বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান ১৫০০ কোটি ডলার
বছরে
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান ১৫০০ কোটি ডলার। এই অর্থ যোগানদাতারা
হলেন আত্মীয়-স্বজন ফেলে বিদেশে পাড়ি দেয়া বাংলাদেশি অভিবাসীরা। কিন্তু কি
অসীম কষ্ট, যন্ত্রণা ভোগের মধ্য দিয়ে তাদের কাজ করতে হয়, কতটা মানসিক
অস্বস্তি কাজ করে সেটা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন না। তাদের নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও’র অনলাইন সাংবাদিক জেসন বিউবিয়েনের
লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, আপনি কীভাবে বাংলাদেশকে
সামনে এগিয়ে নিতে চান? তার উত্তর বেশির ভাগ সময়ই আসে এই বলে যে, বাংলাদেশ
ছেড়ে গিয়ে। অর্থাৎ বিদেশে গিয়ে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিদেশে কাজ করেন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি অভিবাসী। তার বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক।
তারা কাজ করেন বেশির ভাগ আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, প্রতি বছর বাংলাদেশের চেয়ে বেশি শ্রমিক পাঠায় শুধু ভারত, মেক্সিকো, রাশিয়া ও চীন। বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশির ভাগই কাজ করেন গার্ডেনার, নির্মাণ শ্রমিক, প্রহরী এবং গৃহপরিচারিকা হিসেবে। গড়ে তাদের মাসে আয় প্রায় ৪০০ ডলার। দেশে কাজ করলে তারা যে বেতন পেতেন, এই অর্থ তার চেয়ে অনেক বেশি। আর সব মিলিয়ে বড় একটি অঙ্কে দাঁড়ায়। গত বছর তারা সব মিলে মোট ১৫০০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। একে বলা হয় রেমিটেন্স। এতে অর্থনীতি সচল হয়েছে। আর বিশালাকায় বস্ত্রখাতের মাধ্যমে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পর এটাই হলো এই মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। এসব শ্রমিককে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিদেশে কাটাতে হয় নানা দুর্ভোগে, নানা রকম কেলেঙ্কারি, শোষণ আর নির্যাতনের মধ্যদিয়ে- এসব দাবি শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোর।
শ্রমিক নিয়োগ, তাদের স্ক্রিন ও কারা বিদেশে যেতে পারবেন তার জন্য বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে একটি ইন্ডাস্ট্রি। রাজধানী ঢাকায় দু’তলা বিশিষ্ট একটি ভবনের সামনে আরব উপসাগরে যাওয়ার আগ্রহীদের লম্বা লাইন। তারা রাস্তায় লাইনে অপেক্ষা করছেন। শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য সেখানে অপেক্ষা করেন তারা। এটি একটি মেডিকেল টেস্টের শাখা অফিস।
এখানে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতে হয়। প্রমাণ দেখাতে হয় যে, তারা কাজের জন্য যোগ্য। তাদের করা হয় এইচআইভি, টিবি এবং অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির পরীক্ষা। যদি রিপোর্ট পজেটিভ আসে তাহলে উপসাগরীয় অঞ্চলে কাজের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যান তারা। নারীদের দিতে হয় গর্ভসঞ্চার বিষয়ক পরীক্ষা। যদি এ পরীক্ষায় দেখা যায় তারা সন্তান সম্ভাব্য তাহলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। এসব পরীক্ষা শেষে অফিসটি থেকে এসব বাংলাদেশির আঙ্গুলের ছাপ, ভ্রমণ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট পাঠিয়ে দেয় সেন্ট্রাল ডাটাবেজে। যে দেশে তাদেরকে নিয়োগ করা হবে সে দেশের সংশ্লিষ্ট অভিবাসন কর্তৃপক্ষ তা দেখতে পারেন।
এপ্রিলে এমন একজন আবেদনকারী হলেন মোহাম্মদ কিরণ মিয়া (৩৬)। তিনি ওমানে একজন গার্ডেনার হিসেবে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এটা হলো তার জন্য তৃতীয়বার বিদেশ যাত্রা। প্রথম বার তিনি ওমানে দর্জির কাজ করেছেন সাত মাস। তারপর তিনি দুই বছরের চুক্তিতে গিয়েছিলেন গার্ডেনার হিসেবে। এবারও তিনি ওই অফিসে গিয়েছিলেন। কিরণ মিয়ার সঙ্গে এসেছিলেন তার গ্রামের আরো কিছু প্রতিবেশী। কিরণ মিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ওমানের কাজটা আমাদের জন্য একটা ভালো সুযোগ। কারণ, সেখানে ওয়ার্ক পারমিটের খরচ সৌদি আরব বা দুবাইয়ের চেয়ে অনেক কম।
এই ওয়ার্ক পারমিটের ফি নির্ভর করে গন্তব্য ও কাজের ওপর। এর খরচ পড়তে পারে কয়েক হাজার ডলার। কিরণ মিয়া বলেন, পরিবার ও আমার সন্তানের উন্নত জীবন চাই আমি। বাংলাদেশে কাজ করলে যে টাকা পাবো, ওমানে তার দ্বিগুণ উপার্জন করতে পারবো।
কিরণ মিয়া যে অফিসে তার ডকুমেন্ট জমা দিতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ৪৬টি অফিসের মধ্যে তা একটি। এসব অফিস থেকে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে শ্রমিক পাঠানোর কাজ করে থাকে। এ ছাড়া ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে শ্রমিক পাঠানোর কাজ করে থাকে দেশের অন্যান্য শ্রমিক বিষয়ক ব্রোকার এজেন্সি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অলাভজনক উন্নয়ন ও সামাজিক সেবা বিষয়ক এজেন্সি ব্রাক-এর অভিবাসন বিষয়ক প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসেবে অভিবাসন ও রেমিটেন্সের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। তিনি বলেন, এই রেমিটেন্স বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিবাসীর পাঠানো অর্থ দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তার পরিবারের খাদ্যের জোগান দিয়ে থাকে। তিনি মনে করে, উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশিরা কখনো ৫, ১০ এমনকি ২০ বছরও বিদেশে থাকেন।
তার মতে, বাংলাদেশে এমন একজন মানুষও আপনি পাবেন না, যার কোনো না কোনো আত্মীয় বিদেশে থাকেন না। তাই প্রতিজন মানুষই এই অভিবাসন ও রেমিটেন্স প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। তা সত্ত্বেও বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ এখনো। সামপ্রতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনে প্রতি বছর মাথাপিছু আয় রয়েছে ২০০০ ডলারের নিচে।
শরীফুল ইসলাম হাসান বলেন, বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের পোহাতে হয় নানা রকম দুর্ভোগ। অনেকেই ব্রোকারদের দুর্নীতির শিকারে পরিণত হন। তাদের ভিসা, ফ্লাইট এমন কি ওয়ার্ক পারমিটে গরমিল করা হয়। কেউ একজন এক রকম কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন, যেম আবু ধাবিতে ডেলিভারি ভ্যান চালানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন, কিন্তু দুবাইয়ে তাকে দেয়া হলো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ। তাকে দীর্ঘ সময় উত্তপ্ত গরমের মধ্যে বাইরে কাজ করতে হয়। নারীরা প্রাথমিকভাবে গৃহপরিচারিকা এবং বাড়ির ক্লিনার হিসেবে কাজ নেন। হাসান বলেন, বেশির ভাগ সময়ে নারীদেরকে দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এমন কি যৌন নির্যাতনেরও শিকার হন তারা। তিনি আরো বলেন, যদি কোনো শ্রমিকের ছুটি না থাকে, যদি তাদের খাদ্য দেয়া না হয় অথবা প্রয়োজনীয় চাহিদায় ঘাটতি থাকে- তাহলে আধুনিক সময়ের দাসত্বের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এটাকে বলা হয় এক ধরণের দাসত্ব।
এসব বিষয় ভালোভাবে জানেন ২২ বছরর বয়সী মিম আকতার তানিয়া। পুরান ঢাকায় স্বামী, মেয়ে নিয়ে একটি এপার্টমেন্টে থাকেন তিনি। তাদের সঙ্গে থাকেন আরেকটি নবদম্পতি। গত বছর সৌদি আরবের একটি হাসপাতালের দেখাশোনার কাজ পেতে যোগাযোগ করেন তানিয়া। এমন কাজ পেয়ে তিনি উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। তানিয়া বলেন, ওই সময়ে আমাদের কোনো অর্থ ছিল না। তাই আমার মনে হয়েছিল, সৌদি আরবে গেলে আমাদের জীবন উন্নত হবে। তিনি আশা করেছিলেন, সৌদি আরবে গিয়ে হাসপাতালে একজন নার্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট অথবা মেডিকেল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতে পারবেন। এ জন্য তখন তার এক বছর বয়সী মেয়েকে নিজের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সৌদি আরবে কাজ করার জন্য দুই বছর মেয়াদি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। কিন্তু তিনি যখন রিয়াদ পৌঁছালেন দেখলেন ওই হাসপাতালে কোনো কাজ নেই। ফলে তাকে হাসপাতালের কাজের পরিবর্তে গৃহপরিচারিকার কাজ দেয়া হলো।
তানিয়া বলেন, সারাদিন তিনি তার বসের বাসায় কাজ করার পর সন্ধ্যায় তাকে পাঠানো হতো তার বসের ভাইয়ের বাড়ি পরিষ্কার করতে। তার ভাষায়, আমি জানতাম এসব কাজ আমাকে করতেই হবে। কিন্তু নিয়োগকারী মোটেও ভালো মানুষ ছিলেন না। মাঝে মাঝেই তিনি আমাকে মারতেন। খুবই রুক্ষ ব্যবহার করতেন। এক পর্যায়ে আমার বস ও তার ভাই আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। আমি দৌড়ে পালাই। চলে যাই সৌদি আরবে পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ করলো উল্টো কাজ। তারা আমাকে ধরে ওই নিয়োগকারীর বাড়িতেই পাঠিয়ে দিলো।
তানিয়া সৌদি আরব পৌঁছার দু’মাস পরে তার বস তাকে একটি ব্যালকনি থেকে ধাক্কা মারেন। এতে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের নাগাল পান। দূতাবাস তাকে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে রাখে। ওই আশ্রয়কেন্দ্রটি আরো একই রকম নির্যাতিত বাংলাদেশি নারীতে ঠাসা। এসব নারী তাদের নিয়োগকারীদের কাছ থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়েছেন। অপেক্ষা করছিলেন দেশে ফেরার জন্য। তানিয়ার সঙ্গে মাসে ১৬০ ডলারের চুক্তি হয়েছিল। সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। তানিয়া বলেন, সেখানে কাজ করার বিনিময়ে আমি কখনোই কোনো বেতন পাইনি।
শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, তানিয়ার এই অভিজ্ঞতা খুবই কমন। আমরা এত বেশি অর্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি যে, প্রতি মাসেই এই অর্থের জন্য শ্রমিকদের পাঠাচ্ছি। যেখানে তাদের প্রতি অশোভন আচরণ ও নির্যাতনের বিষয়টিকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অনতি দূরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। সেখানে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমাণ বেগমের পরিবার। তার মেয়ে, যার বয়স তারা বলছেন ১৬ বছর, সে মায়ের কাছেই বসে আছে। তার পরনে কালো বোরকা। তার মুখের বাম চিবুকে থেঁতলানো দাগ। গলার কাছে কাটা দাগ। মেয়েটি কথা বলতে চাইল না। তার মা মিনারা বেগম বলছেন, বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি ও তার স্বামী মেয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। অকস্মাৎ তারা জানতে পারেন সে সৌদি আরব থেকে ফোন করে জানায় দেশে আসছে।
মিনারা বলেন, এই দুর্ভোগের শুরু হয় কয়েক মাস আগে। তাদের গ্রামের একজন নারী বিউটি। তিনি মিনারাকে প্রস্তাব দেন ঢাকায় একটি বাসায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য তার মেয়েকে কাজে দিতে। প্রতি মাসে তার মেয়ে তাদেরকে ১৬০০০ করে টাকা পাঠাতো। কিন্তু বেশ কিছুদিন মেয়ের খবর পান না তারা। মিনারা আরো বলেন, তার মেয়ের বয়স ১৫ বছর। তখন সে গ্রাম ছাড়ে। কিন্তু এখন কয়েক মাসের ব্যবধানে তার মেয়ের হাতে একটি পাসপোর্ট দেয়া হয়েছে। তাতে তার বয়স দেখানো হয়েছে ২৬ বছর। মেয়েটির পিতামাতা মনে করেন, এই ভুয়া পাসপোর্টটির ব্যবস্থা করিয়েছেন বিউটি। মিনারা ও তার স্বামী তাদের মেয়েকে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ডাক্তার বা নার্সদের ডাকে সাড়া দিচ্ছিল না সে। একটি ছোট্ট রুমে তার পরীক্ষা করানোর কথা। মিনারা বলেছেন, তাদের মেয়ে শুধুই বাড়ি ফিরতে চাইছিল।
মিনারা শুধু বোঝার চেষ্টা করছেন তার মেয়ের কি ঘটেছিল। মিনারাকে সৌদি আরব থেকে মেয়ে অর্থ পাঠিয়েছে। কিন্তু কীভাবে পাঠিয়েছে তা তারা জানেন না।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিদেশে কাজ করেন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি অভিবাসী। তার বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক।
তারা কাজ করেন বেশির ভাগ আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, প্রতি বছর বাংলাদেশের চেয়ে বেশি শ্রমিক পাঠায় শুধু ভারত, মেক্সিকো, রাশিয়া ও চীন। বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশির ভাগই কাজ করেন গার্ডেনার, নির্মাণ শ্রমিক, প্রহরী এবং গৃহপরিচারিকা হিসেবে। গড়ে তাদের মাসে আয় প্রায় ৪০০ ডলার। দেশে কাজ করলে তারা যে বেতন পেতেন, এই অর্থ তার চেয়ে অনেক বেশি। আর সব মিলিয়ে বড় একটি অঙ্কে দাঁড়ায়। গত বছর তারা সব মিলে মোট ১৫০০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। একে বলা হয় রেমিটেন্স। এতে অর্থনীতি সচল হয়েছে। আর বিশালাকায় বস্ত্রখাতের মাধ্যমে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পর এটাই হলো এই মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। এসব শ্রমিককে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিদেশে কাটাতে হয় নানা দুর্ভোগে, নানা রকম কেলেঙ্কারি, শোষণ আর নির্যাতনের মধ্যদিয়ে- এসব দাবি শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোর।
শ্রমিক নিয়োগ, তাদের স্ক্রিন ও কারা বিদেশে যেতে পারবেন তার জন্য বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে একটি ইন্ডাস্ট্রি। রাজধানী ঢাকায় দু’তলা বিশিষ্ট একটি ভবনের সামনে আরব উপসাগরে যাওয়ার আগ্রহীদের লম্বা লাইন। তারা রাস্তায় লাইনে অপেক্ষা করছেন। শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য সেখানে অপেক্ষা করেন তারা। এটি একটি মেডিকেল টেস্টের শাখা অফিস।
এখানে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতে হয়। প্রমাণ দেখাতে হয় যে, তারা কাজের জন্য যোগ্য। তাদের করা হয় এইচআইভি, টিবি এবং অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির পরীক্ষা। যদি রিপোর্ট পজেটিভ আসে তাহলে উপসাগরীয় অঞ্চলে কাজের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যান তারা। নারীদের দিতে হয় গর্ভসঞ্চার বিষয়ক পরীক্ষা। যদি এ পরীক্ষায় দেখা যায় তারা সন্তান সম্ভাব্য তাহলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। এসব পরীক্ষা শেষে অফিসটি থেকে এসব বাংলাদেশির আঙ্গুলের ছাপ, ভ্রমণ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট পাঠিয়ে দেয় সেন্ট্রাল ডাটাবেজে। যে দেশে তাদেরকে নিয়োগ করা হবে সে দেশের সংশ্লিষ্ট অভিবাসন কর্তৃপক্ষ তা দেখতে পারেন।
এপ্রিলে এমন একজন আবেদনকারী হলেন মোহাম্মদ কিরণ মিয়া (৩৬)। তিনি ওমানে একজন গার্ডেনার হিসেবে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এটা হলো তার জন্য তৃতীয়বার বিদেশ যাত্রা। প্রথম বার তিনি ওমানে দর্জির কাজ করেছেন সাত মাস। তারপর তিনি দুই বছরের চুক্তিতে গিয়েছিলেন গার্ডেনার হিসেবে। এবারও তিনি ওই অফিসে গিয়েছিলেন। কিরণ মিয়ার সঙ্গে এসেছিলেন তার গ্রামের আরো কিছু প্রতিবেশী। কিরণ মিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ওমানের কাজটা আমাদের জন্য একটা ভালো সুযোগ। কারণ, সেখানে ওয়ার্ক পারমিটের খরচ সৌদি আরব বা দুবাইয়ের চেয়ে অনেক কম।
এই ওয়ার্ক পারমিটের ফি নির্ভর করে গন্তব্য ও কাজের ওপর। এর খরচ পড়তে পারে কয়েক হাজার ডলার। কিরণ মিয়া বলেন, পরিবার ও আমার সন্তানের উন্নত জীবন চাই আমি। বাংলাদেশে কাজ করলে যে টাকা পাবো, ওমানে তার দ্বিগুণ উপার্জন করতে পারবো।
কিরণ মিয়া যে অফিসে তার ডকুমেন্ট জমা দিতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ৪৬টি অফিসের মধ্যে তা একটি। এসব অফিস থেকে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে শ্রমিক পাঠানোর কাজ করে থাকে। এ ছাড়া ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে শ্রমিক পাঠানোর কাজ করে থাকে দেশের অন্যান্য শ্রমিক বিষয়ক ব্রোকার এজেন্সি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অলাভজনক উন্নয়ন ও সামাজিক সেবা বিষয়ক এজেন্সি ব্রাক-এর অভিবাসন বিষয়ক প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসেবে অভিবাসন ও রেমিটেন্সের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। তিনি বলেন, এই রেমিটেন্স বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিবাসীর পাঠানো অর্থ দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তার পরিবারের খাদ্যের জোগান দিয়ে থাকে। তিনি মনে করে, উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশিরা কখনো ৫, ১০ এমনকি ২০ বছরও বিদেশে থাকেন।
তার মতে, বাংলাদেশে এমন একজন মানুষও আপনি পাবেন না, যার কোনো না কোনো আত্মীয় বিদেশে থাকেন না। তাই প্রতিজন মানুষই এই অভিবাসন ও রেমিটেন্স প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। তা সত্ত্বেও বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ এখনো। সামপ্রতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনে প্রতি বছর মাথাপিছু আয় রয়েছে ২০০০ ডলারের নিচে।
শরীফুল ইসলাম হাসান বলেন, বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের পোহাতে হয় নানা রকম দুর্ভোগ। অনেকেই ব্রোকারদের দুর্নীতির শিকারে পরিণত হন। তাদের ভিসা, ফ্লাইট এমন কি ওয়ার্ক পারমিটে গরমিল করা হয়। কেউ একজন এক রকম কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন, যেম আবু ধাবিতে ডেলিভারি ভ্যান চালানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন, কিন্তু দুবাইয়ে তাকে দেয়া হলো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ। তাকে দীর্ঘ সময় উত্তপ্ত গরমের মধ্যে বাইরে কাজ করতে হয়। নারীরা প্রাথমিকভাবে গৃহপরিচারিকা এবং বাড়ির ক্লিনার হিসেবে কাজ নেন। হাসান বলেন, বেশির ভাগ সময়ে নারীদেরকে দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এমন কি যৌন নির্যাতনেরও শিকার হন তারা। তিনি আরো বলেন, যদি কোনো শ্রমিকের ছুটি না থাকে, যদি তাদের খাদ্য দেয়া না হয় অথবা প্রয়োজনীয় চাহিদায় ঘাটতি থাকে- তাহলে আধুনিক সময়ের দাসত্বের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এটাকে বলা হয় এক ধরণের দাসত্ব।
এসব বিষয় ভালোভাবে জানেন ২২ বছরর বয়সী মিম আকতার তানিয়া। পুরান ঢাকায় স্বামী, মেয়ে নিয়ে একটি এপার্টমেন্টে থাকেন তিনি। তাদের সঙ্গে থাকেন আরেকটি নবদম্পতি। গত বছর সৌদি আরবের একটি হাসপাতালের দেখাশোনার কাজ পেতে যোগাযোগ করেন তানিয়া। এমন কাজ পেয়ে তিনি উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। তানিয়া বলেন, ওই সময়ে আমাদের কোনো অর্থ ছিল না। তাই আমার মনে হয়েছিল, সৌদি আরবে গেলে আমাদের জীবন উন্নত হবে। তিনি আশা করেছিলেন, সৌদি আরবে গিয়ে হাসপাতালে একজন নার্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট অথবা মেডিকেল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতে পারবেন। এ জন্য তখন তার এক বছর বয়সী মেয়েকে নিজের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সৌদি আরবে কাজ করার জন্য দুই বছর মেয়াদি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। কিন্তু তিনি যখন রিয়াদ পৌঁছালেন দেখলেন ওই হাসপাতালে কোনো কাজ নেই। ফলে তাকে হাসপাতালের কাজের পরিবর্তে গৃহপরিচারিকার কাজ দেয়া হলো।
তানিয়া বলেন, সারাদিন তিনি তার বসের বাসায় কাজ করার পর সন্ধ্যায় তাকে পাঠানো হতো তার বসের ভাইয়ের বাড়ি পরিষ্কার করতে। তার ভাষায়, আমি জানতাম এসব কাজ আমাকে করতেই হবে। কিন্তু নিয়োগকারী মোটেও ভালো মানুষ ছিলেন না। মাঝে মাঝেই তিনি আমাকে মারতেন। খুবই রুক্ষ ব্যবহার করতেন। এক পর্যায়ে আমার বস ও তার ভাই আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। আমি দৌড়ে পালাই। চলে যাই সৌদি আরবে পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ করলো উল্টো কাজ। তারা আমাকে ধরে ওই নিয়োগকারীর বাড়িতেই পাঠিয়ে দিলো।
তানিয়া সৌদি আরব পৌঁছার দু’মাস পরে তার বস তাকে একটি ব্যালকনি থেকে ধাক্কা মারেন। এতে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের নাগাল পান। দূতাবাস তাকে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে রাখে। ওই আশ্রয়কেন্দ্রটি আরো একই রকম নির্যাতিত বাংলাদেশি নারীতে ঠাসা। এসব নারী তাদের নিয়োগকারীদের কাছ থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়েছেন। অপেক্ষা করছিলেন দেশে ফেরার জন্য। তানিয়ার সঙ্গে মাসে ১৬০ ডলারের চুক্তি হয়েছিল। সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। তানিয়া বলেন, সেখানে কাজ করার বিনিময়ে আমি কখনোই কোনো বেতন পাইনি।
শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, তানিয়ার এই অভিজ্ঞতা খুবই কমন। আমরা এত বেশি অর্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি যে, প্রতি মাসেই এই অর্থের জন্য শ্রমিকদের পাঠাচ্ছি। যেখানে তাদের প্রতি অশোভন আচরণ ও নির্যাতনের বিষয়টিকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অনতি দূরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। সেখানে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমাণ বেগমের পরিবার। তার মেয়ে, যার বয়স তারা বলছেন ১৬ বছর, সে মায়ের কাছেই বসে আছে। তার পরনে কালো বোরকা। তার মুখের বাম চিবুকে থেঁতলানো দাগ। গলার কাছে কাটা দাগ। মেয়েটি কথা বলতে চাইল না। তার মা মিনারা বেগম বলছেন, বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি ও তার স্বামী মেয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। অকস্মাৎ তারা জানতে পারেন সে সৌদি আরব থেকে ফোন করে জানায় দেশে আসছে।
মিনারা বলেন, এই দুর্ভোগের শুরু হয় কয়েক মাস আগে। তাদের গ্রামের একজন নারী বিউটি। তিনি মিনারাকে প্রস্তাব দেন ঢাকায় একটি বাসায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য তার মেয়েকে কাজে দিতে। প্রতি মাসে তার মেয়ে তাদেরকে ১৬০০০ করে টাকা পাঠাতো। কিন্তু বেশ কিছুদিন মেয়ের খবর পান না তারা। মিনারা আরো বলেন, তার মেয়ের বয়স ১৫ বছর। তখন সে গ্রাম ছাড়ে। কিন্তু এখন কয়েক মাসের ব্যবধানে তার মেয়ের হাতে একটি পাসপোর্ট দেয়া হয়েছে। তাতে তার বয়স দেখানো হয়েছে ২৬ বছর। মেয়েটির পিতামাতা মনে করেন, এই ভুয়া পাসপোর্টটির ব্যবস্থা করিয়েছেন বিউটি। মিনারা ও তার স্বামী তাদের মেয়েকে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ডাক্তার বা নার্সদের ডাকে সাড়া দিচ্ছিল না সে। একটি ছোট্ট রুমে তার পরীক্ষা করানোর কথা। মিনারা বলেছেন, তাদের মেয়ে শুধুই বাড়ি ফিরতে চাইছিল।
মিনারা শুধু বোঝার চেষ্টা করছেন তার মেয়ের কি ঘটেছিল। মিনারাকে সৌদি আরব থেকে মেয়ে অর্থ পাঠিয়েছে। কিন্তু কীভাবে পাঠিয়েছে তা তারা জানেন না।
বিদেশে কাজ করেন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি, অর্থনীতিতে তাদের অবদান ১৫০০ কোটি ডলার |
No comments