বিচার রাজনীতিকরণ হওয়া উচিত নয় -শিশির মনির by শরিফ রুবেল

২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা-মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির মানবজমিনকে বলেছেন, কোনো অপরাধ অথবা কোনো বিচার, এমনকি কোনো তদন্ত প্রক্রিয়াকেও কখনো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে যার যতটুকু অপরাধ আছে তাকে যদি সঠিকভাবে আইডেন্টিফাই করা যায়, তবে তার ততকুটুই বিচার করা উচিত। ততটুকু সাজা দেয়া উচিত। এখানে পরিকল্পিতভাবে ও রাগের বশবর্তী হয়ে যদি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা হয় অথবা কাউকে যদি রাজনৈতিকভাবে শিক্ষা দেয়ার জন্য শাস্তি দেয়া হয় তাহলে এর শেষ পরিণতি কারও জন্যই ভালো হবে না। এতে যার যখন সুযোগ হবে, সে তখন তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করবেন।

২১শে আগস্টের ঘটনা থেকে সকলকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আমি মনে করি বিচারিক প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের যে অভিপ্রায় চলমান আছে, তা থেকে সকলের সরে আসা উচিত। বিচারকে বিচারের মতো করে চলতে দিতে হবে। এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মোটেও সমীচীন নয়। কোনো বিচারকে কখনো রাজনীতিকরণ করা উচিত নয়। কোনো হত্যাকাণ্ড বা মামলা যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলকভাবে বিচার করা হয়, তাহলে মামলার প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে থেকে যায়। শাস্তি থেকে পার পেয়ে যায়। গ্রেনেড হামলা প্রসঙ্গ টেনে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ২১শে আগস্টের ঘটনা দেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিরল। ২০০৪ সালে যখন এই ঘটনাটি ঘটেছে, তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুনামি ঘটেছিল। এই ধরনের ঘটনা দেশের জন্য মোটেও কাম্য নয়। এই ধরনের ঘটনা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের জন্যও সুখকর নয়। তারপরেও এই ঘটনা ঘটেছে। আমরা ২১শে আগস্ট মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় গিয়ে দুটি তদন্ত রিপোর্ট দেখেছি। একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে মঈনুদ্দিন- ফখরুদ্দীন সরকার। আরেকটি দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। ২০০৮ সালের তদন্তে ২৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার তদন্ত রিপোর্টে আরও ৩০ জনকে এজাহারভুক্ত করা হয়। এটাই বিচারের অন্যতম ভুল ছিল। মূলত মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে এদেরকে আসামি করা হয়। এখানেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেমন তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, কায়কোবাদসহ আরও অনেককে আসামির তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। মুফতি হান্নান প্রথমে একটি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। পরে সেটা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি দ্বিতীয়বার স্বীকারোক্তি দেন। সেটাও পরে প্রত্যাহার করে নেন। ওই স্বীকারোক্তি ছিল দীর্ঘদিন অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা। প্রায় ৪১০ দিন তাকে টিএফআই সেলে রেখে নির্যাতন করে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করা হয়। যা বিচার বিভাগের জন্য একটি কালো অধ্যায়। তারপরে ওই নির্যাতনে আদায় করা স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করেই সাজা দেয়া হয়। আর এই পুরো কাজটি সফলতার সঙ্গে শেষ করেন শেখ হাসিনার নিয়োগ করা তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দ। যিনি পরে আওয়ামী লীগ সরকারের নৌকার মনোনয়ন পান। নির্বাচনও করেন। তারেক রহমানকে জড়ানোর কারণে কাহহার আকন্দকে নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়। আমি একটি কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা গল্প সাজিয়ে অপরাধের সঙ্গে জড়ানোর যে অপচেষ্টা, এটা দেশের জন্য একটি বড় ধরনের অশনি সংকেত। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটির ফলে রাজনীতির প্রতি মানুষকে বিমুখ করে তুলবে। রাজনীতি যদি এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক হয় তাহলে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হবে। কেউ আর রাজনীতিতে আসতে চাইবে না। তদন্ত পাল্টে দেয়ার বিষয়ে এডভোকেট শিশির মনির বলেন, এই মামলায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো প্রথম চার্জশিট দেয়ার পরে ৬১ জন সাক্ষীর জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে যাওয়ার পরেও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পুনরায় তদন্ত দেয়া। এটা বিচার বিভাগের জন্য নজিরবিহীন। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে আর ঘটেনি। এমন ঘটনা একমাত্র এই মামলায় হয়েছে, একইভাবে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা কাহহার আকন্দের বিষয়ে আসামিরা কোনো পদক্ষেপ নিবে কিনা জানতে চাওয়া হলে এই আইনজীবী বলেন, আসলে আপিলে তদন্ত কর্মকর্তার বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু চাওয়া যায় না। তবে তার মিথ্যা তদন্ত রিপোর্টে যারা এতদিন জেলে ছিলেন, সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করেছেন, ফাঁসির সেলে থেকেছেন, জীবন থেকে ১৩ বছর সময় হারিয়েছেন তারা আলাদাভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। বিচার চাইতে পারেন। তারা রাষ্ট্রের কাছে এর ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন। তদন্ত কর্মকর্তার শাস্তি চাইতে পারবেন। পরিশেষে বলবো, একটি বিচারকে রাজনীতিকরণ এবং আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে রাজনীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার যে রেওয়াজ তৈরি হয়েছে সেখান থেকে দ্রুত সরে আসতে হবে। এটা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পদক্ষেপ। সাক্ষীকে যদি ২০০ দিন ৩০০ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করে জোরপূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। এবং সেই স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে সাজা দেয়া হয়, তাহলে সবাই খালাস পাবে এটাই স্বাভাবিক। অপরাধীরাও পার পেয়ে যাবেন। এতে অপরাধ আরও বাড়বে ছাড়া কমবে না।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.