ইন্টারনেট বন্ধ করে মিথ্যা কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী -জাতিসংঘের রিপোর্ট
১১৪ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, জুলাই বিপ্লবের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের ওপর গভীরভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, ব্যাঙ্কেট শাটডাউন বিশেষ পরিণতি বয়ে আনে। একে কোনোভাবেই বৈধতা দেয়া যায় না। নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা রাষ্ট্র যখন বিঘ্নিত করে তখন তার বৈষম্যমূলক ক্ষতিকর প্রভাব থাকে। তবে জাতীয় নিরাপত্তা এবং জনশৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে এটাকে ব্যতিক্রমভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিদ্যমান আইনের অধীনে দ্ব্যর্থহীনভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে আগে থেকে কোনো আদালত বা নিরপেক্ষ বিচারিক প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু কোনো রকম আগাম ঘোষণা না দিয়ে ১৫ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেয় সরকার। এক্ষেত্রে কোনো বৈধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি। এতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। এ বিষয়ে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওএইচসিএইচআর জানতে পেরেছে যে, ইন্টারনটে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল মন্ত্রী পর্যায় থেকে। তা জাহির করা হয়েছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) মাধ্যমে। অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে তদন্ত করেছে এবং তা ওএইচসিএইচআরের সঙ্গে শেয়ার করেছে, তার সঙ্গে এই তদন্ত মিলে যায়।
রিপোর্টে বলা হয়, ১৪-১৫ই জুলাই রাতে মধ্যরাতের সামান্য পরে মোবাইল অপারেটরদের ঢাকা ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এবং শাহজালাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এসইউএসটি) এলাকার চারপাশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে নির্দেশনা দেয় বিটিআরসি। অনেক ক্ষেত্রে এই বার্তা দেয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজে। ১৫-১৬ জুলাই রাতের বেলা মোট ৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এ বিষয়ে আবারও যোগাযোগ করে বিটিআরসি। ১৭ই জুলাই স্থানীয় সময় দুপুর দেড়টায় এনটিএমসি অপারেটরদের নির্দেশ দেয় ফেসবুক ও ইউটিউব মধ্যরাত থেকে বন্ধ রাখতে। মধ্যরাতের সামান্য পর সব রকম ফোর জি সার্ভিস বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয় এনটিএমসি। একই সঙ্গে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নেয়। ১৮ই জুলাই সন্ধ্যায় বিটিআরসি ক্যাবল কোম্পানি এবং ইন্টারনেট গেটওয়ে সরবরাহকারীদের নির্দেশনা দেয় ব্রডব্যান্ট ইন্টারনেট সুবিধা কর্তন করতে। ফলে ৫ দিন পুরো দেশ ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। জনগণ ব্যাংকিং খাত, স্বাস্থ্য খাত ও অন্যান্য অনলাইনভিত্তিক অত্যাবশ্যক সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। চলমান এই সঙ্কটের সময় তারা প্রিয়জনের কোনো খোঁজখবরও নিতে পারছিলেন না। এই শাটডাউনের কারণে বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতি হয়। একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে ১০০০ কোটি ডলার। ২২শে জুলাই তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক মিটিংয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখার কারণে ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরেন ব্যবসায়ী নেতারা। পরের দিন কিছু এলাকায় প্রথমে ব্রডব্যান্ড খুলে দেয়া হয়। পরে সারাদেশে তা ছাড়া হয়। তবে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ বিষয়ক অ্যাপ্লিকেশনগুলো অব্যাহতভাবে বন্ধই ছিল। ২৮শে জুলাই বিকেল নাগাদ আস্তে আস্তে খুলে দেয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট। তবে ফেসবুক এবং টিকটক তখনও বন্ধ রাখা হয়। ২রা আগস্ট ইনটিএমসির নির্দেশনায় বন্ধ রাখা হয় টেলিগ্রাম এবং ম্যাসেঞ্জার। টু জি-এর বেশি মাত্রার ইন্টারনেট সেবা দেয়া হয় এমন মোবাইল ইন্টারনেট অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে ৪ঠা আগস্ট রাত ৮টার দিকে নির্দেশ দেয় এনটিএমসি। ৫ই আগস্ট সকাল সাড়ে দশটার দিকে ব্রাডব্যান্ড বন্ধ ছিল। ওইদিন আরও পরে পালিয়ে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরেই কেন তা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকারের এই শাটডাউনের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা দেয়া হয়নি। বিবৃতিতে তখনকার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী একটি বিবৃতিতে বিপরীত বর্ণনা দেন। তিনি মিথ্যাভাবে দাবি করেন, সহিংস বিক্ষোভকারীরা ঢাকায় ডাটাসেন্টারে আগুন দেয়ার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে। টেলিযোগাযোগ সেবাদানকারীরা এই ইচ্ছাকৃত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়। সাবেক সরকারি সিনিয়র কর্মকর্তারা এবং এ বিষয়ে জানেন এমন ব্যক্তিরা ওএইচসিএইচআর’কে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রীর বস্তব্য তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ বিষয়ে প্রযুক্তিগত ডাটা এবং বিশেষজ্ঞদের যে বিশ্লেষণ পেয়েছে ওএইচসিএইচআর তাতে দেখা যায়, মন্ত্রীর ওই বক্তব্য মিথ্যা। কারণ, ডাটা বলছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে অব্যাহতভাবে ইন্টারনেট ছিল। যেসব এলাকায় ডাটাসেন্টার অবস্থিত তার আশেপাশে ইন্টারনেট ছিল। আরেক বার সাবেক ওই প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বন্ধ করতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবে।
অন্যদিকে সাবেক একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ফলেই বরং অধিক পরিমাণে ভুয়া তথ্য চড়িয়ে পড়েছিল। ভুয়া তথ্য বন্ধ করার পরিবর্তে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ায় জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ ব্যাহত হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আসলে বড় বিক্ষোভ এবং সহিংস দমনপীড়নকে চাপা দিতে। ১৪ থেকে ১৭ই জুলাই তখনও বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ভয়াবহভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্দেশ দেয় সরকার। এর আগে ব্রডব্যান্ড এবং মোবাইল ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রথমে ১৮ই জুলাই রাতে প্রথম পুরোপুরিভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অধিক পরিমাণ প্রাণঘাতী শক্তি মোতায়েনের নির্দেশ দেয়া হয় নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের। দ্বিতীয় পুরোপুরি শাটডাউন আরোপ করা হয় ৫ই আগস্ট সকালে। ওই সকালে সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল শক্তি প্রয়োগ করে ‘মার্চ অন ঢাকা’ থামাতে। এতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের সহিংসভাবে দমন করতে সরকার অন্যায়ভাবে এবং বেআইনিভাবে শাটডাউন করেছিল। উপরন্তু এর ফলে বিক্ষোভকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সংগঠিত হতে পারছিলেন না।
No comments