গুলিতে মৃত্যু: বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করতে চেয়েছিলেন আরিফ by ফাহিমা আক্তার সুমি

আরিফ হোসেন। আঠারো বছরের এই তরুণ গত ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হন। তার ডান চোখের নিচে গুলিটি বিদ্ধ হয়ে মাথার পেছন  দিক থেকে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আরিফ চতুর্থ। সে তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান। পড়তেন ভোলার লালমোহনের একটি মাদ্রাসায়। তার বাবা কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। আরিফ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কষ্ট ঘোচাতে এসেছিলেন ঢাকায়। অভাবের সংসারে হাল ধরতে যাত্রাবাড়ীর একটি খাবারের হোটেলে চাকরিও নিয়েছিলেন। পরিবারকে নিয়ে সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি তার। সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার বাবা-মা। বোনেরা তাদের একমাত্র ভাইকে দিন-রাত খুঁজে ফিরছেন।

আরিফের বাবা মো. ইউসুফ মানবজমিনকে বলেন, আমার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল আরিফ। তার চিন্তায় একেবারে ভেঙে পড়েছি। ওর মা সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে, এখনো ঠিকমতো খেতে চায় না। অভাবের সংসারে পরিবারের হাল ধরতে তাকে ঢাকা পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে হোটেলে কাজ করতো। শেষ ঢাকায় যাওয়ার ১৭-১৮ দিন পর গুলিতে মারা যায়। আরিফ ভোলার লালমোহনে একটি মাদ্রাসায় পড়তো। আমি কোনোমতে কৃষিকাজ করে সন্তানগুলোকে বড় করেছি। সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো, সন্তানদের পড়াশোনার অনেক খরচ হতো। এদিকে আমার দুই মেয়ে এখনো পড়াশোনা করে- সবমিলিয়ে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। আমার ছয় সন্তানের মধ্যে আরিফ একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। আমি চেয়েছিলাম আমার সন্তান ঢাকায় চাকরি করে আমাকে সহযোগিতা করবে, আমি কখনো ভাবিনি আমার সন্তান এভাবে হারিয়ে যাবে। এটা যদি জানতাম তাহলে আমার হাজার কষ্ট হলেও আমি তাকে ঢাকায় পাঠাতাম না। গ্রামে রেখেই আমি কাজ করে তাকে পড়াশোনা শেষ করাতাম। আরিফও চাইতো আমাদের সংসারের অভাব ঘোচাতে।

তিনি আরও বলেন, ওর মাকে কোনোভাবে বুঝাতে পারছি না; তাকে নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকতে হয়। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে। আমিও বয়সের কারণে বিভিন্নভাবে অসুস্থ। এখন বেশি পরিশ্রমের কাজ করতে পারি না। দুইটা মেয়ে এখনো পড়াশোনা করছে; আমি একা কীভাবে তাদের সামলাবো। সরকার যদি আমার মেয়েদের দিকে একটু সুদৃষ্টি দেন তাহলে আমাদের পরিবারের জন্য অনেক ভালো হবে। হয়তো ছেলে সন্তানের অভাব পূরণ হবে না কিন্তু আমি মেয়েদেরও মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। আরিফ থাকলে তো আমাদের এই বয়সে এসে মেয়েদের জন্য চিন্তা করতে হতো না- সে সবই সামলে নিতো। আমি মাঠে-ঘাটে কাজ করলেও আমার সন্তানদের পড়াশোনা করিয়েছি। ওর মা চিন্তা করে মেয়েরা তো সব শ্বশুর বাড়িতে চলে যাবে; বৃদ্ধ বয়সে আমাদের কী হবে। আরিফ ছোটবেলা থেকে অনেক ভদ্র-শান্ত স্বভাবের ছিল। সে খেলাধুলায় অনেক সময় দিতো।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরিফের মামাতো ভাই সাহাবউদ্দিন বলেন, গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার দুপুরের পর নামাজ ও খাওয়া-দাওয়া শেষে আরিফ যাত্রাবাড়ীতে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যায়। কিছুক্ষণ পরে সেখানে থাকা শিক্ষার্থীরা খবর দেন আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা না পেয়ে আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে নেয়ার পরে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গুলিটি তার ডান চোখের নিচ থেকে ঢুকে মাথার পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। আরিফ কোরবানির ঈদের পরে ঢাকায় এসে ঢাকার যাত্রবাড়ীতে একটি খাবার হোটেলে চাকরি নেয়। ওর বাবা কৃষিকাজ করে সংসার চালান। বর্তমানে বয়সের ভারে তেমন কিছু করতে পারেন না। সন্তান হারানোর শোকে এখন বাবা-মা দুজনেই অনেকটা ভেঙে পড়েছেন। এত দ্রুত কি সন্তান হারানোর শোক পরিবার ভুলতে পারে। বোনগুলোও অনেক ভেঙে পড়েছে। পাঁচবোনের একমাত্র ভাই ছিল আরিফ। ওর বাবা-মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল আরবি লাইনে পড়াশোনা শেষ করানোর। বাবার কষ্ট দেখে আরিফের স্বপ্ন ছিল ঢাকায় এসে চাকরি করবে- সেই টাকা দিয়ে বাবা-মা ও বোনকে দেখবে, নিজের পড়াশোনার খরচ চালাবে। ১৯শে জুলাইয়ের আগেও সে আন্দোলনে গিয়েছিল কিন্তু এইদিন আর ফিরে আসেনি।

তিনি বলেন, আরিফ আমার সঙ্গেই ঢাকায় থাকতো। ভাইবোনের মধ্যে ও ছিল চতুর্থ। ঘটনার দিনে আমরা একসঙ্গে দুপুরে নামাজ পড়ে খাবার খেয়েছি। ওইদিন আন্দোলনে যাবে সেটি জানতাম কিন্তু গিয়েছিল এটি আর জানতাম না। বিকাল তিনটার দিকে আমার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর আসে। সেদিন ঘটনাস্থলেই গুলিতে সে মারা যায়। পরের দিন রাত নয়টায় তার মরদেহ হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি ভোলাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওর বাবা-মা এখনো কাঁদতে থাকে সন্তানের স্মৃতি নিয়ে। তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, কাকে নিয়ে থাকবে- সেই চিন্তা করে দিন-রাত পার করেন। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.