আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘আমি একজন কবি ছাড়া এক সুতোও ওপরে কিছু নই’ by সালেহ উদ্দিন আহমদ

আজ সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের মৃত্যুদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা।

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সাল। আল মাহমুদ মারা গেলেন। আমি তখন ঢাকায়। চোখ রাখলাম পত্রিকার পাতায়, কে কী লিখলেন এবং কে কী শোকবার্তা দিলেন। না, কেউ তেমন কিছু করলেন না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি—কারও কোনো বাণী দেখলাম না।

তখন ঢাকায় একুশের বইমেলা চলছিল। বইমেলায় গেলাম। সেখানেও আনুষ্ঠানিকভাবে আল মাহমুদের জন্য তেমনভাবে কোনো শোক প্রকাশ চোখে পড়ল না। একটা জায়গায় প্যান্ডেল টানিয়ে সভা হচ্ছে। গিয়ে দেখলাম, একজন রাজনৈতিক নেতার জীবনদর্শন নিয়ে কেউ একটা বই লিখেছেন, তারই মহরত। আল মাহমুদের একটা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন’ কিনে ফিরে এলাম। ভাবলাম, আমি আর কী করতে পারি? রাতে বাড়িতে এসে আনাড়ি হাতে একটা কবিতা লিখলাম। তারপর আল মাহমুদের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংকলন খুলে বসলাম। একজন কবিকে শ্রদ্ধাতে তাঁর কবিতা পড়া ছাড়া উপায় কী!

আল মাহমুদ মনে করতেন, কবিতাঙ্গনে তাঁর কাজের জন্য তিনি যথেষ্ট স্বীকৃতি পাননি। তিনি তাঁর কবিতাতেই এ নিয়ে অভিযোগ করে গেছেন:

‘ধৈর্য ধরে থেকেছি বহুকাল

খাতির ধাপে উঠল বুঝি পা,

ভিতর থেকে বিমুখ মহাকাল

বলল, নারে, এখনো নয়, না।’

—‘ধৈর্য’: আল মাহমুদ

আল মাহমুদের কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় সমকাল–এর সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে। তখন আমি ঢাকা কলেজে পড়ি। নিয়মমাফিক যেতাম নিউমার্কেটের নলেজ হোম নামের বইয়ের দোকানে বইয়ের চেয়ে পত্র–পত্রিকার আকর্ষণে। ছোট– বড় সব পত্রিকাই রাখতেন এ দোকানের স্বত্বাধিকারী মজলিশ সাহেব। যাঁরা তাঁর দোকানে যেতেন, কেনাকাটার চেয়ে ঘাঁটাঘাঁটিই করতেন বেশি, কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পড়তেন, যেন এদিনের ‘ব্যারনস অ্যান্ড নোবলেস’। মজলিশ সাহেব কখনো বাধা দিতেন না, পুনরায় ম্যাগাজিনগুলো ঠিকঠাক করে রাখতেন।

আমার বড় আকর্ষণ ছিল সিকান্দর আবু জাফরের সম্পাদনায় সাহিত্য পত্রিকা সমকাল। তখন প্রতি মাসেই নিয়মিত বের হতো, ঝকঝকে প্রচ্ছদ, তিন পাশে আধা ইঞ্চি বাড়তি মলাট ভেতরের লেখাগুলোর লজ্জা ঢেকে রাখত, খুললেই নতুন কাগজের গন্ধ অদ্ভুত অনুভূতি জাগাত। পত্রিকাটি একজন কবির অনেকগুলো কবিতা একই সংখ্যায় প্রকাশ করে কবিকে নিবিড়ভাবে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করে দিত। সিকান্দর আবু জাফরের কথা বলতে গেলে আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। তাই তাঁকে নিয়ে আলোচনা অন্য সময়ের জন্য সরিয়ে রাখলাম। তো সেদিন সমকাল খুলে আল মাহমুদের কবিতাগুলো পড়লাম, একবার–দুইবার নয়, অনেকবার। পরিচয় হলো আমার অপরিচিত এক কবির সঙ্গে। সেই থেকে আল মাহমুদ হয়ে গেলেন আমার প্রিয় কবি এবং আরও অনেকের প্রিয় কবি। বাংলাদেশের শীর্ষ এক কবি।

কবিতা ও প্রেমের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেননি তিনি।

‘আধুনিক কবিতা বলতে আপনি কী বোঝেন?

আমি বলি, সে তো লালমাটিয়া মহিলা কলেজে

এখন মেয়েদের বাংলা পড়ায় আর পরীক্ষার খাতা দেখে

নিজের নৈসঙ্গ যাপন করছে।’

—‘আধুনিক কবিতা’: আল মাহমুদ

আল মাহমুদ বেঁচে থাকতেই বাংলাদেশে হাজারবার প্রশ্ন উঠেছে, ‘সোনালি কাবিন’–এর এই কবি কি রাজনীতি করতেন? তিনি কি জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন? তিনি কি ইসলামিক রাজনীতির সপক্ষে কাজ করেছিলেন? তিনি কি টাকা নিয়ে ফরমায়েশি লেখা লিখতেন? এসব প্রশ্ন যাঁরা করতেন, তাঁদের বলা যায়, আপনারা কি কখনো এ প্রশ্নও করেছিলেন, আল মাহমুদ অনেক ভালো কবিতা লিখতেন কি না?

একজন কবির পোশাকের কোনো দাম নেই। তিনি চে গুয়েভারার পোশাক পরলেই বিপ্লবী বনে যাবেন না, কিংবা আচকান টুপি পরলেই যে তিনি ধর্মে ঝুঁকবেন, এমনও নয়। তিনি জামা বদলাবেন, মত বদলাবেন, মোদ্দাকথা তিনি তাঁর অধিকার চর্চা করবেন। কিন্তু তিনি তাঁর কবিতা বদলাবেন না। আপনি কি দেখেছেন, ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার দ্বিতীয় সংস্করণ? হ্যাঁ, এই বইয়ের সংস্করণ হয়েছে, কিন্তু কবিতার নয়।

একজন কবির কাছে জীবনটাই একরকম এক্সপেরিমেন্ট। যেমন একটা গাছ তার পাতার রং বদলায় বারবার আপন সৌন্দর্য ছড়াতে, আবার কখনোবা নিজের বাঁচার প্রয়োজনে; কিন্তু গাছটা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নিজের শিকড় আঁকড়ে। কবি আল মাহমুদও তেমন।

আল মাহমুদ চিরদিনই থাকবেন প্রেম, সুন্দর ও আনন্দের কবি হিসেবে। তিনি কবিতা লিখেছেন ইসলামের নবী (সা.)–কে নিয়ে, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে লিখেছেন ‘ভাসানী স্মৃতি’, লিখেছেন ‘কৃষ্ণকীর্তন’। কিন্তু আধুনিকতাই তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য।

মুক্তিযুদ্ধের পরপর ১৯৭২ সালে কয়েকজন যুবক কবিকে বের করে এনেছিল পত্রিকার বেজমেন্ট থেকে, হয়তোবা নিজেদের প্রয়োজনে। আল মাহমুদকে যখন জসদের গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক বানানো হলো, তিনি মনের আনন্দে ফিদেল কাস্ত্রোর পোশাকে ঘুরে বেড়াতেন। সবাই বলতেন, তিনি বিপ্লবী হয়ে গেছেন। সম্ভবত গণকণ্ঠ পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর তিনি রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ, কমিউনিজম, ইসলামি রাজনীতি, বুর্জোয়া গণতন্ত্র—এসব নিয়ে নানা সময়ে তিনি বিভিন্ন কথা বলেছেন। খুব গভীর চিন্তা থেকে রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলেছেন, সব সময় এমন না–ও হতে পারে। তিনি তো নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি অত রাজনীতি–সচতেন নই।’ তবে পরিতাপের বিষয় হলো, তাঁকে নিয়ে ‘রাজনীতি’ করার জন্যই অনেকে এ কবির কথাবার্তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

চিরদিন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন আল মাহমুদ। নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘খুব দুঃখপূর্ণ জীবন। একটা দরিদ্র লোকের জীবন যেমন হয়।’ শেষ বয়েসে তিনি হয়তো চেয়েছিলেন একটা সুন্দর ছোট্ট ঘর, যেখানে ভোরের রোদ উষ্ণতা ছড়াবে আর বসন্তের বাতাস হাওয়া দেবে। আরও থাকবে একটা টেবিল ও চেয়ার। এখানে বসে তিনি কবিতা লিখবেন। এ জন্য তাঁকে অনেক প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল। একজন কবিকে কে লালন করবে? কবিতা লিখে একজন কবি কি বেজমেন্ট থেকে খোলা ছাদে উঠতে পারবেন? রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতায় দেখেছি কবির স্ত্রীর বিড়ম্বনা:

‘রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,

রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,

মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,

তার খোঁজ রাখো কি!’

সাহিত্যিক রাজু আলাউদ্দিন ২০১৩ সালের এক সাক্ষাৎকারে খুবই ভদ্রভাবে অনেক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন আল মাহমুদকে। আল মাহমুদ কোনোটার উত্তর দিয়েছেন, কোনো কোনোটাতে ছিলেন খুব আত্মরক্ষামূলক, আবার কোনোটাতে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন না করাই ভালো…।’ সত্যি তো, কী আর বলবেন তিনি? রাজু তো তাঁকে আধুনিক কবিতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। বলার বিষয় হলো, এসব আবার নিজের কবিতাতেও এনেছিলেন পঞ্চাশের দশকের এই শক্তিমান কবি:

‘প্রশ্নকারীরা আজকাল আমাকে খুব উত্ত্যক্ত করে মারে।

ভদ্রতার খ্যাতির আমি তাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে থাকি।

আধুনিক কবিতা বলতে আপনি কী বোঝেন?’

—‘আধুনিক কবিতা’: আল মাহমুদ

অথবা তিনি কি সেই ‘সোনালি কাবিন’–এর মধ্যে তো দিয়ে গেছেন সব প্রশ্নের উত্তর:

‘আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি

আহত বিক্ষত করে চারিদিকে চতুর ভ্রুকুটি।’

আল মাহমুদকে কেউ কেউ দুই ভাগ করেছেন, যেমন তাঁর ১৯৭০ পর্যন্ত কবিতাগুলো তাঁরা স্বীকার করেন, পরেরগুলো নয়। তবে আমার মতে, কবিতা হলো কবিতাই, কবিতার সঙ্গে ভাব ও মতের লেবেল লাগিয়ে তা স্বীকার-অস্বীকারের বিষয় নয়। প্রথমত কবিতা হলো ভালো লাগার, ভালোবাসার। সচরাচর রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আমরা খুলি না, যেগুলো ভালো লাগে, সেগুলোই বারবার পড়ি। কমিউনিস্ট না হয়েও অনেকে নাজিম হিকমত আর সুকান্তের কবিতা পড়েন। কেন? ওই যে ভালো লাগার খাতিরে।

রাজু আলাউদ্দিনের নেওয়া সাক্ষাৎকারটিতে আল মাহমুদ নিজেই বলেছেন, ‘আমি একজন কবি ছাড়া এক সুতোও ওপরে কিছু নই।’

আল মাহমুদ সম্বন্ধে এটাই শেষ কথা। আজ তাঁর প্রায়াণদিবসে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

কবি আল মাহমুদ
কবি আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬—১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) ছবি: নাসির আলী মামুন

No comments

Powered by Blogger.