যুদ্ধের কিনারায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান: শেষ মুহূর্তে হামলার হুকুম থেকে সরলেন ট্রাম্প
নতুন
মোড় নিয়েছে ইরান-আমেরিকা উত্তেজনা। হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। ইরানে হামলার উদ্দেশ্যে আকাশে উড়ছিল মার্কিন
যুদ্ধবিমান। সাগরে অবস্থান নিয়েছিল জাহাজ। মিনিট কয়েক দেরি হলেই শত্রুবধের
উদ্দেশ্যে ছোড়া হতো ক্ষেপণাস্ত্র। এমন সময় আচমকা হামলার অভিযান বাতিল করলেন
ট্রাম্প। গতকাল শুক্রবার ভোরে এ ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বনেতারা বলছেন, যুদ্ধের
কিনারে আছে দুই দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করার অভিযোগও ওঠেছে। প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সকালে হরমুজ প্রণালীতে এক মার্কিন ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করে ইরান। এর জবাবেই দেশটিতে হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী। কিন্তু অল্পের জন্য শুরু হয়নি যুদ্ধ। শুরু হলে অচিরেই তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুপ নিতে পারতো। তবে যেকোনো মুহূর্তে পাল্টে যেতে পারে পরিস্থিতি।
হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরীণ সূত্রের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানে হামলা চালানোর প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। তখন আচমকাই নিজেই হামলার নির্দেশ বাতিল করে দেন ট্রাম্প। ঠিক কী কারণে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন ট্রাম্প সে বিষয় এখনো স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি হোয়াইট হাউস। বৃহস্পতিবার ইরান দাবি করে, তারা একটি মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোনকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। তাদের দাবি ছিল, ইরানের জলসীমায় ঢুকে পড়েছিল ড্রোনটি। দেশের নিরাপত্তার কারণেই সেটাকে ভূপাতিত করা হয়। এদিকে, পেন্টাগন তাদের ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার খবর স্বীকার করেছে। তবে তাদের দাবি, এটি ছিল টহল ড্রোন। আর এটি আন্তর্জাতিক জলসীমার উপরেই ছিল।
কতদূর প্রস্তুতি নিয়েছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী?
বৃহস্পতিবারের ড্রোন হামলার পর থেকেই ক্ষিপ্ত ছিলেন ট্রাম্প। মার্কিন সামরিক ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা ইরানের ওপর হামলা হতে পারে এমনটা প্রত্যাশা করছিলেন। হরমুজ প্রণালীতে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার পর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে হোয়াইট হাউসে বৈঠক বসেন দেশটির শীর্ষ প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা। বৈঠকে তাদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন, ট্রাম্পের শীর্ষ নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তা, কংগ্রেস নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈঠকের পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায় হামলার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো অভিযানটির প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে সামরিক বাহিনী। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরানে হামলা চালাতো মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে আচমকাই সামরিক বাহিনীকে অভিযানটি বাতিল করতে বলেন তিনি। ততক্ষণে আকাশে সকল প্রস্তুতি নিয়ে উড়ছিল যুদ্ধবিমান, সমুদ্রে ঠিকঠাক অবস্থান নিয়ে ফেলেছিল যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু ছোড়া হয়নি কোনো ক্ষেপণাস্ত্র।
অভিযান অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নির্দেশে চালানো তৃতীয় হামলা হতো এটি। এর আগে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সিরিয়ায় হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। শেষ মুহূর্তে কী কারণে নিজের মত পাল্টেছেন তিনি সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের কাছে জানতে চাইলে কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। একইরকম প্রতিক্রিয়া দেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও।
হামলায় সম্মতি ছিল সিআইএর
ড্রোনে হামলার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রতিশোধমূলক হামলার গুঞ্জন শোনা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে বিভক্ত ছিলেন ট্রাম্পের উপদেষ্টারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন ও সিআইএর পরিচালক জিনা হাসপেল সামরিক হামলার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ কর্মকর্তারা বিমুখ ছিলেন। সতর্ক করেছিলেন, ইরানে হামলা চালালে তার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। হামলার বিষয়ে জ্ঞাত ছিলেন কংগ্রেস নেতারাও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন ড্রোনে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান উত্তেজনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে ইরান। সম্প্রতি হরমুজ প্রণালীতে চারটি সৌদি তেলের ট্যাংকারে হামলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, এই হামলা চালিয়েছে ইরান। তবে ইরান এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। ওই ঘটনার পর থেকেই নতুন করে তীব্র আকার ধারণ করেছে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা। অঞ্চলটিতে অতিরিক্ত সেনা ও রণতরী মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ড্রোন হামলা
ইরানের দাবি, তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করার পরই মার্কিন ড্রোনটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। তাদের ইসলামিক রেভুলিউশনারি গার্ডস বলছে, আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক নামের ওই ড্রোনটি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হরমোজগানে তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল। ড্রোনটিকে রেডিও সিগনালের মাধ্যমে বারবার সতর্ক করা হলেও সে সতর্কতা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ফলস্বরূপ সেটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে।
এদিকে, নিজেদের ড্রোন ধ্বংসের কথা স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তাদের দাবি এটি একটি নজরদারী ড্রোন। আর এটি আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় ছিল, ইরানের না। ট্রাম্প বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বলেন, তার সন্দেহ যে, ইরানের কোনো ব্যক্তি বড় ধরনের ভুল করেছে। যদিও ইরান ড্রোনটি ধ্বংস করার দায় স্বীকার করেছে। উভয় দেশ জানিয়েছে যে, স্থানীয় সময় ভোর ৪:০৫ মিনিটে ড্রোনটি ধ্বংস করা হয়। ড্রোনটি ধ্বংস করা হয়েছে ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দিয়ে। এতে অবাক হয়েছেন অনেক আমেরিকান কর্মকর্তা। কেননা, ওই ড্রোনটি তৈরি করা হয়েছিল এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার হামলা-বিরোধী হিসেবে। তারা বলছেন, এতে প্রমাণ হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই বেশ কঠিন হবে।
বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি ছবি প্রকাশ করে দাবি করে যে, ড্রোনটি আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পায় যে, ছবিটি যখন তোলা হয়েছিল তখন ড্রোনটি চলমান ছিল। যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেখানে তোলা না। ইরান পরবর্তীতে ড্রোনটি যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেখানকার সঠিক স্থানাঙ্ক প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় যে, ড্রোনটি এমন স্থানে অবস্থান করছিল যেটিকে ইরান নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। ড্রোনটি ইরানের উপকূল থেকে ৮ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল। যেখানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ইরানের ভূখণ্ড হিসেবে ধরা হয়।
এদিকে, রেভুলিউশনারি গার্ডসের প্রধান হুসেইন সালামি বলেন, আমরা যুদ্ধে জড়াতে চাই না। তবে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। এই ঘটনা ঠিক এই বার্তাটিই প্রমাণ করে।
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি বলেছেন, আকাশসীমা হচ্ছে ইরানের ‘রেড লাইন’। কেউ এই রেড লাইন অতিক্রম করলে এর কঠিন জবাব দেয়া হবে। ইরান এর আগেও একই কাজ করেছে বলে তিনি জানান। রাশিয়ার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনের অবকাশে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। আলী শামখানি বলেন, আমরা বারবারই বলছি ইরান নিজের আকাশসীমা ও জলসীমা সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। কাউকে ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের সুযোগ দেয়া হবে না। (ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী) কোনো বিমান বা ড্রোন যে দেশেরই হোক না কেন তা ভূপাতিত করা হবে ও কঠিন জবাব দেয়া হবে।
ইরানের আকাশে মার্কিন বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ
এদিকে, সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষ এফএএ জানিয়েছে, ইরান নিয়ন্ত্রিত সমুদ্র ও স্থলপথের আকাশসীমায় মার্কিন বিমান উড্ডয়ন বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপিত অঞ্চলের মধ্যে স্পর্শকাতর হরমুজ প্রণালি ও ওমান উপসাগর রয়েছে। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
এফএএ’র বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিধ্বস্ত ড্রোনের প্রায় ৪৫ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সবচেয়ে কাছের বেসামরিক বিমান অবস্থান করছিল। ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার সময় ওই এলাকায় অনেক বেসামরিক বিমান চলাচল করছিল। উপসাগরীয় অঞ্চলের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংকটে বিমানের নিরাপত্তায় এফএএ উদ্বিগ্ন।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত উস্কানির অভিযোগ এনেছে রাশিয়া। বলেছে, তারা ইরানকে যুদ্ধের কিনারে নিয়ে এসেছে। শুক্রবার ওয়াশিংটনকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেন, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে তা ভাবা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা খুবই ভয়ঙ্কর হবে।
এদিকে, যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, তারা চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, আমরা বারবার উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়ে আসছি। ইরানের কার্যক্রম নিয়ে আমাদের অবস্থানও আমরা বহু আগেই স্পষ্ট করেছি। উত্তেজনা কোনোভাবেই সুবিধাজনক নয়। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছি।
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেল বলেন, ট্রাম্পের ব্যাপারে আমি এটি বলতে পারি যে, তিনি চেষ্টা করবেন সামরিক আগ্রাসন এড়াতে। আমরা সে সিদ্ধান্তকে স্বাগতম জানাই। এ ছাড়া তিনি উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, উভয়পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘও। সংগঠনটির মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আমার এক্ষেত্রে একটিই পরামর্শ রয়েছে- ইস্পাতের মনোবল ধারণ করুন। এর আগে ড্রোন ধ্বংসের খবরে গুতেরেস জানান, তিনি ইরান-আমেরিকা পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইরান-বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন ট্রাম্প। ২০১৮ সালের মে মাসে ইরানের সনে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের করে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। আরোপ করেছেন নিষেধাজ্ঞা। তবে চুক্তি রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে এর অন্যান্য অংশীদাররা। ইরান হুমকি দিয়েছে, ২৭শে জুনের মধ্যে চুক্তির অন্যান্য অংশীদাররা যদি ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে তবে তারা চুক্তি লঙ্ঘন করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করবে। এতে উত্তেজনা আরো বেড়েছে। প্রসঙ্গত, সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে তা দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রও তৈরি করা যায়। আর ট্রাম্প প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তিনি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেবেন না। সমপ্রতি মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধের দামামার মধ্যে মধ্যে অতিরিক্ত ১০০০ সেনা সদস্য মোতায়েন করছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করার অভিযোগও ওঠেছে। প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সকালে হরমুজ প্রণালীতে এক মার্কিন ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করে ইরান। এর জবাবেই দেশটিতে হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী। কিন্তু অল্পের জন্য শুরু হয়নি যুদ্ধ। শুরু হলে অচিরেই তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুপ নিতে পারতো। তবে যেকোনো মুহূর্তে পাল্টে যেতে পারে পরিস্থিতি।
হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরীণ সূত্রের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানে হামলা চালানোর প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। তখন আচমকাই নিজেই হামলার নির্দেশ বাতিল করে দেন ট্রাম্প। ঠিক কী কারণে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন ট্রাম্প সে বিষয় এখনো স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি হোয়াইট হাউস। বৃহস্পতিবার ইরান দাবি করে, তারা একটি মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোনকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। তাদের দাবি ছিল, ইরানের জলসীমায় ঢুকে পড়েছিল ড্রোনটি। দেশের নিরাপত্তার কারণেই সেটাকে ভূপাতিত করা হয়। এদিকে, পেন্টাগন তাদের ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার খবর স্বীকার করেছে। তবে তাদের দাবি, এটি ছিল টহল ড্রোন। আর এটি আন্তর্জাতিক জলসীমার উপরেই ছিল।
কতদূর প্রস্তুতি নিয়েছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী?
বৃহস্পতিবারের ড্রোন হামলার পর থেকেই ক্ষিপ্ত ছিলেন ট্রাম্প। মার্কিন সামরিক ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা ইরানের ওপর হামলা হতে পারে এমনটা প্রত্যাশা করছিলেন। হরমুজ প্রণালীতে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার পর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে হোয়াইট হাউসে বৈঠক বসেন দেশটির শীর্ষ প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা। বৈঠকে তাদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন, ট্রাম্পের শীর্ষ নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তা, কংগ্রেস নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈঠকের পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায় হামলার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো অভিযানটির প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে সামরিক বাহিনী। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরানে হামলা চালাতো মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে আচমকাই সামরিক বাহিনীকে অভিযানটি বাতিল করতে বলেন তিনি। ততক্ষণে আকাশে সকল প্রস্তুতি নিয়ে উড়ছিল যুদ্ধবিমান, সমুদ্রে ঠিকঠাক অবস্থান নিয়ে ফেলেছিল যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু ছোড়া হয়নি কোনো ক্ষেপণাস্ত্র।
অভিযান অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নির্দেশে চালানো তৃতীয় হামলা হতো এটি। এর আগে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সিরিয়ায় হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। শেষ মুহূর্তে কী কারণে নিজের মত পাল্টেছেন তিনি সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের কাছে জানতে চাইলে কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। একইরকম প্রতিক্রিয়া দেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও।
হামলায় সম্মতি ছিল সিআইএর
ড্রোনে হামলার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রতিশোধমূলক হামলার গুঞ্জন শোনা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে বিভক্ত ছিলেন ট্রাম্পের উপদেষ্টারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন ও সিআইএর পরিচালক জিনা হাসপেল সামরিক হামলার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ কর্মকর্তারা বিমুখ ছিলেন। সতর্ক করেছিলেন, ইরানে হামলা চালালে তার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। হামলার বিষয়ে জ্ঞাত ছিলেন কংগ্রেস নেতারাও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন ড্রোনে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান উত্তেজনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে ইরান। সম্প্রতি হরমুজ প্রণালীতে চারটি সৌদি তেলের ট্যাংকারে হামলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, এই হামলা চালিয়েছে ইরান। তবে ইরান এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। ওই ঘটনার পর থেকেই নতুন করে তীব্র আকার ধারণ করেছে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা। অঞ্চলটিতে অতিরিক্ত সেনা ও রণতরী মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ড্রোন হামলা
ইরানের দাবি, তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করার পরই মার্কিন ড্রোনটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। তাদের ইসলামিক রেভুলিউশনারি গার্ডস বলছে, আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক নামের ওই ড্রোনটি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হরমোজগানে তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল। ড্রোনটিকে রেডিও সিগনালের মাধ্যমে বারবার সতর্ক করা হলেও সে সতর্কতা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ফলস্বরূপ সেটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে।
এদিকে, নিজেদের ড্রোন ধ্বংসের কথা স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তাদের দাবি এটি একটি নজরদারী ড্রোন। আর এটি আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় ছিল, ইরানের না। ট্রাম্প বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বলেন, তার সন্দেহ যে, ইরানের কোনো ব্যক্তি বড় ধরনের ভুল করেছে। যদিও ইরান ড্রোনটি ধ্বংস করার দায় স্বীকার করেছে। উভয় দেশ জানিয়েছে যে, স্থানীয় সময় ভোর ৪:০৫ মিনিটে ড্রোনটি ধ্বংস করা হয়। ড্রোনটি ধ্বংস করা হয়েছে ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দিয়ে। এতে অবাক হয়েছেন অনেক আমেরিকান কর্মকর্তা। কেননা, ওই ড্রোনটি তৈরি করা হয়েছিল এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার হামলা-বিরোধী হিসেবে। তারা বলছেন, এতে প্রমাণ হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই বেশ কঠিন হবে।
বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি ছবি প্রকাশ করে দাবি করে যে, ড্রোনটি আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পায় যে, ছবিটি যখন তোলা হয়েছিল তখন ড্রোনটি চলমান ছিল। যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেখানে তোলা না। ইরান পরবর্তীতে ড্রোনটি যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেখানকার সঠিক স্থানাঙ্ক প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় যে, ড্রোনটি এমন স্থানে অবস্থান করছিল যেটিকে ইরান নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। ড্রোনটি ইরানের উপকূল থেকে ৮ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল। যেখানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ইরানের ভূখণ্ড হিসেবে ধরা হয়।
এদিকে, রেভুলিউশনারি গার্ডসের প্রধান হুসেইন সালামি বলেন, আমরা যুদ্ধে জড়াতে চাই না। তবে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। এই ঘটনা ঠিক এই বার্তাটিই প্রমাণ করে।
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি বলেছেন, আকাশসীমা হচ্ছে ইরানের ‘রেড লাইন’। কেউ এই রেড লাইন অতিক্রম করলে এর কঠিন জবাব দেয়া হবে। ইরান এর আগেও একই কাজ করেছে বলে তিনি জানান। রাশিয়ার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনের অবকাশে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। আলী শামখানি বলেন, আমরা বারবারই বলছি ইরান নিজের আকাশসীমা ও জলসীমা সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। কাউকে ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের সুযোগ দেয়া হবে না। (ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী) কোনো বিমান বা ড্রোন যে দেশেরই হোক না কেন তা ভূপাতিত করা হবে ও কঠিন জবাব দেয়া হবে।
ইরানের আকাশে মার্কিন বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ
এদিকে, সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষ এফএএ জানিয়েছে, ইরান নিয়ন্ত্রিত সমুদ্র ও স্থলপথের আকাশসীমায় মার্কিন বিমান উড্ডয়ন বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপিত অঞ্চলের মধ্যে স্পর্শকাতর হরমুজ প্রণালি ও ওমান উপসাগর রয়েছে। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
এফএএ’র বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিধ্বস্ত ড্রোনের প্রায় ৪৫ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সবচেয়ে কাছের বেসামরিক বিমান অবস্থান করছিল। ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার সময় ওই এলাকায় অনেক বেসামরিক বিমান চলাচল করছিল। উপসাগরীয় অঞ্চলের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংকটে বিমানের নিরাপত্তায় এফএএ উদ্বিগ্ন।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত উস্কানির অভিযোগ এনেছে রাশিয়া। বলেছে, তারা ইরানকে যুদ্ধের কিনারে নিয়ে এসেছে। শুক্রবার ওয়াশিংটনকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেন, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে তা ভাবা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা খুবই ভয়ঙ্কর হবে।
এদিকে, যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, তারা চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, আমরা বারবার উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়ে আসছি। ইরানের কার্যক্রম নিয়ে আমাদের অবস্থানও আমরা বহু আগেই স্পষ্ট করেছি। উত্তেজনা কোনোভাবেই সুবিধাজনক নয়। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছি।
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেল বলেন, ট্রাম্পের ব্যাপারে আমি এটি বলতে পারি যে, তিনি চেষ্টা করবেন সামরিক আগ্রাসন এড়াতে। আমরা সে সিদ্ধান্তকে স্বাগতম জানাই। এ ছাড়া তিনি উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, উভয়পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘও। সংগঠনটির মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, আমার এক্ষেত্রে একটিই পরামর্শ রয়েছে- ইস্পাতের মনোবল ধারণ করুন। এর আগে ড্রোন ধ্বংসের খবরে গুতেরেস জানান, তিনি ইরান-আমেরিকা পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইরান-বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন ট্রাম্প। ২০১৮ সালের মে মাসে ইরানের সনে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের করে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। আরোপ করেছেন নিষেধাজ্ঞা। তবে চুক্তি রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে এর অন্যান্য অংশীদাররা। ইরান হুমকি দিয়েছে, ২৭শে জুনের মধ্যে চুক্তির অন্যান্য অংশীদাররা যদি ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে তবে তারা চুক্তি লঙ্ঘন করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করবে। এতে উত্তেজনা আরো বেড়েছে। প্রসঙ্গত, সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে তা দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রও তৈরি করা যায়। আর ট্রাম্প প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তিনি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেবেন না। সমপ্রতি মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধের দামামার মধ্যে মধ্যে অতিরিক্ত ১০০০ সেনা সদস্য মোতায়েন করছে যুক্তরাষ্ট্র।
No comments