সড়কের নাম ভিআইপি by মরিয়ম চম্পা
বায়ান্ন
বাজার তিপ্পান্ন গলি। চারশ’ বছরের পুরনো শহর ঢাকা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা
দিয়ে বেড়েছে এই শহরের আয়তন, জনসংখ্যা। বেড়েছে রাস্তা, গলি আর বাজার। হরেক
রকম নাম। নানা ইতিহাস। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সড়ক পরিচিত আলাদা নামে।
কখনো বা লোকমুখে প্রচারিত নামের আড়ালে হারিয়ে গেছে আসল নাম।
ভিআইপি রোড। এ নামেই খ্যাত সড়কটি। রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচলের কারণেই মূলত এ পরিচিতি। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চলাচল করেন এ সড়কে। প্রধানমন্ত্রীর চলাচল প্রায় নিয়মিত। মন্ত্রী-এমপিরাও করেন যাতায়াত। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান এলেও এ পথে ছুটতে দেখা যায় তাদের। অতিথিদের অভিনন্দন জানিয়ে টাঙানো হয় নানা ব্যানার-ফেস্টুন। বার্তা দেয়া হয় বন্ধুত্বের। কাগজে-কলমে এ সড়কটির নাম নজরুল ইসলাম এভিনিউ। পুরনো এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট হয়ে শাহ্বাগে চলে যাওয়া এ সড়কের খুব বেশি আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। সড়কটি অবশ্য রিকশামুক্ত। যদিও রাতে ভ্যানগাড়ি কিংবা কিছু রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। ফুটপাথে কাটাছেঁড়া চলতে থাকে বছরব্যাপীই। এ কাজের যেন শেষ নেই। যানজট লেগে থাকে সবসময়ই। ব্যক্তিগত গাড়ি আর গণপরিবহনের লম্বা সারি- এ সড়কের স্বাভাবিক দৃশ্য। কাওরানবাজার অংশে গভীর রাতেও দেখা যায় যানবাহনের ভিড়। তবে ভিভিআইপি মুভমেন্টের সময় পরিস্থিতি থাকে একেবারেই আলাদা। মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায় সবকিছু। এ সড়কের আশপাশেই গত ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগের জনসভার দিন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন এক কলেজছাত্রী। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি জড়িতদের কেউ। সড়কটিতে ছিনতাইয়ের ঘটনাও নজিরবিহীন নয়। নগর পরিকল্পনাবিদদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৬ সাল থেকেই সড়কটি ভিআইপি সড়ক নামে পরিচিত। ট্রাফিক পুলিশও এ নামেই ট্রিট করে সড়কটিকে। যদিও সিটি করপোরেশনের খাতায় এ নাম নেই।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরওয়ার জাহান বলেন, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রী-এমপিরা এই রাস্তা ধরে যাতায়াত করেন। ঢাকার একাধিক পাঁচ তারকা হোটেলও এই সড়ক সংলগ্ন। মূলত এইসব কারণেই সড়কটি ভিআইপি রোড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ১৯৮৬ সালের দিকে এরশাদ সরকার ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তখন রিকশাচালকরা প্রধান সড়ক ধরে রিকশা চলার বিষয়ে দাবি তুললে সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয় যে, ভিআইপি রোড ধরে কোনো রিকশা চলতে পারবে না। তিনি বলেন, ভিআইপি রোড হিসেবে ফরমালি কোথাও এই সড়কের নাম লেখা নেই। এটা মূলত এরশাদ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। বর্তমান কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ নামটা সিটি করপোরেশন কর্তৃক দেয়া। আগে ঢাকা ময়মনসিংহ রোড, এয়ারপোর্ট রোড এভাবে বিভিন্ন ধরনের নাম ছিল। ভিআইপি সড়কেও কেন যানজট এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রচলিত ভিআইপি বা প্রধান সড়কে যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে- প্রাইভেট গাড়ি বেড়ে যাওয়া। রাস্তার ধারণক্ষমতার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে যানজট বেশি হচ্ছে এ সড়কে। তিনি বলেন, রাস্তার বিশৃঙ্খলা কমাতে গেলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা ম্যাস ট্রানজিটের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কন্সট্রাকশন দ্রব্যাদি রাখা ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ না করলে রাস্তার শৃঙ্খল অবস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। এছাড়া প্রধান সড়কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও অপ্রীতিকর ঘটনা দূর করতে পুলিশের যেটা করণীয় সেটা ঠিকভাবে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে পুলিশের কর্তব্যরতদের নিয়মিত মনিটরিং থাকা দরকার।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভিআইপি সড়ক নামটা আসলে কোথা থেকে এলো জানি না। এ রাস্তাটির নাম কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ। তবে এ রাস্তায় ভিআইপি মুভমেন্ট হয়। ভিআইপি রোড একটি প্রচারিত এবং প্রচলিত কথা হতে পারে। প্রধান সড়কে যানজট নিরসণের বিষয়ে নগরপরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, যানজট নিরসণে ঢাকা শহরের প্রধান ৫টি সংস্থা আছে যারা সমন্বিতভাবে কাজ করলে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রথম বিষয়টি হচ্ছে মাস্টারপ্লান। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ হচ্ছে অবকাঠামোগত রক্ষণাবেক্ষণ করা। অর্থাৎ রাস্তা ভেঙে গেলে সেটার মেরামত করা। ফুটপাথে পথচারীরা যেন স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। এবং রাস্তা পারাপারে জেব্রাক্রসিং নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে রাস্তার ভেতর যেন কেউ কোনো অবৈধ স্ট্রাকচার রেখে চলাচলে বিঘ্ন না ঘটায় সেটা নিশ্চিত করা।
নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ভিআইপি সড়ক কোনো আধুনিক শহরে আছে বলে আমার জানা নেই। এখন বাংলাদেশে যদি কেউ কোনো সড়ককে ভিআইপি সড়ক নাম দেন তাহলে যারা দেন তারাই বলতে পারবেন ভিআইপি সড়কের সংজ্ঞা। আমি পৃথিবীর কোনো শহরে দেখি না যে, ভিআইপি সড়ক বলে কোনো সড়ক আছে। তবে আমাদের দেশে প্রধান সড়ককে যে ভিআইপি সড়ক বলা হয় এটা হয়তো পুলিশের নিজস্ব ধারণা। পুলিশই মূলত বলতে পারবে কাকে ভিআইপি সড়ক বলা হয়। সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এক কথায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা ট্রান্সপোর্ট ট্রাফিকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। আমরা যদি বিদেশের উদাহরণ দেই বা শিক্ষা নেই তাহলে দেখা যাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ব্যাংকক, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট পথ চলাচলের সময় পথচারীদের চলার পথ বন্ধ করে দিয়ে বা আটকে রেখে চলাফেরা করেন না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত উন্নত দেশগুলোর নিয়ম-কানুনগুলো অনুসরণ করা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোসলেহ উদ্দিন বলেন, আমাদের মূলত তিনটি আর্টারি রয়েছে। ভিআইপি সড়ক, মিরপুর ও প্রগতি সরণি। এই তিনটি হচ্ছে- আমাদের ঢাকা শহরের মূল সড়ক। ঢাকা শহরে ঢোকা এবং বের হওয়ার জন্য আমরা সাধারণত এই প্রধান তিনটি সড়কই ব্যবহার করি। এই প্রধান সড়কের মধ্যে ভিআইপি সড়কটি নাম্বার ওয়ান। কারণ এই সড়ক ধরে আমাদের রাষ্ট্রীয় চলাচল বা মুভমেন্টগুলো বেশি হয়। অর্থাৎ জরুরি সার্ভিসের গাড়ি, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচল ও সাধারণ মানুষের চলাচল সবকিছু বিবেচনা করেই মূলত এটাকে ভিআইপি সড়ক বলা হয়। মোসলেহ উদ্দিন বলেন, প্রথমত হচ্ছে- যেটা দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ভিআইপি, ভিভিআইপিরা চলাচল করেন এবং অনেক বেশি ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ যে রাস্তা ধরে সাধারণ জনগণ অনেক বেশি চলাচল করে- এটাই হচ্ছে আমাদের ভিআইপি রাস্তার বৈশিষ্ট্য। ঢাকা শহরে ভিআইপি রোড হচ্ছে একটাই যেটা এয়ারপোর্ট থেকে রূপসী বাংলা হয়ে বঙ্গভবন পর্যন্ত। আর অন্যান্য সড়কগুলোর আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। ভিআইপি সড়কে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অনিয়ম দেখামাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। পুরো ভিআইপি সড়ক জুড়েই আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার আছে। যখনই কেউ ট্রাফিক রুলস মানছে না সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এদিকে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার হওয়ার পর থেকে ভিআইপি সড়কে বিশেষ করে বাংলামোটর অংশে গাড়ির চাপ আরো বেড়েছে। বেড়েছে যানজট। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, যে গাড়িগুলো রাজারবাগ-মৌচাক হয়ে ৩/৪টি সিগন্যাল পেরিয়ে বাংলামোটর পর্যন্ত আসতো সেগুলো এখন ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে সিগন্যাল ছাড়াই অল্প সময়ে বাংলামোটরের দিকে চলে আসছে। যে কারণে বাংলামোটর ভিআইপি সড়কে যানজট তৈরি হচ্ছে।
উড়াল সড়কটির বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও এই প্রকল্পের পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ফ্লাইওভারের সবগুলো নামার পথে তেমন একটা যানজট নেই। তবে বাংলামোটর সিগন্যালের আগ পর্যন্ত যানজট কিছুটা সৃষ্টি হচ্ছে, এটা আসলে ফ্লাইওভারের জন্য নয়। বাংলামোটরের এই সিগন্যালটি অনেক আগে থেকেই খুবই ব্যস্ত একটি সিগন্যাল। এখন ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াতের সুবিধার কারণে আরো বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে যানজট দেখা দিচ্ছে। ফ্লাইওভার হলেই যে যানজট কমে যাবে- এটা ঠিক নয়। যানজট কমানোর জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপের মধ্যে ফ্লাইওভার একটি পদক্ষেপ।
এ বিষয়ে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাস্তার পরিকল্পনা অবকাঠামো সাধারণত এলজিইডি মন্ত্রণালয় তৈরি করে। এটা যদি আমাদের সিটি করপোরেশন থেকে হতো তাহলে আমরা অবশ্যই পরামর্শ দিতাম যে, বাংলামোটরকে ক্রস করে ওপারে গিয়ে প্রধান সংযোগ নামানো। বাংলামোটরে মুভমেন্ট বেশি হওয়ায় এখানকার সিগন্যালের পয়েন্টটা পার করে যদি ব্রিজটা নামানো হতো তাহলে যানজটের মাত্রা আরো কমে আসতো।
ভিআইপি রোড। এ নামেই খ্যাত সড়কটি। রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচলের কারণেই মূলত এ পরিচিতি। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চলাচল করেন এ সড়কে। প্রধানমন্ত্রীর চলাচল প্রায় নিয়মিত। মন্ত্রী-এমপিরাও করেন যাতায়াত। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান এলেও এ পথে ছুটতে দেখা যায় তাদের। অতিথিদের অভিনন্দন জানিয়ে টাঙানো হয় নানা ব্যানার-ফেস্টুন। বার্তা দেয়া হয় বন্ধুত্বের। কাগজে-কলমে এ সড়কটির নাম নজরুল ইসলাম এভিনিউ। পুরনো এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট হয়ে শাহ্বাগে চলে যাওয়া এ সড়কের খুব বেশি আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। সড়কটি অবশ্য রিকশামুক্ত। যদিও রাতে ভ্যানগাড়ি কিংবা কিছু রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। ফুটপাথে কাটাছেঁড়া চলতে থাকে বছরব্যাপীই। এ কাজের যেন শেষ নেই। যানজট লেগে থাকে সবসময়ই। ব্যক্তিগত গাড়ি আর গণপরিবহনের লম্বা সারি- এ সড়কের স্বাভাবিক দৃশ্য। কাওরানবাজার অংশে গভীর রাতেও দেখা যায় যানবাহনের ভিড়। তবে ভিভিআইপি মুভমেন্টের সময় পরিস্থিতি থাকে একেবারেই আলাদা। মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায় সবকিছু। এ সড়কের আশপাশেই গত ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগের জনসভার দিন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন এক কলেজছাত্রী। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি জড়িতদের কেউ। সড়কটিতে ছিনতাইয়ের ঘটনাও নজিরবিহীন নয়। নগর পরিকল্পনাবিদদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৬ সাল থেকেই সড়কটি ভিআইপি সড়ক নামে পরিচিত। ট্রাফিক পুলিশও এ নামেই ট্রিট করে সড়কটিকে। যদিও সিটি করপোরেশনের খাতায় এ নাম নেই।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরওয়ার জাহান বলেন, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রী-এমপিরা এই রাস্তা ধরে যাতায়াত করেন। ঢাকার একাধিক পাঁচ তারকা হোটেলও এই সড়ক সংলগ্ন। মূলত এইসব কারণেই সড়কটি ভিআইপি রোড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ১৯৮৬ সালের দিকে এরশাদ সরকার ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তখন রিকশাচালকরা প্রধান সড়ক ধরে রিকশা চলার বিষয়ে দাবি তুললে সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয় যে, ভিআইপি রোড ধরে কোনো রিকশা চলতে পারবে না। তিনি বলেন, ভিআইপি রোড হিসেবে ফরমালি কোথাও এই সড়কের নাম লেখা নেই। এটা মূলত এরশাদ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। বর্তমান কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ নামটা সিটি করপোরেশন কর্তৃক দেয়া। আগে ঢাকা ময়মনসিংহ রোড, এয়ারপোর্ট রোড এভাবে বিভিন্ন ধরনের নাম ছিল। ভিআইপি সড়কেও কেন যানজট এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রচলিত ভিআইপি বা প্রধান সড়কে যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে- প্রাইভেট গাড়ি বেড়ে যাওয়া। রাস্তার ধারণক্ষমতার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে যানজট বেশি হচ্ছে এ সড়কে। তিনি বলেন, রাস্তার বিশৃঙ্খলা কমাতে গেলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা ম্যাস ট্রানজিটের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কন্সট্রাকশন দ্রব্যাদি রাখা ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ না করলে রাস্তার শৃঙ্খল অবস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। এছাড়া প্রধান সড়কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও অপ্রীতিকর ঘটনা দূর করতে পুলিশের যেটা করণীয় সেটা ঠিকভাবে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে পুলিশের কর্তব্যরতদের নিয়মিত মনিটরিং থাকা দরকার।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভিআইপি সড়ক নামটা আসলে কোথা থেকে এলো জানি না। এ রাস্তাটির নাম কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ। তবে এ রাস্তায় ভিআইপি মুভমেন্ট হয়। ভিআইপি রোড একটি প্রচারিত এবং প্রচলিত কথা হতে পারে। প্রধান সড়কে যানজট নিরসণের বিষয়ে নগরপরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, যানজট নিরসণে ঢাকা শহরের প্রধান ৫টি সংস্থা আছে যারা সমন্বিতভাবে কাজ করলে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রথম বিষয়টি হচ্ছে মাস্টারপ্লান। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ হচ্ছে অবকাঠামোগত রক্ষণাবেক্ষণ করা। অর্থাৎ রাস্তা ভেঙে গেলে সেটার মেরামত করা। ফুটপাথে পথচারীরা যেন স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। এবং রাস্তা পারাপারে জেব্রাক্রসিং নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে রাস্তার ভেতর যেন কেউ কোনো অবৈধ স্ট্রাকচার রেখে চলাচলে বিঘ্ন না ঘটায় সেটা নিশ্চিত করা।
নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ভিআইপি সড়ক কোনো আধুনিক শহরে আছে বলে আমার জানা নেই। এখন বাংলাদেশে যদি কেউ কোনো সড়ককে ভিআইপি সড়ক নাম দেন তাহলে যারা দেন তারাই বলতে পারবেন ভিআইপি সড়কের সংজ্ঞা। আমি পৃথিবীর কোনো শহরে দেখি না যে, ভিআইপি সড়ক বলে কোনো সড়ক আছে। তবে আমাদের দেশে প্রধান সড়ককে যে ভিআইপি সড়ক বলা হয় এটা হয়তো পুলিশের নিজস্ব ধারণা। পুলিশই মূলত বলতে পারবে কাকে ভিআইপি সড়ক বলা হয়। সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এক কথায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা ট্রান্সপোর্ট ট্রাফিকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। আমরা যদি বিদেশের উদাহরণ দেই বা শিক্ষা নেই তাহলে দেখা যাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ব্যাংকক, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট পথ চলাচলের সময় পথচারীদের চলার পথ বন্ধ করে দিয়ে বা আটকে রেখে চলাফেরা করেন না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত উন্নত দেশগুলোর নিয়ম-কানুনগুলো অনুসরণ করা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোসলেহ উদ্দিন বলেন, আমাদের মূলত তিনটি আর্টারি রয়েছে। ভিআইপি সড়ক, মিরপুর ও প্রগতি সরণি। এই তিনটি হচ্ছে- আমাদের ঢাকা শহরের মূল সড়ক। ঢাকা শহরে ঢোকা এবং বের হওয়ার জন্য আমরা সাধারণত এই প্রধান তিনটি সড়কই ব্যবহার করি। এই প্রধান সড়কের মধ্যে ভিআইপি সড়কটি নাম্বার ওয়ান। কারণ এই সড়ক ধরে আমাদের রাষ্ট্রীয় চলাচল বা মুভমেন্টগুলো বেশি হয়। অর্থাৎ জরুরি সার্ভিসের গাড়ি, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচল ও সাধারণ মানুষের চলাচল সবকিছু বিবেচনা করেই মূলত এটাকে ভিআইপি সড়ক বলা হয়। মোসলেহ উদ্দিন বলেন, প্রথমত হচ্ছে- যেটা দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ভিআইপি, ভিভিআইপিরা চলাচল করেন এবং অনেক বেশি ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ যে রাস্তা ধরে সাধারণ জনগণ অনেক বেশি চলাচল করে- এটাই হচ্ছে আমাদের ভিআইপি রাস্তার বৈশিষ্ট্য। ঢাকা শহরে ভিআইপি রোড হচ্ছে একটাই যেটা এয়ারপোর্ট থেকে রূপসী বাংলা হয়ে বঙ্গভবন পর্যন্ত। আর অন্যান্য সড়কগুলোর আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। ভিআইপি সড়কে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অনিয়ম দেখামাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। পুরো ভিআইপি সড়ক জুড়েই আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার আছে। যখনই কেউ ট্রাফিক রুলস মানছে না সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এদিকে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার হওয়ার পর থেকে ভিআইপি সড়কে বিশেষ করে বাংলামোটর অংশে গাড়ির চাপ আরো বেড়েছে। বেড়েছে যানজট। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, যে গাড়িগুলো রাজারবাগ-মৌচাক হয়ে ৩/৪টি সিগন্যাল পেরিয়ে বাংলামোটর পর্যন্ত আসতো সেগুলো এখন ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে সিগন্যাল ছাড়াই অল্প সময়ে বাংলামোটরের দিকে চলে আসছে। যে কারণে বাংলামোটর ভিআইপি সড়কে যানজট তৈরি হচ্ছে।
উড়াল সড়কটির বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও এই প্রকল্পের পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ফ্লাইওভারের সবগুলো নামার পথে তেমন একটা যানজট নেই। তবে বাংলামোটর সিগন্যালের আগ পর্যন্ত যানজট কিছুটা সৃষ্টি হচ্ছে, এটা আসলে ফ্লাইওভারের জন্য নয়। বাংলামোটরের এই সিগন্যালটি অনেক আগে থেকেই খুবই ব্যস্ত একটি সিগন্যাল। এখন ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াতের সুবিধার কারণে আরো বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে যানজট দেখা দিচ্ছে। ফ্লাইওভার হলেই যে যানজট কমে যাবে- এটা ঠিক নয়। যানজট কমানোর জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপের মধ্যে ফ্লাইওভার একটি পদক্ষেপ।
এ বিষয়ে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাস্তার পরিকল্পনা অবকাঠামো সাধারণত এলজিইডি মন্ত্রণালয় তৈরি করে। এটা যদি আমাদের সিটি করপোরেশন থেকে হতো তাহলে আমরা অবশ্যই পরামর্শ দিতাম যে, বাংলামোটরকে ক্রস করে ওপারে গিয়ে প্রধান সংযোগ নামানো। বাংলামোটরে মুভমেন্ট বেশি হওয়ায় এখানকার সিগন্যালের পয়েন্টটা পার করে যদি ব্রিজটা নামানো হতো তাহলে যানজটের মাত্রা আরো কমে আসতো।
No comments