সব মানুষ গুনতে হবে, কিন্তু কার জন্য by ফরিদা আখতার
বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত, এ তথ্য সবার কাছে ঠিকমতো আছে কি না, আমার ঘোরতর সন্দেহ হয়। মন্ত্রীদের বক্তব্যে ১৫ কোটি থেকে ১৬ কোটি হতে সময় লাগে না। এক দিন এদিক-ওদিক হলেই এক কোটি বেড়ে যায় বা কমে যায়। বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোও একেক কথা বলে। কারও কথার সঙ্গে কারও কথার মিল নেই। সাধারণ মানুষ এসব কথার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। ১৫ কোটি হোক কি ১৬ কোটি, এই গুনতির মধ্যে তারা আছে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
যেদিন বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে দাঁড়াল, সে তারিখ ছিল ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এই দিনটিকে দ্য ডে অব ফাইভ বিলিয়ন হিসেবে পালন করেছিল। এরপর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ১৯৮৯ সাল থেকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। এই হলো সহজভাবে দিবসটি পালনের কথা। বাংলাদেশেও আমরা ভালোই টের পাই।
এসব দিবস পালনের জন্য একটি রীতি দাঁড়িয়েছে, তা হচ্ছে, প্রতিপাদ্য বিষয় থাকা। সে অনুযায়ী এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে এভরিওয়ান কাউন্টস বা প্রত্যেকেই গণনার মধ্যে থাকবে। গণনা ছাড়া নিশ্চয়ই মানুষের সংখ্যা এত দিন জানা যায়নি, তবে এবার একটু বিস্তারিত জানার দিকে গুরুত্ব দিতে চাইছে জাতিসংঘ। নারী-পুরুষ ভাগ তো থাকবেই; তা ছাড়া জাতি, বর্ণ, ধনী, গরিব কত আছে, তা জানার প্রয়োজন আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহসংস্থান করতে হলে জানতে হবে কত মানুষ কী অবস্থায় আছে। অবশ্য আমি একটু অবাক হচ্ছি, এমন একটি বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে জাতিসংঘ এত দেরি কেন করল। তবে তারা এবার নির্ভরযোগ্য তথ্যের কথা বলছে। এর ফলে সঠিকভাবে জানা যাবে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে কারা বাদ পড়ল। তাহলে এত দিনের তথ্য কি নির্ভরযোগ্য ছিল না?
এ বছর জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের উদ্যোগে ৬০টি দেশে ২০১০ সালের মানুষ গণনা বা আদমশুমারি করা হচ্ছে। আদমশুমারি করতে হলে ঘরে ঘরে গিয়ে একেবারে মাথা গোনা ছাড়া পথ নেই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের এই উদ্যোগে বাংলাদেশ আছে কি না, জানা যায়নি। তবে গত ডিসেম্বর (২০০৯) মাসে জলবায়ু সম্মেলন চলাকালে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বাংলাদেশে অবস্থিত জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের কার্যালয় থেকে একটি জনসংখ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, যা কোনো আদমশুমারির মাধ্যমে হয়নি। এবং সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে জনসংখ্যা বেশি হওয়ার বিষয়টি যুক্ত করে দিয়ে একধরনের দোষারোপের কাজই করা হয়েছে। এগুলো অতি পুরোনো কৌশল, এখন আর কাজ হয় না। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের এই দিনে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশে সবাইকে গণনা করা হয়নি। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করেই আমরা ১৬ কোটি!
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অবস্থা হয়েছে ‘গরিবের বউ’ সবার ভাবির মতো। দেশি-বিদেশি সব সংগঠন এসে আমাদের মানুষ গুনে বসে। আমার জানামতে, ২০০১ সালে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের উদ্যোগে (সেটাও তাদের করার কথা নয়, এটা সরকারের কাজ)। তার প্রাথমিক ফলাফল দেওয়া হয়েছে ১৩ কোটি, কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল জানা যায়নি। প্রশ্ন জাগে, এই ফলাফল কি তাদের মনঃপূত হয়নি? অন্য সংস্থার ফলাফল ১৩ কোটি ৩৩ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮৪ জন (২০০২) http://www.discoverybangladesh.com/ meetbangladesh/statistic.html।
বিশ্বব্যাংক ২০০৮ সালে হিসাব করে বলেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১২৮ (World Bank, World Development Indicators; Last updated June 16, 2010)। অর্থাৎ, ছয় বছরে তিন কোটিরও বেশি মানুষ বেড়েছে। এই একই সময়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কিছুটা কমে গেলেও বন্ধ ছিল বলা যাবে না। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও সাধারণ মানুষের পর্যায়ে অনেকটাই এসে গেছে। কাজেই এত বেশি বাড়ার কথা নয়। সারকথা হচ্ছে, কোনোরকম গণনা না করে যে কেউ আমাদের মানুষের সংখ্যা বলে দেবে, তা ঠিক কাজ বলে মনে হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে খবরদারি করার দায়িত্ব আরও একটি সংস্থা নিয়েছে, সেটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ। তারা দি ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক (ISSN 1553-8133) নামের প্রতিবেদনে তাদের তালিকাভুক্ত দেশের জনসংখ্যা, অর্থনীতি, সরকার ও সামরিক তথ্য নেয়। আমরা জানি না, তাদের খাতায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত।
যারা জনসংখ্যা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, তারা হিসাব কষে দেখেছে, বিশ্বের জনসংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল ৬.৮ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে হবে ৯.১ বিলিয়ন। ভারতের জনসংখ্যা হবে ১.৭ বিলিয়ন আর চীনে ১.৪ বিলিয়ন, অর্থাৎ ভারতে চীন থেকে বেশি মানুষ হবে। আবার আফ্রিকাতেও জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দুই বিলিয়নে। সর্বনাশ! যদিও বিশ্বে সার্বিকভাবে জন্মহার দম্পতি প্রতি ছয় সন্তান থেকে নেমে হয়েছে ২.১। ধনী দেশের জন্য জন্মহার কমছে, বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, আর গরিব দেশে কম বয়সী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে! স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে (৪৯টি দেশ) ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ বছরের কম, আর তার বিপরীতে ধনী দেশে বেশির ভাগ মানুষের বয়স ৬০ বছরের বেশি!
গরিব দেশে মানুষ বেশি বলেই যে তারা পৃথিবী ধ্বংসের জন্য দায়ী, তা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংগঠন World Watch Institute তাদের State of the World 2010 প্রতিবেদনে বলেছে, ৫০০ মিলিয়ন ধনী মানুষ (৫০ কোটি, পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র সাত শতাংশ) বিশ্বের ৫০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। অন্যদিকে গরিব তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি মানুষ মাত্র ছয় শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে। এই তথ্যে কেউ চিন্তিত হয় না?
মানুষের সংখ্যা বেশি বলে বলপ্রয়োগকারী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ১৯৬৫ সাল থেকে আমরা অনেক দেখেছি। এর ফল হয়েছে নারীর শরীরের ওপর অত্যাচার। চীনে ১৯৭৯ সাল থেকে এক সন্তান নীতি গ্রহণ করে ৪০ কোটি জন্ম রোধ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, কিন্তু কিসের বিনিময়ে? গর্ভে থাকা অবস্থায় কন্যাসন্তান সম্পর্কে জানতে পারলেই গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে। অর্থাৎ, মেয়েদের জন্মাতে দেওয়া হয়নি। বর্তমানে চীনে ২০ বছরের নিচের বয়সের পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় তিন কোটিরও বেশি। তারা বিয়ে করার জন্য মেয়ে পাচ্ছে না। ভারতেও একই ঘটনা ঘটছে। কন্যাভ্রূণ হত্যা এখন একটি বড় সমস্যা।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতির ব্যবহার হয়েছে, কোনো প্রকার বাছ-বিচার ছাড়াই। দাতা বলেছে, সরকার বলেছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাই বিদেশ থেকে আমদানি করা পদ্ধতি নারীর শরীরে প্রয়োগ হয়েছে। গরিব নারীদের ওপর চালানো হয়েছে গবেষণা। পরিণাম এখন উল্টো, বাংলাদেশে বন্ধ্যত্ব মোচনের সঙ্গে জড়িত ক্লিনিকগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বন্ধ্যত্ব বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে। এর কুফলও নারীকেই ভোগ করতে হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি বা টেস্ট টিউব বেবির নামে কিছু ডাক্তার বিপুল অর্থ উপার্জন করছেন, সন্তানের মুখ দেখছে মাত্র ২০ শতাংশ দম্পতি। তারা একটি সন্তানের জন্য আসছে, জন্মাচ্ছে একসঙ্গে তিনটি বা চারটি। হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর কত টেস্ট টিউব শিশু বেঁচে থাকছে, তার খোঁজ কয়জন রাখে? এ বিষয়গুলো ঠিক হচ্ছে কি না, তা দেখার কোনো সংস্থা নেই।
আমি ইদানীং দেখছি, সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠান এবং মন্ত্রী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। দুটি সন্তান যথেষ্ট, একটি হলে আরও ভালো স্লোগান আবার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নারী ও গরিব মানুষকে জিম্মি করে কোনো কর্মসূচি এ দেশের মানুষ আর গ্রহণ করবে না—এ কথা যেন মনে থাকে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
যেদিন বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে দাঁড়াল, সে তারিখ ছিল ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এই দিনটিকে দ্য ডে অব ফাইভ বিলিয়ন হিসেবে পালন করেছিল। এরপর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ১৯৮৯ সাল থেকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। এই হলো সহজভাবে দিবসটি পালনের কথা। বাংলাদেশেও আমরা ভালোই টের পাই।
এসব দিবস পালনের জন্য একটি রীতি দাঁড়িয়েছে, তা হচ্ছে, প্রতিপাদ্য বিষয় থাকা। সে অনুযায়ী এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে এভরিওয়ান কাউন্টস বা প্রত্যেকেই গণনার মধ্যে থাকবে। গণনা ছাড়া নিশ্চয়ই মানুষের সংখ্যা এত দিন জানা যায়নি, তবে এবার একটু বিস্তারিত জানার দিকে গুরুত্ব দিতে চাইছে জাতিসংঘ। নারী-পুরুষ ভাগ তো থাকবেই; তা ছাড়া জাতি, বর্ণ, ধনী, গরিব কত আছে, তা জানার প্রয়োজন আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহসংস্থান করতে হলে জানতে হবে কত মানুষ কী অবস্থায় আছে। অবশ্য আমি একটু অবাক হচ্ছি, এমন একটি বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে জাতিসংঘ এত দেরি কেন করল। তবে তারা এবার নির্ভরযোগ্য তথ্যের কথা বলছে। এর ফলে সঠিকভাবে জানা যাবে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে কারা বাদ পড়ল। তাহলে এত দিনের তথ্য কি নির্ভরযোগ্য ছিল না?
এ বছর জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের উদ্যোগে ৬০টি দেশে ২০১০ সালের মানুষ গণনা বা আদমশুমারি করা হচ্ছে। আদমশুমারি করতে হলে ঘরে ঘরে গিয়ে একেবারে মাথা গোনা ছাড়া পথ নেই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের এই উদ্যোগে বাংলাদেশ আছে কি না, জানা যায়নি। তবে গত ডিসেম্বর (২০০৯) মাসে জলবায়ু সম্মেলন চলাকালে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বাংলাদেশে অবস্থিত জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের কার্যালয় থেকে একটি জনসংখ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, যা কোনো আদমশুমারির মাধ্যমে হয়নি। এবং সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে জনসংখ্যা বেশি হওয়ার বিষয়টি যুক্ত করে দিয়ে একধরনের দোষারোপের কাজই করা হয়েছে। এগুলো অতি পুরোনো কৌশল, এখন আর কাজ হয় না। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের এই দিনে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশে সবাইকে গণনা করা হয়নি। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করেই আমরা ১৬ কোটি!
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অবস্থা হয়েছে ‘গরিবের বউ’ সবার ভাবির মতো। দেশি-বিদেশি সব সংগঠন এসে আমাদের মানুষ গুনে বসে। আমার জানামতে, ২০০১ সালে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের উদ্যোগে (সেটাও তাদের করার কথা নয়, এটা সরকারের কাজ)। তার প্রাথমিক ফলাফল দেওয়া হয়েছে ১৩ কোটি, কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল জানা যায়নি। প্রশ্ন জাগে, এই ফলাফল কি তাদের মনঃপূত হয়নি? অন্য সংস্থার ফলাফল ১৩ কোটি ৩৩ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮৪ জন (২০০২) http://www.discoverybangladesh.com/ meetbangladesh/statistic.html।
বিশ্বব্যাংক ২০০৮ সালে হিসাব করে বলেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১২৮ (World Bank, World Development Indicators; Last updated June 16, 2010)। অর্থাৎ, ছয় বছরে তিন কোটিরও বেশি মানুষ বেড়েছে। এই একই সময়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কিছুটা কমে গেলেও বন্ধ ছিল বলা যাবে না। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও সাধারণ মানুষের পর্যায়ে অনেকটাই এসে গেছে। কাজেই এত বেশি বাড়ার কথা নয়। সারকথা হচ্ছে, কোনোরকম গণনা না করে যে কেউ আমাদের মানুষের সংখ্যা বলে দেবে, তা ঠিক কাজ বলে মনে হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে খবরদারি করার দায়িত্ব আরও একটি সংস্থা নিয়েছে, সেটা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ। তারা দি ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক (ISSN 1553-8133) নামের প্রতিবেদনে তাদের তালিকাভুক্ত দেশের জনসংখ্যা, অর্থনীতি, সরকার ও সামরিক তথ্য নেয়। আমরা জানি না, তাদের খাতায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত।
যারা জনসংখ্যা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, তারা হিসাব কষে দেখেছে, বিশ্বের জনসংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল ৬.৮ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে হবে ৯.১ বিলিয়ন। ভারতের জনসংখ্যা হবে ১.৭ বিলিয়ন আর চীনে ১.৪ বিলিয়ন, অর্থাৎ ভারতে চীন থেকে বেশি মানুষ হবে। আবার আফ্রিকাতেও জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দুই বিলিয়নে। সর্বনাশ! যদিও বিশ্বে সার্বিকভাবে জন্মহার দম্পতি প্রতি ছয় সন্তান থেকে নেমে হয়েছে ২.১। ধনী দেশের জন্য জন্মহার কমছে, বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, আর গরিব দেশে কম বয়সী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে! স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে (৪৯টি দেশ) ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ বছরের কম, আর তার বিপরীতে ধনী দেশে বেশির ভাগ মানুষের বয়স ৬০ বছরের বেশি!
গরিব দেশে মানুষ বেশি বলেই যে তারা পৃথিবী ধ্বংসের জন্য দায়ী, তা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংগঠন World Watch Institute তাদের State of the World 2010 প্রতিবেদনে বলেছে, ৫০০ মিলিয়ন ধনী মানুষ (৫০ কোটি, পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র সাত শতাংশ) বিশ্বের ৫০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। অন্যদিকে গরিব তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি মানুষ মাত্র ছয় শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে। এই তথ্যে কেউ চিন্তিত হয় না?
মানুষের সংখ্যা বেশি বলে বলপ্রয়োগকারী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ১৯৬৫ সাল থেকে আমরা অনেক দেখেছি। এর ফল হয়েছে নারীর শরীরের ওপর অত্যাচার। চীনে ১৯৭৯ সাল থেকে এক সন্তান নীতি গ্রহণ করে ৪০ কোটি জন্ম রোধ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, কিন্তু কিসের বিনিময়ে? গর্ভে থাকা অবস্থায় কন্যাসন্তান সম্পর্কে জানতে পারলেই গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে। অর্থাৎ, মেয়েদের জন্মাতে দেওয়া হয়নি। বর্তমানে চীনে ২০ বছরের নিচের বয়সের পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় তিন কোটিরও বেশি। তারা বিয়ে করার জন্য মেয়ে পাচ্ছে না। ভারতেও একই ঘটনা ঘটছে। কন্যাভ্রূণ হত্যা এখন একটি বড় সমস্যা।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতির ব্যবহার হয়েছে, কোনো প্রকার বাছ-বিচার ছাড়াই। দাতা বলেছে, সরকার বলেছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাই বিদেশ থেকে আমদানি করা পদ্ধতি নারীর শরীরে প্রয়োগ হয়েছে। গরিব নারীদের ওপর চালানো হয়েছে গবেষণা। পরিণাম এখন উল্টো, বাংলাদেশে বন্ধ্যত্ব মোচনের সঙ্গে জড়িত ক্লিনিকগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে বন্ধ্যত্ব বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে। এর কুফলও নারীকেই ভোগ করতে হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি বা টেস্ট টিউব বেবির নামে কিছু ডাক্তার বিপুল অর্থ উপার্জন করছেন, সন্তানের মুখ দেখছে মাত্র ২০ শতাংশ দম্পতি। তারা একটি সন্তানের জন্য আসছে, জন্মাচ্ছে একসঙ্গে তিনটি বা চারটি। হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর কত টেস্ট টিউব শিশু বেঁচে থাকছে, তার খোঁজ কয়জন রাখে? এ বিষয়গুলো ঠিক হচ্ছে কি না, তা দেখার কোনো সংস্থা নেই।
আমি ইদানীং দেখছি, সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠান এবং মন্ত্রী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। দুটি সন্তান যথেষ্ট, একটি হলে আরও ভালো স্লোগান আবার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নারী ও গরিব মানুষকে জিম্মি করে কোনো কর্মসূচি এ দেশের মানুষ আর গ্রহণ করবে না—এ কথা যেন মনে থাকে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments