রাজনৈতিক সরকার কী গণতান্ত্রিক সরকার by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কয়েক মাস পরেই বাংলাদেশের বয়স চল্লিশে পড়বে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর থেকে এক দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর হতে পারত জাতীয় জীবনের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের আরম্ভ। বাহাত্তর হতে পারত ‘বিচিত্র জীবনচর্চার বেগে চঞ্চল’ একটি বছর। প্রথম নির্বাচনের বছর তিয়াত্তর হওয়া উচিত ছিল ‘জাগ্রত চিত্তবৃত্তির তাড়নায় এক নতুন অধ্যায়’ রচনার বছর।
শেষ বাক্য দুটির ঊর্ধ্ব-কমার ভেতরের কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের। কথাগুলো তিনি বাংলাদেশকে উদ্দেশ করে বলেননি। তাঁর মৃত্যুর পুরো ৩০ বছর পরে বাংলাদেশ যে একটি রাষ্ট্র হবে, তা ছিল তাঁর কল্পনার অতীত এবং সেই রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত অগ্রিম তাঁকেই রচনা করে যেতে হবে—তাও তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না। বিধাতা জানতেন। কবির ধ্যানের বাংলা ছিল ‘সোনার বাংলা’। বাস্তবে এ বাংলা সোনারও নয়, পিতলেরও নয়—সবুজ শস্যের। যে শস্য ফলায় পাঁজরের ও চোয়ালের হাড় বের হওয়া কৃষক, ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা পলিটিশিয়ান ও ভদ্রলোকেরা নন। অথবা আরও বাহারি লেবাস পরা ধর্মীয় নেতারাও নন।
কানা-খোঁড়া যা হোক, এক ধরনের গণতন্ত্র কাগজেপত্রে আছে বলেই আমাদের রাজনীতিবিদেরা পলিটিকস করার সুযোগ পাচ্ছেন। কোনো রকমে এই অবস্থাটা টিকিয়ে রাখা তাঁদের এবং তাঁদের বিদেশি মাস্টারদের স্বার্থেই প্রয়োজন। গণতন্ত্রটা বেশি কার্যকর হয়ে উঠলে পলিটিকসটা জমবে না, রাজনীতির চরিত্র যাবে পাল্টে। তাতে রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ অর্থবহ হয়ে উঠবে, অল্পসংখ্যক রাজনীতিকের পলিটিকস করা কঠিন হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের স্থায়ী কর্তা আমলাদেরও তাতে মুশকিল। এখন যে রাজনীতি, তা রাজনীতিক-আমলা-ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই গণতন্ত্রে জনগণ গৌণ—সিন্ডিকেটের সদস্যরাই আসল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল আসল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সিন্ডিকেটের গণতন্ত্র নয়।
স্বাধীনতার আগে আইয়ুব-মোনায়েমের আমলে সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক সরকার আমরা দেখেছি। জনগণের জন্য তা ছিল অভিশাপ। সরকার ছিল জনগণের মাথার ওপর একটি পাথরের মতো। আমরা সেই পাথর সরাতে চেয়েছিলাম এবং আমাদের পছন্দমতো মানুষের সরকার গঠন করতে চেয়েছিলাম। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছি। গণতন্ত্রের সংগ্রাম দরখাস্ত চালাচালির সংগ্রাম নয়, চায়ের কাপ ও স্যান্ডউইচ খেতে খেতে আলাপ-আলোচনার ব্যাপার নয়। গণতন্ত্রের জন্য জনগণকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। জনগণের মূল্য দেওয়া মানে পাঁচ কেজি ধান দেওয়া নয়। রক্ত দেওয়া। সে রক্তও প্যাথলজির ডিসপোজেবল সিরিঞ্জে দেওয়া দুই চামচ রক্ত নয়। গণতন্ত্রের জন্য ঘড়ায় ঘড়ায় বা কলসে কলসে রক্ত দিতে হয়েছে।
সত্তরের নির্বাচনের পর থেকেই আমরা প্রত্যাশা করেছি, জনগণ একটি গণতান্ত্রিক সরকার পেতে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আমাদের সেই প্রত্যাশা আরও সুদৃঢ় হয়। মানুষের সেদিন সামান্য দাবি ছিল, একটি গণতান্ত্রিক সরকার—অর্থাৎ রাজনৈতিক সরকার, আমলাতান্ত্রিক সরকার আর নয়, সামরিক সরকার তো মোটেই নয়। জনগণের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরে একটি অসামরিক রাজনৈতিক সরকারই পাওয়া গেল বটে, কিন্তু তাতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হলো না। গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে যে গতিশীলতা থাকে, আমাদের সরকারে সেই গতিশীলতা ছিল না।
স্বাধীনতার পরে একটি সামন্তবাদী রাজনৈতিক ধারা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলাম। ওই ধারার রাজনীতিতে দলের সব নেতার সমমর্যাদার ভিত্তিতে বসে আলোচনার সুযোগ নেই। দলের শীর্ষ নেতা যিনি আছেন, তাঁকে হুজুর হুজুর করার একটা রেওয়াজ অনেক কাল থেকেই। তিনি বেঠিক বললেও তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা চলবে না। নেতার কথা হাসিমুখে অথবা মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। দলের ভেতরে কয়েকজনে মিলে আরেকটি নতুন মত তৈরির সুযোগ নেই। নতুন মত তৈরি মানে নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা ষড়যন্ত্র করা নয়। নতুন মত নিয়ে বিতর্কে দলের সবাই যোগ দেবেন। যুক্তির পাল্লা যেদিকে ভারী, সেই পক্ষ বিজয়ী হবে। সেটাই গণতান্ত্রিক রীতি।
আমাদের রাজনীতিতে তেমনটি কল্পনাও করা যায় না। নেতার সঙ্গে দ্বিমত করা দেশদ্রোহিতার শামিল। তারপর তাঁর দলে থাকাই কঠিন এবং থাকলেও কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। তা ছাড়া নেতাও জানেন, তাঁর কথা মেনে নেওয়া হবেই। ফলে তাঁর বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার ভয় নেই। তাঁর একটি অন্যায় আবদার বা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত দলের সিদ্ধান্ত হিসেবেই চালানো হয়। যেমন—কোনো ভবন, প্রতিষ্ঠান বা ব্রিজের নামকরণ হবে—সেখানে সবার মত নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সংসদে আলোচনারও প্রয়োজন নেই। দলের সভায় বা মন্ত্রিসভার বৈঠকে একজন স্তাবক তাঁর নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ধা করে একটা প্রস্তাব করলেন। ব্যস। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। পাঁচ-দশটা নাম থেকে একটি নাম বেছে নেওয়াই তো গণতান্ত্রিক রীতি।
ভালো ও কার্যকর গণতন্ত্রের রাস্তাটা একেবারেই সোজা নয়। গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য মানুষের মন তৈরি করতে হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। যে জনগণ দীর্ঘকাল সামন্তবাদী শাসন-শোষণের মধ্যে ছিল, তাকে বোঝাতে হবে গণতন্ত্র কী। তা বোঝানোর দায়িত্ব রাজনীতিকদের ও উচ্চশিক্ষিত সমাজের মানুষদের, যাঁদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলে ডাকি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমার ও আমার বয়সী আরও কারও কারও একটি ধারণা হয়েছিল যে স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রে নতুন চিন্তার সূচনা হবে। সব শ্রেণীর মানুষ যখন স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, উদার গণতন্ত্রী যেমন আছেন, তেমনি কট্টর বামও আছেন—সুতরাং সব মানুষের গ্রহণযোগ্য একটি মধ্যপন্থার চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটবে। কিন্তু চরমভাবে হতাশ হলাম। স্বাধীন দেশে নতুন চিন্তা তো দূরের কথা, দেশ ও সমাজ নিয়ে, জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করাটাই বন্ধ হয়ে গেল। যেসব অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলা নিয়ে ভেবেছেন, তাঁরা একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। কেউ সরকারকে তোয়াজ করতে লাগলেন, কেউ ঘরের ভেতরে বসে সরকারের বিরুদ্ধে গুজগুজ করতে থাকলেন। তরুণদের ভেতর থেকেও তীক্ষ সৎ ও নিবেদিত তেমন কেউ বের হলেন না। অবশ্য তরুণেরা বেঁচে থাকার সংগ্রামে এতটা গলদঘর্ম হতে থাকলেন যে চিন্তা করার জন্য যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরুপদ্রব অবকাশ প্রয়োজন, তা তাঁদের ছিল না। ফলে একটি নতুন রাষ্ট্র শুধু হাত-পা ও শরীরটা নিয়ে যাত্রা শুরু করল, তার মাথা ও মগজটা থাকল না।
পশ্চিমের উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা খুব বড়। রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানে রাজনীতিকেরাই যথেষ্ট নন। সব সমস্যা তাঁদের চোখে পড়েও না। সেই সমস্যা তাঁদের চোখে ধরিয়ে দেন নাগরিক সমাজের নেতারা। যেসব দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও থিংক ট্যাংক থেকে ব্যাপক গবেষণা হয়, সেসব গবেষণা সরকারি আনুকূল্যেও হয়, তবে বেসরকারি পর্যায়েই হয় বেশি। সুতরাং স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ বেশি। সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষপাতহীন বিচার-বিশ্লেষণ হলে, সরকারের ভুল নীতি নিয়ে গবেষণা হলে অনেক সমস্যার জট খুলে যায়।
গত ৩৫ বছরে আমাদের দেশে ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। আমরা নিজের অর্থে এই উন্নয়ন করতে পারিনি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও দাতা দেশগুলোর সহায়তায় আমরা রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা প্রভৃতি করেছি, সরকারি কর্মকর্তাদের অফিস কক্ষ সাজিয়েছি, সড়ক যোগাযোগের উন্নতি করতে গিয়ে রেলকে ধ্বংস করেছি। গ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করতে গিয়ে এনজিও কর্মকাণ্ডের এমন প্রসার ঘটেছে যে মহানগরগুলোর বাইরে গোটা দেশে সরকারের ভূমিকা আজ গৌণ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করছে এনজিওরা। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক বীজ ও ফোন কোম্পানির সহযোগী হয়ে উঠেছে। দরিদ্র ও নিম্নমধ্য শ্রেণীর কষ্টার্জিত অর্থ আজ বিদেশে চলে যাচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশ তার নিজের তেল, গ্যাস, কয়লা নিজে খুঁড়ে বের করতে পারে না। রাজনীতিকেরা অতি আনন্দের সঙ্গে তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অথবা দয়াপরবশ হয়ে কি তুলে দেন? বিদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করলে আগামী পাঁচ পুরুষ আর তাদের কোনো রোজগার করার প্রয়োজন হবে না।
আমাদের দেশ আছে, দেশের মাটি আছে কিন্তু ক্রমাগত আমাদের রাষ্ট্র—আমাদের সরকার অনুপস্থিত হয়ে পড়ছে। অন্তত জনগণ সরকারের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে না। যেদিকে তাকায়, সেদিকেই তারা দেখে দয়াময় এনজিও। শুধু ঋণ বিতরণের এনজিও নয়, বুদ্ধি বিতরণের এনজিও আজ অগণিত। বৈদেশিক টাকায় গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য কনসালটেন্সি ফার্ম, থিংক ট্যাংক ও নানা নামে নানা রকম প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, কূটনীতিক, সাংবাদিকেরা এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা বাংলাদেশকে বিশ্ব পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ও অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁদের প্রধান সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিকেরা।
কিছুকাল ধরে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রবল টক শোর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। দেশে স্বাধীন ও সৃষ্টিশীল চিন্তার বিস্তার ঘটলে টক শোর নামে এসব আবোল-তাবোল প্রলাপের আসর বসার সুযোগ থাকত না। টক শোগুলোয় কোনো চিন্তামূলক বা সৃষ্টিশীল বিতর্ক হয় না। সারা দিন কনসালটেন্সি আর সূর্যটি ডুবলেই অসহনীয় যানজটের মধ্যেও কারা ছুটছেন উত্তাল গতিতে এই চ্যানেল থেকে সেই চ্যানেলে? যে আমলা সারা জীবন জনগণের জন্য এক ছটাক কাজ করেননি, তিনি মালকোঁচা মেরে টক শোতে যাচ্ছেন যেন সরকার অথবা কোনো বিদেশি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কুস্তি লড়বেন। মধ্যরাতে গর্জে উঠছে টেলিভিশনের পর্দা। দর্শকের চোখ কপালে। লোকটির সাহস কী রে বাবা! এ নৈরাজ্যের শেষ কবে?
গণতন্ত্রে নাগরিক সমাজের নেতাদের কথার মূল্য খুব বেশি। সব দেশেই বুদ্ধিমান শাসকেরা তাঁদের কথার মূল্য দেন। ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেও তাঁরা ক্ষমতাসীনদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা আলাদা। আমাদের নাগরিক সমাজের নেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পেতে চান। কিন্তু ব্যয়বহুল নির্বাচন করার মতো অত টাকা তাঁদের নেই। তাই রাজনীতির সদর দরজাটা তাঁদের জন্য বন্ধ। তাঁরা খিড়কির দরজার খোঁজে থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি ভালো খিড়কির দরজা। সেই দরজার কাছে যাওয়ার আগে সরকার ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য টক শো, গোলটেবিল, সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়া অপরিহার্য। সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এসব উপসর্গ অনুকূল নয়।
শক্ত স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। আইয়ুব খান ছিলেন সামরিক একনায়ক। দেশের কোথাও তাঁর রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে তিনি একটি পোষা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বাহিনী তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরে রাজনৈতিক সরকারও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের শাসক দলের লেজুড়বৃত্তিতে বাধ্য করে। সেখানেই গণতন্ত্রের অর্ধেক শেষ হয়ে গেল। শীর্ষ পর্যায়ে রাজনীতিক ও আমলাদের মিতালি ছিল; টেস্ট রিলিফের গম প্রভৃতির কারণে তৃণমূল পর্যায়েও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দলীয় মাস্তানদের এক ক্রীড়াচক্র গড়ে ওঠে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ও পেশাজীবী সংগঠনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা গণতন্ত্রের অংশ। স্বাধীনতার পরে শিল্পশ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষের ইউনিয়নের নেতাদের শাসক দলের চামচা বানানো হয়। ট্রেড ইউনিয়ন এখন সম্পূর্ণ ধ্বংস। অথচ ৩৯ বছরে শ্রমিকনেতাদের অনেকের অবস্থা একজন মাঝারি শিল্পপতির চেয়ে ভালো। সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে চাঁদাবাজি তো আছেই, তার ওপর মালিক ও সরকার পক্ষের এনাম ও সুবিধাদি তাঁরা যা পাচ্ছেন, তার পরিমাণ আমাদের ধারণার বাইরে। স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া গণতন্ত্র অচল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ট্রেড ইউনিয়ন ও পেশাজীবী সংগঠনকে সহ্য করতে পারে না।
বাহাত্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনন্য সুযোগটি হাতছাড়া করেছিল রাজনৈতিক সরকার। বিরোধী দলকে মাথা তুলতে দেয়নি। মূল্য তাকেই দিতে হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ’৯৫ পর্যন্ত ১৫ বছর ছিল সামরিক ও আধাসামরিক সরকার এবং পাঁচ বছর ছিল খালেদা জিয়ার নির্বাচিত মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সরকার। তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যাবে না। মোশতাক সরকার, জিয়া সরকার, সাত্তার সরকার, এরশাদ সরকার ও খালেদা সরকারের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য বিশেষ ছিল না। তাঁরা সবাই ছিলেন সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনুসারী। এর মধ্যে উত্থান ঘটে জামায়াত প্রভৃতি মৌলবাদী শক্তির। তারা সরকারের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য পায়। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সঙ্গে মৌলবাদী রাজনীতি যোগ হয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো, দেশে রাজনীতিটাই থাকল, কিন্তু গণতন্ত্রটা গেল নষ্ট হয়ে। অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে ক্ষমতা পেল, কিন্তু তাঁরা মৌলবাদীদের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতিই গ্রহণ করেন। তা ছাড়া বিরোধী দলকে তাঁরা সহ্যই করতে পারতেন না। সুতরাং নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার পেলাম, গণতান্ত্রিক সরকার পাওয়া গেল না।
অত্যাচার ও শোষণ করে বলেই আমরা পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে ছিলাম। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি ছিল আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু স্বাধীনতার পরে আমাদের রাজনৈতিক সরকার স্বাধীনতার আগের প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানাও ধ্বংস করতে থাকে। নতুন প্রতিষ্ঠার তো প্রশ্নই নেই। চোরাচালান বাড়ে এবং পাট ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হতে থাকে। বাঙালি শ্রমিকদের মতো দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। আশির দশক থেকে নতুন খাত পোশাকশিল্প দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু গত দুই নির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, মালিকেরা শিল্পপতি হয়েছেন জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য নয়, রাজনীতিতে অংশ নিতে। সংসদের ৩০০ আসনের প্রায় ২০০ সদস্য শিল্পপতি-ব্যবসায়ী। অর্থাৎ অর্থনীতির জন্য রাজনীতি, গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি নয়। কৃষকের দুর্দশা সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জনগণ চেয়েছিল গণতান্ত্রিক সরকার। তাঁরা আমাদের উপহার দিয়েছেন রাজনৈতিক সরকার। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে গত দুই দশকে। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাতার ছায়ায় তৈরি করছে দক্ষ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ বাহিনী। ভালো ছাত্ররা আজ অসহায়। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। আমাদের অপরাধপ্রবণ সমাজে রাজনৈতিক সরকারের কারণে পুরোনো অপরাধের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন অপরাধ: টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, হল দখল ও আরও নানা রকমের বাজি ও বাণিজ্য।
গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় বিরোধী দলকে স্বাগত জানায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার বিরোধী দলকে নির্মূল করতে চায়। গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে নির্মূল করা মানে গণতন্ত্রের একটি ঠ্যাং কেটে ফেলা। এক পা নিয়ে সরকার কিছুদূর যেতে পারবে, কিন্তু একপর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়বে।
গণতন্ত্র কোনো নিয়ন্ত্রণের বস্তু নয়। গণতন্ত্রকে বনগরুর মতো স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে বা চলতে দেওয়া ভালো। তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আথালে বা গোয়ালে আটকে রাখলে সে যেমন আরাম পায় না, গেরস্তেরও গুঁতা খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পঞ্চাশের দশক থেকে বহু রাষ্ট্রনায়ক গণতন্ত্রের গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধতে গিয়ে তার গুঁতা খেয়ে জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন। আমরা শুধু নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার চাই না, গণতান্ত্রিক সরকার চাই। বাহাত্তরের মতো ২০০৯-এ একটি সুযোগ এসেছে। এবারের সুযোগ হারালে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
শেষ বাক্য দুটির ঊর্ধ্ব-কমার ভেতরের কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের। কথাগুলো তিনি বাংলাদেশকে উদ্দেশ করে বলেননি। তাঁর মৃত্যুর পুরো ৩০ বছর পরে বাংলাদেশ যে একটি রাষ্ট্র হবে, তা ছিল তাঁর কল্পনার অতীত এবং সেই রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত অগ্রিম তাঁকেই রচনা করে যেতে হবে—তাও তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না। বিধাতা জানতেন। কবির ধ্যানের বাংলা ছিল ‘সোনার বাংলা’। বাস্তবে এ বাংলা সোনারও নয়, পিতলেরও নয়—সবুজ শস্যের। যে শস্য ফলায় পাঁজরের ও চোয়ালের হাড় বের হওয়া কৃষক, ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা পলিটিশিয়ান ও ভদ্রলোকেরা নন। অথবা আরও বাহারি লেবাস পরা ধর্মীয় নেতারাও নন।
কানা-খোঁড়া যা হোক, এক ধরনের গণতন্ত্র কাগজেপত্রে আছে বলেই আমাদের রাজনীতিবিদেরা পলিটিকস করার সুযোগ পাচ্ছেন। কোনো রকমে এই অবস্থাটা টিকিয়ে রাখা তাঁদের এবং তাঁদের বিদেশি মাস্টারদের স্বার্থেই প্রয়োজন। গণতন্ত্রটা বেশি কার্যকর হয়ে উঠলে পলিটিকসটা জমবে না, রাজনীতির চরিত্র যাবে পাল্টে। তাতে রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ অর্থবহ হয়ে উঠবে, অল্পসংখ্যক রাজনীতিকের পলিটিকস করা কঠিন হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের স্থায়ী কর্তা আমলাদেরও তাতে মুশকিল। এখন যে রাজনীতি, তা রাজনীতিক-আমলা-ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই গণতন্ত্রে জনগণ গৌণ—সিন্ডিকেটের সদস্যরাই আসল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল আসল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সিন্ডিকেটের গণতন্ত্র নয়।
স্বাধীনতার আগে আইয়ুব-মোনায়েমের আমলে সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক সরকার আমরা দেখেছি। জনগণের জন্য তা ছিল অভিশাপ। সরকার ছিল জনগণের মাথার ওপর একটি পাথরের মতো। আমরা সেই পাথর সরাতে চেয়েছিলাম এবং আমাদের পছন্দমতো মানুষের সরকার গঠন করতে চেয়েছিলাম। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছি। গণতন্ত্রের সংগ্রাম দরখাস্ত চালাচালির সংগ্রাম নয়, চায়ের কাপ ও স্যান্ডউইচ খেতে খেতে আলাপ-আলোচনার ব্যাপার নয়। গণতন্ত্রের জন্য জনগণকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। জনগণের মূল্য দেওয়া মানে পাঁচ কেজি ধান দেওয়া নয়। রক্ত দেওয়া। সে রক্তও প্যাথলজির ডিসপোজেবল সিরিঞ্জে দেওয়া দুই চামচ রক্ত নয়। গণতন্ত্রের জন্য ঘড়ায় ঘড়ায় বা কলসে কলসে রক্ত দিতে হয়েছে।
সত্তরের নির্বাচনের পর থেকেই আমরা প্রত্যাশা করেছি, জনগণ একটি গণতান্ত্রিক সরকার পেতে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আমাদের সেই প্রত্যাশা আরও সুদৃঢ় হয়। মানুষের সেদিন সামান্য দাবি ছিল, একটি গণতান্ত্রিক সরকার—অর্থাৎ রাজনৈতিক সরকার, আমলাতান্ত্রিক সরকার আর নয়, সামরিক সরকার তো মোটেই নয়। জনগণের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরে একটি অসামরিক রাজনৈতিক সরকারই পাওয়া গেল বটে, কিন্তু তাতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হলো না। গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে যে গতিশীলতা থাকে, আমাদের সরকারে সেই গতিশীলতা ছিল না।
স্বাধীনতার পরে একটি সামন্তবাদী রাজনৈতিক ধারা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলাম। ওই ধারার রাজনীতিতে দলের সব নেতার সমমর্যাদার ভিত্তিতে বসে আলোচনার সুযোগ নেই। দলের শীর্ষ নেতা যিনি আছেন, তাঁকে হুজুর হুজুর করার একটা রেওয়াজ অনেক কাল থেকেই। তিনি বেঠিক বললেও তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা চলবে না। নেতার কথা হাসিমুখে অথবা মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। দলের ভেতরে কয়েকজনে মিলে আরেকটি নতুন মত তৈরির সুযোগ নেই। নতুন মত তৈরি মানে নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা ষড়যন্ত্র করা নয়। নতুন মত নিয়ে বিতর্কে দলের সবাই যোগ দেবেন। যুক্তির পাল্লা যেদিকে ভারী, সেই পক্ষ বিজয়ী হবে। সেটাই গণতান্ত্রিক রীতি।
আমাদের রাজনীতিতে তেমনটি কল্পনাও করা যায় না। নেতার সঙ্গে দ্বিমত করা দেশদ্রোহিতার শামিল। তারপর তাঁর দলে থাকাই কঠিন এবং থাকলেও কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। তা ছাড়া নেতাও জানেন, তাঁর কথা মেনে নেওয়া হবেই। ফলে তাঁর বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার ভয় নেই। তাঁর একটি অন্যায় আবদার বা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত দলের সিদ্ধান্ত হিসেবেই চালানো হয়। যেমন—কোনো ভবন, প্রতিষ্ঠান বা ব্রিজের নামকরণ হবে—সেখানে সবার মত নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সংসদে আলোচনারও প্রয়োজন নেই। দলের সভায় বা মন্ত্রিসভার বৈঠকে একজন স্তাবক তাঁর নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ধা করে একটা প্রস্তাব করলেন। ব্যস। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। পাঁচ-দশটা নাম থেকে একটি নাম বেছে নেওয়াই তো গণতান্ত্রিক রীতি।
ভালো ও কার্যকর গণতন্ত্রের রাস্তাটা একেবারেই সোজা নয়। গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য মানুষের মন তৈরি করতে হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। যে জনগণ দীর্ঘকাল সামন্তবাদী শাসন-শোষণের মধ্যে ছিল, তাকে বোঝাতে হবে গণতন্ত্র কী। তা বোঝানোর দায়িত্ব রাজনীতিকদের ও উচ্চশিক্ষিত সমাজের মানুষদের, যাঁদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলে ডাকি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমার ও আমার বয়সী আরও কারও কারও একটি ধারণা হয়েছিল যে স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রে নতুন চিন্তার সূচনা হবে। সব শ্রেণীর মানুষ যখন স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, উদার গণতন্ত্রী যেমন আছেন, তেমনি কট্টর বামও আছেন—সুতরাং সব মানুষের গ্রহণযোগ্য একটি মধ্যপন্থার চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটবে। কিন্তু চরমভাবে হতাশ হলাম। স্বাধীন দেশে নতুন চিন্তা তো দূরের কথা, দেশ ও সমাজ নিয়ে, জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করাটাই বন্ধ হয়ে গেল। যেসব অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলা নিয়ে ভেবেছেন, তাঁরা একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। কেউ সরকারকে তোয়াজ করতে লাগলেন, কেউ ঘরের ভেতরে বসে সরকারের বিরুদ্ধে গুজগুজ করতে থাকলেন। তরুণদের ভেতর থেকেও তীক্ষ সৎ ও নিবেদিত তেমন কেউ বের হলেন না। অবশ্য তরুণেরা বেঁচে থাকার সংগ্রামে এতটা গলদঘর্ম হতে থাকলেন যে চিন্তা করার জন্য যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরুপদ্রব অবকাশ প্রয়োজন, তা তাঁদের ছিল না। ফলে একটি নতুন রাষ্ট্র শুধু হাত-পা ও শরীরটা নিয়ে যাত্রা শুরু করল, তার মাথা ও মগজটা থাকল না।
পশ্চিমের উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা খুব বড়। রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানে রাজনীতিকেরাই যথেষ্ট নন। সব সমস্যা তাঁদের চোখে পড়েও না। সেই সমস্যা তাঁদের চোখে ধরিয়ে দেন নাগরিক সমাজের নেতারা। যেসব দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও থিংক ট্যাংক থেকে ব্যাপক গবেষণা হয়, সেসব গবেষণা সরকারি আনুকূল্যেও হয়, তবে বেসরকারি পর্যায়েই হয় বেশি। সুতরাং স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ বেশি। সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষপাতহীন বিচার-বিশ্লেষণ হলে, সরকারের ভুল নীতি নিয়ে গবেষণা হলে অনেক সমস্যার জট খুলে যায়।
গত ৩৫ বছরে আমাদের দেশে ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। আমরা নিজের অর্থে এই উন্নয়ন করতে পারিনি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও দাতা দেশগুলোর সহায়তায় আমরা রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা প্রভৃতি করেছি, সরকারি কর্মকর্তাদের অফিস কক্ষ সাজিয়েছি, সড়ক যোগাযোগের উন্নতি করতে গিয়ে রেলকে ধ্বংস করেছি। গ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করতে গিয়ে এনজিও কর্মকাণ্ডের এমন প্রসার ঘটেছে যে মহানগরগুলোর বাইরে গোটা দেশে সরকারের ভূমিকা আজ গৌণ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করছে এনজিওরা। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক বীজ ও ফোন কোম্পানির সহযোগী হয়ে উঠেছে। দরিদ্র ও নিম্নমধ্য শ্রেণীর কষ্টার্জিত অর্থ আজ বিদেশে চলে যাচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশ তার নিজের তেল, গ্যাস, কয়লা নিজে খুঁড়ে বের করতে পারে না। রাজনীতিকেরা অতি আনন্দের সঙ্গে তা বিদেশিদের হাতে তুলে দেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অথবা দয়াপরবশ হয়ে কি তুলে দেন? বিদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করলে আগামী পাঁচ পুরুষ আর তাদের কোনো রোজগার করার প্রয়োজন হবে না।
আমাদের দেশ আছে, দেশের মাটি আছে কিন্তু ক্রমাগত আমাদের রাষ্ট্র—আমাদের সরকার অনুপস্থিত হয়ে পড়ছে। অন্তত জনগণ সরকারের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে না। যেদিকে তাকায়, সেদিকেই তারা দেখে দয়াময় এনজিও। শুধু ঋণ বিতরণের এনজিও নয়, বুদ্ধি বিতরণের এনজিও আজ অগণিত। বৈদেশিক টাকায় গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য কনসালটেন্সি ফার্ম, থিংক ট্যাংক ও নানা নামে নানা রকম প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, কূটনীতিক, সাংবাদিকেরা এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা বাংলাদেশকে বিশ্ব পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ও অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁদের প্রধান সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিকেরা।
কিছুকাল ধরে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রবল টক শোর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। দেশে স্বাধীন ও সৃষ্টিশীল চিন্তার বিস্তার ঘটলে টক শোর নামে এসব আবোল-তাবোল প্রলাপের আসর বসার সুযোগ থাকত না। টক শোগুলোয় কোনো চিন্তামূলক বা সৃষ্টিশীল বিতর্ক হয় না। সারা দিন কনসালটেন্সি আর সূর্যটি ডুবলেই অসহনীয় যানজটের মধ্যেও কারা ছুটছেন উত্তাল গতিতে এই চ্যানেল থেকে সেই চ্যানেলে? যে আমলা সারা জীবন জনগণের জন্য এক ছটাক কাজ করেননি, তিনি মালকোঁচা মেরে টক শোতে যাচ্ছেন যেন সরকার অথবা কোনো বিদেশি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কুস্তি লড়বেন। মধ্যরাতে গর্জে উঠছে টেলিভিশনের পর্দা। দর্শকের চোখ কপালে। লোকটির সাহস কী রে বাবা! এ নৈরাজ্যের শেষ কবে?
গণতন্ত্রে নাগরিক সমাজের নেতাদের কথার মূল্য খুব বেশি। সব দেশেই বুদ্ধিমান শাসকেরা তাঁদের কথার মূল্য দেন। ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেও তাঁরা ক্ষমতাসীনদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা আলাদা। আমাদের নাগরিক সমাজের নেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পেতে চান। কিন্তু ব্যয়বহুল নির্বাচন করার মতো অত টাকা তাঁদের নেই। তাই রাজনীতির সদর দরজাটা তাঁদের জন্য বন্ধ। তাঁরা খিড়কির দরজার খোঁজে থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি ভালো খিড়কির দরজা। সেই দরজার কাছে যাওয়ার আগে সরকার ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য টক শো, গোলটেবিল, সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়া অপরিহার্য। সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এসব উপসর্গ অনুকূল নয়।
শক্ত স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। আইয়ুব খান ছিলেন সামরিক একনায়ক। দেশের কোথাও তাঁর রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে তিনি একটি পোষা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বাহিনী তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরে রাজনৈতিক সরকারও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের শাসক দলের লেজুড়বৃত্তিতে বাধ্য করে। সেখানেই গণতন্ত্রের অর্ধেক শেষ হয়ে গেল। শীর্ষ পর্যায়ে রাজনীতিক ও আমলাদের মিতালি ছিল; টেস্ট রিলিফের গম প্রভৃতির কারণে তৃণমূল পর্যায়েও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দলীয় মাস্তানদের এক ক্রীড়াচক্র গড়ে ওঠে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ও পেশাজীবী সংগঠনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা গণতন্ত্রের অংশ। স্বাধীনতার পরে শিল্পশ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষের ইউনিয়নের নেতাদের শাসক দলের চামচা বানানো হয়। ট্রেড ইউনিয়ন এখন সম্পূর্ণ ধ্বংস। অথচ ৩৯ বছরে শ্রমিকনেতাদের অনেকের অবস্থা একজন মাঝারি শিল্পপতির চেয়ে ভালো। সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে চাঁদাবাজি তো আছেই, তার ওপর মালিক ও সরকার পক্ষের এনাম ও সুবিধাদি তাঁরা যা পাচ্ছেন, তার পরিমাণ আমাদের ধারণার বাইরে। স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া গণতন্ত্র অচল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ট্রেড ইউনিয়ন ও পেশাজীবী সংগঠনকে সহ্য করতে পারে না।
বাহাত্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনন্য সুযোগটি হাতছাড়া করেছিল রাজনৈতিক সরকার। বিরোধী দলকে মাথা তুলতে দেয়নি। মূল্য তাকেই দিতে হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ’৯৫ পর্যন্ত ১৫ বছর ছিল সামরিক ও আধাসামরিক সরকার এবং পাঁচ বছর ছিল খালেদা জিয়ার নির্বাচিত মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সরকার। তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যাবে না। মোশতাক সরকার, জিয়া সরকার, সাত্তার সরকার, এরশাদ সরকার ও খালেদা সরকারের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য বিশেষ ছিল না। তাঁরা সবাই ছিলেন সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনুসারী। এর মধ্যে উত্থান ঘটে জামায়াত প্রভৃতি মৌলবাদী শক্তির। তারা সরকারের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য পায়। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সঙ্গে মৌলবাদী রাজনীতি যোগ হয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো, দেশে রাজনীতিটাই থাকল, কিন্তু গণতন্ত্রটা গেল নষ্ট হয়ে। অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে ক্ষমতা পেল, কিন্তু তাঁরা মৌলবাদীদের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতিই গ্রহণ করেন। তা ছাড়া বিরোধী দলকে তাঁরা সহ্যই করতে পারতেন না। সুতরাং নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার পেলাম, গণতান্ত্রিক সরকার পাওয়া গেল না।
অত্যাচার ও শোষণ করে বলেই আমরা পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে ছিলাম। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি ছিল আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু স্বাধীনতার পরে আমাদের রাজনৈতিক সরকার স্বাধীনতার আগের প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানাও ধ্বংস করতে থাকে। নতুন প্রতিষ্ঠার তো প্রশ্নই নেই। চোরাচালান বাড়ে এবং পাট ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হতে থাকে। বাঙালি শ্রমিকদের মতো দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। আশির দশক থেকে নতুন খাত পোশাকশিল্প দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু গত দুই নির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, মালিকেরা শিল্পপতি হয়েছেন জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য নয়, রাজনীতিতে অংশ নিতে। সংসদের ৩০০ আসনের প্রায় ২০০ সদস্য শিল্পপতি-ব্যবসায়ী। অর্থাৎ অর্থনীতির জন্য রাজনীতি, গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি নয়। কৃষকের দুর্দশা সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জনগণ চেয়েছিল গণতান্ত্রিক সরকার। তাঁরা আমাদের উপহার দিয়েছেন রাজনৈতিক সরকার। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে গত দুই দশকে। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাতার ছায়ায় তৈরি করছে দক্ষ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ বাহিনী। ভালো ছাত্ররা আজ অসহায়। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। আমাদের অপরাধপ্রবণ সমাজে রাজনৈতিক সরকারের কারণে পুরোনো অপরাধের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন অপরাধ: টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, হল দখল ও আরও নানা রকমের বাজি ও বাণিজ্য।
গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় বিরোধী দলকে স্বাগত জানায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার বিরোধী দলকে নির্মূল করতে চায়। গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে নির্মূল করা মানে গণতন্ত্রের একটি ঠ্যাং কেটে ফেলা। এক পা নিয়ে সরকার কিছুদূর যেতে পারবে, কিন্তু একপর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়বে।
গণতন্ত্র কোনো নিয়ন্ত্রণের বস্তু নয়। গণতন্ত্রকে বনগরুর মতো স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে বা চলতে দেওয়া ভালো। তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আথালে বা গোয়ালে আটকে রাখলে সে যেমন আরাম পায় না, গেরস্তেরও গুঁতা খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পঞ্চাশের দশক থেকে বহু রাষ্ট্রনায়ক গণতন্ত্রের গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধতে গিয়ে তার গুঁতা খেয়ে জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন। আমরা শুধু নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার চাই না, গণতান্ত্রিক সরকার চাই। বাহাত্তরের মতো ২০০৯-এ একটি সুযোগ এসেছে। এবারের সুযোগ হারালে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
No comments