পরম নামে ডাকি -নির্লিপ্ত নয়ন
সময় কি রূপকথার সেই আগুনমুখা একচক্ষু দৈত্য, চোখের পলকে মুহূর্তকে শুধু স্মৃতি করে দেয়! গল্পগাথার মতো বহুবর্ণিল স্মৃতির মহাফিলে কত না দৃশ্যের সার্কারামা রোজ ওঠে আর নামে। খুব দ্রুতই পুরোনো হয়ে যায় দিনপঞ্জির রাত্রিদিন। এই তো তিনি আমাদের দিকে সুতীক্ষ চাহনিতে তাকালেন, ওই তো শেষ বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে সুরে-বেসুরে ধরলেন ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে...’। সবকিছু কি আজ স্মৃতি বলে মেনে নিতে হবে? জানি, একচক্ষু দৈত্য দেবে না কোনো উত্তর। বনশ্রীবালা, চুক্কুলি, নোলক, সাঁঝমালা কিংবা যমুনাপারের আবছা—তাঁর নাটকের এই চরিত্ররা কী করে এখন, স্রষ্টার জন্মদিনে বইয়ের কালো অক্ষরের ভেতর থেকে তারা কি কাঁদছে? তারা কি নীরবে আনন্দ-প্রদীপ ভাসাচ্ছে তাদের স্রষ্টার জন্মোৎসবের ক্ষণে? উত্তর নাই।
‘উত্তর নাই’ বাক্যাংশটিও সেলিম আল দীন রচিত কথানাট্য প্রাচ্য থেকে ধার করা। নাটকে নোলকের সর্পদংশনের পর মুহূর্তের বর্ণনায় বাক্যটি ব্যবহার করেছিলেন তিনি। আর আমরা যাঁরা আজ নিজের ভেতরে স্মৃতির দংশন অনুভব করছি, তাঁরা ই-বা কী করব এখন? হঠাৎ হঠাৎ আমাদের নচ্ছার মন যখন অচলায়তন নাটকের পঞ্চকের মতো করে চারপাশের বন্ধ দেয়ালগুলো ভাঙতে চাই; মনে পড়ে, কেই বা বলবে আর ‘হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙো দাদাঠাকুর’। আমাদের যে দাদাঠাকুর নেই, আমাদের যে আচার্য নেই। সেলিম আল দীন আমাদের আচার্য। আজ তাঁর ৬১তম জন্মদিনে সব স্মৃতি যেন বা ফিরে আসছে একচক্ষু দৈত্যের হাত ঘুরে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হরীতকী-মহুয়াগাছের সারি পেছনে ফেলে আমরা যাঁরা তাঁর সঙ্গে প্রতিদিন হাঁটতাম; লাল ইটের সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো কোথাও হঠাৎই দাঁড়িয়ে যেতেন তিনি। পথ থেকে অনামা লতাগুল্ম কুড়িয়ে নিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বলতেন, ‘দেখেছিস, দেখেছিস...এই গাছের নাম জানিস...দুপুরবেলা সূর্যের আলো পড়ার পর গাছের পাতার রং কেমন হয় দেখেছিস কখনো...এসব না জানলে তো সাহিত্য লিখতে পারবি না, বাবা।’
তাঁর কথার অবসরে অনেকেই সেদিন মুখটিপে হেসেছি আমরা। এসব কী বলেন স্যার, লিখতে গেলে এও চিনতে হবে নাকি! অনেক পূর্ণিমা রাতে তন্ময় হয়ে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকেছেন আকাশে। তাঁর গলায় সে সময় রবিঠাকুর ও গীতবিতান। উন্মুক্ত মাঠের ভেতের সেই চাঁদ-ভাসানো রাতে দুরন্ত শিশুর মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি আর হতচকিত আমরা বিস্ময় নিয়ে দেখছি কাণ্ড! সেদিন বুঝিনি, কিন্তু আজ মনে হয়, পাঠশালায় নিয়মিত বেতের বাড়ি খাওয়া আমাদের তিনি যেন এভাবেই দাদাঠাকুরের সেই দর্ভকপল্লিতে নিয়ে যেতেন। বলতেন, ‘দ্যাখ, চোখ মেলে চারপাশটা দেখে নে শালার পুত।’ আজ যখন ইট-কাষ্ঠঘেরা নাগরিক অচলায়তনে হাঁসফাঁস করতে করতে পঞ্চকের কণ্ঠ বাজিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে...’, তখন দাদাঠাকুরকে কোথায় পাই? লেখার টেবিলভর্তি কাগজের স্তূপ ঠেলে হোমার, মধুসূদন, জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথের মহাভুবন প্রসঙ্গে তিনি কী কথা বলবেন আবার? নিজের সদ্য লেখা শোনাতে শোনাতে কিছুটা গৌরবে কি হেসে উঠবেন শিশুর সারল্যে? আমাদের কাঁচা হাতে লেখা দুর্বল কোনো কবিতা পড়ে কেউ কি আর কখনো বলবে, ‘এটা আমার ছাত্রের লেখা...এই শব্দ প্রয়োগটা কিন্তু ভালো হয়েছে।’
এক উন্মূল জীবন ডিঙিয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার সৌভাগ্যে বাংলা ভাষার অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ নাট্যকারকে কাছাকাছি পেয়েছিলাম কিছুদিন। কিন্তু আমাদের মনে তো সেদিন পঞ্চকের মতো বন্ধন মুক্তির রং জাগেনি, তাই দাদাঠাকুরকে হয়তো চিনতেও পারিনি ঠিকঠাক।
চেনা-অচেনার দোলাচল নিয়ে আজও যখন তাঁর ঘুম-জাগরণের সি/৪৭-এর সেই ঘরে যাওয়া হয়, দেখি, দাদাঠাকুর ছবি হয়ে তাকিয়ে আছেন! অথচ এই ঘরেই তো একদিন ‘ঊষা উৎসব’-এর সিসিথাপ্পা ঢোল বাজিয়েছে, পুত্র নাটকের আবছা ও মাইটাল সিরাজ ঝগড়ায় মশগুল হয়েছে—আমরা মুখোমুখি বসে শুনেছি সেসব। ২০০৭ সালের ১৭ আগস্ট জীবদ্দশায় নিজের শেষ জন্মতিথি উদ্যাপনের ক্ষণে কবি শামসুর রাহমানের প্রয়াণের সংবাদে এই ঘরেই তো বিষণ্ন, স্তব্ধ হয়ে গেছেন তিনি। শামসুর রাহমানের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন আর কবির লেখা কখনো আমার মাকে কবিতাটি কতবার না আওড়েছিলেন সেদিন। সময়ের নিষ্ঠুর একচক্ষু দৈত্যের চোরাটানে সবকিছুই কি স্মৃতি হয়ে গেল আজ!
অনেক দিন হরীতকী-মহুয়া আর শোনপাংশুদের দলে মিশে দর্ভকপল্লিতে যাওয়া হয়নি। অনেক দিন তাঁর ‘অত্যাচারের’ আঁচ থেকে মাথামুণ্ডুসহ বেঁচে গিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে আর গুনতে হয় না এই শুকতারা ওই সপ্তর্ষি...তবু কেন এ ছিন্ন লেখায় তাঁর জন্য আজ সাজাই তরণী, প্রভাতের ওপারে দাঁড়িয়ে তাঁরে কেন পরম নামে ডাকি? ‘ওরে ভোলামন, নিরঞ্জনকে চিনতে হলে একবার তাকাও আপনাতে...’ হরগজ নাটকের গানে এ কথা বলেছিলেন একদিন। আজ আপনার দিকে তাকাতেই দেখি, আমাদের চারদিকে সময়-দৈত্য এবং তার পিঠের ওপর ক্রমাগত বড় হচ্ছে অচলায়তনের দেয়াল। সেই দেয়ালের পাষাণভার হাসতে হাসতে কে আর ভাঙবে আজ? গানে গানে কে আর বলবে দাদাঠাকুর, ‘আমি নদীর কাছে গিয়েছিলাম/ নদী তোমার কী নাম/ ভাঙা কিনারার ধু-ধু চরে মেলে না উত্তর।’
‘উত্তর নাই’ বাক্যাংশটিও সেলিম আল দীন রচিত কথানাট্য প্রাচ্য থেকে ধার করা। নাটকে নোলকের সর্পদংশনের পর মুহূর্তের বর্ণনায় বাক্যটি ব্যবহার করেছিলেন তিনি। আর আমরা যাঁরা আজ নিজের ভেতরে স্মৃতির দংশন অনুভব করছি, তাঁরা ই-বা কী করব এখন? হঠাৎ হঠাৎ আমাদের নচ্ছার মন যখন অচলায়তন নাটকের পঞ্চকের মতো করে চারপাশের বন্ধ দেয়ালগুলো ভাঙতে চাই; মনে পড়ে, কেই বা বলবে আর ‘হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙো দাদাঠাকুর’। আমাদের যে দাদাঠাকুর নেই, আমাদের যে আচার্য নেই। সেলিম আল দীন আমাদের আচার্য। আজ তাঁর ৬১তম জন্মদিনে সব স্মৃতি যেন বা ফিরে আসছে একচক্ষু দৈত্যের হাত ঘুরে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হরীতকী-মহুয়াগাছের সারি পেছনে ফেলে আমরা যাঁরা তাঁর সঙ্গে প্রতিদিন হাঁটতাম; লাল ইটের সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হয়তো কোথাও হঠাৎই দাঁড়িয়ে যেতেন তিনি। পথ থেকে অনামা লতাগুল্ম কুড়িয়ে নিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বলতেন, ‘দেখেছিস, দেখেছিস...এই গাছের নাম জানিস...দুপুরবেলা সূর্যের আলো পড়ার পর গাছের পাতার রং কেমন হয় দেখেছিস কখনো...এসব না জানলে তো সাহিত্য লিখতে পারবি না, বাবা।’
তাঁর কথার অবসরে অনেকেই সেদিন মুখটিপে হেসেছি আমরা। এসব কী বলেন স্যার, লিখতে গেলে এও চিনতে হবে নাকি! অনেক পূর্ণিমা রাতে তন্ময় হয়ে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকেছেন আকাশে। তাঁর গলায় সে সময় রবিঠাকুর ও গীতবিতান। উন্মুক্ত মাঠের ভেতের সেই চাঁদ-ভাসানো রাতে দুরন্ত শিশুর মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি আর হতচকিত আমরা বিস্ময় নিয়ে দেখছি কাণ্ড! সেদিন বুঝিনি, কিন্তু আজ মনে হয়, পাঠশালায় নিয়মিত বেতের বাড়ি খাওয়া আমাদের তিনি যেন এভাবেই দাদাঠাকুরের সেই দর্ভকপল্লিতে নিয়ে যেতেন। বলতেন, ‘দ্যাখ, চোখ মেলে চারপাশটা দেখে নে শালার পুত।’ আজ যখন ইট-কাষ্ঠঘেরা নাগরিক অচলায়তনে হাঁসফাঁস করতে করতে পঞ্চকের কণ্ঠ বাজিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে...’, তখন দাদাঠাকুরকে কোথায় পাই? লেখার টেবিলভর্তি কাগজের স্তূপ ঠেলে হোমার, মধুসূদন, জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথের মহাভুবন প্রসঙ্গে তিনি কী কথা বলবেন আবার? নিজের সদ্য লেখা শোনাতে শোনাতে কিছুটা গৌরবে কি হেসে উঠবেন শিশুর সারল্যে? আমাদের কাঁচা হাতে লেখা দুর্বল কোনো কবিতা পড়ে কেউ কি আর কখনো বলবে, ‘এটা আমার ছাত্রের লেখা...এই শব্দ প্রয়োগটা কিন্তু ভালো হয়েছে।’
এক উন্মূল জীবন ডিঙিয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার সৌভাগ্যে বাংলা ভাষার অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ নাট্যকারকে কাছাকাছি পেয়েছিলাম কিছুদিন। কিন্তু আমাদের মনে তো সেদিন পঞ্চকের মতো বন্ধন মুক্তির রং জাগেনি, তাই দাদাঠাকুরকে হয়তো চিনতেও পারিনি ঠিকঠাক।
চেনা-অচেনার দোলাচল নিয়ে আজও যখন তাঁর ঘুম-জাগরণের সি/৪৭-এর সেই ঘরে যাওয়া হয়, দেখি, দাদাঠাকুর ছবি হয়ে তাকিয়ে আছেন! অথচ এই ঘরেই তো একদিন ‘ঊষা উৎসব’-এর সিসিথাপ্পা ঢোল বাজিয়েছে, পুত্র নাটকের আবছা ও মাইটাল সিরাজ ঝগড়ায় মশগুল হয়েছে—আমরা মুখোমুখি বসে শুনেছি সেসব। ২০০৭ সালের ১৭ আগস্ট জীবদ্দশায় নিজের শেষ জন্মতিথি উদ্যাপনের ক্ষণে কবি শামসুর রাহমানের প্রয়াণের সংবাদে এই ঘরেই তো বিষণ্ন, স্তব্ধ হয়ে গেছেন তিনি। শামসুর রাহমানের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন আর কবির লেখা কখনো আমার মাকে কবিতাটি কতবার না আওড়েছিলেন সেদিন। সময়ের নিষ্ঠুর একচক্ষু দৈত্যের চোরাটানে সবকিছুই কি স্মৃতি হয়ে গেল আজ!
অনেক দিন হরীতকী-মহুয়া আর শোনপাংশুদের দলে মিশে দর্ভকপল্লিতে যাওয়া হয়নি। অনেক দিন তাঁর ‘অত্যাচারের’ আঁচ থেকে মাথামুণ্ডুসহ বেঁচে গিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে আর গুনতে হয় না এই শুকতারা ওই সপ্তর্ষি...তবু কেন এ ছিন্ন লেখায় তাঁর জন্য আজ সাজাই তরণী, প্রভাতের ওপারে দাঁড়িয়ে তাঁরে কেন পরম নামে ডাকি? ‘ওরে ভোলামন, নিরঞ্জনকে চিনতে হলে একবার তাকাও আপনাতে...’ হরগজ নাটকের গানে এ কথা বলেছিলেন একদিন। আজ আপনার দিকে তাকাতেই দেখি, আমাদের চারদিকে সময়-দৈত্য এবং তার পিঠের ওপর ক্রমাগত বড় হচ্ছে অচলায়তনের দেয়াল। সেই দেয়ালের পাষাণভার হাসতে হাসতে কে আর ভাঙবে আজ? গানে গানে কে আর বলবে দাদাঠাকুর, ‘আমি নদীর কাছে গিয়েছিলাম/ নদী তোমার কী নাম/ ভাঙা কিনারার ধু-ধু চরে মেলে না উত্তর।’
No comments