জাতিসংঘের দলিল: হাসিনাকে আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল, তিনি পাত্তা দেননি

ছাত্রদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন সম্পর্কে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে অবহিত করেছিলেন সিনিয়র গোয়েন্দা এবং সরকারি কর্মকর্তারা। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদেরকে পাত্তা দেননি। তার সরকার উল্টো প্রতিবাদী ছাত্রদের আন্দোলনে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। তাদেরকে অবৈধ করার চেষ্টা করে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের অফিস (ওএইচসিএইচআর) ১১৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ওই রিপোর্ট প্রকাশ করে। একে জাতিসংঘের একটি অনন্য দলিল হিসেবে দেখা হয়। শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করেছিলেন এমন সরকারি কর্মকর্তা ও সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাক্ষাৎকারে উপরোক্ত তথ্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ২০২৪ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলন ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় সরকারের ক্ষমতায় থাকার বিরুদ্ধে একটি বড় রাজনৈতিক হুমকি হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে তারা শেখ হাসিনাকে জানিয়েছিলেন। তারা সতর্ক করেছিলেন যে, ছাত্রদের এই আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যুক্ত হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সমস্যার সমাধানের জন্য দ্রুততার সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে। কিন্তু শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান নেন। তিনি সিনিয়র কর্মকর্তাদের প্রাইভেটলি বলেন, শিক্ষার্থী জানতে পারবে যে তাদের প্রতিবাদ বিফলে যাবে। ৭ই জুলাই তিনি প্রকাশ্যে বলেন যে, হাইকোর্টের রায়ের পর কোটাবিরোধী আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে ছাত্রদের আন্দোলনে বিরোধীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে নিন্দা জানাতে শুরু করেন। সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- তখনকার ডিজিএফআই মহাপরিচালক ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে ১০-১১ই জুলাই রাতের বেলা মিটিং করেন শেখ হাসিনা। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গোপনে সমঝোতা করার জন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে কর্তৃত্ব দেন হাসিনা।  ১১ই জুলাই বর্তমানে নিষিদ্ধ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন দৃশ্যত একটি হুমকি দেন। তিনি বলেন- কেউ কেউ এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। তাদের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ছাত্রলীগ। একই দিনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভে পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করে। লাঠিচার্জ করে। কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। শাহবাগে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চট্টগ্রামে ছাত্রদের বিক্ষোভের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ। ১৩ই জুলাই প্রতিবাদ বিক্ষোভে অনুপ্রবেশের বিষয়ে পুলিশি তদন্তের ঘোষণা দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ। ২০২৪ সালের ১৪ই জুলাই তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো উত্তেজনা ছড়িয়ে দেন একটি বক্তব্যের মাধ্যমে। তিনি বলেন, তাদের (ছাত্র আন্দোলনকারীরা) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এত ক্ষোভ কেন? যদি মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা সুবিধা না পায়, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা সেই সুবিধা পাবে?

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ব্যক্তিগতভাবে আহত হন ছাত্ররা। একই দিন সন্ধ্যায় বিপুল সংখ্যক ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করেন। তারা স্লোগান দেন- তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার। এই স্লোগানে র‌্যালি থেকে যেন কান্না ভেসে আসতে থাকে। পরে তারা এই স্লোগানকে আরো পরিষ্কার করে। যুক্ত করে- কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রী প্রতিবাদে যোগ দিতে রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে বেরিয়ে আসেন। শিক্ষার্থীদের রাজাকার স্লোগানের জবাবে সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলতে থাকেন যে, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মেনে নেয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। ১৪ই জুলাই তখনকার শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল চৌধুরী বলেন, এসব বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি সম্মান দেখানো রাষ্ট্রের পক্ষে আর সম্ভব নয়। এ সময় তিনি বিক্ষোভকারীদের এ যুগের রাজাকার আখ্যায়িত করেন। তখনকার তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত ঘোষণা দেন- যারা রাজাকার হতে চায়, তাদের কোনো দাবিই মেনে নেয়া হবে না। একইভাবে তখনকার সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী দিপু মনি ইঙ্গিত দেন যে, যারা নিজেদেরকে রাজাকার হিসেবে পরিচয় দিয়েছে তাদের মাথায় ওই (বাংলাদেশের) পতাকা বেঁধে মার্চ করার কোনো অধিকার নেই।
একপর্যায়ে ছাত্রলীগ, পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। ১৪ই জুলাই সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র কর্মকর্তারা মাঠে নেমে পড়েন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে পরবর্তী দুই দিন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালানোর উস্কানি দেন। ছাত্ররা তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকেন। মাঝে মাঝে ছাত্রলীড়ের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। ওএইচসিএইচআর যেসব তথ্য পেয়েছে তাতে বলা হয়েছে, এসব পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। সাবেক একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ওএইচসিএইচআরকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, আমাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের আহ্বানের ভিত্তিতে আমাদের ছাত্ররা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়। যা ঘটেছে তা অপ্রত্যাশিত। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা লড়াই করেছে। ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ বিক্ষোভকে দমিয়ে রাখতে একা ছাত্রলীগের যথেষ্ট শক্তি ছিল না। ফলে পুলিশ অধিক শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ও বাইরে পুলিশ কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। এর মধ্যে আছে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট। তবে তাদের কাছে প্রাণঘাতী ধাতব গুলি লোড করা শটান ছিল। এ সময় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকরা পুলিশের সহায়তায় হামলা চালায়। শুধু ১৬ই জুলাই নিহত হন ৬ জন। তার মধ্যে অন্যতম রংপুরের আবু সাঈদ। তাকে হত্যার ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পর আন্দোলন আরো ক্ষিপ্রতা পায়। যুক্ত হন বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.