তিনি কলমের নিবটা দোয়াতে চুবিয়ে ধরে উঠে পড়েন। শুরু করেন পায়চারি। দিলিস্ন এখন মৃতনগরী। সিপাহীরা পরাজিত হয়েছে। দিলিস্ন দখল করেছে ব্রিটিশরা। ওই ব্রিটিশ, ব্রিটিশরাজ- গালিবের কণ্ঠে দ্বিধা। কদিন ধরে শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ। গালিব থমকে দাঁড়ান। যেন পা জোড়া আটকে গেছে মেঝেতে। তিনি আর নড়তে পারছেন না। চারদিক থেকে ভেসে আসছে মানুষের আর্তনাদ। তিনি আবার ফিরে আসেন টেবিলে। অাঁকিবুকি কাটা কাগজটা দুমড়ে-মুচড়ে টেবিলের এক কোণে রেখে দিন। নতুন একটি কাগজ টেনে বের করে দোয়াতে চোবানো কলমটা দ্রুত হাতে উঠিয়ে নিয়ে লিখতে থাকেন:
'দুঃখের রাগরাগিণীর মূল্যও বুঝতে লেখো, হূদয় আমার; অস্তিত্বের এই বিচিত্রবীণাটি একদিন নিঃশব্দ হয়ে যাবে।' গজলটি লিখে গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন। খুব কষ্ট হচ্ছে। বারবারই মনে হয় বুকের ধুকপুষ্ট শব্দটি যে কোন মুহূর্তে থেমে যেতে পারে। হয়তো তখন গালিব নামের এই কবিকে চিনবে না দিলিস্নবাসী। হয়তো বাতাসের মর্মরধ্বনিতে উড়ে যাবে মুশায়রায় উচ্চারিত গালিবের কণ্ঠ। আর কি হবে? আর কি হতে পারে? গালিবের হাতে ধরা কলমটি নেমে আসে কাগজের ওপরে। লিখতে শুরু করেন আর একটি গজল:
'আমার এ গানের তিক্ততা ক্ষমার চোখে দেখো, গালিব, হূদয়ের ব্যথা আজ পূর্বের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ।।'
আবার কলমের মাথা বন্ধ হয়ে যায়। কলমটাকে রেখে দেন দোয়াতের পাশে। একমুহূর্ত তাকিয়ে দেখে ভাবেন, নিবের গায়ে লেগে থাকা কালিটুকু শুকিয়ে যেতে কতক্ষণ লাগবে? হয়তো বেশি সময় না, হয়তো বেশি- কে জানে। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে গেলেও এখনও বাতাস উষ্ণ এবং শুষ্ক। শরীরে তার স্পর্শ তেমনভাবে আরামদায়ক নয়।
তখন উমরাও জান দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, সব কি শেষ হয়ে গেল?
গালিব তার দিকে তাকালেন না এবং কোন উত্তরও দিলেন না। মুখ ঘুরিয়ে নির্দিষ্টমনে নিজের লেখা গজলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবলেন, কোন কিছু যেন মাথায় এসে যাচ্ছে। কলমটা কি হাতে নেবেন?
উমরাও জান কণ্ঠস্বর খানিকটা উঁচু করে বলেন, কথা বলছেন না যে?
স্ত্রীর দিকে মুখ না ফিরিয়েই গালিব বলেন, ইচ্ছে হয় না কথা বলতে। কথা আমি লিখতেই জানি।
উমরাও জান কণ্ঠস্বর ঝাঁঝিয়ে বলেন, আপনি কথা বলতেও জানেন। আপনার মুখে রসিকতার ফুলকি ছোটে। বন্ধুদের সঙ্গে আপনি তা বলতেই থকেন। আপরি এখন আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু।
গালিব এবার মুখ ফেরান। মৃদু হেসে বলেন, বেগমতো রাগবেই। খুদাতালা তাকে রাগের শক্তি দিয়েছেন।
হঁ্যা রাগের শক্তিতো দেবেনই। কারণ আপনি আমাকে রাগিয়ে দেয়ার মতো রসিকতা করতেও ভালোবাসেন।
কোনটা বলতো? আমিতো মনে করতে পারছি না।
ঠিক, ঠিক ভুলে গেছেন?
বিলকুল ভুলে গেছি বেগম।
এটাও রসিকতা।
খোদার কসম, এটা রসিকতা না। তুমি বল বেগম? তাড়াতাড়ি বল। আমাদের ঘরের বাইরে দিলিস্নর মহলস্না, রাস্তাগুলো পুড়ছে।
ওহ, খুদা।
উমরাও জান দোপাট্টা দিয়ে মুখ ঢাকেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ান। গালিব পেছন থেকে হাত ধরে বলেন, বললে না আমার রসিকতার কথা।
উমরাও জান দুইচোখ আগুন ঝরান। তারপর তপ্ত কণ্ঠে বলেন, দিলিস্নর মতো আমার কলজেটাও পুড়ছে।
ওহ, বেগম। আসল কথাটা বলো।
আপনি একবার উমরাও সিংয়ের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন।
গালিব মাথা নাড়িয়ে বলেন, আমার শিষ্য উমরাও সিং?
হঁ্যা, হঁ্যা তিনি। উমরাও জানের কণ্ঠে ঈষৎ ব্যাঙ্গ।
ওর দ্বিতীয় পত্নীর মৃতু্যর পরে আামি একটি চিঠি পেয়েছিলাম।
মনে আছে, ও চিঠিতে কি লিখেছিল?
তা আছে বৈকি। ও লিখেছিল, আমাকে এখন তৃতীয় পত্নী গ্রহণ করতে হবে। নইলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কে দেখাশোনা করবে।
মনে আছে আপনি কি লিখেছিলেন?
গালিব গড়গড়িয়ে বলেন, লিখেছিলাম, উমরাও সিং তোমার জন্য আমার দয়া হচ্ছে, আর নিজের জন্য হিংসে হচ্ছে। তুমি দু'বার বেড়িকাটার সুযোগ পেলে, আর আমি একান্ন বছর ধরে ফাঁসির দড়ি পরে আছি। দড়িটা ছেঁড়েও না, আমার প্রাণও বের হয় না। আমিতো গলায় ফাঁস আটকানো মানুষ।
আমি আপনার গলায় ফাঁস?
তা, নয়তো কি? আমিতো সত্যি স্বীকার করতে ভালোবাসি। বেগম তুমিতো চেনো আমাকে।
তারপরও আপনি আমার সঙ্গে ঘর করলেন? আপনি কবি। শের লেখেন। কিন্তু স্ত্রীর কলজের আগুন দেখতে পান না। আপনি কেমন কবি? নিষ্ঠুর রসিকতা করে মজা পান।
উমরাও জান শব্দ করে কেঁদে ওঠেন। তারপর ও দ্রুতপায়ে চলে যান। গালিব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর জোরে জোরে আওড়াতে থাকেন নিজের লেখা প্রিয় শের-
'এ যে মানুষের হূদয়, ইটপাথর নয়, ব্যথায় ভরে যাবে না কেন? আমি হাজার বার কাঁদবো, কেউ আমাকে কাঁদায় কেন?'
দু'বার শের আউড়ে তিনি জানালার খুলখুলি দিয়ে রাস্তা দেখার চেষ্টা করেন। দরজা বন্ধ। এই দুঃসময়ে দরজা খুলে রাখার সাহস নেই। ব্রিটিশ সৈন্যরা উন্মাদের মতো আচরণ করছে। জানালার খুলখুলি দিয়ে খানিকটুকু বাতাস আসছে। তাতে গরমের উষ্ণ প্রবাহ কমছে না। ঘরও ঠাণ্ডা হচ্ছে না। তিনি হাঁ করে বাতাস টানলেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন, এ বাতাস দিলিস্ন শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বাভাবিক বাতাস নয়। এ বাতাসে মানুষের আর্তনাদ মিশে আছে। দীর্ঘশ্বাসও রক্তের গঙ্গ নিয়ে বইছে। হঠাৎ বুকের ভেতরে প্রবল কাঁপুনি অনুভব করেন। ভয় আর আতঙ্কে তিনি দিশেহারা বোধ করলে চিৎকার করে স্ত্রীকে ডাকেন। উমরাও জান ততক্ষণে কিছুটা শান্ত হয়েছেন। মানুষটি এমনই- সেই বালিকা বয়স থেকে তাকে দেখছেন। দেখে শেষ করাতো হয়েইছে, তবে আর নতুন করে দুঃখ কি। তিনি হূদয়ের জ্বালা প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। এমন সময় শুনতে পান স্বামীর ডাক। বুঝতে পারেন যে তার নিজের ভেতরে কোনো প্রশ্ন জেগেছে।
তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর তাকে জিজ্ঞেস করবেন। উমরাও জান ধীর পায়ে স্বামীর ঘরে আসেন। বলেন, কি হয়েছে? আমাকে কেন দরকার হয়েছে আপনার?
বেগম আমি বেঁচে আছি কেন? বলতে পারো আমার বেঁচে থাকার কিসের প্রয়োজন?
উমরাও জান এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বলেন, কারণ আপনি দস্তাম্বু লেখা শেষ করেননি।
গালিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলেন, হঁ্যা, আমার একটি বড় কাজ বাকিদ্ধ আছে। এটা আমি লিখে শেষ করবো। কিন্তু বেগম তারপরও বলো, আমি বেঁচে আছি কেন?
উমরাও জান চুপ করেই থাকেন। কারণ এরপর আর কোনো উত্তর তার জানা নেই। মানুষ কেন বেঁচে থাকে এ কথার উত্তর তিনি নিজের মতো করে কিছু বলতে পারেন। কিন্তু তার স্বামী কেন বেঁচে আছে এ উত্তর তিনি নিজের মতো করেও বলতে পারবেন না। জোর গলায় বলতে পারবেন না যে তুমি আমার জন্য বেঁচে আছ। আমাদের ভালোবাসার সংসার আছে। ভালোবাসার সংসার রেখে কেউ মরে যেতে চায় না। গালিব বিরক্তির সঙ্গে বলেন, বেগম তুমি কথা বলছো না কেন?
আমার মনে হয় আপনি দস্তাম্বু লিখতে বসলে আপনার মন থেকে খারাপ চিন্তা চলে যাবে।
গালিব উষ্মার সঙ্গে বলেন, এটা মোটেই খারাপ চিন্তা নয়। এটা দার্শনিক চিন্তা। একজন কবির চিন্তা। এত বছর ধরে ঘর করে একজন কবিকে তুমি বুঝতেই পারলে না।
আপনার জন্য আমি নিসতার সরবত পাঠাচ্ছি। খেয়ে মাথা ঠান্ডা করুন। এমন মরণের শহরে ঘরে বন্দী হয়ে থাকলে কবিতো পাগল হয়েই যাবে। কবির কি দোষ!
মরণের শহর! দিলস্নী, আমার প্রিয় দিলস্নী এখন মরণের শহর!
গালিব বিড়বিড় করেন। উমরাও জান তার সামনে থেকে চলে গেছে। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ ঘর। কোথাও একটি টিকটিকির শব্দও নেই। আরশোলা দেখা যাচ্ছে না। পিঁপড়েও না। মানুষের মতো কি ওরাও শহর থেকে পালিয়েছে? কই কাকের ডাকও তো ভেসে আসছে না। তিনি টেবিলে এসে বসেন। দস্তাম্বু যে খাতায় লিখছিলেন সেটা টেনে নিয়ে বসেন। সাদা পৃষ্ঠার ওপর কালির অাঁচড় পড়তে থাকে; মহররম মাসের ২৬ তারিখ। ১৮ই সেপ্টেম্বর। শুত্রবার। মধ্যাহ্নে বিজয়ীরা লালকেলস্নাসহ পুরো শহরটি দখল করে ফেলে। সিপাহী বিদ্রোহের অবসান ঘটে গেল। দিলস্নীর পথে পথে মানুষেরা আতঙ্কে ছুটোছুটি করছে। গ্রেফতারি ও হত্যার আতঙ্ক চারদিকে। চাঁদনি চকের সীমানার পরেই খুন-জখমের মাত্রা ছাড়িয়ে যয়। রাস্তাগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দখল হয়ে আছে। ভয়াবহতার পরিমাণ বলে শেষ করা যায় না। ব্রিটিশদের মতো এ বৃদ্ধ সিংহ শহরে ঢুকেছে। অসহায় মানুষদের নির্বিচারে মেরে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি বিজয়ের পরে এ ধরনের নৃশংসতার প্রকাশ বুঝি এভাবেই ঘটে থাকে। তারপরও বলতে হয় এই ঘটনায় শহরে বাসকারী অসহায় মানুষদের বুক দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল এবং গণহত্যা দেখে তারা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকল। বিজয়ীরা যাকেই সামনে পেয়েছে তাকেই কচুকাটা করেছে। অভিজাত মানুষেরা নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্য ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। অন্যভাবে বলতে হয় তাড়া নিজেরাই নিজেদেরকে বন্দী করে রেখেছে। অভিজাতরাতো রাস্তায় হাঁটতে পারে না। তারা পালকিতে চড়ে। এসব ভাবনা ভাবতেও বিরক্ত লাগছে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। কিন্তু ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে নিজের কথাই ভাবেন। কারণ তাকে ভাবতে হয়। সিপাহি বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা করে আবার টেবিলে বসেন। কাগজ টেনে লিখতে থাকেন, দরিদ্র, কিন্তু সমাজের অন্য সবার থেকে আলাদা, তারা নিজেদের রুটি-রুজির জন্য ব্রিটিশদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা বিভিন্ন মহলস্নায় বাস করতো। কখনো একসঙ্গে এক জায়দায় বাস করেনি। তারা এক একজন দ্বীপের মত মানুষ। অস্ত্র সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এমনকি কুঠার বা তীর-ধনুক সম্পর্কেও। তাই বিদ্রোহের সময় তারা সেপাইদের পায়ের শব্দ পেলেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তো। যুদ্ধ করতে পারার মতো মানুষই তারা ছিল না। কি যে দুঃসময় বয়ে গেছে তাদের জীবনের উপর দিয়ে। ভাবাই যায় না। তারা জানত সব ধরনের কষ্ট সহ্য করে ঘরে বসে থাকতে। বন্দী জীবনযাপন করতেই তারা বুঝেছিল। এটাতো সত্যি ছুটে আসা পানির তোড়কে শুধু ঘাসের অাঁটি দিয়ে আটকানো যায় না। এদের সবার মতো আমিও একজন অসহায় এবং আঘাত-জর্জর মানুষ।
এটুকু লিখে কলমটা দোয়াতে চুবিয়ে রাখলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। জীবন-জগতের নানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশি করে মনে পড়ছে নিজের কবিতার বই 'দীওয়ান' প্রকাশের সময়ের কথা। মানুষ অসহায় হয়ে থাকলে কি স্মৃতি তাকে বেশি করে তাড়িত করে? নিজের প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছেই নেই। তিনি আবার স্ত্রীকে ডাকেন। প্রবল বিরক্তি নিয়ে কাছে এসে দাঁড়ান উমরাও জান।
বলেন, কি হয়েছে?
আমার একটি শের তোমাকে শোনাতে চাই বেগম।
উমরাও জান মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতে চাইলে তিনি তার হাত টেনে ধরে বলতে থাকেন-
'জীবনের ঘোড়া ছুটে চলেবে, দেখো কোথায় থামে; না হাতে আছে লাগাম, না পা আছে বেকাবে ।।'
তোমার জীবনের ঘোড়া থামবে না। তবে ঘোড়ার মতোই ছুটতে থাকবে। মুখ থুবড়ে পড়া চলবে না।
বিবি, তুমি এভাবে বললে?
হঁ্যা, বললাম। বলবোই। আপনার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে আমার জীবনও শেষ। আমিতো মুখ থুবড়ে পড়েই গেছি। কারণ ঠিকই লিখেছেন শের-এ। আপনি লাগাম ধরতে জানেন না। রেকাবেও পা রাখতে জানেন না।
তুমি আজ নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছো। বুঝতে পারছি ব্রিটিশদের রোষ তোমাকে ভর করেছে। দিলিস্নর বাতাসে তোমার নিঃশ্বাস পূর্ণ হয়ে গেছে।
আজ আমাকে এইসব কথা বলে লাভ নেই। আমার শরীর ভালো নেই। আমাকে আর এভাবে ডাকাডাকি করবেন না। আপনার জন্য শামী কাবাব বানিয়ে রেখে আমি শুয়ে পড়বো।
তোমার অশেষ মেহেরবানী বিবি।
মেহেরজান যেতে চাইলে গালিব আবার তার হাত টেনে ধরেন। উমরাও জান ভুরু কুঁচকে বলেন, আবার কি?
গালিব গভীর স্বরে বুকের ভেতর থেকে উঠিয়ে আনা শব্দ রাজি ছড়িয়ে দিতে থাকেন-
'এদিকে তাকাও, আয়না হাতে অতো তন্ময় কেন? দেখো, কি গভীর তৃষ্ণা চোখে নিয়ে আমি তোমাকে দেখছি।'
তোমার এই শের বারবনিতাদের জন্য, ঘরের বিবির জন্য নয়।
দিলিস্ন শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নিষ্ঠুরতা আমি তোমার ভেতরে দেখতে পাচ্ছি। বিবি, তুমি যাও। হায় খুদা, এত যন্ত্রণা কেন আমাকে ভোগ করতে হয়!
গালিব উল্টো দিকে মুখ ঘোরান। উমরাও জানের চলে যাওয়া দেখতে চান না। তীব্র বিবমিষায় তার শরীরী কম্পন তাকে বিপর্যস্ত করলে, তিনি বিছানায় আশ্রয় নেন এবং পর মুহূর্তে সোজা হয়ে বসে বলেন, উমরাও জান টিক কথাই বলেছে। একবিন্দু মিথ্যে নেই। তিনি আবার শুয়ে পড়েন। এবং অল্পক্ষণে তার ঘুম আসে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘুম ভাঙে কালস্নু মিয়ার চেঁচামেচিতে।
হুজুর! হুজুর! হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে কালস্নু মিয়া।
তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন। ক্রন্দনরত কালস্নু মিয়াকে দেখেন। কান্নার দলকে তার শরীর কতখানি নড়ছে সেটা বুঝে বিষয়টি অনুমান করার চেষ্টা করেন। তারপরও চুপ করে বসে থাকেন। ঘুসের আমেজ কাটেনি তা নয়, কিন্তু কোলাহলহীন শহরের নিস্তব্ধতা বুকের মধ্যে অনুভব করেন। কালস্নু মিয়ার কান্নায় হেঁচকি উঠছে। এক সময় থামলে তিনি আস্তে করে বলেন, তুমি এক গস্নাস পানি খেয়ে এসো কালস্নু মিয়া। তোমার কলজে শুকিয়ে গেছে।
ঠিক বলেছেন, হুজুর। আমি পানি খেয়ে আসছি।
ও চলে গেলে গালিব চুপচাপ বিছানায় বসে থাকেন। মাথার মধ্যে নানাকিছু চিন্তা। নিজেকেই বলেন, ঘরের কোণায় খুব অসহায় হয়ে পড়ে থাকছি। একন কলম আমার বন্ধু। যখন দিনলিপি তখন দুঃখের শব্দ ঝরে কাগজের ওপর। আর নিজের চোখের পানি ঝরে বুকের ওপরে। কি করবো আমি? ব্রিটিশদের অত্যাচার-নৃশংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ এই ব্রিটিশদের দেয়া পেনশনে আমিতো আমার পরিবার লালন-পালন করছি। পরিবারটি ছোট নয়। কালস্নুর মতো অনেকে আছে। দুই নাতি আছে। আমার স্ত্রী তাদেরকে খুব ভালোবাসে। আমিও ওদেরকে খুব ভালোবাসি। আমার নিজের সন্তানেরা কেউ বেঁচে নেই। মাঝে ম াঝে ভাবি, ভালোই হয়েছে যে খুদাতালা ওদেরকে নিয়ে গেছেন। নইলে অভাবের মাঝে ক্ষুধার্ত শিশুদের দিকে তো আমি তাকাতেই পারতাম না। আপসোস করি না। আমার স্ত্রী বলে, আমার কলজেয় এজন্য কোনো আপসোস নাই। আপসোস থাকবে কেন? আমিতো মনে করি আমার জন্য এটা খুদাতালার মেহেরবাণী।
সে মুহূর্তে হুড়োহুড়ি কর ঢুকে পড়ে দুইভাই।
নানা মিঠাই খাবো।
মিঠাই? গালিব বিমূঢ় হয়ে যান।
নানা, মিঠাই, মিঠাই। দুই ভাই লাফাতে লাফাতে বলে। কতদিন মিঠাই খাইনি।
গালিব ওদের কাছে ডেকে আদর করে বলেন, এখনতো মিঠাই পাওয়া যাবে না রে সোনারা। দোকানপাট সব বন্ধ।
কেন বন্ধ নানা? চারদিকে এত তুফান কেন? আমাদের গলিটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
হঁ্যা, সেজন্যইতো মিঠাইয়ের জন্য কাউকে পাঠানো যাচ্ছে না।
আচ্ছা নানা, ওরা লোকজনদের মেরে ফেলছে কেন? ওই লালমুখো সাহেবগুলো খুব খারাপ। খুব শয়তান। আজকে যাই। কালকে কিন্তু মিঠাই খাবো। মিঠাই আমাদেরকে দিতেই হবে। কয়েকদিন ধরে নানি আমাদেরকে দুধও দিচ্ছে না।
আর একজন গালিবের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, আখরোট, নাসপাতিও না।
শহরের অবস্থা ঠিক হোক তোমাদেরকে সবকিছু দেয়া হবে।
দেয়া হবে, দেয়া হবে- বলতে বলতে ওরা ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খায়। তারপর একদৌড়ে ঘর ছাড়ে।
আনন্দে গালিবের চোখ বুঁজে আসে। দু'চার ফোঁটা পানিও গড়ায় গালের ওপর। মনে পড়ে আগ্রায় তার একটি চমৎকার শৈশব ছিল। ঘুড়ি-ওড়ানোর বন্ধু ছিল বংশীধর। ওহ্, কতদিন বংশীধরের সঙ্গে দেখা নেই। বংশীধর দিলিস্নতে এলে ওর জন্য লাউ-কুমড়ো, ফলমূল নিয়ে আসতো। ঝুড়ি বোঝাই করে আনতো। দু'জন মিলে শৈশবের স্মৃতিচারণ করে মেতে উঠতো- কি আনন্দ ছিল! কতটুকুই বা সময়ের জন্য ওরা ফিরে যেতো শৈশবে, কিন্তু মনে হতো দিনগুলো হারিয়ে যায়নি। এই এখন যেমন এই বাচ্চাদের শৈশবে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ওদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে না। গালিব বিছানা থেকে নামার জন্য পা ঝুলিয়ে দিলে ফোঁসফোঁস করতে করতে কালস্নু মিয়া ঢোকে।
হুজুর, হুজুর আমার প্রাণের দোস্ত বশির মিয়া নাই।
বশির মিয়া? কোন বশির মিয়া?
গালিব ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।
গোস্তের দোকানদার। কসাই বশির মিয়া। গোস্তের সবচেয়ে বড় টুকরোটা ও আপনার জন্য রেখে দিত। ওটা দিয়েইতো শামী কাবাব বানানো হয়। আপনি খেয়ে খুব আনন্দ পান।
গলির রাস্তাতো বন্ধ। তুমি খবর পেলে কি করে?
আমি ও কেমন আছে খোঁজ নেয়ার জন্য লুকিয়ে বের হয়েছিলাম। হুজুর, ও একা নয়, ওর সঙ্গে আরও অনেকে রাস্তার উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। হায় আলস্নাহ! এ কেমন দিন এলো আমাদের জীবনে! ওই গোরা সৈনিকেরা দিলিস্ন শহরের একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দিবে না।
কালস্নু মিয়ার কান্না থামে না। ঘরের মেঝেতে বসে কাঁদতে থাকে গালিব অন্যমনস্ক চিন্তায় ওর কান্নার শব্দ শোনেন। যেন শব্দ যমুনা নদীর ওপর দিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। পেঁৗছে যাচ্ছে ওর শৈশবের আগ্রা শহরে- ওখানে উড়ছে ওর শৈশবের ঘুড়ি। সেই ঘুড়ি শব্দ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে কিংবা অন্য কোথাও। গালিব বিড়বিড় করে বলেন, অন্য কোথাও। অন্য কোথাও। অন্য কোথাও-। দেখতে পান কালস্নু মিয়া চোখ মুছতে মুছতে চলে যাচ্ছে। তখন তিনি উঁচু কণ্ঠে ওকে ডাকেন। কালস্নু মিয়া ফিরে এসে দাঁড়ায়। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে যান। কি যেন বলতে চেয়েছিলেন ওকে।
হুজুর, আমাকে ডাকলেন কেন? তুমি কি আমার ভাই ইউসুফ মীর্জার খবর আনতে পারো?
আমার রাস্তায় বের হতে ভয় করে।
ভয়?
হঁ্যা হুজুর, ভয় ভয়। সৈনিকগুলো আমাকেও মেরে ফেলতে পারে, এই ভয়।
আমার ভাইয়ের বাড়ি তো এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তাছাড়া আমার ভাই গোস্ত বিক্রি করে না। ও একটা পাগল। ত্রিশ বছর বয়সে ওর পাগলামি ধরা পড়ে। সেই থেকে, কালস্নু মিয়া সেই থেকে এখন পর্যন্ত ও আর ভালো হয়নি।
আমি এসব জানি হুজুর।
হঁ্যা, হঁ্যা, তুমিতো সবই জানো। তুমিতো আমার পরিবারেরই একজন। কালস্নু মিয়া আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি। এতবড় পরিবার টানতে আমার খুব কষ্ট হয়। তারপরও- তারপরও আমি চাই তোমরা সবাই আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।
কালস্নু মিয়া অকস্মাৎ গালিবের পায়ে কদমবুছি করে বলে, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি হুজুর যে, আমি ইউসুফ হুজুরের খবর আপনাকে জানাবো।
সাবধানে যেও।
হঁ্যা, আমাকেতো সাবধানেই যেতে হবে এবং ফিরে আসতে হবে। নইলে আমি কেমন করে আপনাকে খবর জানাবো। সেলাম, জুহুর।
কালস্নু মিয়া দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায়। গালিবের মনে হয় তার শরীর কাঁপছে। তিনি বেশিকিছু ভাবতে পারছেন না। তার ভাই সারাদিনে কি খেলো, রাত্রে ঘুমুতে পারছে কিনা কে জানে, কোনো খবরই পাচ্ছেন না। একজন মানুষ উন্মাদদশা নিয়ে ষাট বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছেন। এই যন্ত্রণার কথা কাকে বলবেন? স্ত্রী আর মেয়েরাই বুঝতে পারে তাকে? না, একদমই না। তিনি কাউকে বিরক্ত করে না, চেঁচামেচি করে না। নিজের মনে থাকে। হায় খুদা, কালস্নু মিয়া কি খবর আনবে কে জানে। আমি যদি জাদু জানতাম তাহলে কারো পিঠে পাখা লাগিয়ে উড়িয়ে দিতাম। না, জাদু জানলেও কাজ হতো না। ওদেরকে আমি এখানে নিয়ে আসতে পারতাম না। কোনো খাবারও পাঠাতে পারতাম না। ইউসুফ মীর্জার কি খাবার পছন্দ তাও আমার জানা নেই। শহরে আমরা দু'ভাই বাস করি, কিন্তু একে অপরকে ঠিকভাবে জানি না। আমার কি দুর্ভাগ্য! আমার কষ্ট আমি কাউকে ভাগ করে দিতে পারি না। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও আমার দূর দূর ব্যবধান।
গালিব ধীরপায়ে বারান্দায় আসেন। বালতি থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে নিজেকে শীতল করেন। পানির স্পর্শ তাকে সি্নগ্ধই করে। তিনি স্বস্তিবোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয় দস্তাম্বুর পৃষ্ঠা ভরাবেন ভারতবাসী এবং ব্রিটিশদের ভূমিকার কথা লিখে। যারা ন্যায়বিচারের কথা বলে এবং অত্যাচারের নিন্দা করে তাদের জানা উচিত যে সফরের সময় ভারতীয় সিপাইরা নির্বিচারে হত্যা করছে। হত্যা করেছে অসহায় নারীদের, এমনকি দোলনায় খেলতে থাকা শিশুদেরও। সে তুলনায় ইংরেজদের আচরণও খতিয়ে দেখা যায়। যখন তারা জিতলো, তারাও বদলা নেয়ার লড়াই শুরু করলো, বিরোধিতাকারীদের শাস্তি দিতে শুরু করলো। কিন্তু তারা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলো না। অথচ শহরবাসীরাতো গদরকে সমর্থন করেছিল, তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারতো ইংরেজরা। কিন্তু করেনি। তারা নারী ও শিশুদের রেহাই দিয়েছে। তারা এটা করেছে এজন্য যে, অপরাধী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে। ইংরেজরা এতই ভদ্র যে, যাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, শুনেছি, তাদেরকে ছাড়া আর কাউকে বিরক্ত করা হচ্ছে না। ওরা যদি উন্মত্ত হতো তাহলে এই শহরের কুকুর-বেড়ালকেও বেঁচে থাকতে দিত না। হঁ্যা, এখন আমাকে রানী ভিক্টোরিয়ার নামে কসীদা লিখতে হবে। তার কাছে আমার তিনটি প্রার্থনা আছে। আমরাতো সবাই জানি গ্রিস, ইরান এবং অন্য অনেক দেশে কবি-সাহিত্যিকদের কতভাবে সম্মানিত করা হয়- তাদের দু'হাত মুক্তা দিয়ে ভরে দেয়া হয়, কখনো কোনো বখশিস দেয়া হয়, ইনাম দেয়া হয়। রানীর কাছে আমার প্রার্থনা এই যে, তিনি নিজে আমাকে একটি খেতাব প্রদান করবেন। তিনি আমাকে দরবারী পোশাক-খিলঅত উপহার দিবেন এবং সামান্য কয়েক টুকরো রুটির ব্যবস্থা করবেন। যদিও আমি জানি আমি তাদের পেনশনভোগী। তারপরও বারবার আমাকে রুটির জন্য আবেদন করতে হয়। এসবই কপালের লিখন। সব মানুষেরই ভাগ্যতো নির্ধারিত থাকে। আর এই বেঁচে থাকার জন্য সামগ্রী দিয়ে দেয়া হয়। এই যে জীবন চলছে, এর মধ্যেই থাকে বিপদ এবং বিপদ থেকে রক্ষা। কারো সাধ্য নেই এর থেকে বাইরে যাওয়া। ছোট বাচ্চারা যেমন সব তামাসাতে মজা পায়, আনন্দ করে, এই বুড়ো বয়সে আমারও উচিত সময়ে যা কিছু ঘটছে সেটাকে খুশি মনে মেনে নেয়া। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই একমাত্র উপায় সম্বল করে আমার শেষ দিনগুলো কেটে যাক, নিজের জন্য এই আমার প্রার্থনা।
গালিব বারান্দা থেকে ঘরে আসেন। পানি দিয়ে ধোয়া মুখ গামছায় মোছা হয়নি। পানির স্পর্শ লেগে আছে ত্বকে। তিনি দাড়িতে হাত বোলান। তারপর চুল এলোমেলো করেন। মনে মনে ভাবেন, এক পেয়ালা সুরা পেলে সময়টা খুব আনন্দে কাটাতে পারবেন। ওহ্! এই দুঃসময়কে মনোরম করার আর কিইবা উপায় আছে। তিনি নিজের শের আওড়াতে থাকেন-
'নাদা হো যো কহতে হো কে কিয়োঁ জিতে হ্যায় গালিব
কিস্মৎ মে হ্যায় মরণে কী তামান্না কোঈ দিন অওর।'
অবুঝ লোকেরা বলে গালিব কেন বেঁচে
ভাগ্যে রয়েছে বাঁচার ইচ্ছে কিছুদিন আরও।'
সত্যিতো তাকে বাঁচতে হবে আরও। কেন মারা যাবেন? ইংরেজরা দিলিস্ন দখল করার পরে বাদশা কেমন আছে খোঁজ পাননি। পাবেনই বা কি করে ঘরে তো বন্দি তিনি। মহম্মদ ইব্রাহিম জওকের মৃতু্যর পরে বাদশা গালিবকে সাম্রাজ্যের কবির পদে বরণ করেছিলেন আসলে জওকের মৃতু্যর পরে এই পদের দাবিদার আর কবি ছিলেন না। তিনি খুব খুশি মনে পদটি গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি জানতেন তিনি যেমন বাদশার কবিতার তেমন প্রশংসা করেন না, বাদশাও তার কবিতার দারুণ সমঝদার নন। তিনি 'শায়র-উল-মুলক' হলেন বটে; কিন্তু জওকের মতো মালিক-উল-সুয়ারা' অর্থাৎ কবিদের রাজা উপাধি তার পাওয়া হবে না। তাছাড়া পারিশ্রমিকও বাড়েনি। বাদশার ওস্তাদ হওয়ায় বাদশার কবিতা তাকে সংশোধন করতে হতো। মাঝে মাঝে ভাবতেন কাজটি কখনো খুব কঠিন। কারণ, অকারণ প্রশংসা করা সহজ কাজ নয়। সে তিনি বাদশাই হোন বা অন্য কোনো কবিই হোন না কেন! তাতে কিছু এসে যায় না। তার বোঝাটাই সত্য।
তিনি ঘরের মাঝে এসে দাঁড়ান। এখন একজন বন্ধু থাকলে বেশ হতো। এই দারুণ সময়কে তিনি গজলের মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারতেন। তার দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিতে পারতেন। তিনি ঘরে পায়াচরি করতে করতে আবারও ভাবেন, কেমন আছেন বাদশা? একবার ঈদ উপলক্ষে বাদশার সামনে একটি কসীদা পাঠ করেন তিনি। বাদশা তাঁর কবিতার প্রশংসা করতেন না। কাসীদা শুনে বললেন, 'মির্জা তুম পড়তে বহোৎ খুব হো।' তার আবৃত্তির প্রশংসা করলেন। গালিবতো জানেন মুশায়রার তিনি যখন পাঠ করেন তখন উপস্থিত সবাই তার পাঠে উচ্ছ্বসিত থাকেন। এ ব্যাপারে তাঁর সুনামের কমতি নেই। কিন্তু বাদশা যখন বলেন, তখন বাদশা কাসীদার প্রশংসা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই করেন, এটা তিনি বুঝতে পারেন। পরস্পরকে বোঝার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের সূত্র তৈরি হয়। কবিইতো বুঝবেন অন্তরের কথা। কবিইতো জানেন কোনটা নকল রঙ, কোনটা তামাশা, কোনটা বুকের ভেতরের খাঁটি রঙ। সেদিন তার খুব মন খারাপ হয়েছিল। ফেরার পথে বন্ধু শইফতার বাড়ি গিয়েছিলেন। ওর সঙ্গে কথা বলে স্বস্তি পেয়েছিলেন। মনের দুঃখ লাঘব হয়েছিলেন। সেদিন দু'জনেই একমত হয়েছিলেন যে খাঁটি পৃষ্ঠপোষক পাওয়া কঠিন। এই মুহূর্তে বন্ধু শইফতা, তুফতা এবং আরও অনেকের কথা মনে হচ্ছে। সফরের শুরু থেকেই কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। দোস্ত, তোমরা কেমন আছ?
তিনি চেয়ারে বসেন। টেবিলের ওপর কনুই রেখে হাতের তালুতে মুখ রেখে মাথা কাৎ করেন। এটি তাঁর একটি প্রিয় ভঙ্গি। স্মৃতি রোমন্থন কিংবা নানাকিছু ভাবনার সময় এই ভঙ্গিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। গরদের প্রসঙ্গ মনে হতেই ভাবলেন, গরদের ঘটনাটি তো একদিনের নয়। থাক, এ প্রসঙ্গ। তিনি নিজের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চাইলেন। পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
ঘরে এলেন উমরাও জান।
গালিব ভুরু উঁচিয়ে এক মুহূর্ত তাকে দেখলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, কি হয়েছে বিবি?
ইংরেজরা শহরের লোকজনকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
কে জানালো খবরটা?
খাদিমা। ওরা চলে যাচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছে?
শহরের বাইরে কোনো খোলা জায়গায় ওদের পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
ওরা কোথায় থাকবে?
খোলা আকাশের নিচে নিশ্চয়ই না। খাদিমা বলেছে, ওরা কোনো ব্যবস্থা করবে। তাঁবু চাইতে পারে কারো কাছে কিংবা মাথার ওপরে অন্য কোনো ছাউনির চিন্তা ওদের আছে। খাদিমা বলেছে, ওরা শুধু ভয়ে-আতঙ্ক শহর ছেড়ে যাচেছ না। ওরা কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে।
গালিব গভীর শ্বাস টেনে বললেন, তবু ওরা বেঁচে আছে। ওরা হয়তো একদিন আবার ফিরে আসবে। শহরে।
উমরাও জান দোপাট্টায় চেখে মোছেন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ওরা তো শত শত মানুষকে মেরেও ফেলেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে।
ওহ বিবি, তোমার কষ্ট কলবের মধ্যে গেঁথে রাখো। আমাকে আমার পরিবারের কথা ভাবতে দাও। তুমিতো জানো বিবি, এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমি দিলিস্নর কালেকটরি থেকে পেনসন পেয়েছি। দগরের মাস থেকে পেনসন বন্ধ হয়ে আছে। দগরের মাস থেকে পেনসন বন্ধ হয়ে আছে। আমি এখন খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। আগে তুমি আর আমি ছিলাম। এখন দুটি এতিম শিশু আমাদের সঙ্গে আছে।
উমরাও জান মাথা নেড়ে বলেন, ওরা আমার নাতি সম্পর্কের। এখন ওদেরকে দুধ-মিঠাই-কাবাব-রুটি ঠিকমতো খাওয়াতে পারছি না।
ভেবে দেখো। আমরা কত দুঃখে আছি। এছাড়া আমাদের সংসারে কত জন আশ্রিত আছেন। পেনসন না পেলে ওদের দেখাশোনাইবা কীভাবে চলবে।
উমরাও জান চোখে উজ্জ্বল তরে বলেন, ইংরেজরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। এবার আপনার পেনসন আবার চালু হবে। ঠিক বলেছি?
গালিব দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলেন, ঠিক কিনা এখনও জানি না। আমি তো বাদশার সভাকবি ছিলাম। ওরা আমাকে বিশ্বাস করবেতো?
তিনি তাঁর দু'হাত চুলের ভেরে ঢুকিয়ে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলেন, বিবি আমার খিদে পেয়েছে।
যাই, দু'টুকরো শুকনো রুটি নিয়ে আসি।
শুধু শুকনো রুটি?
আরতো কিছু নেই। কোথায় থেকে আসবে? বলতে বলতে উমরাও জান চলে যান। গালিব নিজেকে শক্ত করে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি তো খবর পেয়েছেন, শহরের যে কোনো যুবক এবং সমর্থ মুসলমানকে রাজদ্রোহিতার অপরাধে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদেরকে হত্যা করা হয়েছে। তা সে অপরাধী বা নিরপরাধী-যেই হোক না কেন।
তিনি দু'পা হেঁটে আবার ভাবলেন, আমার প্রতি যারা শত্রুতার মনোভাব লালন করে, যারা ব্রিটিশদের বিশেষ বন্ধু তারা আমার বিরুদ্ধে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। এটা তারা করতেই পারে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য।
তিনি ঘরে পায়চারী করলেন। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই বললেন, আমিতো সেই মধ্য দুুপুরের কথা ভুলে যাইনি, যেদিন ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে কেলস্নার দেয়াল ও দরজাগুলো কেঁপে উঠেছিল। মীরাটের উন্মত্ত সিপাহিরা ছিল নেমকহারাম এবং ইংরেজদের রক্তের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। ওরা রক্তলোলুপ দুর্বৃত্ত। শহরের প্রবেশদ্বারের রক্ষীরা ওদের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল। ওরা শহর রক্ষাকারীর দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়েছিল। প্রভুর প্রতি নিজেদের বিশ্বস্ততার কথা ভুলে গিয়েছিল। আর শহরবাসীর অনেকে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। সেপাইদের সঙ্গে এক হয়ে লুটতরাজ আর হত্যায় লিপ্ত হয়ে গেলো। এখন তার পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে।
দু'টুকরো রুটি নিয়ে ঘরে আসেন উমরাও জান। সঙ্গে এক গস্নাস পানি। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার ভুরু কুঁচকে আছে কেন? আপনি কি কিছু ভাবছেন?
ভাবছিলাম গদরের কথা। সেদিন সেপাহিরা যে ইংরেজকে সামনে পেয়েছিল তাকে হত্যা করেছিল। বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওরা থামতে পারেনি।
এসব কথা থাক এখন। আপনি রুটির টুকরো দু'টো খেয়ে ফেলুন।
গালিব রুটির টুকরোটা হাতে নিতে নিতে বলেন, যাদেরকে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের মধ্যে আমার কোনো বন্ধু থাকলে কি হবে? কেমন করে যোগাযোগ করবো? আমরা যারা শহরের ভেতরে রয়ে গেলাম তারা যদি ওদের খবরাখবর নিতে পারতাম তাহলে খানিকটা দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারতাম।
তা ঠিক। উমরাও জান দোপাট্টা দিয়ে মুখের ঘাম মোছেন।
এখন আমরা হূদয় যন্ত্রণায় কাতর।
তার চেয়েও বড় শহরের মানুষেরা ইংরেজদের হত্যাকান্ডে আতঙ্কিত।
হ্যাঁ, শহরটা এখন একটি মৃতু্যজমিন। বসন্তের ফুল-ফোটা বন্ধ থাকবে, শীতের উত্তুরে বাতাস বইবে না। বর্ষার বৃষ্টির ধারা যমুনায় পড়বে না। মৃতু্যজমিন মানুষের শোনিতে-
উমরাও জান রুদ্ধকণ্ঠে স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, আপনি এভাবে বলবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না।
দ্রুতপায়ে চলে যান। গালিব শুকনো রুটি শেষ করে গস্নাসের পানি খান। মনে হয় বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। প্রবল জ্বালা ছড়িয়ে যাচ্ছে মৃতু্যজমিনে বসবাসকারী একজন কবির হূদয়ে।
পরদিন কালস্নু মিয়া মির্জা ইউসুফের খবর নিয়ে আসে।
গালিবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকে, হুজুর!
গালিব ওর দিকে ঘুরে তাকালে কালস্নু মিয়া দেখতে পায় তাঁর দু'চোখ লাল। শরীর বোধ হয় জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কিংবা মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। কালস্নু মিয়া বুঝতে পারে না যে এসময় কি তাকে মির্জা ইউসুফের খবর দেয়া ঠিক হবে কিনা? গালিব ইশারায় কালস্নু মিয়াকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, আমার ভাইয়ের বাড়িতে যেতে পেরেছিলে?
পেরেছিলাম। সেখান থেকেই আমি এইমাত্র এসেছি।
গালিব উদগ্রীব কণ্ঠে বলেন, কেমন আছে আমার ভাই? তুমি তো জানো না যে ও আমার চেয়ে মাত্র দু'বছরের ছোট। আমার খুব আদরের ভাই। বলো ও কেমন আছে?
ভালো আছে হুজুর। তবে-
তবে-তবে কি? থামলে কেন?
তাঁর বিবি ও মেয়েরা অন্যদের সঙ্গে শহর ছেড়ে চলে গেছে।
চলে গেছে?
দু'দিন হলো চলে গেছে।
কে আছে ওর সঙ্গে? মানে ওর দেখাশোনা -
বুড়ো দারোয়ান আছেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ আকরামা খুব ভালো লোক। খুব বিশ্বস্ত।
তাঁর পরিচারিকা-
আহা, বুড়ো নেকজানের মা। ওরা দু'জন ছাড়া তো ওর সংসার অচল। বুঝলে কালস্নু মিয়া আমার ভাই দু'জন ভালো লোকের দেখাশোনাতেই আছে। তুমি ওকে সুস্থ দেখেছ তো?
হ্যাঁ, তিনি সুস্থই আছেন। দারোয়ান ভাইয়া বললো খাওয়াদাওয়ার একটু অসুবিধে হচ্ছে।
সেতো হবেই। সবই নসীব। আমরা এখন দুর্যোগের মধ্যে বাস করছি। তুমি যাও কালস্নু মিয়া তোমাকে শুকরিয়া যে তুমি জানের ঝুঁকি নিয়ে আমার ভাইয়ের খবর এনেছ। জানো তো ইংরেজরা এই শহরের মুসলমানদের বাঁচিয়ে রাখবে না। ওরা রক্তের বদলা নিচ্ছে।
যতই কিছু হোক না কেন আমি আপনার ভাইয়ের খবর আপনাকে এনে দেবো। আমি সময়-সুযোগ বুঝে ওই বাড়িতে যাবো হুজুর।
সাবধানে যাবে।
আপনি ঘাবড়াবেন না হুজুর।
কালস্নু মিয়া চলে গেলে গালিব লিখতে বসলেন। কলমটা দোয়াতে চুবিয়ে লিখলেন, 'এখন শস্ত্রধারী ইংরেজ সেনা স্বেচ্ছাচারী ও স্বাধীন। আতঙ্কহিম নিশ্চল মানুষ, পথ জনহীন।'
ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়েদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়া তাঁকে খুব মর্মাহত করে। তারা তাঁর ভাইকে রেখে চলে গেছে। হায় খুদা। তিনি গভীর আক্ষেপের সঙ্গে আবার লিখলেন:
'নিরাপদ বাসভূমি আজ কারাগার
চক পরাজিতের রদে রঙিন।'
চাঁদনি চক তাঁর প্রিয় জায়গা। সেই জমিন আজ রক্তে ভিজে ডুবে যাচ্ছে। না, ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়েদের প্রতি তাঁর কোনো ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ পুষবেন কেন? তাঁদেরও তো জীবনের ভয় আছে। মানুষ তো বাঁচতে চায়। তিনি নিজেও ষাটের বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছেন। আরও বেঁচে থাকতে চান। তাঁর বেঁচে থাকার তৃষ্ণায় অনন্ত ধারায় পানি সিঞ্চিত হোক। সতেজ থাকতে বয়সের নবীন চারা। পরক্ষণে আবার মন খারাপ হয়ে যায়। দিলিস্নর বর্তমান সময় তাকে তাড়িত করে ফিরছে। নিজেকে সামলে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আবার লিখেছেন:
'নগর মুসলমানের শোনিত-তৃষিত
প্রতিটি ধুলিকণা তৃপ্তবিহীন।'
শের তিনটি একটি আলাদা কাগজে লিখলেন। সের তিনটি দস্তম্বু'তে রাখবেন না। দিনলিপির অংশ হবে না এগুলো। কারণ 'দস্তম্বু' বই হয়ে বের হলে ওটা ব্রিটিশদের হাতে পড়তে পারে। তারা তাঁকে কত করতে পারে। কে জানে। তিনি কাগজটি ভাঁজ করে আলাদা রাখলেন। বন্ধুদের চিঠিতে শেরগুলো জুড়ে দিলে যারা লক্ষ্নৌ বা আগ্রায় বাস করছে তারা বুঝতে পারবে যে, দিলিস্নর আস্থা কেমন ছিল! গালিব দু'হাতে চোখের জল মোছেন। বাসগৃহ কারাগার হয়ে গেলে একজন মানুষের বেঁচে থাকা কতটা অর্থহীন হয়ে যায় এটা তারচেয়ে বেশি কে আর বুঝবে। তিনি চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে শূন্য ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
এক পেয়ালা সরবত নিয়ে ঘরে আসে বাকির।
নানা আপনার জন্য চা এনেছি।
বাহ্, বহুৎ আচ্ছা। আমার মনে হচ্ছে আমি মনে মনে সরবত খেতে চেয়েছিলাম।
সত্যি!
হ্যাঁ, সত্যি। তুমি এখন যাও বাকির।
আপনি কি করবেন?
আমি লিখবো।
আপনি কি লিখবেন?
আমি একটা দিনলিপি লিখছি।
আপনিতো সবসময় লিখেন নানা। আমার জন্য একটা গজল লিখবেন?
তোমার জন্য গজল? উ'হু, পারবো না। তোমার জন্য লেখা খুব কঠিন। আমি লিখতে পারবো না।
থাক, না পারলে লিখতে হবে না। আপনার দিনলিপির নাম কি নানা?
দস্তম্বু।
সস্তম্বু, দস্তম্বু! সুন্দর নাম। আচ্ছা আমি যাই।
দৌড়ে চলে যায় বাকির। এক ছোট বাচ্চা দস্তম্বু মানে কি বুঝলো কে জানে। ওর বোঝার বয়সইবা কি। গালিব চুমুকে চুমুকে সরবত শেষ করেন। ভাবেন, বিবির মেজাজ ভালো আছে। নইলে নাতিকে দিয়ে সরবত পাঠাতো না। যাক, ভালো। ভালো লাগে তাঁর। তিনি দস্তম্বুর পৃষ্ঠা খুলে বসেন। লিখতে শুরু করেন:
১৮ সেপ্টেম্বর
শুক্রবার জম্মার দিন। ২৬ মহরম। যেসব সেপাই বিপথগামী হয়েছিল, উন্মত্ত হয়ে এই শহরে প্রবেশ করেছিল, ঝড়ের মতো তান্ডবে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে ভরিয়ে দিয়েছিল শহর, তারা এখন পালাতে শুরু করেছে। যেদিন ইংরেজ সেনানায়ক পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে বিজয়ীর বেশে শহরের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেন সেদিনই শহর ও কেলস্না দখল করে নিলেন। হত্যা আর গ্রেফতারের খবর এই গলিতে এসে পেঁৗছালো। আতঙ্কে শীতল হয়ে গেল সকলের কলজে।
এটুকু লিখে তিনি আবার কাটলেন। কেটে পৃষ্ঠাটা টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। ভাবলেন, আবার নতুন করে লিখবেন। আসলে যা লিখতে চাইছেন তা হচ্ছে না। এই আতঙ্কিত শহর আমার বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। শরীরের চেয়ে আমার বুক অনেক বেশি আহত এবং যন্ত্রণাদগ্ধ। অনেক বেশি পীড়িত। কত বেশি যে পীড়িত তা আমি কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে পারবো না।
তিনি একটা কিছু লিখবেন তা ভাবার আগেই দুই নাতি এসে হাজির হয়।
নানা, আপনার লেখা শেষ হয়েছে?
নাতো? কেন?
আমরা চাই আপনি আমাদের সঙ্গে গলিতে মার্বেল খেলবেন।
আমার শৈশবে আমি ঘুড়ি উড়াতাম। মার্বেল খেলতাম।
এখন আবার খেলবেন। আপনি তো তেমন বুড়ো হননি নানা।
কে বলেছে বুড়ো হইনি? অনেক বুড়ো হয়েছি। আমি এখন বাদশার সভাকবি।
সভাকবি! দুই বাচ্চা পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর বলে আমরাই খেলবো। আপনার যেতে হবে না। আমরা তো গলিতে খেলতে পারি নানা?
না, না গলিতে খেলতে যেও না।
গলির মুখতো পাথর দিয়ে বন্ধ। কেউ খুলতে পারবে না।
ও হঁ্যা, তাইতো। গালিব অন্যমনস্ক হয়ে মাথা নাড়েন।
দুই ভাই দৌড়ে বেরিয়ে যায়।
তিনি তাঁর 'দস্তম্বু'র পৃষ্ঠায় লেখেন:
গলির বন্ধ দরজা
এই গলিতে দশ/বারোটি বাড়ি আছে। গালিটির মুখ একটিই। কানাগলি বলতে হবে। গলির বেশিরভাগ বাড়ির লোক চলে গেছে। নারীরা বাচ্চাদের বুকে আগলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তাদের হাতে দু'একটা পুটলিও ছিল। পুরুষরা যা বহন করা যায় তেমন জিনিসপত্রের গাটরি নিয়ে চলে গেছে। ওহ্, এমন দৃশ্য আমাকে দেখতে হয়েছে। কদিন ধরে এমন দৃশ্য দেখলাম। আমরা যারা রয়ে গেলাম তারা ঠিক করলাম গলির মুখটা বন্ধ করে দেবো। আমরা সবাই মিলে একটি পাথর দিয়ে গলির মুখ আটকে দিলাম। এই গলিতে কোনো কুয়ো নেই। তারপরও এমন করতে হয়েছে। গলিটির আগে একটি চোখ ছিল, এখন দুটোই গেছে। পুরোই অন্ধ হয়ে গেছে বিলিস্নসারোত্তয়ের এই গলি।
এটুকু লিখে তিনি কলমটা দোয়াতে ঢোকালেন। আরও কিছু লিখবেন বলে ভাবলেন। শহরের চিত্র ভেসে ওঠে। ১৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে শহরের বাড়ির দরজাগুলো বন্ধ। যে যেভাবে পেরেছে পালিয়ে গেছে। নইলে খুন হয়েছে। দোকানগুলো বন্ধ। গম-আটা ইত্যাদি কেনার জন্য দোকানদার নাই। কাপড় ধোয়ানোর জন্য ধোপা নাই। চুল কাটানোর জন্য নাপিত নাই। ময়লা সাফ করার জন্য মেথরও নাই। গলির লোকেরা পানির জন্য বাইরেও যেতে পারছে না। গলিটাকে পাথর দিয়ে বন্ধ করে যে অন্ধকার তৈরি হয়েছে, সে অন্ধকারে আমার হূদয়ও পূর্ণ হয়ে আছে।
তখন উমরাও জান ঢোকেন। খানিকটুকু উত্তেজিত।
এই অবস্থা আর কতদিন চলবে? যেটুকু দানাপানি মজুদ ছিল তা শেষ হয়ে এসেছে। আর দু'-একদিন চলতে পারে
গালিব নিস্পৃহ কণ্ঠে বলেন, আমার কি করার আছে?
বাইরে বের হয়েতো দেখতে পারেন। কিছু করা যায় কিনা তার চেষ্টাতো করতে পারেন।
বিবি বসো। আমাকে ভাবতে দাও।
পাতিয়ালার মহারাজা গলি রক্ষার জন্য যাদের দাঁড় করিয়েছেন, ওদের সঙ্গে কথা বলুন।
ঠিক আছে, আমি সেটাই করে দেখছি।
উমরাওজান ফোঁস করে বললেন, আশ্রিতদের সবাইকে ঠিকমতো খাবার দিতে পারছি না। একটু একটু করে ভাগ করে দিয়েও কুলাচ্ছে না। গত রাত থেকে তিন-চারজন না খেয়ে আছে। দু'চার গস্নাস পানি খেয়ে কাটাবে সে অবস্থাও নাই। আগেতো গলির লোকেরা পানি আনতে পারতো, আটাও পাওয়া যেতো।
জানি, বিবি এসব আমি জানি।
তাহলে এমন বসে আছেন কেন? কেন নড়াচড়া করছেন না?
যাচ্ছি, এখুনি যাচ্ছি।
গালিব চপ্পল পায়ে গলিতে নামেন। পাহারায় যে রক্ষী ছিল তাকে বললেন, আমি বাইরে যেতে চাই। ভীষণ জরুরি দরকার।
হুজুর, আপনার কি দরকার আমাকে বলবেন?
এই কিছু সওদা করা দরকার।
রক্ষী দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে, চকের বাজার পর্যন্ত যেতে পারবেন হুজুর।
সেটুকু যেতে পারলেই হবে।
বোধহয় হবে না হুজুর।
কেন?
হত্যা-খুনে বাজারও খুব গরম। আমি আপনাকে না যেতেই বলি হুজুর। রাস্তাও খুব খারাপ। নানা ধরনের বিপদ আছে রাস্তায়। যাবেন না হুজুর।
আচ্ছা থাক। নাইবা গেলাম। কিন্তু পানি ছাড়া তো চলছে না।
আমরা ঠিক করেছি পানি আনার জন্য দরজা খুলে দেবো। যার যার বাড়ি থেকে কোনো পুরুষ মানুষ গিয়ে পানি আনবে। এখনতো শহরে ভিস্তিওয়ালারা নেই যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানি দিয়ে আসবে।
যার ঘরে যেটুকু পানি মজুত ছিল তাই দিয়ে কদিন চললো। আর তো চলছে না।
হুজুর আপনি বাড়ি যান। আজাদ বা কালস্নু মিয়াকে মটকি বা খড়া নিয়ে পাঠিয়ে দিন।
তাই করছি।
গালিব খানিকটুকু আশ্বস্ত হয়ে ধীরেসুস্থে বাড়ি আসেন। দূর থেকেই দেখতে পান যে, উমরাও জান দুই নাতির হাত ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। উদ্গ ীব চোখের দৃস্টি। কাছে যেতেই বলেন, কিছু হলো?
পানির সুরাহা হয়েছে। ভৃত্যদের পাঠাও। রক্ষী দরজা খুলে দেবে।
মিঠা পানি পাওয়া যাবে তো?
সে তো আর আমি বলতে পারবো না।
উমরাও জান ঝংকার দিয়ে বলে, তাতো পারবেন না। পারবেন কি? পারবেন শুধু-
আহ থামো বিবি। দেখো নাতিরা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।
উমরাও জান মুখ ঘুরিয়ে নাতিদের হাত টেনে চলে যান। একটু পরে দু'জন কাজের ছেলে ঘড়া নিয়ে ছুটতে থাকে। গালিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আমাদেরকে যিনি প্রতিপালন করেন তিনি আমাদেরকে ভুলবেন না। ঈশ্বরের প্রতি সে কৃতজ্ঞ থাকে না শয়তান থাকে ভর করে।
পানি পাওয়ার সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত গালিব অস্থির হয়ে রইলেন। ঘরে-বারান্দায় পায়চারি করতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে দুই নাতি হাতে দুটো গস্নাস নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। দু'একবার শুধু বললো, পানির জন্য মরে যাচ্ছি। বুক ফেটে যাচ্ছে নানা।
সবুর করো তোমরা। সবুরে মেওয়া ফলে।
ওরা কাতর চোখে নানার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।
শেষ পর্যন্ত মটকিভরা পানি নিয়ে ফিরে এলো দু'জনে। আজাদ দরজার সামনে মটকি নামিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললো, হুজুর আমাদেরকে দূরে যেতে দেয়া হয়নি। মিঠা পানি পাইনি। নোনা পানি নিয়ে আমাদেরকে ফিরে আসতে হয়েছে।
শুকুর আলহামদুলিলস্নাহ। তবুতো পাওয়া গিয়েছে। তোমরা পানি পান করো বাচ্চারা।
দু'ভাই এক চুমুচ পানি পান করে মুখ কুঁচকায়।
নানা খেতে পারছি না।
উমরাওজান পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, একটু একটু করে খাও বাচ্চারা।
গালিব চারদিকে তাকিয়ে বলেন, আমাদের তৃষ্ণার আগুন এভাবেই নেভাতে হবে।
তিনি নিজেও একটু একটু করে এক গস্নাস পানি পান করলেন। তাঁর মনে হলো মাথার ওপর থেকে খররোদ সরে গেছে। চারদিকে ছায়া নেমেছে। আজ তিনি দেয়ালের ওপর একটি চড়ই পানি বসে থাকতে দেখেন। মাথার ভেতরে একটি শের তৈরি হয়-
'গোলাপের কলিগুলি পাপড়ি মেলেছে বিদায় জানাবার জন্য; হে বুলবুল, চলো এবার, চলে যাচ্ছে বসন্তের দিন।।
শেরটি এখুনি লিখতে বসলেন না। মাথায় রাখলেন। ভাবলেন, ঘুম পাচ্ছে। জাগরণে-স্বপ্নে শেরটি ধরে রাখার জন্যই শুয়ে পড়লেন। অল্পক্ষণে ঘুমিযে পড়লেন তিনি।
দু'দিন পরে বৃষ্টি নামলো। বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। আকাশ কালো করে চারদিক ঝাঁপানো বৃষ্টি। বাড়ির সবাই বৃষ্টির পানি ধরার জন্য মেতে উঠলো। উঠোনে একটি চাদর টানিয়ে তার নিচে ঘড়া-মটকি রেখে দেয়া হলো। টানা বৃষ্টিতে ভরে গেল পাত্রগুলো। পানি দেখে খুশি সবাই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন উমরাও জান। দোপাট্টা দিয়ে ভিজে যাওয়া মুখ মুছতে মুছতে বললেন, বেশ অনেকদিনের জন্য নিশ্চিত হওয়া গেলো।
গালিব মৃদু হেসে বললেন, বেশ অনেকদিন পরে তোমার হাসিমুখ দেখতে পেলাম বিবি।
উমরাও জান ভুরু কোঁচকালেন। মুখে কিছু বললেন না। মাথার ওপর থেকে দোপাট্টা সরিয়ে হাত খোঁপা করে রাখা চুল ছড়িয়ে দিলেন পিঠের ওপর। দীঘল কেশরাশির দিকে তাকিয়ে গালিব বললেন, আজাদের একদিন কৈশোর ছিল।
থাকবেইতো। আমরাতো জন্মেই বুড়িয়ে যাইনি। তারজন্য আপনার দুঃখ হচ্ছে?
হয়ইতো। সৌন্দর্য নষ্ট হলে মানুষের দুঃখ হওয়াই স্বাভাবিক।
বয়সেরও সৌন্দর্য আছে। মানুষের বয়স এক জায়গায় থেমে থাকলে আপনারা কবি হতে পারতেন না।
বাব্বা, বিবি তুমিতো বেশ কথা বলেছো।
যাই, পানি মজুত রাখার ব্যবস্থা করি। আপনি কি আর এক গস্নাস বৃষ্টির পানি খাবেন?
বৃষ্টির পানিতো খোদার মেহেরবানী। আমাকে আরও দু'চার গস্নাস পানি দিও দুপুরের খাবার সময়।
আচ্ছা দেবো। আপনি কি এখন আপনার কৈশোর নিয়ে কসীদা লিখবেন?
ভেবে দেখি। তারপর উমরাও জানের হাত টেনে ধরে বলেন:
'কোঈ দিন পর জিন্দগানী অওর হ্যায়
আপন দিল সে মেনে ঠানী অওর হ্যায়।
জীবন যদি আরও কিছুদিন থাকে
মনে মনে আমি ঠিক করেছি কিছু অন্যরকম।।'
উমরাও জান মৃদু হেসে বলেন, তা আমি জানি। আমাকে বিয়ে করে আপনি খুশি নন। আপনি সবসময় অন্যরকমই ভেবেছেন এতগুলো বছর।
গালিব একদৃষ্টে উমরাও জানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভেবেছিলেন বৃষ্টিস্নাাত বর্ষার সি্নগ্ধতার তাঁর বিবি জীবনের দুঃখ ধুয়ে ফেলবেন। দেখলেন উমরাও জানের জীবনে বৃষ্টি শুধুই খাওয়ার পানি।
উমরাও জান ভুরু কুঁচকে বলেন, দেখছেন কি? আপনি আমাকে কয়েকদিন পর পর বলেচেন, যখন আমার আব্বাজান মৃতু্যর গভীর নিন্দ্রায় চলে গেলেন, সেই সঙ্গে আমার ভাগ্যও নিদ্রায় ডুবে গেলো।
হঁ্যা, আমিতো আমার ভাগ্যের কথা বলেছি।
কিন্তু আব্বাজানের মৃতু্যর পরে আপনার চাচাজানের কোলে ঠাঁই পেয়েছিলেন। সেটাওতো ভাগ্যবানের লক্ষণ।
ঠিক বলেছো বিবি।
তাহলে স্বীকার করেন যে আপনার ভাগ্য নিদ্রায় তলিয়ে যায়নি।
গালিব এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। তারপর প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, আমার চাচাজান জেনারেল লর্ড লেক বাহাদুরের খুবই বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। তিনি চারশো ঘোড়সওয়ারের সর্দার ছিলেন। আগ্রার কাছে দুটি পরগনার মালিক হয়েছিলেন।
তারপরও আপনি কেন বলেন যে, আপনার ভাগ্য-
আহ বিবি, থামো থামো। তুমি তো জানো আমার চাচাজানের মৃতু্যর পরে ইংরেজ সরকার পরগনা দুটি ফিরিয়ে নিয়েছিল।
উমরাও জান এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বলেন, পরগনার বদলে আপনাকে এবং আপনার ভাইকে পেনশন মঞ্জুর করেছিল ইংরেজ সরকার।
হঁ্যা, তা করেছিল। আমরা বেশ আরামেই ছিলাম।
আমাদের বিয়ের পরে আমার আব্বাজান আপনাকে দিলিস্ন নিয়ে এসেছিলেন।
হঁ্যা, তা সত্যি। আপনি আসাদ নামে কবিতা লিখবেন না গালিব নামে লিখবেন তা আমার আব্বাজান ঠিক করে দিয়েছিলেন। এখন আপনি একজন বড় কবি। বাদশার সভাকবি।
বিবি, তুমি একজন বেশ আলেমদার মহিলা। তোমার অনেক বুদ্ধি।
এই বুদ্ধি দিয়ে এখন পানি মজুদ করার ব্যবস্থা করবো। নসীব আপনা আপনা। আপনার চেয়ে আমার নসিবই নিদ্রায় তলিয়ে গেছে। আমার চেয়ে এটা আর কে বেশি জানে।
গালিবকে আর কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উমরাও জান দ্রুতপায়ে ঘর ছাড়েন। গালিব বড় করে শ্বাস টানেন। উমরাও জান তাঁকে অনেক কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল।
তিনি 'দস্তম্বু'র খাতা খুলে লিখলেন, আমার পাঁচ বছর বয়সে পিতা আবদুলস্নাহ বেগ ইন্তেকাল করলেন। আমার নয় বছর বয়সে আমার চাচা নসরুলস্নাহ বেগ ইন্তেকাল করলেন। মৃতু্য আমার ভাগ্য অন্ধকারে নিয়ে গেলো। নইলে আমার আরও অন্যকিছু হতে পারতো। আমি জানি না তা কি।
সেদিন সন্ধেবেলা একুশবার তোপধ্বনি শুনতে পেল শহরের অধিবাসী। গালিব কান খাড়া করে শুনলেন। ভাবলেন কি হলো? একুশবার কেন? তিনি তো জানেন লেফটেনান্ট গভর্নর এলে সতেরো বার তোপধ্বনি হয়। গভর্নর জেনারেল এলে হয় ঊনিশবার। কি হয়েছে তার কোনো খবর পাওয়ার উপায় নেই। তবে কি ওরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আর একটি লড়াইয়ে জিতেছে? সেজন্যই হবে হয়তো। এখনো বিদ্রোহীরা কয়েক জায়গায় লড়াই করছে। বেরিলী, ফররুখাবাদ, লক্ষ্নৌ-জিততে পারবে না জেনেও লড়াই। মানুষ তো এমনই। সহজে পরাজয় স্বীকার করতে চায় না। আস্তে আস্তে সব যুদ্ধেই জিতবে ইংরেজরা। আস্তে আস্তে ওরা -তিনি থামলেন। ভাবলেন, এখনো অবরুদ্ধ এই শহর। আর কতদিন লাগবে তাদের মুক্ত হতে? সে রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারলেন না তিনি। উঠলেন, পানি খেলেন। শেষ রাতে ঘুম এলো। ঘুম যখন ভাঙলো তখন বেলা বেশ গড়িয়েছে।
বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে উমরাও জান ডাকাডাকি করছেন তাঁকে। তার পেছনে কালস্নু মিয়াসহ আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে বিবি?
সর্বনাশ হয়েছে। ইউসুফ ভাই সাহেবের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কালস্নু মিয়া তার খবর জানতে গিয়েছিল।
জ্বী হুজুর। আমি নিজে দেখে এসেছি। গলির আরও অন্য বাড়ির সঙ্গে তার বাড়িও লুট হয়েছে।
আমার ভাই কেমন আছে?
তিনি ভালো আছেন। তাঁর বুড়ো দারোয়ান আর বুড়িকে কিচ্ছু বলেনি লুটেরারা!
যাক, বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
গালিব হিসেব করে বললেন, ইংরেজরা শহর দখলের সতেরো দিন পরে এমন ঘটনা ঘটলো। যাক, আমরা ভাগ্যবান যে, আমার ভাইয়ের গায়ে ওরা হাত দেয়নি। কালস্নু মিয়া, ওই বাড়িতে দানাপানি আছে তো?
আছে হুজুর। বুড়ো দারোয়ান দু'জন হিন্দুকে আশ্রয় দিয়েছেন। ওই দু'জন থাকাতে খানিকটা সুবিধা হয়েছে। ওরা দানাপানি যোগাড়ের চেষ্টা করে। বুড়োর তেমন কষ্ট হয় না। বুড়ো বরং হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
যাক, এটা একটা সুখবর। কি বলো বিবি?
হঁ্যা, আমারও তাই মনে হয়।
গালিব পায়ে চপ্পল গলিয়ে খাট থেকে নামেন। বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলেন, বুকটা বেশ হালকা লাগছে। খুদা মেহেরবান।
বালতি থেকে পানি নিয়ে মুখে ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, লুটপাট করলো কে? সিপাহীরা বিদ্রোহ করলে শহরের ঘরবাড়ি লুটপাট হয়, ইংরেজরা বিজয়ী হলেও লুটপাট হয়। তাহলে লুটপাটের হোতা দিলিস্নবাসীরা। হাঃ! নিজেদের লোকই নিজেদের শত্রু। দুঃসময়ে তারা নিজেরা বন্ধুর আচরণ করে না। সে জন্যই চারদিকে এত জ্বালা-যন্ত্রণা। তিনি আবার ঘরে ফিরে আসেন। মুখ জুড়ে, হাতে, গলায় ফোঁটা ফোঁটা পানি লেগে থাকে। কপাল থেকে একটি সরু ধারা গালের ওপর গড়িয়ে আসে। তিনি হাত দিয়ে পানি মুছতে মুছতে বলেন, বেশ আরাম লাগছে। ভালোইতো আছি।
পরদিন দুপুরবেলা। আকাশে মেঘ আছে, তবে বৃষ্টি নেই। ভ্যাপসা গরম অস্বস্তিকর। গালিব নিজেই হাতপাখা নিয়ে নিজেকে বাতাস দিচ্ছেন। কিছু লিখবেন বলে ভাবছেন, অন্তত 'দস্তাবু'র পৃষ্ঠা ভরাবেন বলে চিন্তা করছেন। তখুনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে আসে আজাদ।
হুজুর। হুজুর।
হাঁফাচ্ছো কেন? কি হয়েছে?
কয়েকজন গোরা সৈন্য দেয়ালের ওপর উঠে পড়েছে। মনে হয় ওরা আমাদের বাড়ির দিকে আসছে।
গোরা সৈন্য গলিতে? গালিব উৎকণ্ঠিত হন। দ্রুতকণ্ঠে বলেন, এই গলি পাহারা দেয় মহারাজা নরেন্দ্র সিংয়ের রক্ষীরা। তারা কি করছে? তারা ওদেরকে বাধা দিতে পারচে না?
না, হুজুর পারেনি। অন্য বাড়িতেও ওরা ঢোকেনি। এতক্ষণে বোধহয় আমাদের দরজায় এসে পড়েছে। যাই দেখি।
গালিব কলম হাতে নিয়ে কাগজের ওপর মাথা নুইয়ে বসে রইলেন। বুকটা ভয়ে কাঁপছে। ওরা তো জানে যে, তিনি বাদশার সভাকবি। বাদশার কবিতা পরিমার্জনা করে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। তবে কি?
তখন দরজায় বুটের শব্দ হয়। অর্থাৎ ওরা পেঁৗছে গেছে। বাড়ির মালামাল কি লুট হয়ে যাবে? তিনি দ্রুত নানাকিছু ভাবলেন। তাঁর টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো একজন। বাকিরা দরজার কিংবা ঘরের অন্য জায়গায় দাঁড়ালো। কেউ কোনো জিনিসপত্রে হাত দিলো না। টেবিলের সামনে যে দাঁড়িয়েছিল সে ভদ্র ভাষাতেই বললো, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, কোথায়?
কর্নেল ব্রাউনের অফিসে।
আমি তো পালকি ছাড়া কোথাও যাই না। পালকির বেহারারা শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
কর্নেল ব্রাউনের অফিস আপনার গলি থেকে খুবই কাছে। হেঁটে যেতে কোনো অসুবিধা হবে না! আপনি উঠুন।
আমি কয়েকজনকে সঙ্গে নিতে চাই।
যাকে খুশি নিতে পারেন।
আমাকে পোশাক বদলাতে হবে।
আমরা বাইরে দাঁড়াচ্ছি। আপনি তাড়াতাড়ি পোশাক বদল করে আসুন।
গালিব বুঝলেন যে ওরা তাঁকে নিয়েই যাবে। তাঁকে যেতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝলেন যে, ওরা তার মর্যাদা রেখেছে। আদব-কায়দার সঙ্গে ব্যবহার করছে। তিনি কাপড় চেঞ্জ করার জন্য নিজের ঘরে যেতে যেতে উমরাও জানকে বললেন, বাচ্চাদের কাপড় বদলে দাও। ওরা আমার সঙ্গে যাবে। কালস্নু, আজাদ, হাফিজ, তৌফিক যাবে।
অল্প সময়ে তাঁরা বাইরে এলে দেখতে পান কয়েকজন প্রতিবেশি উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন জিজ্ঞেস করলেন, ওস্তাদ এঁরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে?
কর্নেল ব্রাউনের অফিসে।
তাঁর অফিস কাছেই। আমরা চিনি। দাঁড়িয়ে থাকা চারজন একসঙ্গে বললেন, আমরাও আপনার সঙ্গে যাব।
আমার সঙ্গে যাবেন?
বাহ, আমাদের তো দেখতে হবে যে, ওরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
গোরা সৈন্যরা তাগাদা দিলে সবাই মিলে হাঁটতে শুরু করে। প্রতিবেশি তৌফিক নেয়াজ বলেন, চাঁদনি চকেই সাহেবের অফিস। ব্যবসায়ী কুতুব-উদ দিনের বাড়ি সেটা।
আপনাদের শুকরিয়া জানাই যে, আপনারা আমার সঙ্গে যাচ্ছেন।
মাশ-হুদ, বয়সী ভদ্রলোক। চকে তার ব্যবসা আছে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ওস্তাদ আপনি আমাদের মাথার তাজ। আমরা বেঁচে থাকতে আপনাকে গোরা সৈন্যরা নিয়ে যাবে তা কি হয়? দরকার হলে দিলিস্ন শহরবাসী আপনার কাছে এসে দাঁড়াবে।
গালিব প্রতিবেশিদের আন্তরিকতায় খুবই মুগ্ধ হন। তাঁর বুকটা বড় হয়ে যায় এই ভেবে যে ওরা তাকে খুব ভালোবাসে। তাঁর নাতিরা লাফাতে লাফাতে হাঁটছে। কখনও দৌড় দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেন ওরা এতদিন বন্দি পাখি ছিল। আজ ছাড়া পেয়েছে। ডানা মেলতে পারছে। ওরা উড়ে গিয়ে ছুঁয়ে আসবে আসমানের নীল। কিন্তু চিন্তা বাচ্চাদের মধ্যে থেমে থাকে না। মনে হয় কয়জন প্রতিবেশির ভালোবাসাই সামান্য কথা নয়। তাঁর শত্রুরও শেষ নেই। তখন মনে মনে আওড়ালেন নিজের শের:
'আমি আছি গালিব, আর অবসাদের প্রত্যাশা আছে। দুনিয়ার লোকের ভালোবাসার রকম দেখে হূদয় পুড়ে গেছে।'
তাঁরা পেঁৗছে গেলেন চকে। যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে কর্নেল ব্রাউনের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রতিবেশিরাও তাঁর সঙ্গে ব্রাউনের কক্ষে ঢুকলেন। ব্রাউন ভাঙা ভাঙা উদর্ু এবং ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
আমি শুনেছি আপনি কবি। আপনার পুরো নামটা বলবেন কি?
মির্জা মহম্মদ আসাদুলস্নাহ খান গালিব। আমি গালিব নামে-
প্রতিবেশি নেওয়াজ খান আগ বাড়িয়ে বলেন, তিনি এই নামে কবিতা লিখে খ্যাত। সবাই তাঁকে চেনে।
আপনি?
আমি তাঁর প্রতিবেশী। ব্যবসা করি?
বহুৎ আচ্ছা। একটু জোরের সঙ্গেই বললেন ব্রাউন। গালিবের মনে হলো, মেকী কণ্ঠস্বরে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেলো। তারপরও ব্রাউন যথেষ্ট সৌজন্য দেখাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কেমন আছেন?
গালিব অনুচ্চ স্বরে বললেন, হঁ্যা, আমরা ভালো আছি। বিদ্রোহ দমন হয়েছে, এখন শান্তি হয়েছে।
আমিও তাই মনে করি। দেশে শান্তি হয়েছে।
ঠিক, ঠিক বলেছেন। এখন শহরের দোকানগুলো খুললে, ইয়ে মানে আটা-ময়দা কেনা গেলে আমাদের-
গালিব মীর আলিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শহরে আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। আমরা স্বস্তি পাচ্ছি। আপনাদেরকে বহুত শুকরিয়া সাহেব।
আপনাদের সঙ্গে কথা বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনাদের মুখে শান্তির কথা শুনে ভালো লাগলো্ আমরাতো শান্তি চাই। শান্তি ছাড়া জীবন ঠিকমতো চলে না।
হ্যাঁ, হঁ্যা তা সত্যি, তা সত্যি। আমি আপনাকে শান্তির শের শোনাতে পারি?
অবশ্যই পারেন, অবশ্যই পারেন। বলুন।
গালিব কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন। তারপর দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবৃত্তি করেন:
'আজাদহ্ রু হু অন্তর মেরা মসলক হ্যায় সলহ-এ-কুল।
হরগিজ কভি কিসীসে অদাবত নহী মুঝে।
উদার মনে শান্তি চাই সাবর সাথে
বন্ধুতা চাই, শত্রুতার কাজ নেই আমার ।।'
উপস্থিত সবাই প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ব্রাউন হ্যান্ডসেক করে বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। থ্যাঙ্কু মি. গালিব।
গালিব সবাইকে নিয়ে খুশি মনে বেরিয়ে এলেন। বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক বাঁচা গেলো। ভেবেছিলাম না জানি কি হয়।
নেওয়াজ খানও একই কথা বললেন, আমরাও ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি বাদশার সভাকবি, না জনি ওরা আপনাকে কি করে।
খুদা মেহেরবান। গালিব স্বস্তিতে নিশ্বাস ছাড়েন।
সবাই মিলে বাড়ির পথে এগোতে থাকে। এখন আর সঙ্গে গোরা সৈন্যরা নেই। প্রতিবেশিদের একজন নিচুস্বরে বলে, ব্রিটিশরা লোকজনকে হত্যা করে, তাড়িয়ে দিয়ে খুনের দরিয়া বইয়ে দিয়েছে।
আহ থামুন।
আমার জীবনে আমি শহরে খুনের দরিয়া বইতে দেখিনি।
আহ থামুন। আপনার কথা শুনলে বাচ্চারা ভয় পাবে। আগে বাড়ি চলুন। কাশিম গলিতে ঢোকার পরে বিলিমরাওঁ পেঁৗছালে বুঝবো যে বাড়িতে এসেছি। তার আগে পর্যন্ত নয়।
গালিবের ক্ষুব্ধ কণ্ঠ বাতাসে ভেসে যায়। কেউ আর কথা বলে না।
কয়েক কদম এগোনার পরেই চাদনি চকের দিকে যেতে হৈ-হলস্না ভেসে আসে। গালিব দলবল নিয়ে মসজিদ চকের কাছে দাঁড়ান। একজন প্রতিবেশি তার হাত টেনে ধরে বলে, দাঁড়াবেন না। বাড়ি চলুন। নিশ্চয় কোথাও কেউ খুন হয়েছে। আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।
গালিবের মনে হয় পায়ের পাতা ভারি হয়ে গেছে। পা টেনে ওঠানো যাচ্ছে না। কালস্নু এসে হাত ধরে, হুজুর আমার ঘাড়ে হাত দেন।
গালিব ওর ঘাড়ে হাত রেখে দম নেন। ওর ঘাড়ে ভর দিয়ে খানিকটুকু হেঁটে আসেন। চাঁদনি চক এলাকা ছাড়ার কয়েক কদম পরেই সবাই দেখতে পান যে, একজন ছুটতে ছুটতে আসছেন। গালিবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রবলভাবে দম ফেলে বলে, আদাব মির্জা সাহেব। আপনার জন্য একটি দুঃসংবাদ এনেছি।
দুঃসংবাদ! কি হয়েছে?
সাবই ওকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। লোকটি ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, মীর সাহেব খবরটা আপনাকে জানাতে বলেছেন।
কি হয়েছে বলুন? গালিবের কণ্ঠে উদ্বেগ।
আজ খুব ভোরে কাশ্মিরী গেটের কাছে নওয়াব শামসুদ্দীনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।
ইন্নালিলস্নাহ-
গালিব এটুকু বলতেই লোকটি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে, খোদার দোহাই লাগে আপনি
বাড়ি যান। ঘর থেকে বের হবেন না। চারদিকে মৃতু্য আর মৃতু্য। যাই। খোদা হাফেজ।
লোকটি দৌড়ে চলে যায়। গালিব উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকান। স্খলিত কণ্ঠে বলেন, মৃতু্য, মৃতু্যর মুশায়রা চলছে শহরজুড়ে। কানপাত, কান পাত সবাই। শোন মুশায়রার বিলাপ।
কালস্নু অনুভব করে তার হুজুর তাঁর শরীরের ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি খুব ধীরে ধীরে পা ফেলে বাড়ির দিকে এগুচ্ছেন। পেছনে বাকিরা। শুধু বাচ্চ্চাদুটো দৌড়ে চলে যাচ্ছে আগে আগে। গালিব চারদিকে তাকান। দেখতে পান শহরের হতশ্রী অবস্থা। প্রায় জনমানব শূন্য এলাকা। কাশ্মিরি গেট থেকে চাঁদনি চকের মাঝের এলাকাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। যাকে পেয়েছে তাকেই খুন করেছে তারা। বুকের ভেতরে বিলাপের ধ্বনি ওঠে। তিনি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করেন। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, এখন আমি নিজেই হেঁটে যেতে পারবো। তোমার সাহায্য আর দরকার হবে না কালস্নু মিয়া।
ওর হাত ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রতিবেশিদের দিকে তাকান। বলেন, ব্রাউন আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন, না?
হঁ্যা, তা করেছেন। তবে ওদেরকে বিশ্বাস নেই।
কেনইবা আনপাকে ওর অফিসে ডেকে নিয়ে গেলো তা বুঝতে পারলাম না।
তাইতো, তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেনি ওস্তাদকে।
গালিব মাথা নেড়ে বলেন, ঠিক বলেছেন আপনারা। তবে আমি ওদের পেনশন খাই সেজন্যও ডাকতে পারে।
হতে পারে।
বিদ্রোহের সময় থেকে পেনশন পাওয়া বন্ধ হয়ে আছে। সেটা আবার কবে পাবো কে জানে।
সবাই মিলে বিলিস্নসারাঁওতে পেঁৗছ যায়। তখন সূর্য মধ্যগগন ছেড়ে খানিকটুকু পশ্চিমে সরেছে। তিনি দেখতে পান উমরাও জান তার জন্য এক গস্নাস পানি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নারীর মতো মনে হচ্ছে, যে নারীকে কখনো দেখা হয়নি, অথচ এমন একজন অপেক্ষমান নারীর তৃষ্ণা আছে বুকের মধ্যে তিনি ঘরে ঢুকে উমরাও জানের হাত থেকে পানির গস্নাসটা গ্রহণ করেন। চুমুক দিয়ে বলেন, শুকরিয়া বিবি।
আপনি এখন কি করবেন?
গোসলের পানি দিতে বলো।
আপনি কি খুব ক্লান্ত?
হঁ্যা, খুব ক্লান্ত।
আপনাকে কেমন জানি লাগছে?
কেমন?
মনে হচ্ছে এই শহরে আপনি বুঝি নতুন এসেছেন। শহরটা আপনি চেনেন না।
ঠিকই বলেছো বিবি। শহরটা আমি চিনতে পারছি না। এত নষ্ট এত রক্ত মৃতু্য, মৃতু্য বিবি মৃতু্যর মুশায়রা চলছে।
কি বলছেন মৃতু্যর মুসায়রা? পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমি পানি দিতে বলছি। আপনি গোসল করুন। মাতা ঠান্ডা হবে।
উমরাও জান চলে গেলেও গালিব দাঁড়িয়ে থাকেন। মনে হয় যে মহিলা তাঁর সামনে থেকে চলে গেলেন তাঁকে তিনি চেনেন না। কোনোদিন দেখেননি। আশ্চর্য, কতকাল হলো যে তিনি এই বাড়িতে আছেন? হাজার বছর? নকি তারও বেশি? দিলিস্ন শহর কবে গড়ে উঠেছিল? কীভাবে? যমুনা নদীর গর্ভ থেকে কি দিলিস্নর জন্ম হয়েছিল? আহ্। যমুনা নদী! যমুনা নদীর পাড়ে তাঁর জন্ম, শৈশব কেটেছে সেখানে, কত ঘুড়ি উড়িয়েছেন। নদী, শৈশব-ভাবনা, আকাশজুড়ে ঘুড়ি এবং ঘুড়ির সুতো তাঁর মন ভালো করে দেয়। তিনি স্বস্তিবোধ করেন।
কালস্নু মিয়া এসে দাঁড়ায়।
হুজুর, গোসলের পানি দিয়েছি।
ওই নোনা পানি?
এছাড়া আর তো পানি নেই হুজুর। অনেক খুঁজে একটু খাবার পানি জোগাড় করতে পেরেছি আমরা তিনজনে মিলে।
গালিব চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কালস্নু মিয়ার চলে যাওয়া দেখেন। কিন্তু খানিকটুকু যেতেই তিনি ওকে ডাকেন। কালস্নু মিয়া কাছে এসে দাঁড়ালে বলেন, আমরা কতকাল এই বাড়িতে আছি কালস্নু মিয়া?
কতকাল? ও আঙ্গুলে গুনে সময় হিসেব করতে থাকে। তারপর মাথা চুলকে বলে, আমি মনে করতে পারছি না হুজুর।
গালিব ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, বোধহয় এক হাজার বছরের বেশি হয়ে গেছে।
কালস্নুর চোখ কপালে ওঠে। চোখ বন্ধ করে বলে, এক হাজার বছর!
হঁ্যা, শোন কালস্নু, তুমি কি ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়াতে?
না, হুজুর। আমি কখনো ঘুড়ি উড়াইনি। মার্বেলও খেলিনি। কারণ ওগুলো কেনার টাকা আমাদের ছিলো না। বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে লাভ হতো না।
তাহলে তোমরা-
আমরা হুজুর লুকোচুরি খেলতাম। দৌড়াদৌড়ি করতাম। পুকুরে সাঁতার কাটতাম। পাখির ডিম খুঁজতাম। গরিব মানুষের যেটুকু খেলাধুলা বরাদ্দ ছিল আমরা তাই খেলতাম।
আফসোস! মানুষের যদি শৈশবে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন না থাকে তাহলে মানুষের অনেক কিছু হারিয়ে যায়। মানুষ সেসব জিনিস খুঁজতে থাকে জীবনভর। কিন্তু বুঝতে পারে না যে সে কি খুঁজছে।
ঠিক হুজুর। আমার মাঝে মাঝে এমনই লাগে। তখন আমি কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যাই। ঘুমে খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখি।
কি স্বপ্ন দেখো কালস্নু মিয়া?
এইতো দু'দিন আগে দেখেছি, আমি খুব ছোট। বাবা-মায়ের সঙ্গে যমুনা নদীতে বড় একটা বজরায় চড়ে কোথাও যাচ্ছি। খুব সুন্দর বজরা। আমার নিজেকে বাদশার মতো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি হাওয়ায় ভেসে যেতে পারি।
বাহ্! কালস্নু মিয়া বাহ! তোমার স্বপ্নে তুমি তোমার শৈশব ফিরে পাও। খুদাতালা মানুষকে এভাবে তার হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেন।
কালস্নু মিয়া গদগদ স্বরে কিছু একটা বলে গালিব তা বুঝতে পারেন না। বুঝতে চানও না। বুকের ভেতর যমুনা নদী বইতে শুরু করেছে। তিনি দ্রুত হেঁটে পানির কাছে আসেন। পানিতে মাথা ভেজান। তারপর পুরো শরীর। যেন তাঁর শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যমুনা, গড়াচ্ছে যমুনার জল, আর তিনি এক আশ্চর্য বালক- জল এবং নদীর অনুভব নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন।
পরদিন তাঁর ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই মির্জা ইউসুফের দারোয়ান তাঁর ভাইয়ের মৃতু্যর খবর নিয়ে এলো। তাঁর ঘরের মেঝেতে বসে লোকটি কিছুক্ষণ কাঁদলো। তাঁর বয়সী শরীর অনেকক্ষণ ধরে আন্দোলিত হলো। তিনি ওকে দেখে নিজেকে সামলাচ্ছিলেন। তাঁর চেয়ে মাত্র দু'বছরের ছোট ইউসুফ। কত স্মৃতি আছে ওকে নিয়ে। তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। কেঁদেকেটে স্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছিল ইউসুফের?
পাঁচ দিন ধরে জ্বরে বেহুস ছিল। তারপর মাঝরাতে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। এই পাঁচ দিনে আমি আপনাকে খবর দিতে আসতে পারিনি। কেমন করে আসবো? তাঁকে ছেড়ে তো কোথাও যাইনি। পানি আনতেও না। একফোঁটা ওষুধও দিতে পারিনি।
বুড়ো দারোয়ান আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, এখন আমরা কি করবো? পানি, রুমাল, মুর্দা ফরাস, কবর খোঁড়ার লোক, ইট, চুন কোথায় থেকে পাবো কে জানে। পালকির ব্যবস্থা নেই। আমিইবা তার বাড়িতে কি করে যাবো? কোন কবরস্থানে নিয়ে যাবো যেখানে লোক পাওয়া যাবে? বাজার বন্ধ। ভালো বা খারাপ যাই হোক না কেন কাফনের কাপড়ইতো পাওয়া যাবে না। কবর খোঁড়ার জন্য লোকইবা কোথায়? হিন্দু হলে নদীর ধারে নিয়ে দাহ করা যেতো। তাছাড়া শহরের যা অবস্থা, দু'তিনজন মুসলমানকে একসঙ্গে হাঁটতে দেয়া হয় না। মুর্দার কফিন নিয়েই কি যেতে দেয়া হবে? একমাত্র উপায় শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া।
আজাদ এসে বুড়াকে নাস্তা খাওয়াতে ডেকে নিয়ে যায়। কবির ভাইয়ের মৃতু্য হয়েছে শুনে একে-দুয়ে প্রতিবেশিরা আসতে থাকে। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন গালিব। চোখের পানিতে ভেসে যায় গাল, দাড়ি। একজন বলে, আপনার দু:খে আমরাও কাতর। এখনতো একটা কিছু আপনাকেই করতে হবে। আর তো কেউ নাই।
গালিব চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ওর বউ, মেয়েরা ওকে রেখে শহরের বাইরে চলে গেছে।
সবই নসীব। নসীবের উপর কারো হাত নেই।
আমরা ঠিক করেছি আপনার সাহায্যে কিছু করবো।
গালিব গলা পরিষ্কার করে বলেন, কি করা যায়।
পাচিয়ালার সেপাইরাতো গলিতে রয়েছে। মহারাজাকে বলে ওদের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
হঁ্যা, সেটা হতে পারে।
গালিব মাথা নাড়েন। দীর্ঘশ্বাস ফেলন।
তাহলে আমরা কথা বলার জন্য তার কাছে যাই?
যান। অপেক্ষা করা চলবে না। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
প্রতিবেশিরা চলে গেলে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে আসেন উমরাও জান। বলেন, ইউসুফ ভাইয়ের বিশ বাচ্চাদেরকে কি খবর দেয়া হবে?
ওরা কোথায় আছে আমি তো জানি না।
দারোয়ান জানতে পারে।
উমরাও জান দ্বিধার সঙ্গে বলেন। গালিব চুপ করে থেকে বলেন, দারোয়ানকে এখন পাঠানো ঠিক হবে না। আগে দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে।
কাফনের কাপড়- উমরাও জান কথা শেষ করেন না।
কাফনের কাপড় কেনার জন্য দোকান খোলা নাই। তোমার ঘরের পরিষ্কার দু'তিনটি বিছানার চাদর বের করো।
বিছানার চাদর দিয়ে-
উমরাও জান ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
গালিব মাথা নিচু করে চোখের পানি মোছেন। উমরাও জান ঘর থেকে বেরিয়ে জান। নিজের ঘরের সিন্দুক থেকে দুই-তিনটি চাদর বের করেন।
প্রতিবেশিরা সিপাইদের নিয়ে ফিরে আসে। গালিব তৈরি হয়ে নেন। বাড়ির কাজের লোকেরাও সঙ্গে যায়। ওদের হাতে দাফনের কাপড় বিছানার চাদর। কোথাও আতর-লোবান নাই। সিপাইদের সামনে রেখে তারা কয়েকজন মানুষ হেঁটে ইউসুফ মির্জার বাড়িতে আসেন। মুর্দাকে গোসল করানো হয়। চাদর জড়িয়ে বাড়ির কাছের মসজিদে নিয়ে এসে সেখানে কবর দেয়া হয়। অবসন্ন গালিব ফিরে আসেন বাড়িতে। মনে হয় কান্নার শক্তিও ফুরিয়ে গেছে।
উমরাও জান একগস্নাস লেবুর শরবত নিয়ে আসেন। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকান। গস্নাস হাতে নেন না।
যান শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা লাগবে।
তিনি মাথা নেড়ে বলেন, শরবত খাবো না। গোসল করবো।
গোসল! উমরাও জান বিব্রত বোধ করেন। গালিব বুঝতে পারেন যে, বোধহয় পানি নেই।
গোসল করব শুনে অবাক হয়েছ বিবি। বুঝতে পারছি যে বোধহয় পানি নেই। আমার সৌভাগ্য যে, আমি আমার ভাইকে শেষ গোসল দিতে পেরেছি। ওই বাড়িতে একজন মুর্দার গোসলের পানি ছিল।
কাঁদতে আরম্ভ করেন তিনি। গস্নাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন উমরাও জান। কি বলবেন বুঝতে পারেন না। নিজের চোখ থেকেও পানি গড়ায়। চোখের জল মুছে গালিব নিজের শের বলতে থাকেন জোরে জোরে:
'তুম কৌনসে যে অ্যায়সে ঘরে ছাদ ব সিতদ কে
করতা মুলক অলমওত তকাজা কোঈ দিন অওর।
এত তাড়া ছিল মৃতু্যর?
না হয় যেতে কিছুদিন পরে আরও।'
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। উমরাও জানকে বলেন, বিবি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও। কেউ যেন না আসে।
উমরাও জান টেবিলের ওপর শরবতের গস্নাস রেখে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যান। শুনতে পান খাঁচায় আটকে রাখা তোতা পাখিটা ঠোঁট দিয়ে ঠুকঠুক শব্দ করছে। ওটার জন্যও দানাপানি ঠিকমতো জোটে না। তিনি খাঁচাটার সামনে এসে দাঁড়ান। আঙুল ঢুকিয়ে ডানার পালকে মৃদু পরশ দেন। তোতা বিরক্ত হয়। আঙুলে ঠোকর দেয়ার চেষ্টা করে। তিনি আঙুল বের করে নেন। আবার ঢোকান। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে খেলা করতে করতে তাঁর মনে পড়ে তাঁর স্বামীর একটি কৌতুকের কথা। তখন তাঁরা বলিস্নসঁরাওতে আসেননি। লালকুয়ার কালে সাহেবের বাড়িতে থাকতেন। সেবার খুব শীত পড়েছিল। তোতা পাখিটি ঠান্ডা সইতে পারতো না। বেশির ভাগ সময় ঘড়ে কাত করে নিজের পালকে ঠোঁট গুঁজে রাখতো। যেন নিজের পালক থেকে ঠোঁট গরম ছড়িয়ে দিতে চাইত। উমরাও জানের মনে হতো পাখিও নিজের শরীরকে উষ্ণ রাখার কৌশল বের করে। সব প্রাণীরই নিজস্ব কৌশল আছে। তিনি একদিন স্বামীকে বলেছিলেন, দেখেন আমাদের তোতা পাখির কাণ্ড। শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেমন ঠোঁট গুঁজে বসে আছে।
গালিব হাসতে হাসতে পাখির খাঁচা নাড়া দিয়ে বলেন, ওহ মিয়া তোমারতো বউ-বাচ্চা নাই। তাহলে এমন ঘাড় গুঁজে বসে আছ কেন? তোমার কিসের এত চিন্তা?
উমরাও জান হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি মুখ ফিরিয়ে বলেছিলেন, হাঁ করে দেখছো কি বিবি?
আপনিতো তোতাকে নিয়ে নয়, আমাকে নিয়ে কৌতুক করলেন। আপনি আমাকে নিয়ে এমন শক্ত কৌতুক করতে পছন্দ করেন।
আমিতো এমনই। তুমিতো আমাকে অনেককাল ধরে চেনো বিবি।
উমরাও জান গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, হঁ্যা চিনি। মনে আছে একবার আপনি আমাকে ভূত বলেছিলেন।
গালিব চোখ কপালে তুলে বলেন, বলেছিলাম নাকি? মনে করতে পারছি না তো।
মনে করিয়ে দেবো?
দাও। গালিব ঘাড় নেড়ে বলেন।
আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি আমাকে থামিয়ে দেবেন না কিন্তু।
তুমি আমার ওপর নোটিস জারি করছো বিবি।
আপনিতো আমার সঙ্গে এমন ব্যবহারই করেন। সেজন্য বলছি।
ঠিক আছে, তোমার কথা বলো। আমি কিচ্ছু বলবো না। মনে আছে, একবার আপনি বাড়ি বদল করার জন্য বাড়ি দেখছিলেন।
গালিব কথা না বলে মাথা ঝাঁকান।
উমরাও জান বলতে থাকেন, আপনি আগে নিজে একটি বাড়ি দেখে আসেন। বৈঠকখানাটি আপনার পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়ির ভেতরের ঘর আপনাকে দেখতে দেয়া হয়নি। তাই আপনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। মনে আছে?
গালিব মুখ বুঁজে ঘাড় নাড়েন।
আমি বাড়ি দেখতে গেলাম। লোকে আমাকে নানা কথা বললো। আমি পছন্দ-অপছন্দ কোনটাই করতে পারলাম না। আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পছন্দ হয়েছে বিবি? আমি বলেছিলাম, লোকে বলছে ওই বাড়িতে নাকি ভূত থাকে। আপনি কি বলেছিলেন মনে আছে?
গালিব চুপ করে থাকেন। হাঁ বা না-সূচক ঘাড়ও নাড়ান না।
উমরাও জান গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, আপনি বলেছিলেন দুনিয়াতে তোমার চেয়েও বড় ভূত আছে নাকি? মনে আছে?
গালিব এবারও চুপ করে থাকেন।
উমরাও জান ঝাঁঝালো গলায় বলেন, আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনি এবার আপনার কথা বলতে পারেন।
এতক্ষণ জোর করে নিজের দম আটকে রাখা গালিব আচমকা হাসিতে ভেঙে পড়েন। নিজের লেখা কথা আউড়ে বলেন, লোকে প্রেমের ব্যাপারে ভয় পায়। কিন্তু আমিতো জানি খাওয়া-পারার খোঁজ করার চেয়ে বড় বিপদ আর কিছু নাই। একইভাবে বলতে হয় যে, মহাজনের তাগাদার চেয়েও বড় চিন্তা আর কিছু না।
উমরাও জানের চোখে পানি আসে। মানুষটা পেনশন উড়িয়ে দিয়ে দিন চালালো। মনের সুখে মদ খেলো। আর দেনা করে মদ খেয়ে কতআ লিখলো। হায় কবি, মহাজনের চিন্তায় অস্থির।
এখন এই দুর্যোগের সময় একমাত্র ভাইটি মরে গেলো। কে থাকলো আর। নিজের সাতটি সন্তানের জন্ম হলো। একটিও বাঁচলো না। উমরাও জানের চোখ দিয়ে পানি গড়ালো। দাপাট্টা দিয়ে পানি মুছে গালিবের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সামান্য ফাঁক করে তাকিয়ে দেখলেন মানুষটি নিঃসাড় ঘুমাচ্ছে।
দিন গেলো, রাত গেলো।
গালিবের ঘুম ভাঙলো পরদিন সকালে।
মনে হলো চারদিকে নতুন দিন। নতুন সূর্য।
দুপুরের খাবার খেয়ে লিখতে বসলেন। ইউসুফ ছাড়া কার কথাই বা এখন তার মনে আছে। লিখেন-খুবই আপশোসের কথা যে, ষাট বছরের মধ্যে মাত্র ত্রিশ বছর ও মানসিকভাবে সুস্থ ছিল। শৈশব থেকে ত্রিশ বছর। দুনিয়াটা চিনে বড় হতে হতেই ও আবার চেনা দুনিয়াটাকে ভুলে গেলো। কবরে ওর জন্য কোনো বালিস নাই। ওখানে ও মাটি ছাড়া আর কিছুই পায়নি। মাটিইতো সবার জন্য শেষ বিছানা। খুদাতালা ওকে যেন দয়া করেন। জীবিত অবস্থায় ওর অনেক কষ্ট ছিল। আরাম কি তা জানতো না। আহ, এখন যেন কোনো ফেরেশতা ওকে বেহেশতে নিয়ে যায়। ওর জন্য আর কোনো প্রার্থনার ভাষা আমি জানি না।
এটুকু লিখে কলমটা দোয়াতে চুবিয়ে রাখলেন। ভাবলেন, আর কি লিখবেন? মাথায় তো কিছু আসছে না? তারপর কলমটা নিয়ে আবার কাগজের টুকরোয় লিখলেন, ১৯ অক্টোবর। অনেকক্ষণ ধরে তারিখটা লিখলেন আর কাটলেন। কালো কালিতে কাগজের পৃষ্ঠা ভরে গেলো। বড় বড় করে লিখলেন- এই দিনটিকে সপ্তাহের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়া উচিত। ওহ্, এই সপ্তাহে একটি দিন না থাকলে কি এসে যায়। কার কি ক্ষতি হয়। পুরো মাস থেকে একটি দিন বাদ গেলে হিসেবে কি খুব গরমিল হয়ে যাবে? তিনি কলমটা রেখে দিয়ে দোয়াতের মুখ বন্ধ করলেন। তারপর মৃদু হেসে নিজেকে বললেন, এত কাটাকুটির পরেও ওই তারিখটি কালো কালিতে তাঁর স্মৃতির খাতায় লেখা থাকবে। তার আগে তার ছোট ভাইটির চলে যাওয়া তো নিষ্ঠুর সত্য। তিনি চেয়ারের উপর পা উঠিয়ে মাথা হেলিয়ে দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন। বুকের ভেতর কেমন একটা ধুকপুক ধ্বনি হচ্ছে। বেশ লাগছে সেই শব্দ উপভোগ করতে। কতক্ষণ যে একইভাবে বসে থাকেন নিজেও জানেন না। নিজেই বলেন, তোমার হূদয়কে যদি দূরে রাখো তাহলে লোভ করো কেন? তোমার হূদয়কে যদি হারিয়ে ফেলো তাহলে বেদনার অনুভব থাকবে কেন? তোমার হূদয় যদি তোমার সঙ্গে না থাকে তাহলে শুধু জিহবা দিয়ে বিলাপ করার দরকার কি? গালিব তুমি তোমার শরীরের সবটুকু সন্ধান করো। দেখো সব জায়গা ঠিক আছে কিনা। গালিব হূদয়কে কঠিন করতে নেই। কঠিন হূদয় মানুষকে কষ্ট দেয়। যে বুকভরে কাঁদতে পারে সে হূদয়ই প্রকৃত হূদয়। তার অনুভবে প্রেম থাকে, দরদ থাকে। তার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। তিনি সে পানি মুছতে চান না। ভিজে যাক মুখের সবটুকু। তাহলে যমুনা নদীর অনুভব তার শরীরে কম্পন তুলবে। তিনি নিজের লেখা শের নিজেকেই শোনান:
'নেশা করে সুখ পেতে চায় কোন মুখপোড়া,
আমি চাই কেবল রাতদিন নিজেকে একটুখানি ভুলে থাকতে।'
পিপাসা, বুকের ভেতর সহস ধারার পিপাসা। কতদিন তিনি সুরা পান করেননি। আহ্, বুকের চৌচির প্রান্তর সুরার বৃষ্টি চায়। সুরা, সুরা। কতবারতো প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে দেনা করে মদ পান করবেন না। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখতে পারলেন কই? প্রতিজ্ঞা রক্ষা খুবই কঠিন। আবারও নিজেকে শোনালেন নিজের শের:
'মদ স্পর্শ করবে না বলে শপথ করেছো, গালিব;
তোমার শপথের উপর কিন্তু একটুও ভরসা করা যায় না।'
সোজা হয়ে বসে দু'হাতে চোখের পানি মোছেন। ভিজে যাওয়া দাড়িতে হাত বোলান। তারপরে উঠে পায়চারি করেন। ফিরে এসে আবার টেবিলে বসেন। তুফতার কথা মনে হয়। গদরের পরে তুফতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ওকে একটি চিঠি লেখা দরকার। গদরের পরে তুফতা শহর ছেড়ে চলে গেছে। তিনি কাগজ টেনে নিলেন। দোয়াতের ছিপি খুলে কলমটা ডোবালেন কালো কালিতে। ভাবলেন চিঠির সম্বোধন, ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা পরে করবেন, আগে শহরের অবস্থাটা লিখে ফেলা দরকার। শুরু করলেন এভাবে, আমি তোমাকে একটি শব্দও বাড়িয়ে লিখছি না দোস্ত-জেনে রাখো যে শহরের ধনী-গরিব নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছে। অভিজাত পরিবারের সঙ্গে তাদের অনুগ্রহে বেঁচে থাকা মানুষেরাসহ দোকানি-কারিগর এমন কেউই বাদ নেই। তোমাকে কতটা লিখব বুঝতে পারছি না। কারণ খুঁটিনাটি সব লিখতে ভয় পাচ্ছি। লালকেলস্নার কর্মাচারীদের অবস্থা খুব খারাপ। তাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ওরা সারাক্ষণ কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে আছে। অনেককে কারাবাসে পাঠানো হয়েছে। তুফতা, তুমিতো জানো আমি এক গরিব কবি। গত দশ-বারো বছর ধরে দরবারে 'তারিখি' লেখা ও বাদশার কবিতার পরিমার্জনা করা ছিল আমার কাজ। তুমি এ কাজকে দু'ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারো। বলা যায় এটা দরবারি কাজ, আর নয়তো বলা যায় এটা দিনমজুরের পেনসন। তুমি যেভাবে বুঝতে চাও বুঝে নিতে পারো। তুমি ভালো করেই জানো যে সিপাহীদের বিদ্রোহে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না। আমি আমার কাজকে কবিতার মধ্যেই আটকে রেখেছিলাম। অন্য কোনো কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিনি। আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে আমি নির্দোষ। তাই আমি শহর ছেড়ে পালাইনি। বলো বন্ধু, আমার শহর থেকে বিনাদোষে আমি পালাবো কেন? ব্রিটিশ শাসকরা দরবারের কাগজে কিংবা নিজেদের গুপ্তচরদের কাছে আমার বিরুদ্ধে কিছুই পায়নি। পেলে আমাকে হেস্তনেস্ত করে ছাড়তো। জিজ্ঞাসাবাদ করে নাজেহাল করতো। আমি তো জানি ওরা শহরের অনেক সম্মানিত ব্যক্তিদের ছাড়েনি। আমিতো ওদের কাছে কেউকেটা কেউ না। বেশিরভাগ সময় আমি বাড়িতেই থাকি। বাইরে কমই বের হই। তাছাড়া আমার কাছে দেখা করতে কে আসবে? শহরে আছেইবা কে? কতদিন তোমাদের মতো বন্ধুদের মুখ দেখি না। যারা লুকিয়ে ছাপিয়ে আছে তারা রাস্তায় বের হতে ভয় পায়। ঘরের পরে ঘর মানুষহীন। একটুও বিস্মিত হবে না একথা জেনে যে প্রতিদিন অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে মৃতু্য ঘটেছে। এই শহরে মৃতু্য এখন রুটি আর আচার খাওয়ার মতো সাধারণ ঘটনা। ১১ মে সামরিক শাসন চালু হয়েছিল, এখন পর্যন্ত তা বহাল আছে। কতদিন এই অবস্থা চলবে কেউ জানে না। কি হয় তা দেখার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। ব্যবস্থাটা এমন যে পারমিট ছাড়া কেউ শহরে আসতে বা বের হতে পারছে না। তুমি শহর ছেড়ে বাইরে চলে গেছো, ভালোই করেছো। কোনো অবস্থাতেই ফিরে আসার কথা ভেবো না। মুসলমানদের শহরে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হয় কি না তা দেখার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
এটুকু লিখে তাঁর আর লিখতে ইচ্ছে হলো না। কাগজটা একটা ছোট পাথরের টুকরো দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলেন। উঠে পায়চারি করলেন। কালস্নু মিয়া কয়েকটা আখরোট নিয়ে এলো। তিনি খুশি হয়ে পিরিচটা হাতে নিয়ে শতরঞ্জির ওপর বসলেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে দিলেন।
হুজুর। কালস্নু মিয়ার বিনীত কণ্ঠ। কি বলবে, বলো।
তিনি মনোযোগ দিয়ে আখরোট খাচ্ছেন। বেশ লাগছে ফলটা চিবুতে। বেশ অনেকদিন পরে বাড়িতে আখরোট এসেছে। কোথা থেকে জোগাড় হয়েছে তিনি তা জানতে চাইলেন না। ভাবলেন, জিজ্ঞেস করে লাভ কি, ফল জুটেছে এটাই বড় কথা। বেশি কিছু জানার দরকার নেই।
হুজুর। কালস্নু মিয়ার অনুচ্চ কণ্ঠ।
তুমি আমাকে কিছু বলছো না কেন কালস্নু মিয়া?
সাহেবের অফিসে আপনাকে তলব করতে পারে?
তলব করবে? কে বলেছে?
মহারাজার রক্ষীরা। গোরা সেপাইরা ওদের কাছে জেনে গেছে যে আপনি বাড়িতে আছেন কি না।
কেন তলব করবে বলেছে কিছু?
না, সেসব কিছু বলেনি। না, মানে আমি ঠিক জানি না। রক্ষীদের কাছে বললে বলতেও পারে।
যাও, ওদের কাছ থেকে জেনে আসো। কালস্নু মিয়া চলে গেলে তিনি চোখ বুঁজে ভাবেন, কি হতে পারে? নতুন ফন্দি কি আটা হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে? তবে এটাও ঠিক যে এখন পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাঁর গায়ে হাত দেয়নি। নানা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা কোনো খারাপ দিক মোড় নেয়নি। তাকে শহর ছাড়তে হয়নি, নির্বাসন দন্ড পেতে হয়নি। তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়নি। খোদাতালার অশেষ মেহেরবানী! গালিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভাবেন যে, ওদের মৃতু্যর মুলায়রাতো এখনো চলছে। কবে এই আসর ভাঙবে কে জানে। তার আখরোট খাওয়া শেষ হয়েছে। এত গস্নাস পানি পেলে ভালোলাগতো। কাউকে ডাকাডাকি না করে, তিনি কালস্নুর সেরার অপেক্ষা করেন। অল্পক্ষণে কালস্নু ফিরে আসে। চোখ মুখ শুকনো। গালিব ওর চেহারা দেখে বুঝলেন যে কোনো ভালো খবর নেই। বরং খবর শুনে ও ভয় পেয়ে গেছে।
হুজুর। কালস্নুর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর।
গালিব পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন। বলেন, খবরটা কতটা খারাপ তা আমাকে বুঝতে দাও কালস্নু মিয়া।
ওরা একটু পরেই আসবে।
কেন জানতে পেরেছ?
বাদশার সিক্কায় আপনার কবিতা-
বুঝেছি। আর বলতে হবে না। তুমি আমার জন্য এক গস্নাস পানি নিয়ে এসো।
কালস্নু মিয়া পানি আনলে তিনি খেয়ে শেষ করতে পারেননি, তখন দু'জন গোরা সৈন্য এসে বাড়ির উঠোনে ঢোকে। তিনি কাপড় বদলে বের হয়ে যান। উমরাও জান নিজের ঘরে ছিলেন। তিনি কিছুই জানতে পারেন না। কালস্নু মিয়া সঙ্গে গেলো।
সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিদ্রোহের সময় বাদশার নামে যে শীলমোহর খোদাই করা হয়েছিল, কথাগুলো কি আপনি লিখেছিলেন?
তিনি এক মুহূর্ত ভাবেন, চিন্তার ভান করেন। তারপর বলেন, বাদশা নিজে কবি। দরবারে অনেক কবি আসতেন। শাহজাদাদের কয়েকজন কবি। এতজনের মধ্যে একজনকে কবিকে সন্দেহ করা কি যুক্তিযুক্ত?
আপনি কি বলতে চাইছেন?
এই অর্থে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
সাহেব তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি নির্ভয়ে বলেন, আহসানউলস্নাহ খানের মতো দরবারের কর্মকর্তাও এই কথাই বলবেন। কারণ এত কবির মধ্যে একজনের কবিতা বোঝা কঠিন।
সাহেব বুঝতে পারেন যে চট করে এই কবির যুক্তি খন্ডন করা যাবে না। কারণ তার কাছে তেমন কোনো প্রমাণও নেই। এটি প্রমাণ করার জন্য দরবারে তেমন কোনো নথি খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
গালিব তখন বিগলিত হেসে বলেন, আমি যদি ওই কথাগুলো লিখেই থাকি তবে নিরুপায় হয়ে লিখেছি। এই বিচারে আমি নির্দোষ।
সাহেব মাথা ঝাঁকালেন। কি কারণে ঝাঁকালেন তা বোঝা গেলো না। তিনি আরও গদগদ কণ্ঠে বললেন, বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশরা তো অনেক সেপাইকে ক্ষমা করেছে। এটি যদি তারা করতে পারে তবে দুটো লাইন লেখার জন্য একজন কবিকে কি ক্ষমা করা যায় না?
সাহেব একটুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নেড়ে বললেন, আচ্ছা আপনি আসুন।
ফেরার পথে তাঁর বারবারই মনে হলো কাগজে-পত্রে কোনো প্রমাণ না থাকলেও বিষয়টিতো সত্য। বিদ্রোহের পরে বাদশা আবার পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। উৎসব পালন করা হয়েছিল। উৎসব উপলক্ষে সিক্কাটি চালু করা হয়েছিল। সিক্কার ওপর খোদিত লেখাগুলো তাঁরই রচনা। তিনি সাহেবের সামনে নানাকিছু বলে পার হয়ে এলেন। এই কৌশল গ্রহণ করার দরকার ছিল। কিন্তু বিষয়টি জানে অনেকে। মুন্সি জীবনলাল তাকে বলেছিলেন যে, তিনি যে রোজনামচা লিখছেন-সেখানে এই ঘটনাটির উলেস্নখ করবেন। যদিও বিষয়টি এখনো ব্রিটিশরা জানে না। এটাতো মিথ্যে নয় যে রাজদরবারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তিনি আরও ভাবলেন, নথিপত্র এর প্রমাণ না থাকার কথা নয়। তবে এমন হতে পারে ব্রিটিশরা শহরের পুরো দখল নেয়ার আগে দরবারের নথিপত্রে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সবই খোদাতালার মেহেরবানী, কালস্নু মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফেরার সময় তিনি এভাবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ইংরেজদের পরাজিত করায় তিনি বাদশার স্তুতি করে কাসিদা পাঠ করেছিলেন। বাদশা তাঁকে মিলস্নাত দিয়েছিলেন, সম্মানিত করেছিলেন। মাত্র মাস দুই আগের কথা, এখনো তিনি একটি কাসিদা লিখে বাদশাকে সম্মান জানিয়েছিলেন। যাহোক, যা করেছেন তা তিনি ঠিকই করেছেন, একথা ভেবেই তিনি নিজের ভেতরে শক্তি অনুভব করলেন। তাঁর হাঁটার গতি বেড়ে গেলো। তিনি জোরে জোরেই বললেন,
'বার্জারি আফতাব ও নুকরা-ই-সাহ
সিক্কা জড়দার-জাঁহা-বাহাদুর-শাহ্
সূর্যের সোনা ও চন্দ্রের রূপোর মতোই
বাহাদুর শাহ-ও এই মুদ্রায় তাঁর চিহ্নটি রেখেছেন।'
কালস্নু মিয়া তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, হুজুর!
কালস্নু মিয়া দু'হাজার ইংরেজ সৈন্যের বিশাল বাহিনী একদিন দিলিস্ন শহরে ঢুকে পড়লো। কেঁপে উঠলো শহরটা। তুমি আমার কাছে আসো কালস্নু মিয়া, আমি তোমার ঘাড়ে হাত রাখি।
হুজুর।
কালস্নু মিয়া।
হুজুর।
বাদশার এখন বিচার চলছে।
ওরা কি বাদশাকে মেরে ফেলবে হুজুর?
আমাকে হাঁটতে দাও। আমি এই পথে বসে পড়তে চাই না।
হুজুর।
কালস্নু মিয়া বাদশার নামে প্রচলিত মুদ্রায় আমিতো লিখেছিলাম যে সূর্যের সোনা এবং চাঁদের রুপোর মতো বাদশা।
হুজুর আপনিতো ঠিকই লিখেছিলেন।
গালিব আর কথা বাড়ান না। তিনি খানিকটা জোরে হাঁটার চেষ্টা করেন। কালস্নু মিয়ার ঘাড়ে হাত রেখেই হাঁটেন।
হুজুর।
বলো কি বলবে?
বিচারে কি বাদশার ফাঁসি হবে?
খামোশ! চুপ করে থাকো।
গালি
======================
গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ  সেলিনা হোসেন


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.