বছরে ২ লাখ কোটি টাকা পাচার: অর্থনীতির শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট জমা

অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। প্রতি ডলার ১২০ টাকা দরে দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। গতকাল শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রমুখ।

শ্বেতপত্র প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে বলে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রস্তাবিত শ্বেতপত্রে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার আওতায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি ব্যয় (সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি ও ঋণ) এবং বাজেট ঘাটতির অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উৎপাদন, সরকারি সংগ্রহ এবং খাদ্য বণ্টন ছাড়াও রপ্তানি, আমদানি, রেমিট্যান্স, এফডিআই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ ও বৈদেশিক অর্থ প্রবাহের বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ ছাড়া চাহিদা, সরবরাহ, মূল্য নির্ধারণ, খরচ ও ক্রয় চুক্তিসহ ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রেডিট, বিদ্যুৎ, সংযোগ এবং লজিস্টিকসে অ্যাক্সেস ছাড়াও দেশ ও বিদেশে কর্মসংস্থান, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মজুরি এবং যুব কর্মসংস্থানের বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
প্রতিবেদন গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই প্রতিবেদন আমাদের জন্য একটা ঐতিহাসিক দলিল। আর্থিক খাতে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা ছিল একটা আতঙ্কিত বিষয়। আমাদের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেউ এটা নিয়ে কথা বলেননি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কমিটির প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে। প্রতিবেদন জমার সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তিনি অর্থনীতি সংস্কারে সব পদক্ষেপ সমন্বিতভাবে পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনের সুপারিশ করেছেন। ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করেছি এবং সরকারের কোনো প্রভাব ছিল না। শ্বেতপত্রটি ৩০টি অধ্যায়ে এবং ৪০০ পৃষ্ঠার বিশদ বিবরণীসহ প্রকাশিত হবে বলেও জানান তিনি।

বিগত সরকারের শাসনামলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত এই শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সময় বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি, লুটপাট ও পরিসংখ্যানগত কারসাজির মাত্রা ছিল ভয়াবহ।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা ২৯টি বড় প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বিশ্লেষণ করেছেন। প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা পরে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। কমিটির অন্য সদস্য প্রফেসর একে এনামুল হক বলেন, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে, যার ৪০ শতাংশ লুটপাট হয়েছে।

কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ জানান, কর মওকুফের পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপি’র ছয় শতাংশ। এর পরিমাণ অর্ধেক কমালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট দ্বিগুণ-তিনগুণ করা যেত।

উল্লেখ্য, গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কমিটি বিভিন্ন দলিলপত্র পর্যালোচনা করে ও নানা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। সেই ধারাবাহিকতায় রোববার ওই কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.