বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবনের সাক্ষী কলকাতার বেকার হোস্টেল by মিঠুন সরকার
বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকক্ষ |
বাসে চড়ে কলকাতা। তারপর ট্যাক্সিতে করে তালতলার স্মিথ লেন। ধীরে
ধীরে শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো ধবধব করছে। বেশ ভালোভাবেই অনুভব করছি
ব্যাপারটা। এ যেন কোনও যোদ্ধার অনুভূতি! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
ছাত্রজীবন কেটেছে যেখানে সেই বেকার হোস্টেলের সামনে দাঁড়ালে এমনটা
স্বাভাবিকই। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন বাঙালি জাতির শক্তির উৎস।
হোস্টেলের ভেতরে ঢুকে যত সামনে যাচ্ছি, ততই শক্তির সঞ্চার বাড়ছে।
জায়গাটা বিশ্বনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই পুরোপুরি জানান দেয়। তাকে
সম্মান ও শ্রদ্ধায় ভরিয়ে রাখতে কমতি নেই ভারত সরকারের। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত
চেয়ার, টেবিল, বই, খাট ও আলমারিসহ ছোট ছোট জিনিসগুলো খুব যত্ন করে সাজিয়ে
রাখা হয়েছে হোস্টেলে। এছাড়া আছে শ্বেতপাথর দিয়ে নির্মিত তার একটি
আবক্ষমূর্তি।
গত
১ আগস্ট সকালে সবুজ প্রকৃতি ঘেরা বেকার হোস্টেলে ঢুকে দেখি আমি একা নই।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বঙ্গবন্ধুকে অনুভব করতে হাজির আরও অনেক
দর্শনার্থী। লোহার ফটক পেরিয়ে আবক্ষমূর্তিতে দেখা মেলে তার গর্জন, যার কথা
শোনার জন্য বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষ এক হয়েছিল। তার প্রতি বিশ্বাস ও
ভালোবাসা থেকে জীবন বাজি রেখেছিল সবাই। তিনি নিরাশ করেননি। বাংলাদেশের
স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে দিয়েছেন এই বাংলাকে। ৭ মার্চের ভাষণে মৃত্যুকে পরোয়া
করেননি। হোস্টেলে এসে যেন সেই জ্বালাময়ী ভাষণ শুনতে পাচ্ছি! এ এক অন্যরকম
গর্বের অনুভূতি। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চোখের কোণে কখন জল জমেছে টেরই পাইনি।
বেকার হোস্টেলে এগোতে এগোতে মহান মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ২৪ নম্বর
স্মৃতিকক্ষে ঢুকলাম। ছাত্রজীবনে এখানেই থাকতেন তিনি। পড়ালেখার পাশাপাশি এই
কক্ষে বসেই রাজনীতির চর্চা করতেন। সাদা চাদরে মোড়ানো ছোট একটি খাট ও
চেয়ার-টেবিল। পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। জানালার দু’পাশে দেয়ালজুড়ে ফ্রেমে
বাঁধাই করা তার চিত্রকর্ম ও আলোকচিত্র। তার ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিলের কাছে
গেলাম। অজান্তেই নীরবতা চলে এলো নিজের মধ্যে। এখানে বাঙালিদের প্রাণের নেতা
বসতেন, কথা বলতেন ও শুনতেন।
বেকার
হোস্টেলের কর্মী শেখ মো. গোলাম জানান, এখানে বঙ্গবন্ধু বেশকিছু সভা
করেছিলেন। সেই সময় হোস্টেল সুপার ছিলেন অধ্যাপক সাঈদুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে
আলাদাভাবে স্নেহ করতেন তিনি। একবার হোস্টেল ছাত্র সংসদের নেতা হিসেবেও
মনোনীত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ডিগ্রি পড়ার
সময় এই হোস্টেলে থাকতেন তিনি।
আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানতে যায়, ১৯৪৫-৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু
বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে ছিলেন। বর্তমানে ইসলামিয়া কলেজের নাম বদলে
রাখা হয়েছে মাওলানা আজাদ কলেজ। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ২৪ নম্বরের পাশের ২৩ নম্বর
কক্ষটিকে যুক্ত করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ গড়ার উদ্যোগ নেন।
১৯৯৮
সালের ৩১ জুলাই বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক সত্যসাধন চক্রবর্তী। এতে
এখনও সংরক্ষিত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত খাট, চেয়ার, টেবিল ও আলমারি। এখানে
ঘুরতে আসা কয়েকজন তরুণ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক আদর্শের
ইতিহাস। যে বন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তার অসাম্প্রদায়িক
আদর্শ ধারণ করে বাঙালি একত্রিত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল। সেই মাটি ও
দেশের মানুষ হিসেবে আমি গর্বিত। তার অসাম্প্রদায়িক আদর্শ আমার ও আমাদের
অন্তরে চিরজাগ্রত।’
গোটা
বিশ্বে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৩০০ গ্রন্থ রচনা হয়েছে। তাকে নিয়ে রয়েছে অসংখ্য
গান ও কবিতা। বঙ্গবন্ধুর মতো অধিনায়কত্বসুলভ সহৃদয়, মনুষ্যত্বপূর্ণ ও
উদারচিত্তের নেতা বিশ্বে বিরল। তার বলিষ্ঠ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের
সাধারণ জনগণ দেশ স্বাধীন করেছিলেন। তিনি হলেন সারাবিশ্বের জন্য অনুকরণীয়
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
নেতৃত্ব প্রদানের অপরিসীম গুণাবলীর আঁধার ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান। তিনি কৈশোর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালির কল্যাণের কথা
ভেবেছেন। বেকার হোস্টেল সেই মহান মানুষের স্মৃতি ধরে রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
>>>ছবি: লেখক
>>>ছবি: লেখক
No comments