লেজেগোবরে আইনশৃঙ্খলা by মরিয়ম চম্পা

ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দেশের শাসন ক্ষমতায় পরিবর্তনের পর থেকেই চারদিকে অস্থিরতা। দাবি-দাওয়া, হাহাকার তুলে মাঠে স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারা সক্রিয়। যারপর নাই চাপ তৈরি করছে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। এখনই তাদের সবার সব দাবি পূরণ করতে হবে। দাবি-দাওয়া পার্টির কারণে দেশ জুড়ে যখন তখন সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনার তরুণ ছাত্রদের আন্তঃক্যাম্পাস কলহ। এটা এক নৈরাজ্যকর অবস্থার জানান দিচ্ছে। কলেজে কলেজে সংঘর্ষ থামাতে উদ্যোগী হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সচিবালয়ের সবচেয়ে উঁচু ভবনে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। সেই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় উস্কানিদাতাদের খুঁজে বের করতে মাঠে সরকারি সংস্থাগুলো। যখন অবস্থা তখন আচমকা সক্রিয় সনাতনীরা। তাদের জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারে উদ্বেগ ছড়িয়েছে সীমান্তের ওপারেও। রক্তাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বিবাদীর সমর্থকরা। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভুল-নীতি কৌশলের কারণেই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আজ এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সরকারের সকাল-বিকাল আদেশ- নিষেধ পরিবর্তন এবং সিদ্ধান্তহীনতাই এর জন্য দায়ী। আইনশৃঙ্খলা রীতিমতো লেজেগোবরে অবস্থা! তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বরতদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। বলাবলি আছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নির্দেশনা আসে অন্য উপদেষ্টা ও দপ্তর থেকে। মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত অবস্থান করে অভিভাবকহীনতার প্রমাণও মিলে। ওই সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) সদ্য নিয়োগ পাওয়া মো. খোদা বকস চৌধুরীকে মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায়নি। তারা মিটিংয়ের কাজে বাইরে ছিলেন বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র সূত্র। এদিন ঢাকার বাইরে ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বুধবারও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অফিস করে বেরিয়ে যান উপদেষ্টা।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তর কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কোন কৌশলে এগোচ্ছে? এ বিষয়ে জানতে কথা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি মাসের শুরুর দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মো. খোদা বকস চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) নিয়োগ দেয়া হয়। এর কিছুদিন পর নতুন করে আইজিপি এবং ডিএমপি কমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়। এত কিছুর পরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি অনুবিভাগ) নাসির-উদ-দৌলা মানবজমিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা-সচিবের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে আরেক যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, তারা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে কথা বলেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সিনিয়র সচিব গণমাধ্যমে কেন কথা বলছেন না- এটা একান্ত তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বিগত আইজিপি এবং ডিএমপি কমিশনার দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছেন। এ সময় সদর দপ্তরে নানান বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নতুন করে আইজিপি এবং ডিএমপি কমিশনার নিয়োগ দেয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। সাম্প্রতিক ইস্যুতে সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডিএমপিসহ সকল বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ডিএমপিসহ বিভাগীয় শহরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে চেকপোস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মসজিদ-মন্দির-গির্জা ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিশেষ টহলের ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কেউ আইন এবং রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করলে তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না। জিরো টলারেন্স। অপরাধীরা কোন রাজনৈতিক দল-মতের সেটা বিবেচনা করা হবে না। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর মানবজমিনকে বলেন, পুলিশকে মাঠ পর্যায়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কেউ আইন ভঙ্গ করলে কিংবা জনজীবনে ব্যত্যয় ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মাঠ পর্যায়ে সকল কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সচিব মমিনউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যস্ত কাকে বদলি, ওএসডি, কাকে পদায়ন করবেন এটা নিয়ে। পুলিশে এত ঘনঘন বদলি করার দরকার ছিল না। মাঠ পর্যায়ে পুলিশের অনেকেই আতঙ্কের মধ্যে আছেন। কে কখন বদলি, ওএসডি- গ্রেপ্তার হন। পুলিশের মধ্য থেকে এই ভীতি দূর করে তাদের মধ্যে মনোবল ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও মনোযোগী হতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) মো. খোদা বকস চৌধুরীকে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপদেষ্টা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা টোট্যালি ফেলিওর। তিনি কিন্তু যেসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করলে সাধারণ মানুষ খুশি হবে সেটা করছেন না। এবং করেন নি। তিনি বিডিআর বিদ্রোহের হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই করেন নি। একটির পর একটি বিশৃঙ্খলার ঘটনায় রীতিমতো লেজেগোবরে অবস্থা। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.