ওই দেখা যায় হাওর-পাহাড়-মেঘ by হিমাদ্রি শেখর ভদ্র
মেঘালয় পাহাড় (ছবি– প্রতিনিধি) |
ছোট ও মাঝারি হাওর-বাঁওড়। এর দু’পাশ জুড়ে সবুজ
ধানক্ষেত। মেঘালয়ের নীল-সবুজ পাহাড়। আর মেঘের তটরেখার সঙ্গে আশ্চর্য
জলরাশি। এর নাম সুনামগঞ্জ; যাকে হাওর আর পাহাড়ের ‘দেশ’ বলেন পর্যটকেরা।
গাঢ় সবুজের তল না দেখা অতল জলের প্রকৃতির রূপসুধা
পান, ভাটি অঞ্চলের বাউলদের দরাজ গলার গান শোনা, চনমনে রোদ বা মুষলধারে হওয়া
বৃষ্টিতে ঘোর লাগা স্বপ্নের মতো সময় কাটানো, খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের ওপর
নীল আকাশ বা পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ সবুজরঙা পাহাড়ি নদী দেখতে
চাইলে সুনামগঞ্জের জুড়ি মেলা ভার।
এ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর, শনি মাটিয়ান হাওর,
বারিকটিলা, যাদুকাটা নদী, এশিয়ার বৃহত্তম শিমুলবাগান, শহীদ সিরাজ লেকসহ
নানা দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা পর্যটকদের আনাগোনায় মুখর থাকে সারা বছরই; যা
দুই ঈদে ভিন্ন মাত্রা পায়। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে এবারও পর্যটনদের আনাগোনা
প্রত্যাশা ছাড়াবে বলেই মনে করছে প্রশাসন। তাই পর্যটকদের নিরাপত্তায় নেওয়া
হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এক দশক আগেও সুনামগঞ্জের
পর্যটন এলাকাগুলো দেশবাসীর কাছে এতটা পরিচিত ছিল না। তাই পর্যটকদের
আনাগোনাও ছিল কম। তবে এখন আর সে অবস্থা নেই। বর্তমানে এ জেলার প্রকৃতির
রূপ-সৌন্দর্য দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছে। তাই
দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত হোটেল-মোটেল না থাকার কষ্ট মেনেও হাওর
রাজ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন পর্যটকরা।
জেলা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরত্বে ভাটির জনপদ
তাহিরপুরের অবস্থান। এখানকার টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত জলে ভাসা
সারি সারি হিজল-করচ। নানান বনজ লতাপাতা ও জলজ উদ্ভিদে সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার
হাওর যেন এক প্রাকৃতিক অ্যাকুয়ারিয়াম। হাওরের মধ্যভাগে স্থাপিত গোলাবাড়ী
এলাকার সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে পুরো হাওরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা
যায়। টাওয়ারের নিচে ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পর্যটকদের অন্য জগতে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে সবুজাভ জলরাশি দু’চোখে এনে দেয় প্রশান্তি।
সীমান্ত সংলগ্ন মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত
টেকেরঘাট। এখানে রয়েছে তিনটি শুল্ক স্টেশন, যা দিয়ে ভারতের মেঘালয় থেকে
কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি করা হয়। টেকেরঘাট বাংলোর পেছেনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে
সম্মুখসমরে নিহত শহীদ বীরবিক্রম সিরাজের সমাধি। পরিত্যক্ত খনি প্রকল্পের
পূর্বদিকে রয়েছে মাটির টিলা।
লাকমাছড়া এলাকায় গেলে ছোট-বড় পাথরের বিচালি দেখা
যাবে। বৃষ্টি নামলে এসব বিচালির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলধারা অন্য এক
রূপ ধারণ করে। এছাড়া, পাশে থাকা বারিক টিলার চাঁনপুর জলধারায় পাহাড়ের
গাঘেঁষে নেমে আসা হিমশীতল স্বচ্ছ পানির প্রবাহ উপভোগ করা যাবে।
মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিরে বের হয়ে এসেছে রূপের নদী
যাদুকাটা। যাদুকাটার স্বচ্ছ শীতল জলে গা ভেজালে মিলবে অন্যরকম সুখানুভূতি। এ
নদীতে বালু পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে আশপাশের এলাকার হাজার
হাজার হতদরিদ্র মানুষ। মেঘালয় থেকে ভেসে আসা বালি-পাথর সংগ্রহ করেন তারা।
বারেকটিলার পর রয়েছে আদিবাসী পল্লি। সেখানে বেড়াতে
গেলে জানা যাবে কঠোর সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা আদিবাসী মানুষের ইতিহাস। টিলার
অপর প্রান্তে রয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগান। এখানে
রয়েছে সারি সারি শিমুল ও লেবু গাছ; যার বর্তমান গাঢ় সবুজ বসন্তে হয়ে যায়
রক্তলাল।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলা সদর থেকে ভাড়ার
মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা-মাইক্রোবাস ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা
নিয়ে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যাওয়া যাবে। মাইক্রোবাস ও নৌকা ভাড়া তিন থেকে
পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে। তবে তাহিরপুর ও সুনামগঞ্জ জেলা সদর ও বড়ছড়া বাজার
ছাড়া অন্য কোথাও কোনও আবাসিক হোটেল নেই।
পর্যটক নিরাপত্তার ব্যাপারে তাহিরপুর থানার ওসি মো.
আতিকুর রহমান জানান, এখানকার পর্যটন এলাকাগুলোতে নির্বিঘ্নে পর্যটকরা ভ্রমণ
করতে পারেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে
সজাগ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে বলে জানান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু
চৌধুরী বাবুল।
সুনামগঞ্জ ২৮ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন-বিজিবি অধিনায়ক
লে. কর্নেল মাকসুদুল আলম জানিয়েছেন, পর্যটন কেন্দ্রগুলো সীমান্ত সংলগ্ন
হওয়ায় দিনরাত বিজিবির টহল দল থাকবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ জানান, পর্যটক বরণ
ও নিরাপত্তায় তারা প্রস্তুত। পর্যটন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ।
No comments