আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল চট্টগ্রাম: সিসিটিভি’র ফুটেজে খুনিরা চিহ্নিত by জালাল রুমি
ওদিকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আইনজীবী সাইফুল হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হামলা-সংঘাতে জড়িত অন্তত ৩৩ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে চট্টগ্রাম পুলিশ। এরমধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত এমন ৬ জন আছেন। গতকাল সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে সাইফুল ইসলামের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা, বিকালে নিজ উপজেলা লোহাগাড়ায় দুইটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। দ্বিতীয় জানাজায় ইমামতি করেন মহানগর জামায়াতের আমীর শাহজাহান চৌধুরী। এতে অন্যদের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হাসান আরিফ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা মাওলানা শাহজাহান, বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী, এরশাদ উল্লাহ, সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
জানাজা শেষে নিহত সাইফুলের লাশ নিয়ে মিছিল করতে থাকেন বিক্ষুব্ধ জনতা। একপর্যায়ে তারা মিছিল নিয়ে নগরের টাইগারপাসে আসেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় টাইগারপাস মোড়ে বিক্ষোভ করেন তারা। সেখানে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহসহ চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। সেখানে উপস্থিত জনতা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার ও ইসকন নিষিদ্ধের দাবি জানান।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা ভুলে যাই নাই আওয়ামী লীগের সহায়তায় এই ইসকন কীভাবে গত ১৬ বছর পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠে আজকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে স্বৈরাচারের সঙ্গী হয়ে ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই হাসিনা এই বাংলাদেশে তোমার আর ঠাঁই হবে না। ভারতে বসে যতই ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হয় আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সেই ষড়যন্ত্র রুখে দেবো।
জঙ্গি ইসকনকে বিতাড়িত করা হাতের ময়লা উল্লেখ করে শোক সমাবেশের বক্তব্যে নাগরিক কমিটির সদস্য ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, ‘যে রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা এই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, যে রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ এসেছে, সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এই চিন্ময়রা উস্কানি দেয়। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে খুনি হাসিনারা উস্কানি দেয়। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে জঙ্গি ইসকনরা উস্কানি দেয়। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের কিছু প্রেত্মারা উস্কানি দেয়। আমরা স্পষ্ট করে সকল প্রেত্মাদের বলে দিতে চাই, আমরা ১৬ বছরের খুনি হাসিনাকে দেশছাড়া করেছি এবং ছোটোখাটো কিছু জঙ্গি ইসকনকে দেশছাড়া করা আমাদের জন্য হাতের ময়লা।
এদিকে এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার প্রতিবাদে বুধবার চট্টগ্রাম আদালতে কর্মবিরতি পালন করেছেন আইনজীবীরা। তারা সেখানে সকালে বিক্ষোভ মিছিলও করেন। এরমধ্যে ইসকনকে সহযোগিতার অভিযোগে চট্টগ্রাম আদালতের ক্লার্ক এসোসিয়েশনের অফিসের (মুন্সি সমিতি) নথিপত্রে আগুন দেয়া হয়।
বিক্ষুব্ধ আইনজীবীদের অভিযোগ, মঙ্গলবার চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুরের পর ইসকন সদস্যরা তাকে বহনকারী প্রিজনভ্যান আটকে বিক্ষোভ করেন। এ সময় মুন্সি সমিতির সদস্যরা নিজেদের পোশাক এবং খাবার পানি বিক্ষোভকারীদের সরবরাহ করেছেন। এ ছাড়া তারা উস্কানিমূলক বিভিন্ন পোস্টও দিয়েছেন ফেসবুকে।
ফিরোজুল ইসলাম তালুকদার নামে এক আইনজীবী বলেন, এখান থেকে গতকাল মুন্সির পোশাক পরে গিয়ে ইসকনকে সাপোর্ট করা হয়েছে। তারা আইনজীবীদের অংশ। তারা তো এটা করতে পারে না। সাধারণ আইনজীবীরা এই নিয়ে ক্ষুব্ধ।
হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ: এদিকে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে মানবজমিনের কাছে। সেই ফুটেজে বেশ কয়েকজন তরুণকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাইফুলকে কোপাতে দেখা যায়। একপর্যায়ে সাইফুলের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তার সেখান থেকে সরে পড়ে। এই তরুণদের ৩ জনের পরিচয় প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। তবে এদেরকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। পরিচয় নিশ্চিত হওয়া এই তরুণরা হলো- শুভ কান্তি দাশ, বিকাশ দাশ ও বিশাল দাশ। এদের মধ্যে বিকাশ দাশ ও বিশাল দাশ মেথরপট্টি এলাকার মেথর সর্দার জগন্নাথ দাশের ছেলে। আর শুভ কান্তি দাশ বেসরকারি বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির আইনের শিক্ষার্থী। এরইমধ্যে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি তার ছাত্রত্ব বাতিল করেছে।
মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত এমন ৬ জনকে আটক করা হয়েছে ভিডিও ফুটেজ দেখে।
এদিকে মঙ্গলবার পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ইসকনের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত সাইফুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। হত্যাকাণ্ডের সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন পদধারী নেতাও ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সূত্র।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) তারেক আজিজ মানবজমিনকে বলেন, মঙ্গলবার আদালতে পুলিশের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় এপর্যন্ত পুলিশ বাদী হয়ে ৩টি মামলা করেছে। এরমধ্যে আটক করা হয়েছে ২৭ জনকে। এদের কয়েকজন আইনজীবী সাইফুল হত্যায় জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের পরিচয় জানানো যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সমর্থকদের হামলায় নিহত হন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সহকারী প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম আলিফ। নিহত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার জামাল হোসেনের পুত্র। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় গঠিত আইনজীবী প্যানেলের সদস্য ছিলেন ৩৩ বছর বয়সী এই আইনজীবী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যাসন্তানের জনক। তার স্ত্রী বর্তমানে ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
ওদিকে চমেক হাসপাতাল থেকে পাওয়া সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাইফুল ইসলাম আলিফের পিঠে ও ঘাড়ে দুটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মাথায় ভারী বস্তুর আঘাতে খুলি ভেঙে গেছে। একটি পাও ভেঙে দেয়া হয়।
সাইফুলের হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে থাকা আইনজীবী এডভোকেট জিয়াউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, মূলত মসজিদে হামলা হওয়ার পর আমরা কয়েকজন আইনজীবী ইসকনের লোকদের ধাওয়া দিয়ে আদালত থেকে বের করে দেই। এরমধ্যে তারা দৌড়ে যাওয়ার সময় সাইফুলকে টেনে নিয়ে পাশের মেথরপট্টির গলির ভেতরে ঢুকিয়ে হত্যা করেছে।
No comments