দুই নম্বর থালাবাসন সমাচার by ইলিরা দেওয়ান

আমি যখন তোমাদের বিদ্যা দান করি, তখন তো আমাকে তোমরা বলো না যে আমি সাঁওতাল, আমার দেওয়া বিদ্যা নেবে না তোমাদের সন্তানেরা। অথচ আমি খেতে চাইলে বলছ, দুই নম্বর থালাবাসন নেই, খাবার দেওয়া যাবে না।’ এ কথাগুলো একজন স্কুলশিক্ষকের, যিনি জাতিতে সাঁওতাল। ৪ জুলাই প্রথম আলোর পাতায় চোখ বোলাতে গিয়ে থমকে গেলাম। একজন স্কুলশিক্ষকের সন্তান হিসেবে আমার বাবাকে যখন এই শিক্ষকের আসনে কল্পনা করলাম, তখন মনে হলো। বারবার মনে হচ্ছিল, আমরা এ কোন দেশে বাস করছি।
রেস্তোরাঁর মালিকের অজ্ঞানতাকে বড় ‘দোষ’ হিসেবে দেখতে চাই না। একই খবরের পরের অংশে পড়লাম, তানোর ডিগ্রি কলেজের ছাত্রাবাসের আদিবাসী ছাত্রদের জন্য নতুন হোস্টেল ‘মনিটর’ আলাদা থালাবাসনের বন্দোবস্ত করেছে। আর কর্তৃপক্ষের এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে হোস্টেলের ১১ জন সাঁওতাল আদিবাসী ছাত্র হোস্টেল ছেড়ে চলে গেছেন। একজন আদিবাসী শিক্ষক (কামেল মারান্ডি) তাঁর বিদ্যাকে জাতপাতের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে আরেক শিক্ষক (মোবারক হোসেন) কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের বীজ বুনে চলেছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির দেশই বটে আমাদের বাংলাদেশ!
দীর্ঘদিন ধরে লালন করা জাতিভেদ মানসিকতার এ চিত্র এটা। বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতি অবজ্ঞার পরিণতি আমরা চাক্ষুস করছি। এতে উৎসাহ জোগায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু বিধিমালা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তিরা। যে বাঙালি শিশুটি অক্ষরজ্ঞান শেখার পাশাপাশি দেশের অন্য জনগোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে শিশুকাল থেকে নেতিবাচক শিক্ষা পায়, সে তো জাতিভেদ সংস্কৃতির মধ্যেই বেড়ে উঠবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে (বিশেষ করে, সমাজবিজ্ঞান) যেকোনো জনগোষ্ঠীর পরিচিতি উপস্থাপনের সময় সে জাতিগোষ্ঠীর ইতিবাচক অতীত ইতিহাসকে (সাঁওতাল বিদ্রোহ, কার্পাস বা চাকমা বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ ইত্যাদি) পাশ কাটিয়ে কেবল তারা কী খায়, কী পরে, কোথায় থাকে ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে বর্ণনা দেওয়া হয়। ফলে বাঙালি ছেলেমেয়েরা এ জনগোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে তাদের চিন্তার ক্ষেত্রটাকে প্রসারিত করতে পারে না। ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে বাঙালি জনগোষ্ঠীর নেতিবাচক, হীন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সামাজিক সচেতনতা ও সর্বোপরি সরকারের সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিবাচক পদক্ষেপ।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচনাকালেই এ দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে জাতীয়ভাবে আত্মপরিচয়ের সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। সংবিধানে সরাসরি এদের কথা উল্লেখ না করে কেবল ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ’ হিসেবে উল্লেখ করে সংবিধানের ১৪, ২৮(৪) ও ২৯ নম্বর ধারায় তাদের অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিধান রাখা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু সংবিধানে এদের অধিকার-সম্পর্কিত অস্পষ্টতার কারণে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। বিদ্যমান ধারাগুলো এ জনগোষ্ঠীগুলোর জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য যথেষ্ট নয়। স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি আজও এ জনগোষ্ঠীগুলোর দাবির অগ্রভাগেই রয়ে গেছে।
সম্প্রতি ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’ নামে একটি আইন প্রণীত হয়েছে, যে আইনের বলে জনগোষ্ঠীগুলো এখন থেকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’রূপে পরিচিত হবে। এ আইন প্রণয়নের আগে বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হলেও যাদের জন্য এ আইন প্রণীত হয়েছে, তাদের মতামত আদৌ নেওয়া হয়নি। ফলে এ আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে এ জনগোষ্ঠীগুলোর মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
তারও আগে, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তিন পার্বত্য জেলা প্রশাসনকে দেওয়া এক চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি ছাড়া অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত না করে ‘উপজাতি’ হিসেবে যেন অভিহিত করা হয়। জাতিগোষ্ঠীগুলোর বারবার পরিচিতি বদলের তৎপরতা শুরু হয়েছে ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন (নং-ইউএনএইচআর ৫০৫১, তাং: ২৫ জুলাই ২০০৫) জারির মধ্য দিয়ে। সে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘Indigenous People’ হলো তারাই, যারা যুগ যুগ ধরে তাদের বর্তমান আবাসভূমিতে বাস করে আসছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Red Indians’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘Aborigines’। এ বিবেচনায় জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ‘Indigenous’ বা ‘আদিবাসী’ না বলে ‘Tribal’ হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করে।
আমাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এ জনগোষ্ঠীগুলোর পরিচিতি নির্ধারণে বারবার বিধিমালা প্রণয়ন বা প্রজ্ঞাপন জারির কারণ কী? যদি আইনই প্রণয়ন করতে হয়, তাহলে এত রাখঢাক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন? প্রজ্ঞাপন আর আইনের জাঁতাকলে পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের পরিচিতি নিয়ে বিপাকে পড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে তারা ‘উপজাতি’, আবার ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’! শুধু বিশেষজ্ঞ দিয়ে পর্যালোচনা না করে দেশের সব জাতিগোষ্ঠী কী পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করাতে চায়, তা যাচাইয়ের জন্য তাদের সামাজিক নেতৃত্বের আগে মতামত নেওয়া উচিত ছিল। এতে এ আইন প্রণয়নে জাতিগোষ্ঠীগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি যেমন থাকত, তেমনি তারা কী পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে চায়, তাও স্পষ্ট হয়ে যেত। এতে আইনটির গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পেত। পরিচিতি চাপিয়ে দিয়ে কোনো জাতিগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য বিকশিত করা সম্ভব নয়।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিকল্প নেই। যত দিন সাংবিধানিকভাবে তাদের অধিকারের কথা বলা হবে না, তত দিন পাহাড় কি সমতলে সর্বত্রই বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়ন অব্যাহত থাকবে। তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রথাগত ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি না দিলে তাদের ধর্ম, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ক্রমে হারিয়ে যাবে।
সাঁওতাল শিক্ষকের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আজ থেকে ১৫৫ বছর আগে দুই বীর সাঁওতাল সহোদর সিদু ও কানুর নেতৃত্বে ‘হুল’ বা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ সূচিত হয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব ও ভূমি রক্ষার তাগিদ এবং স্বাধীনতার জন্য। সিদু-কানুর নেতৃত্বাধীন ‘হুল’-এর কাতারে সেদিন কর্মকার, ডোম, চর্মকারসহ মুসলমানেরাও শামিল হয়েছিল। সেদিন যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন সাঁওতালেরা বুনেছিল, আজ স্বাধীন দেশের মাটিতে সেই সাঁওতালেরা আর দশটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে হোটেলে বসে খাবার গ্রহণের অধিকারটুকুও পাচ্ছে না। কিন্তু সাঁওতালদের আন্দোলনের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এ ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তন কবে হবে?
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.